বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণ ও বাংলাদেশের জামায়াত by এবনে গোলাম সামাদ
আমি কখনো বর্ধমানে যাইনি। বর্ধমান শহর সম্পর্কে আমার কোনো ব্যক্তিগত ধারণা নেই। তবে ক’দিন ধরে আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হলো বর্ধমান শহরের লোক খুবই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। কেননা, সেখানে বাংলাদেশ থেকে কিছু জঙ্গি মুসলিম মৌলবাদী গিয়ে একটি দালানবাড়িতে বোমা বানাচ্ছিলেন। বোমা বানানোর সময় সেখানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে মারা যান দু’জন বোমা নির্মাণকারী ও আহত হন আরো কয়েকজন। যে দালানবাড়িটিতে বোমা বানানো হচ্ছিল, এর ছবি প্রকাশিত হয়েছে আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায়। পত্রিকার ছবি দেখে মনে হলো, বোমা বিস্ফোরণের ফলে বাড়িটির কোনো অংশ ভেঙে যায়নি। আমার মনে তাই প্রশ্ন জাগল, যে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে তা আসলেই বোমা ছিল না পটকা জাতীয় কিছু ছিল, তা নিয়ে। কারণ, প্রকৃত বোমা বিস্ফোরিত হলে দালানটির কিছু-না-কিছু অংশ তিগ্রস্ত হতো। কিন্তু তা হয়নি। তাই বর্ধমান শহরের লোকে ভয়ঙ্করভাবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু ঘটেছে বলে আমার মনে হলো না। যদিও পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, বর্ধমান শহরের মানুষ ভয়ঙ্করভাবে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। পশ্চিমবঙ্গে নকশালপন্থীরা অনেক শক্তিশালী প্রকৃত বোমা বানাতে জানেন। যার বিস্ফোরণে ভেঙে যেতে পারে দালানকোঠা। ভাঙতে পারে সাঁকো, উড়ে যেতে পারে রেললাইন। পশ্চিম বাংলার মানুষ নকশালদের তৈরি বোমা বানানোর সাথে পরিচিত। তাই এরা জঙ্গি মুসলিম মৌলবাদীদের তৈরি পটকা বিস্ফোরণে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। যদিও আমাদের দেশে পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, বর্ধমানে বিরাজ করছে আতঙ্ক। ভারতে ছত্তিশগড় রাজ্যে নকশালপন্থীরা স্থলমাইন ব্যবহার করছে, যা কেবল সেনাবাহিনীর লোকেরাই ব্যবহার করতে পারে। ভারতের নকশালপন্থীরা স্থলমাইন কী করে জোগাড় করতে পারছে, তা হয়ে আছে রহস্যাবৃত। কেউ কেউ এমন মন্তব্য করছেন যে, নকশালপন্থীরা প্রচুর অর্থ দিয়ে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কিনছে স্থলমাইন। কথাটা কতটা সত্য আমরা জানি না। তবে জনশ্র“তি এ বিষয়ে প্রবল।
আমাদের দেশে পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে জড়ানো হচ্ছে বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের সাথে। কিন্তু বর্ধমান শহরে জামায়াত কর্মীরা কেন বোমা বানাতে যাবেন, সেটা আমার কাছে মোটেও বোধগম্য নয়। জামায়াত কর্মীরা যদি বোমা বানাতে চায়, তবে সেটা তার নিজ দেশে বসেই করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে বোমা বানিয়ে তা বাংলাদেশে নিয়ে আসা সহজসাধ্য নয়। এই বোকামি তারা কখনো করতে যেতে পারে না। বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার তৃণমূল কংগ্রেস দল গড়ার জন্য প্রচুর অর্থ পেয়েছিলেন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে। জামায়াতের সাথে তার রয়েছে একটা বিশেষ সম্পর্ক। আর তাই তিনি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বোমা বানানো লোকদের নিজ দেশে দিচ্ছেন প্রশ্রয়। কিন্তু যেখানে সামান্য একজন গরু বিক্রেতা পশ্চিম বাংলা থেকে বাংলাদেশে আসতে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে জামায়াতে ইসলামীদের যাওয়া-আসার অবাধ সুযোগ করে দিতে পারেন, সেটা নিয়ে সহজেই প্রশ্ন উঠানো যেতে পারে। তাই মনে হচ্ছে, পত্রপত্রিকায় প্রচারিত খবর হলো খুবই দুরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী দল একটা গোড়া ধর্মান্ধ মৌলবাদী ইসলামপন্থী দল নয়। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা গোলাম আযমকে মনোবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে একজন কঠোর মনোভাবাপন্ন বা টাফ মাইন্ডেড ব্যক্তি বলা চলে না। বরং বলতে হয়, একজন নমনীয় মনোভাবের বা টেন্ডার মাইন্ডেড ব্যক্তি। তিনি কোনো দিনই চাননি জোর করে মতা দখল করতে। অগ্রসর হতে চেয়েছেন নিয়মতান্ত্রিক পথে। এখনো জামায়াত চাচ্ছে ভোটের মাধ্যমে মতায় যেতে। বোমাবাজি করে মতায় যাওয়া যাবে অথবা উচিত হবে সে কথা ভাবছে না এই দলটি। গোলাম আযমের রাজনৈতিক জীবন আরম্ভ হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। গোলাম আযম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের নির্বাচিত জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি)। তিনি জিএস থাকার সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে দিয়েছিলেন উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংবলিত স্মারকলিপি। ১৯৪৮ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। সফরে এসে ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমন্যাসিয়াম মাঠে এক বিরাট ছাত্রসমাবেশে ভাষণ দেন। সেই ঐতিহাসিক ছাত্রসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের প থেকে ঢাকসুর জিএস গোলাম আযম ছাত্রজনতার করতালির মধ্যে উর্দুর সাথে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবি সংবলিত মেমোরেন্ডাম পাঠ করেন এবং তা দেন লিয়াকত আলী খানকে। তার সম্বন্ধে বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা এক সাাৎকারে বলেছেন : ‘গোলাম আযম সাহেব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) ছিলেন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন মেধাবী। স্বভাবগতভাবেই তিনি ছিলেন অমায়িক এবং ভদ্র। ভালো সার্কেলের ছাত্ররা যেমন পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে, তেমনি আমরা সহজাতভাবে একত্রিত হয়ে ভাষা আন্দোলনে কাজ করেছি। আমাদের এ সার্কেলে আরো অনেক সহযোগী ছিলেন। এর পেছনে আর অন্য কোনো কারণ ছিল না।’..... (দ্রষ্টব্য : মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-১৪৩৯। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা। ২০০৮।)
গোলাম আযম ১৯৭১ সালে বলেছিলেন, শেখ মুজিবের হাতে মতা হস্তান্তর করা হোক। যদিও পরে তিনি করেছিলেন পাকবাহিনীর সাথে সহযোগিতা। কারণ তিনি চাননি, ভারতীয় বাহিনী এসে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান দখল করুক। তিনি ছিলেন ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধী। কিন্তু তিনি কখনোই চাননি পাকবাহিনী নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করুক। তিনি পাক সামরিক জান্তার বাড়াবাড়ির করেছেন সমালোচনা। এখন আমরা জানতে পারছি যে, শেখ মুজিবও চাননি যে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। তিনি চেয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিক স্বায়ত্তশাসন। তিনি আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো ভারতে যেতে চাননি। বন্দী হয়ে চলে গিয়েছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের সাথে গোলাম আযমের ঘোরতর মতভেদ ঘটেছিল, এ রকম সিদ্ধান্ত করা যায় না। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয় উচ্চ আদালতের রায় অনুসারে। উচ্চ আদালতের বিচারকেরা বলেন যে, ১৯৭১-এ গোলাম আযম যা করেছেন, তার জন্য তার নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে পারে না। গোলাম আযম উচ্চ আদালতের রায় বলে হতে পারেন বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করেননি। জামায়াতে ইসলামী দল একটি চরমপন্থী দল নয়। মুসলিম মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি মধ্যপন্থী দল। এখনো জামায়াত বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষিত হয়নি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলেছে। আর এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ফলাও করে ছাপা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামের সদস্যরা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বানাচ্ছিল বলে। সম্প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক নেতা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে একটি মধ্যপন্থী ইসলামি দল হিসেবে বিবেচনা করছেন। বাংলাদেশের জামায়াত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের কাছে পেতে শুরু করেছে বিশেষ বিবেচনা। তারা ভাবছেন, জামায়াত একটি মধ্যপন্থী ইসলামি দল। বাংলাদেশ হলো একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ এবং ওআইসির সদস্য। বাংলাদেশে মধ্যপন্থী একটি ইসলামি দলের প্রভাব বেড়ে যাওয়া, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হতে পারবে শুভ। কেননা, এর ফলে খ্রিষ্টান বিশ্বের প্রতি মুসলিম বিশ্বের বৈরী মনোভাব যাবে কমে। বাড়বে ইতিবাচক সহযোগিতার মনোভাব।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এখন প্রমাণ করতে চাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী হলো একটি গোঁড়া ধর্মান্ধ ইসলামপন্থী দল। তাই আওয়ামী লীগ মতায় না থাকলে জামায়াত মতায় আসবে। আর এর ফলে তিগ্রস্ত হবে ইউরো-মার্কিন জোট। কিন্তু ইউরো-মার্কিন জোটের অনেক নেতাই হতে পারছেন না আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত। বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জামায়াত সম্পর্কে এখন অনেক ভিন্নভাবেই ভাবছে বলেই মনে হয়।
একটি বিষয় বিশেষভাবে লণীয়, তা হলো সাবেক পাকিস্তান আমলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে দল হিসেবে জামায়াত মোটেও শক্তিশালী ছিল না। সে শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছে ১৯৭১ সালের পরে। তার ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী মনোভাবের কারণে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে, বাংলাদেশে জামায়াত সাহায্য ও সহযোগিতা পাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না, তখনই জামায়াত হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গ্রহণযোগ্য শক্তি। বিএনপির সাথে জোট গঠন করে জামায়াত থেকে দু’জন হতে পারেন মন্ত্রী। এই দু’জন মন্ত্রী চেষ্টা করেননি বাংলাদেশে জঙ্গি ইসলামতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার। উদার গণতন্ত্র মেনেই পরিচালনা করতে চেয়েছেন দেশকে। বর্তমানে এই ইতিহাসটুকুকে টপকে যেতে চাচ্ছেন যেন এ দেশের অনেক সাংবাদিক। কেন তারা এটা করছেন, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। অনেক ভারতীয় পত্রপত্রিকার সাথে মিলছে তাদের সাংবাদিকতার ধারা।
সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ তুলেছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাজে হস্তপে করছে। যাতে ফুটে উঠছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব। কিন্তু ভারতের সংবিধান এমন যে, এ রকম হস্তপে কেন্দ্রীয় সরকার করতেই পারে। কেননা, ভারতের সংবিধানে যদিও ভারতকে বলা হয়েছে একটি ইউনিয়ন। কিন্তু ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি ইউনিয়ন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার তার কোনো অঙ্গরাজ্যের ঘরোয়া রাজনীতিতে হস্তপে করতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্য নির্বাচিত করে তাদের নিজস্ব গভর্নর। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর বা রাজ্যপাল নিযুক্তি পান কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে যেকোনো সময় প্রাদেশিক সরকারকে ভেঙে দিতে পারেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার যেকোনো প্রদেশের সীমানার ঘটাতে পারে রদবদল। যেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার পারে না তার অঙ্গরাজ্যের েেত্র। ভারতকে যদি একটা প্রকৃত ফেডারেশন হতে হয়, তবে তার প্রত্যেকটি প্রদেশকে এক হয়ে করতে হবে আন্দোলন। একা পশ্চিমবঙ্গের পে ভারতকে একটা প্রকৃত ফেডারেশনে পরিণত করা কখনোই সম্ভবপর হতে পারে না। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র নয়, যে নাকি পারে পশ্চিমবঙ্গকে এ কাজে সহায়তা করতে। বিরাট রাষ্ট্র ভারত। সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল তার সৈন্য। কিন্তু অনুরূপ কিছু করতে পারে না বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের জন্য। যদিও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য বাংলাদেশের মানুষ অনুভব করে সমমর্মিতা। কিন্তু তবুও ভারতের অনেক পত্রপত্রিকায় এমনভাবে খবর ছাপা হচ্ছে, যা পড়ে মনে হতে পারে বাংলাদেশ চাচ্ছে ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিযুক্তি। জানি না, এ ধরনের প্রচারণার শেষ ফল কী দাঁড়াবে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের সাথে যুক্ত রাখার অজুহাত তুলে বাংলাদেশের সাথে একটা সঙ্ঘাত বাধাবে কি না, সেটাও বলা যাচ্ছে না। আমরা গণতন্ত্রে আস্থাশীল। আস্থাশীল সংবাদপত্রের স্বাধীনতায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা ল করছি যে, আমাদের দেশের অনেক পত্রপত্রিকায় সংবাদ সরবরাহ করা হচ্ছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারেরই অনুকূলে। এ ধরনের সাংবাদিকতা জাতীয় স্বার্থেই বর্জনীয়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
আমাদের দেশে পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে জড়ানো হচ্ছে বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের সাথে। কিন্তু বর্ধমান শহরে জামায়াত কর্মীরা কেন বোমা বানাতে যাবেন, সেটা আমার কাছে মোটেও বোধগম্য নয়। জামায়াত কর্মীরা যদি বোমা বানাতে চায়, তবে সেটা তার নিজ দেশে বসেই করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে বোমা বানিয়ে তা বাংলাদেশে নিয়ে আসা সহজসাধ্য নয়। এই বোকামি তারা কখনো করতে যেতে পারে না। বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার তৃণমূল কংগ্রেস দল গড়ার জন্য প্রচুর অর্থ পেয়েছিলেন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে। জামায়াতের সাথে তার রয়েছে একটা বিশেষ সম্পর্ক। আর তাই তিনি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বোমা বানানো লোকদের নিজ দেশে দিচ্ছেন প্রশ্রয়। কিন্তু যেখানে সামান্য একজন গরু বিক্রেতা পশ্চিম বাংলা থেকে বাংলাদেশে আসতে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে জামায়াতে ইসলামীদের যাওয়া-আসার অবাধ সুযোগ করে দিতে পারেন, সেটা নিয়ে সহজেই প্রশ্ন উঠানো যেতে পারে। তাই মনে হচ্ছে, পত্রপত্রিকায় প্রচারিত খবর হলো খুবই দুরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী দল একটা গোড়া ধর্মান্ধ মৌলবাদী ইসলামপন্থী দল নয়। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা গোলাম আযমকে মনোবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে একজন কঠোর মনোভাবাপন্ন বা টাফ মাইন্ডেড ব্যক্তি বলা চলে না। বরং বলতে হয়, একজন নমনীয় মনোভাবের বা টেন্ডার মাইন্ডেড ব্যক্তি। তিনি কোনো দিনই চাননি জোর করে মতা দখল করতে। অগ্রসর হতে চেয়েছেন নিয়মতান্ত্রিক পথে। এখনো জামায়াত চাচ্ছে ভোটের মাধ্যমে মতায় যেতে। বোমাবাজি করে মতায় যাওয়া যাবে অথবা উচিত হবে সে কথা ভাবছে না এই দলটি। গোলাম আযমের রাজনৈতিক জীবন আরম্ভ হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। গোলাম আযম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের নির্বাচিত জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি)। তিনি জিএস থাকার সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে দিয়েছিলেন উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংবলিত স্মারকলিপি। ১৯৪৮ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। সফরে এসে ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমন্যাসিয়াম মাঠে এক বিরাট ছাত্রসমাবেশে ভাষণ দেন। সেই ঐতিহাসিক ছাত্রসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের প থেকে ঢাকসুর জিএস গোলাম আযম ছাত্রজনতার করতালির মধ্যে উর্দুর সাথে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবি সংবলিত মেমোরেন্ডাম পাঠ করেন এবং তা দেন লিয়াকত আলী খানকে। তার সম্বন্ধে বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা এক সাাৎকারে বলেছেন : ‘গোলাম আযম সাহেব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) ছিলেন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন মেধাবী। স্বভাবগতভাবেই তিনি ছিলেন অমায়িক এবং ভদ্র। ভালো সার্কেলের ছাত্ররা যেমন পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে, তেমনি আমরা সহজাতভাবে একত্রিত হয়ে ভাষা আন্দোলনে কাজ করেছি। আমাদের এ সার্কেলে আরো অনেক সহযোগী ছিলেন। এর পেছনে আর অন্য কোনো কারণ ছিল না।’..... (দ্রষ্টব্য : মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-১৪৩৯। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা। ২০০৮।)
গোলাম আযম ১৯৭১ সালে বলেছিলেন, শেখ মুজিবের হাতে মতা হস্তান্তর করা হোক। যদিও পরে তিনি করেছিলেন পাকবাহিনীর সাথে সহযোগিতা। কারণ তিনি চাননি, ভারতীয় বাহিনী এসে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান দখল করুক। তিনি ছিলেন ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধী। কিন্তু তিনি কখনোই চাননি পাকবাহিনী নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করুক। তিনি পাক সামরিক জান্তার বাড়াবাড়ির করেছেন সমালোচনা। এখন আমরা জানতে পারছি যে, শেখ মুজিবও চাননি যে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। তিনি চেয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিক স্বায়ত্তশাসন। তিনি আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো ভারতে যেতে চাননি। বন্দী হয়ে চলে গিয়েছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের সাথে গোলাম আযমের ঘোরতর মতভেদ ঘটেছিল, এ রকম সিদ্ধান্ত করা যায় না। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয় উচ্চ আদালতের রায় অনুসারে। উচ্চ আদালতের বিচারকেরা বলেন যে, ১৯৭১-এ গোলাম আযম যা করেছেন, তার জন্য তার নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে পারে না। গোলাম আযম উচ্চ আদালতের রায় বলে হতে পারেন বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করেননি। জামায়াতে ইসলামী দল একটি চরমপন্থী দল নয়। মুসলিম মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি মধ্যপন্থী দল। এখনো জামায়াত বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষিত হয়নি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলেছে। আর এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ফলাও করে ছাপা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামের সদস্যরা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বানাচ্ছিল বলে। সম্প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক নেতা বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে একটি মধ্যপন্থী ইসলামি দল হিসেবে বিবেচনা করছেন। বাংলাদেশের জামায়াত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের কাছে পেতে শুরু করেছে বিশেষ বিবেচনা। তারা ভাবছেন, জামায়াত একটি মধ্যপন্থী ইসলামি দল। বাংলাদেশ হলো একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ এবং ওআইসির সদস্য। বাংলাদেশে মধ্যপন্থী একটি ইসলামি দলের প্রভাব বেড়ে যাওয়া, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হতে পারবে শুভ। কেননা, এর ফলে খ্রিষ্টান বিশ্বের প্রতি মুসলিম বিশ্বের বৈরী মনোভাব যাবে কমে। বাড়বে ইতিবাচক সহযোগিতার মনোভাব।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এখন প্রমাণ করতে চাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী হলো একটি গোঁড়া ধর্মান্ধ ইসলামপন্থী দল। তাই আওয়ামী লীগ মতায় না থাকলে জামায়াত মতায় আসবে। আর এর ফলে তিগ্রস্ত হবে ইউরো-মার্কিন জোট। কিন্তু ইউরো-মার্কিন জোটের অনেক নেতাই হতে পারছেন না আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত। বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জামায়াত সম্পর্কে এখন অনেক ভিন্নভাবেই ভাবছে বলেই মনে হয়।
একটি বিষয় বিশেষভাবে লণীয়, তা হলো সাবেক পাকিস্তান আমলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে দল হিসেবে জামায়াত মোটেও শক্তিশালী ছিল না। সে শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছে ১৯৭১ সালের পরে। তার ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী মনোভাবের কারণে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে, বাংলাদেশে জামায়াত সাহায্য ও সহযোগিতা পাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না, তখনই জামায়াত হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গ্রহণযোগ্য শক্তি। বিএনপির সাথে জোট গঠন করে জামায়াত থেকে দু’জন হতে পারেন মন্ত্রী। এই দু’জন মন্ত্রী চেষ্টা করেননি বাংলাদেশে জঙ্গি ইসলামতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার। উদার গণতন্ত্র মেনেই পরিচালনা করতে চেয়েছেন দেশকে। বর্তমানে এই ইতিহাসটুকুকে টপকে যেতে চাচ্ছেন যেন এ দেশের অনেক সাংবাদিক। কেন তারা এটা করছেন, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। অনেক ভারতীয় পত্রপত্রিকার সাথে মিলছে তাদের সাংবাদিকতার ধারা।
সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ তুলেছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাজে হস্তপে করছে। যাতে ফুটে উঠছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব। কিন্তু ভারতের সংবিধান এমন যে, এ রকম হস্তপে কেন্দ্রীয় সরকার করতেই পারে। কেননা, ভারতের সংবিধানে যদিও ভারতকে বলা হয়েছে একটি ইউনিয়ন। কিন্তু ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি ইউনিয়ন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার তার কোনো অঙ্গরাজ্যের ঘরোয়া রাজনীতিতে হস্তপে করতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্য নির্বাচিত করে তাদের নিজস্ব গভর্নর। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর বা রাজ্যপাল নিযুক্তি পান কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে যেকোনো সময় প্রাদেশিক সরকারকে ভেঙে দিতে পারেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার যেকোনো প্রদেশের সীমানার ঘটাতে পারে রদবদল। যেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার পারে না তার অঙ্গরাজ্যের েেত্র। ভারতকে যদি একটা প্রকৃত ফেডারেশন হতে হয়, তবে তার প্রত্যেকটি প্রদেশকে এক হয়ে করতে হবে আন্দোলন। একা পশ্চিমবঙ্গের পে ভারতকে একটা প্রকৃত ফেডারেশনে পরিণত করা কখনোই সম্ভবপর হতে পারে না। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র নয়, যে নাকি পারে পশ্চিমবঙ্গকে এ কাজে সহায়তা করতে। বিরাট রাষ্ট্র ভারত। সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল তার সৈন্য। কিন্তু অনুরূপ কিছু করতে পারে না বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের জন্য। যদিও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য বাংলাদেশের মানুষ অনুভব করে সমমর্মিতা। কিন্তু তবুও ভারতের অনেক পত্রপত্রিকায় এমনভাবে খবর ছাপা হচ্ছে, যা পড়ে মনে হতে পারে বাংলাদেশ চাচ্ছে ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিযুক্তি। জানি না, এ ধরনের প্রচারণার শেষ ফল কী দাঁড়াবে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের সাথে যুক্ত রাখার অজুহাত তুলে বাংলাদেশের সাথে একটা সঙ্ঘাত বাধাবে কি না, সেটাও বলা যাচ্ছে না। আমরা গণতন্ত্রে আস্থাশীল। আস্থাশীল সংবাদপত্রের স্বাধীনতায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা ল করছি যে, আমাদের দেশের অনেক পত্রপত্রিকায় সংবাদ সরবরাহ করা হচ্ছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারেরই অনুকূলে। এ ধরনের সাংবাদিকতা জাতীয় স্বার্থেই বর্জনীয়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
No comments