নেশার খরচ বছরে ২৫,৫০০ কোটি টাকা by আলী ইদরিস
জাতিসংঘের এক জরিপ অনুযায়ী ২০০৯ সালে বাংলাদেশে মোট মাকদাসক্তের সংখ্যা ছিল ৬৫ লাখ, তন্মধ্যে দেড় লাখ নারী ছিল যাদের অধিকাংশই যুবতী। ঢাকা শহরের ভেতর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা ইন্সটিটিউট, কাওরান বাজার, আগারগাঁও, তেজগাঁও শিল্প এলাকা এবং আশপাশের বহু জায়গায় উঠতি বয়সের মাদকাসক্তদের ড্রাগ গ্রহণ করতে দেখা যায়। বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ, তন্মধ্যে প্রায় ৮০% পুরুষ এবং ২০% নারী। এদের বয়স ১৮ বছর থেকে ৩০ বছর। প্রায় ৬৫% মাদকাসক্ত অবিবাহিত এবং ৫৬% বেকার অথবা শিক্ষার্থী। এরা প্রতিদিন প্রায় ৭০ কোটি টাকা মাদক দব্য কিনতে ব্যয় করে। সে হিসাবে বছরে দেশে প্রায় ২৫,৫০০ কোটি টাকা সর্বনাশা মাদক বা নেশাদ্রব্য ক্রয়ে ব্যয় হয়। মাদকাসক্তির চিত্রটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে একটি ভয়াবহ অবস্থা দৃষ্টিগোচর হয়। সমাজের তথা দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী অর্থাৎ উঠতি বয়সের যুবক-যুবতী যারা দেশের উৎপাদনমূলক কার্যক্রমে ভূমিকা রেখে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারতো, তারা মাদকে ভূত হয়ে পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য এবং দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝাস্বরূপ বেঁচে আছে। এরা উৎপাদনমূলক কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য আর্থিক দায় স্বরূপ বছরে দেশের ২৫,৫০০ কোটি টাকা পানিতে ছুড়ে দিচ্ছে। এ টাকা মাদকে খরচ না করে, সঞ্চয় করলে বা খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল, ওষুধ, চিকিৎসা, লেখাপড়ার কাজ ব্যয় করলে মাদকাসক্ত সন্তানের নিজের ও পরিবারের সঞ্চয়, সচ্ছলতা, উৎপাদনশীলতা বাড়তো, দেশের দারিদ্র্য হ্রাস পেতো, জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়তো। যুবশক্তি একটি দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদে রূপ নেয় যখন তাদেরকে শিক্ষা, ও প্র্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল করে গড়া যায়। জাপানসহ পশ্চিমা অনেক দেশে প্রবীণদের সংখ্যাধিক্যের জন্য কর্মক্ষম যুবক যুবতীর সংখ্যা কম। তাই তাদেরকে অন্যদেশ থেকে শ্রম শক্তি আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোক বিদেশে কর্মরত। এদের মধ্যে যুবক-যুবতী, ত্রিশোর্ধ বা চল্লিশোর্ধ ব্যক্তি আছেন। আগামী দশ বা পনেরো বছর পর ওদের একাংশ প্রবীণ হয়ে গেলে দেশের বর্তমান যুবশক্তি তাদের স্থান দখল করতো। এ যুবশক্তি যদি মাদকে মত্ত হয়ে নিজেদেরকে অসুস্থ, অকর্মন্য করে তুলে তাহলে সেটা জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি, শুধু জাতির জন্য নয়, মাদকাসক্তকে নিয়ে প্রত্যেকটি পরিবার, পাড়া-পড়শি ও সমাজ বেকায়দায় দিন কাটাচ্ছে। মাদকের অর্থ-যোগাতে বা মাদকাসক্তের চিকিৎসা দিতে পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে, নেশাগস্ত নেশার টাকা না পেলে, চুরি, চামারিসহ ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি, মা-বোনকে মারধর, এমনকি অতিরিক্ত নেশায় হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটাচ্ছে। নেশাগ্রস্ত সন্তানের দৌরাত্ম্য থেকে বাঁচার জন্য মা বাবা ছেলেকে থানায় পর্যন্ত সোপর্দ করছে। অন্যদিকে ছিন্নমূল পথশিশু ও কিশোররা নেশা করে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, এদেরকে চিকিৎসা দেয়ার কেউ নেই। এ ধরনের সামাজিক সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। নতুবা সমাজে, অস্থিরতা, অবক্ষয় দিন দিন বাড়বে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু রক্ষকই যদি ভক্ষক হয় তাহলে নালিশ করার জায়গা থাকে না। উৎকোচ পেয়ে জনবলের স্বল্পতার দোহাই দিয়ে পুলিশ নেশাখোর ও নেশাদ্রব্য সরবরাহকারীদের দেখেও দেখে না। আবার অনেক সময় পুলিশের ওপর মাদক সরবরাহকারী গডফাদারের প্রচণ্ড চাপ থাকে। অনেক সময় পুলিশ নিজেই নেশায় জড়িয়ে পড়ে। অবৈধ কাঁচা পয়সার ব্যবসা বলে হয়তো সরকারের কোন কোন প্রভাবশালী আমলা বা সংসদ সদস্য আড়ালে পরোক্ষভাবে গডফাদার হিসেবে থাকেন, তাই পুলিশ চাকরি হারানোর ভয়ে চিমসে যায়। তাহলে উপায় কি? উপায় রাষ্ট্রেরই খুঁজে বের করতে হবে। রাষ্ট্রনায়কগণ যদি দেশের মঙ্গল, পাড়া-পড়শি ও আত্মীয়- স্বজনের মঙ্গল চান, তাহলে মাদক বা নেশাদ্রব্য সরবরাহকারী যাদের সংখ্যা মাত্র ১ লাখ, তাদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার আদেশ দিতে পারেন। মাদক সরবরাহকারীরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মিয়ানমার থেকে সিংহভাগ চোরাচালান পায়। এ চোরাই পথ বন্ধ করতে বিজিবি’র একাগ্র তৎপরতা আনুমানিক ৫০% সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। আর দেশের অভ্যন্তরে পুলিশ, র্যাব কাজ করলে আরও শতকরা তিরিশ ভাগ সরবরাহ বন্ধ হবে। বাকি কাজ পরিবারের ওপর, পাড়া-পড়শি ও সমাজের প্রবীণদের নজরদারির ওপর ছেড়ে দিলে নেশাদ্রব্য সরবরাহ নব্বই শতাংশ নিমূর্ল হতে বাধ্য। সরবরাহ না থাকলে নেশাখোররা আপনা-আপনি নেশা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। শেষ অস্ত্র হবে নেশাদ্রব্যের চোরাচালানি ও মজুতদারিদের আটক করে দ্রুত বিচারের আওতায় কঠিন শাস্তি দেয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাদক চোরাচালানিদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এদেশেও একই শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু এ সব কিছুর পিছনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে অবৈধ অর্থলোভী প্রভাবশালী গডফাদাররা যারা সরবরাহকারীদের চালক ও প্রতিপালক এবং যারা পর্দার আড়ালে বসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে পারলে সব অপকর্ম থেমে যেতো। কিন্তু কোন সরকারই সেটা করতে সক্ষম হয়নি। কোন সরকারই প্রকৃত অর্থে সুশাসন কায়েম করতে পারেনি। আজ দেশের তথা সমাজের অস্থিরতা থেকে মুক্ত হতে হলে, জাতীয় উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে মাদকের ছোবল থেকে ৭০ লাখ যুবক- যুবতীকে বাঁচানো একান্ত অপরিহার্য। সরকারকে সেদিকে নজর দিতে হবে।
No comments