‘স্বপ্ন হতে হবে বিশাল, ছোট লক্ষ্য থাকা অপরাধ’ -এপিজে আবদুল কালাম
জীবনের লক্ষ্য অনেক বড় হতে হবে। স্বপ্ন হতে হবে বিশাল। ছোট লক্ষ্য থাকা অপরাধ। মিসাইল ম্যান অব ইন্ডিয়া খ্যাত ভারতের সাবেক (একাদশ) রাষ্ট্রপতি মহাকাশবিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)-এর ১১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজীত ‘এপিজে আবদুল কালামের সঙ্গে যুব সংলাপ’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সাফল্য ও ব্যর্থতার ব্যবস্থাপনা করতে শিখতে হবে। এর চর্চা করতে হবে। বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের যেকোন প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা, সমন্বয় এবং ব্যবস্থাপনার ধারণা থাকতে হয়। জীবনের ক্ষেত্রেও তাই। মানব কল্যানের জন্য, জনগণের হাসির জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। চূড়ান্ত সাফল্য আসে ব্যর্থতার পথ ধরেই। তাই ব্যর্থতার সময়ে এবং বিষয়ে ব্যবস্থাপনা করতে পারাটা জরুরি। একজন সত্যিকারের নেতা তার দলের ব্যর্থতা নিজের ঘাড়ে তুলে নেন। পুরো দলকে নিয়ে সমস্যার সমাধান তৈরি করেন। পরে যখন সাফল্য আসে তখন দলভুক্ত অন্যদের সাফল্যের বর্ণনার জন্য সামনে নিয়ে আসেন। এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি পরমাণু বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি। পারমাণবিক অস্ত্র আমাদের জন্য শঙ্কা তৈরি করেছে। আমেরিকা ও রাশিয়া ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের ৩০ ভাগ পারমানবিক অস্ত্র ধ্বংস করতে সম্মত হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তানও এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছতে পারে। অনেকের মত আমি বিজ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের হাসি দেখতে চাই, কান্না নয়। পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি। নিজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবদুল কালাম বলেন, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় শ্রেণিকক্ষে আমাদের শিক্ষক নিবাস্ত সুব্রামানিয়াম আইয়ার পাখি ও পাখির উড়া সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে দেয়া তার সেই বক্তব্য আমার মনে গেথে গিয়েছিল। পাখি কিভাবে উড়ে? আমি কিভাবে উড়তে পারব এ স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখি। জীবনে একবার বিমান বাহিনীর পাইলট হওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন বলে জানান তিনি। তবে, ওই বছর বিমান বাহিনী মাত্র ৮ জনকে পাইলট হিসেবে নিয়োগ দেয়। তার অবস্থান ছিল নবম। এর পর তিনি অ্যারোনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন। ছাত্রজীবনে একটি এয়ারক্রাফট তৈরি প্রকল্পের দলনেতা হিসেবে তিনি নেতৃত্ব দেন। ৬ মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর তার প্রকল্পটি সফল হয়। তখন প্রকল্প পরিচালকদের নীল শার্ট পরতে দেখতাম। সেই যে নীল রংয়ের শার্ট পরা শুরু করেছি তা এখনও অব্যাহত রেখেছি। তিনি জানান, ২০০৭ সালে বিমান বাহিনী তাকে বিমান নিয়ে আকাশে উড়ার অনুমতি দেয়। শৈশবের স্বপ্ন তিনি পূরণ করেছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, নিজের স্বপ্নকে একটা কাঠামোতে দাঁড় করাও। আজ রাতেই বাসায় গিয়ে তোমার জীবনের লক্ষ্যকে এক পাতায় লিখে ফেলো আর আমাকে মেইল করে দাও। মনে রাখবে তোমাদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, আমার দেশ ভারতের জনসংখ্যা বিলিয়ন, শতকোটির বেশি। আমাদের রয়েছে বিলিয়ন স্বপ্ন এবং বিলিয়ন সমস্যা। আমি এই বিলিয়ন মুখে হাসি দেখতে চাই। আরো ৮৩ বছর বেঁচে থাকলেও এই একই স্বপ্ন দেখব। আবদুল কালাম বলেন, আমি স্বপ্ন দেখেছি মহাকাশে ভারতের স্যাটেলাইট সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। প্রথমবার স্যাটেলাইট উক্ষপণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হই। আমি ছিলাম মিশন পরিচালক। স্যাটেলাইট উক্ষপণের মাত্র ৩ মিনিট ৮ সেকেন্ড আগে একটা সমস্যা ধরা পড়ে। এরপরও আমি তা উক্ষপণের নির্দেশ দেই। পরদিন সংবাদ সম্মেলনে প্রায় দেড় শতাধিক সংবাদ মাধ্যম প্রশ্ন করে কেন আমি এই নির্দেশ দিয়েছিলাম। জবাবে বলেছিলাম, আমরা স্যাটেলাইট উক্ষপনে ব্যর্থ হয়েছি, তবে অনেক কিছু শিখেছি। কারণ এর পেছনে ছিল আমাদের অনেক শ্রম ও অর্থ ব্যয়। ২০১৪ সালে আমাদের স্যাটেলাইট উক্ষপণ সফল হয়। তখন সবাই অভিনন্দন জানায়। তাই বলি, স্বপ্ন দেখতে হবে। সমস্যা আসলে এর সমাধান বের করতে হবে। এ দেশের সব জায়গাতেই পানির প্রাচুর্য রয়েছে। যেখানে গিয়েছি সেখানেই উর্বর ভূমি আর মেধাবী তরুণদের দেখা পেয়েছি। এ দেশের মোট নাগরিকের অর্ধেকের বেশি তরুণ। এ তরুণদের মধ্যে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে যথার্থ পরিকল্পনা করতে হবে। থাকতে হবে বড় স্বপ্ন। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মনোভাব ও উদার মানসিকতা নিয়ে জীবনে পথ চলতে হবে। তিনি বলেন, ভারত এবং বাংলাদেশ একই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক। দুই দেশের ভৌগলিক অবস্থার মধ্যে, মাটির মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। দুই দেশের জনগণই দেশপ্রেমের দারুণ নজির স্থাপন করেছে। সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছে, জীবন দিয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য। দুই দেশই বিশ্বের বুকে উদার ও শক্তিমান রাষ্ট্র হিসেবে ভূমিকা রাখতে চায়। আমাদের উন্নয়ন লক্ষ্যের সূচকগুলোও প্রায় এক। উভয় দেশ এক সঙ্গে কাজ করলে, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে উন্নয়ন পথ পাড়ি দেয়া সহজ হবে। বিজ্ঞানের চর্চা দারুণ সুখ ও উচ্ছ্বাস বয়ে আনে। কোন কিছু সৃষ্টির অনুভূতি বর্ণনাতীত। জগতে যত বড় উদ্ভাবন-সৃষ্টি দেখা যায়, তার পেছনে তত বড় কল্পনা ও স্বপ্ন রয়েছে। কোন কিছু সৃষ্টির পেছনের কথা জানার জন্য আমাদের প্রশ্ন করতে হবে। এ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করতে হবে। সাফল্যের জন্য চাই সততা ও কঠোর পরিশ্রম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এমসিসিআই’র সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমান। বক্তৃতাপর্ব সঞ্চালনা করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। আরও বক্তব্য রাখেন এমসিসিআই’র সহ-সভাপতি আনিস এ খান, তাবিথ আওয়াল। বক্তৃতাপর্বে যোগ দেনদেশের ১৬টি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ শতাধিক শিক্ষার্থী। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, শিক্ষক, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা ও ব্যবসা উদ্যোক্তাসহ দুই শতাধিক অতিথি অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
No comments