আইন ও সংবিধান- বিচারকদের অভিশংসন প্রসঙ্গে by ইকতেদার আহমেদ

পৃথিবীর যেকোনো দেশে গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য জবাবদিহিতা অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংসদ সদস্যদের সংসদের মেয়াদান্তে পুনর্নির্বাচনের জন্য জনগণের কাছে যেতে হয়। একজন সংসদ সদস্য বা তিনি যে দল থেকে নির্বাচিত সে দলের কার্যকলাপের মাধ্যমে তার নির্বাচনী এলাকার জনগণ সন্তুষ্ট থাকলে তার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল থাকে। পক্ষান্তরে তার ও দলের কার্যকলাপে জনগণ বিক্ষুব্ধ হলে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। একজন সংসদ সদস্য বা তার দল যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি জনগণকে দেয়, তা পূরণের মধ্যেই নিহিত থাকে তার বা দলের জবাবদিহিতা। আর প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হলে জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করে।
যেকোনো দেশে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে বিজয়-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়; কিন্তু সে দায়িত্ব চিরস্থায়ী নয়। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন ঘটলে বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ থাকে, জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে। নির্বাচনে নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হওয়া গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যেসব দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হয়েছে সেসব দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরস্পর পরিপূরক। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র বহাল থাকলে সৎ, যোগ্য, ন্যায়নিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে নিয়োগ পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বহাল আছে পৃথিবীর এমন সব দেশে উচ্চ আদালতের বিচারকেরা সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। আর সংসদের কাছে জবাবদিহির প্রকৃত অর্থ হলো জনগণের কাছে জবাবদিহি। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাংবিধানিক পদধারী একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে সংসদীয় অভিশংসনের মাধ্যমে তাকে অপসারণ করা হয়। অসদাচরণ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং একজন ভদ্রলোকের পক্ষে অনুচিত যেকোনো কাজই অসদাচরণ। পৃথিবীর যেসব দেশে সাংবিধানিক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকদের অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদীয় অভিশংসন ব্যবস্থা চালু আছে সেসব দেশে এ ব্যবস্থাটি সংসদ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
আমাদের দেশে ’৭২-এর সংবিধানে শুরুতে সাংবিধানিকভাবে নিয়োগ পাওয়া বিচারকদের অপসারণ বিষয়ে বলা ছিলÑ প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার মাধ্যমে সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না। ’৭২-এর সংবিধানের এ বিধানটি পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এতদসংক্রান্ত বিধানের সমরূপ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া-পরবর্তী এ দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাঅব্যাহত থাকবে সে মানসে যদিও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সাংবিধানিক পদধারী বিচারকদের জন্য সংসদীয় অভিসংশন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল; কিন্তু সে পথে বাংলাদেশ বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী-পরবর্তী সময়ে দেখা গেল সাংবিধানিক পদধারী বিচারকদের অপসারণে অভিশংসন পদ্ধতির রহিত করে বলা হয় অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে কোনো বিচারককে তার পদ থেকে অপসারণ করা যাবে; তবে শর্ত থাকে যে, কোনো বিচারককে তার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা নেয়ার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর যুক্তিসঙ্গত সুযোগদান না করা পর্যন্ত তাকে অপসারিত করা যাবে না। এরপর দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দিয়ে সাংবিধানিক পদধারী বিচারকদের অপসারণসংক্রান্ত ৯৬ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে বলা হয়Ñ গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী বিচারকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ রাষ্ট্রপতির নির্দেশক্রমে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ অপর দুই বিচারক সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তদন্ত করবেন এবং তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে অপসারণ করবেন।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পর আপিল বিভাগও ওই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ে ’৭২-এর সংবিধানে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে; কিন্তু সাংবিধানিক পদধারী বিচারকদের অপসারণ বিষয়ে আপিল বিভাগ অভিমত দেন, রাষ্ট্রপতির কারণ দর্শানোর মাধ্যমে অপসারণের পদ্ধতির চেয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অপসারণ পদ্ধতিটি উৎকৃষ্টতর। তাই এ পদ্ধতিটি বহাল রাখা যুক্তিযুক্ত।
অবসর নেয়ার পর বিচারকদের অক্ষমতা বিষয়ে ৯৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা ছিলÑ কোনো ব্যক্তি বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করে থাকলে ওই পদ থেকে অবসরগ্রহণ বা অপসারিত হওয়ার পর তিনি কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে ওকালিত বা কার্য করবেন না এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। পরে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দিয়ে অবসর-পরবর্তী বিচারকদের বিচার বিভাগীয় বা আধাবিচার বিভাগীয় পদে নিয়োগ লাভের জন্য যোগ্য করাসহ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক পদ থেকে অবসর-পরবর্তী আপিল বিভাগে ওকালতি করার জন্য যোগ্য করা হয়। এরপর সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনের মাধ্যমে বিচারকদের অবসর-পরবর্তী সময়ে প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টার পদে আসীন হওয়ার যোগ্য করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করলে ৭২-এর সংবিধান পুনর্বহালের আবশ্যকতা দেখা দেয় এবং এরই আলোকে ফেব্রুয়ারি ২০১১ আইন মন্ত্রণালয় যে সংবিধান মুদ্রণ করে তাতে দেখা যায়, ৯৯ নম্বর অনুচ্ছেদটি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে বারিত করা হয়। যদিও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী-পরবর্তী দেখা যায় বিচারকদের অবসর-পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ বারিত করা হলেও বিচার বিভাগীয় বা আধাবিচার বিভাগীয় পদগ্রহণ এবং আপিল বিভাগে ওকালতি করার বিধান দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ দিয়ে প্রদত্ত বিধানের মতো অক্ষুণœ রাখা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা চালু নেই। পাকিস্তানের সংবিধানে সামরিক শাসক আয়ুব খান এ অভিনব ব্যবস্থাটির প্রবেশ ঘটান। এ ধরনের ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ব্যবস্থাটি চালু নেই। পাকিস্তান প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কি না, এ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি অবধি পাকিস্তানে যে জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে সরকার গঠনের অধিকারী হয়; কিন্তু আওয়ামী লীগকে অন্যায়ভাবে সরকার গঠন করতে দেয়া না হলে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামে নামে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশ সামরিক শাসনাধীন থাকাবস্থায় বিশ্বের অন্য সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ব্যত্যয়ে শুধু পাকিস্তানের অভিনব সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাটি কী করে আমাদের সংবিধানে স্থান পেল তা বোধগম্য নয়। এ ব্যবস্থাটি বিচারের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নীতি কোনো ব্যক্তি স্বীয় কর্মের বিচারক হবেন না (No person should be the judge of his own cause), এই নীতির পরিপন্থী।
আমাদের সংবিধানে সরকারে প্রতিটি বিভাগের ক্ষমতার সীমারেখা দেয়া আছে। এ সীমারেখা অনুযায়ী সরকারের প্রতিটি বিভাগের সংসদের কাছে জবাবদিহিতা রয়েছে। বাংলাদেশের সাংবিধানিক পদধারী বিচারকেরা সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থার অবর্তমানে তাদের যেকোনো ধরনের অসদাচরণের কারণে সংসদের কাছে যে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয় এ ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। এ ধরনের জবাবদিহিতার অনুপস্থিতিতে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে দেখা যায় সংসদ একজন বিচারক সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন মর্মে রুলিং দেয়ার পরও হাইকোর্ট বিভাগ সে রুলিংকে অবৈধ ঘোষণা করেছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৫(৫)-এর ব্যত্যয়ে দেশের সম্মানিত নাগরিকদের প্রায়ই অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হয়, একজন বিচারক তার স্বপঠিত শপথ এবং ৭৮ নম্বর অনুচ্ছেদের নির্দেশনার ব্যত্যয়ে সংবিধান ও বিভিন্ন আইন বাতিলের কার্যক্রম গ্রহণ করছেন এবং আইনের মাধ্যমে সমর্থিত সমফলপ্রদ বিধান থাকা সত্ত্বেও রুল ইস্যুর মাধ্যমে প্রতিকার দানের প্রয়াস নেয়া হয়।
বিচার বিভাগের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে জবাবদিহিতা যেভাবে উপেক্ষিত হয়ে স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, তা যে সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যেমন সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত ঠিক তেমন প্রথমোল্লিখিত ব্যক্তি দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অপসারণযোগ্য এবং শেষোক্ত ব্যক্তি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে পদত্যাগে বাধ্য হন। উচ্চ আদালতের বিচারকেরা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। সুতরাং স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, সংসদ সদস্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং যে সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করার ক্ষমতা ভোগ করেন, তারা কেন উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না?
গত এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারকদের অপসারণ বিষয়ে সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য আইনমন্ত্রীকে নির্দেশনা দেয়ার পর আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মন্ত্রিসভায় বিচারকদের অভিশংসনের বিলটি অনুমোদিত হয়। অনুমোদন-পরবর্তী সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে এ বিলটি সংবিধানের অংশ হিসেবে আইনে পরিণত হয়েছে। এ দেশের সচেতন জনমানুষ যারা বিচার বিভাগকে তার স্বমর্যাদায় সমাসীন দেখতে চান, তাদের অভিমত সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক পদধারী বিচারকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে কখনো বিচার বিভাগ একজন ব্যক্তির অধিকারবঞ্চিত হওয়ার কোনো ধরনের কারণের উদ্ভব ঘটবে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকার বলবৎ বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজুর যে অধিকার ’৭২-এর সংবিধানে দেয়া ছিল বঙ্গবন্ধু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তা রহিত করে সাংবিধানিক আদালত, ট্রাইব্যুনাল অথবা কমিশন প্রতিষ্ঠার বিধান প্রবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধু কেন এতদবিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন সে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি। আর এত দিন উত্তর খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট ছিলাম না বলেই গণতন্ত্রের সাথে সঙ্গতিহীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রথা এখনো আমাদের সংবিধানে বহাল আছে।
এ কথাটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, একজন বিচারকের অসাংবিধানিক ও বেআইনি কার্যকলাপের দায় সমগ্র বিচার বিভাগ নিতে পারে না। আর এ ধরনের দায়ে কলুষিত ব্যক্তি বিচার বিভাগে বহাল থাকলে তা সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের মর্যাদাকে ক্ষুণœ করে। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় হিসেবে উচ্চ আদালতের মর্যাদা সমুন্নত থাকুক এটি প্রতিটি নাগরিকেরই প্রত্যাশা; কিন্তু সংসদীয় অভিশংসন পদ্ধতির অবর্তমানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল দিয়ে কি সে প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিকভাবে যে ক্ষমতা ভোগ করেন, তা অসীম। ৯০-পরবর্তী বাংলাদেশের বড় দু’টি দলের যে দুইজন নেত্রী বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়েছেন তারা উভয়ে একাধারে দলীয় প্রধানের দায়িত্বও পালন করছেন। তাই সরকার পরিচালনা ও দেশ পরিচালনা উভয়ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ। এ ধরনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে দল ও সরকারের নীতি বিষয়ে অপর কারো দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের বিপরীতে ভিন্নতর কোনো অবস্থান নেয়ার সুযোগ একেবারেই নেই। বর্তমানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে অসীম ক্ষমতা ভোগ করছেন দেশ রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার সময় রাষ্ট্রপতিও প্রধানমন্ত্রীর অনুরূপ ক্ষমতা ভোগ করতেন। সে সময় রাষ্ট্রপতি ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি ছিলেন।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করা হলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সংসদীয় অভিশংসন ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির কারণ দর্শানোর মাধ্যমে অপসারণের বিষয় প্রবর্তন হয়। এর সপক্ষে যুক্তি ছিল জেনারেল কজেজ অ্যাক্টের বিধান অনুযায়ী নিয়োগের ক্ষমতার মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত ও বরখাস্তের ক্ষমতা অন্তর্ভ্ক্তু থাকায় নিয়োগকর্তার সাময়িক বরখাস্ত ও বরখাস্তের ক্ষমতা থাকা বাঞ্ছনীয়। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায় সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকায় রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদের ভিন্নতর কোনো অবস্থান গ্রহণের সুযোগ একেবারেই সীমিত। সুতরাং রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায় বিচারকদের অপসারণ বিষয়ে অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের আছে কি নেই সে বিষয়টি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। অপর দিকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের বিধান গণতন্ত্র ও জনআকাক্সার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৭০-এর বিধান অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্যের দলের বিপক্ষে ভোটদানে আসন শূন্য হওয়ার কারণে অভিশংসন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সার বাইরে যাওয়ার কোনো ধরনের সুযোগ নেই। তাই বিচারকদের অভিশংসন গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ক্ষেত্রে ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের কারণে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বা দলীয় প্রধান যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তা যে বাস্তবে কার্যকর রূপ লাভ করবে এ প্রশ্নে কোনো ধরনের সংশয় নেই। সুতরাং সংসদের অভিশংসনের ক্ষমতা আছে কি নেই তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো একজন বিচারকের অপসারণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা কী?
৭২-এর সংবিধানে যেমন উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ বিষয়ে সংসদীয় অভিশংসন পদ্ধতির কথা বলা ছিল অনুরূপ অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিষয়ে ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা ছিলÑ বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তি এবং বিচার বিভাগে দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। পরে সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের পরিবর্তে এ ক্ষমতাটি রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হওয়াসংক্রান্ত বিধান যদিও অদ্যাবধি অব্যাহত আছে; কিন্তু সংবিধানের দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ দিয়ে ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে শব্দগুলো পরবর্তীকালে বলা হয় এবং সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতিকর্তৃক তা প্রয্ক্তু হবে। উল্লেখ্য দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সমর্থিত হয়। দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের অভিমত উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ বিষয়ে অভিশংসন প্রথা প্রবর্তনে সরকার প্রকৃতই আন্তরিক হয়ে থাকলে সে আন্তরিকতার বহির্প্রকাশ অধস্তন আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রেও প্রত্যাশিত; কিন্তু প্রশ্ন সরকার কি অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করবে?
সংসদের গঠন বিষয়ে সংবিধানের ৬৫(২) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ৩০০ সদস্য এবং তাদের মাধ্যমে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনে একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সর্বমোট ৩৫০ সদস্য সমন্বয়ে সংসদ গঠিত হবে। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় যে দশম সংসদ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে সে নির্বাচনটিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ইতঃপূর্বে উপনির্বাচন ছাড়া জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে কোনো আসন থেকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। দশম সংসদ নির্বাচনে অবশিষ্ট যে ১৪৭টি আসনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ওই আসনগুলোয় ভোটার উপস্থিতির হার এত নগণ্য ছিল যে, এ আসনগুলোর নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন বলা যায় কি না সে বিষয়ে দেশের সচেতন জনমানুষের মধ্যে সংশয় রয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচনের অধিকাংশ প্রার্থী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায়, এ নির্বাচনটিতে ভোটার উপস্থিতি নগণ্য হওয়ায় এবং প্রকৃত অর্থে এ নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হওয়ায় দেশের অধিকাংশ জনমানুষের কাছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ। এ কারণে সঙ্গতভাবেই দেশের জনমানুষের মধ্যে প্রশ্নের উদয় হয়েছে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হলে তা অবশ্যই এমন সংসদের মাধ্যমে হওয়া উচিত যে সংসদটির সদস্যরা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.