কদর্য এশীয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রাষ্ট্রচিন্তা by ড. ফজলুল হক সৈকত
এত দিন আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র (জন্ম ১৫ আগস্ট ১৯২২, মৃত্যু ১০ অক্টোবর ১৯৭১) তিনটি উপন্যাসকে ঘিরেই তাঁর ঔপন্যাসিক খ্যাতি আলোচিত হতে দেখেছি। পরবর্তীকালে, তাঁর দুটি ইংরেজি উপন্যাসের বাংলা ভাষান্তর আমাদের হাতে আসে। শিবব্রত বর্মণের অনুবাদে ২০০৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় দ্য আগলি এশিয়ান-এর বাংলা রূপ কদর্য এশীয়। আর অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় হাউ ডাজ ওয়ান কুক বিন্স্-এর বাংলা ভাষান্তর শিম কিভাবে রান্না করতে হয়। প্রথমটি রাজনীতি-বিষয়ক; দ্বিতীয়টিতে রূপায়িত হয়েছে সাংস্কৃতিক ভাববিনিময়ের সূত্রাবলি ও চিত্রাবলি। আমাদের বর্তমান আলোচনা কদর্য এশীয়কে ঘিরে।
তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক-সংস্কৃতি এবং আমেরিকানির্ভরতার বিশ্বস্ত ছাপচিত্র তাঁর এই উপন্যাস; ভিন্নভাবে দেখলে অনুধাবন করা যায় যে, এশিয়ার যেকোনো দেশই এর ক্যানভাস। জাতি হিশেবে আমরাÑ এশীয়রা যে পিছিয়ে-পড়া, স্মৃতিরোমন্থনপ্রিয়Ñ অহেতুক অতীতচারী, আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জনের আগেই মৃত্যুবরণ করে থাকি, আমাদের হাতে থাকে না কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান, নিজের সংস্কৃতিকে কেবল গান-বাজনার মাধ্যমেই প্রকাশ করতে অভ্যস্ত, আর ঝিমানোর ফাঁকে ফাঁকে কোকাকোলা খেয়ে ঠোঁট ভেজানোয় আমাদের আনন্দ, ভিনদেশী মনোভঙ্গি বিষয়ে আমাদের যে স্পষ্ট কোনো অভিমত নেই; ঐতিহাসিক কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে আমরা যে অহেতুক লম্বা বক্তব্য দিতে পারঙ্গমÑ এমন কিছু জটিল অথচ জরুরি বিষয়ে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্মের অনেক আগেই আমরা যেন এই দেশটির একটি সাবলীল পরিচয়ও পাঠ করতে থাকি। “একটা দেশকে আসলে কিভাবে চেনা যায়? কোথায় দেশের শুরু?”Ñ এসব প্রশ্ন আর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রবাহে মানবমনের বিচিত্র ওঠানামার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে থাকে উপন্যাসটির আবহ।
এক ধনাঢ্য-প্রভাবশালী ব্যক্তির আতিথ্য গ্রহণকারী আমেরিকান এক সাংবাদিক মি. জনসনকে ঘিরে তৈরি ও আবর্তিত হয়েছে বর্তমান উপন্যাসের কাহিনীবলয়; যে কিনা তার দেশের একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রয়োজনে তথ্য-উদঘাটনের মিশনে এখানে এসেছেন। কাহিনীকার গল্পের পটভূমি এই দেশকে কল্পনা করেছেন একটি উত্তপ্ত-গুমোট-ঘনতমসাঘেরা ঘর হিশেবে; সেখানে অবস্থানের এবং পরিকল্পনা-আঁটার স্বাভাবিক পরিবেশ নেই। আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন পশ্চিমা পুরাতন পরাশক্তিগুলোর বেহাল দশা, সমাজতন্ত্রের জাল যখন মানুষকে অনেকাংশে ঘিরে ফেলেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়ে গেছে একমাত্র পরাশক্তি রূপে। এই পরাশক্তির নতুন পররাষ্ট্রনীতিÑ বিশেষত আফ্রিকা এবং এশিয়া বিষয়ে রাষ্ট্রটির পলিসি কী, তা পর্যবেণ এবং মানুষের মর্যাদা, মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পরে শক্তি হিসেবে কাজ করার প্রয়োজনীয় পরামর্শ তৈরির জন্য ’অপিনিয়ন’ নামক পত্রিকার অ্যাসাইনম্যান্ট নিয়ে এখানকার প্রকৃত অবস্থা অবলোকন করতেই মূলত আগমন ঘটেছে মি. জনসনের। আমেরিকার মদদ এবং সহযোগিতা কোন ধরনের ব্যক্তি কিংবা দলের প্রতি থাকা উচিৎÑ এমন ভাবনাও তাঁর পর্যবেণ-কর্মসূচির অন্বিষ্ট বিষয়। সদ্যস্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিকাশমান অর্থনীতির এবং নবতর রাজনীতির অতি প্রয়োজনীয় কতিপয় বিষয় উপন্যাসটির ফ্রেম নির্মাণ করেছে। আর কাহিনী-পরিসরের ফ্রেমে প্রবেশ করেছেন ইতিহাসের অধ্যাপক, অর্থনীতির অধ্যাপক, ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্মকর্তা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, চিত্রশিল্পী, তরুণ শিার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অধ্যাপক [আহসান নামের এই প্রফেসরকে মার্কিনিরা অপছন্দ করে; দেশের পে অনেক কিছু ভাবতে গিয়ে, ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি তিনবার জেল খেটেছেন; আমেরিকানদের দেশভ্রমণের আমন্ত্রণ তিনি প্রত্যাখান করেছেন; তাদের দেশে যাবার ইচ্ছা তার নেই, তারা এদেশে কী করছে সে বিষয়ে তার আগ্রহ] ও তাঁর ভক্ত ছাত্রী, প্রধানমন্ত্রী, ঝিমিয়ে-পড়া কোনো এক সচিব, শিল্পকারখানার বিদ্রোহী শ্রমিক, বিােভরত শিার্থী, উপাচার্য, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সংবাদকর্মী, ভিনদেশী এনজিও কর্মী, জাদরেল ব্যবসায়ী, মার্কিন গোয়েন্দা-উপদেষ্টা, পুলিসপ্রধান, গোয়েন্দাপ্রধান, তরুণ সেনাকর্মকর্তা, জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মী তরুণী আর পরিপার্শে¦র কোনো কোনো প্রাসঙ্গিক চরিত্র। পরিবেশিত হয়েছে মানুষের বিচিত্র প্রবণতা; যা সমাজ-রাজনীতিকে প্রত্য-পরোভাবে প্রতিভাত করে।
আমেরিকার বিভিন্ন তথ্য-সংগ্রহকারী সংস্থা এশিয়াতে কাজ করে চলেছে, তাদের দেশের অভিপ্রায় সম্বন্ধে ধারণা প্রদানের মিশন নিয়ে; ভিশনও আছে নিশ্চয়ই। ’মানুষের মর্যাদা, মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পরে শক্তি’ হিশেবে নিজেদেরকে জাহির করে তারা মূলত রাষ্ট্রীয় ফায়দা অর্জনের চেষ্টায় রাতদিন ব্যস্ত। বৃটিশ শাসকদের এ দেশ ছেড়ে যাবার প্রায় দুই দশক আগে তাদের আনুকূল্য পাওয়া স্বায়ত্তশাসিত সরকারের একজন মন্ত্রী, পরে যিনি স্বৈরশাসক ও দুর্নীতিবাজ হিশেবে পরিচয় লাভ করেছেন, তাঁর [কাল্পনিক হলেও তিনি ভারতের নেতা; তাকে দিয়েই চিনতে পারা যায় আমাদের জাতীয় নেতাদের চরিত্র] সাথে সাাৎ করে একজন আমেরিকান সাংবাদিক যে তথ্য আবিষ্কার করেছেন, তা আমাদের জন্য দারুণ শিণীয় বারতা বহন করে।
অবশ্য তিনি লন্ডন থেকে জামাকাপড় বানিয়ে আনতেন, তার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতো ইংল্যান্ডের সেরা সেরা স্কুলে, অবকাশ যাপনের জন্য সেদেশে একটা সুরম্য বাড়িও কিনেছিলেন। মুশকিল হলো দেশ স্বাধীনের পর, যখন তাকে নতুন জন্ম-নেয়া একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের দায়িত্ব নিতে হলো। তিনি স্বাভাবিকভাবেই কিছু স্বার্থান্বেষী লোকের দ্বারা পরিবেষ্টিত হলেন। কেননা, ’নেতা নিজ দেশ সম্পর্কে অনাসক্ত থাকলে, তার চারপাশে এমন সব লোকজন ভিড় করে, যাদের একমাত্র আসক্তি ব্যক্তিস্বার্থে।’
নির্বাচনে তার ভরাডুবির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমেরিকান সাংবাদিক বের করে ফেলেন তাঁর দুর্বলতার আর নির্ভরতার জায়গাগুলি। যখন, আজকের বিশ্বে, দূরদৃষ্টি কিংবা দুরভিসন্ধিই হলো রাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতির চাবিকাঠি, সেখানে এমন ব্যক্তির নেতৃত্ব একটা ভূখণ্ডের জন্য কতোটা তিকর হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক আমাদেরকে কৌশলে জানাতে চেয়েছেন আমাদের জাতীয় এবং ঐতিহ্যিক দুর্ভাগ্যের ইতিহাস। বলছেন : “একটি নতুন দেশ, যার সামনে অনেক সংস্কারের কাজ পড়ে আছে, যাকে বহু কিছু তৈরি করে নিতে হবে, সে দেশে এসব লোক কোনো উপকারে আসে না।”
’নিরপেতা’ নামক যে নিদ্রাবটিকা খেয়ে আমরা [ভারতীয়] রাষ্ট্রনীতিকে পরিহাস করি, তার সত্যাসত্যের কিছু ইঙ্গিতবারতা সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ পাঠিয়েছেন বর্তমান কাহিনির মাধ্যমে। উপন্যাসে বর্ণিত কাহিনিতে দেখা যায়, আমেরিকান নীতির অন্ধ-অনুসারী নানাভিকে পরাজিত করে নির্বাচনে আব্দুল কাদের জয়ী হয়েছেন সমাজবাদীদের ওই ’নিরপেতা’ নীতিকে সমর্থনের কথা প্রচার করে।
’নিরপেতা’র আড়ালে আমরা যে আমেরিকানদের চিন্তাচেতনাকেই ধারণ ও লালন করি, সে সত্যই লেখক পরিবেশন করতে চেয়েছেন। আমরা জানি, রাষ্ট্রশাসনের জন্য একজন নেতাকে অনেক গুণে ও শিায় আলোকিত মানুষে পরিণত হতে হয়; তাঁকে জানতে হয় জনগোষ্টীর দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতার শতাব্দিপ্রাচীন সমস্যাবলি, সংসদ ও সরকার-ব্যবস্থার যাবতীয় খুঁটিনাটি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিভিন্ন অর্থনৈতিক তত্ত্ব, সমকালীন বিশ্বের পরিস্থিতি; তাঁকে বুঝতে হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সম্ভাবনা ও ঝুঁকিসমূহ।
শিল্পকারখানায় শ্রমিকনির্যাতন আর শ্রমিকবিদ্রোহ দমনের অমানবিক-অগণতান্ত্রিক নিয়মধারা বিষয়ক কিছু রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে পাঠক ধারণা লাভ করেন এই উপন্যাসটির পাঠ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থীদের প্রাসঙ্গিক দাবি ও বিােভ এবং প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দেশী-বিদেশী শাসক ও নিয়ন্ত্রকদের জুলুম-অন্যায়ের ছবিও ওয়ালীউল্লাহ এঁকেছেন দতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে। সরকারের কোনো দায়িত্বশীল [মতাশীলও নিশ্চয়] ব্যক্তির বক্তব্যের সমালোচনা করার জন্য সংবাদকর্মীর ওপর অবিচারের খড়গ চাপানোর যে দৃশ্য আমরা আজও অবলোকন করি, আজ থেকে চল্লিশ কিংবা ষাট বছর আগের সে রকম পরিস্থিতির কথাই লেখক আমাদের সামনে হাজির করেছেন। কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে আমরা বুঝতে পারবো দেশের প্রতি নিমগ্ন মানুষের অসহায়তা, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের অস্পষ্ট অবস্থান, সচেতন মানুষের বিভ্রম আর বিভ্রম-উত্তরণ-ভাবনার কথামালা :
[ক] “বিকেলে ছাত্ররা জড়ো হলে তিনটি ভ্যানবোঝাই বেয়নেটধারী পুলিশ নীরবে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে অবস্থান নেয়। স্তব্ধ ও অশুভদর্শন খাকি পোশাকের সশস্ত্র পুলিশ দেখে কিছু যুবকের মনে ভীতি সঞ্চারিত হয়, বাকিদের মনে পোস্টার-কথিত রহস্য আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে। এরপর আর পিছু হটা চলে না।”
[খ] “উপাচার্য নিজে পুলিশকে দায়মুক্ত করেছেন। বলেছেন, পুলিশ ভুল করেনি।”
বিরাট ক্যানভাসের এই উপন্যাসটিতে মর্যাদার সাথে উপস্থাপিত হয়েছে ভিনদেশী উন্নয়নসংস্থার ল্য ও কার্যাবলি, তাদের কাজ সম্বন্ধে দেশের মানুষের ভাবনা ও মত-প্রকাশে অংশগ্রহণ; প্রসঙ্গত, স্পষ্টভাবেই, রূপলাভ করেছে লেখকের অভিপ্রায়। কথানির্মাতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ধারণা শিা-সমাজ-কৃষি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ইচ্ছার কথা বলে, দূরদেশ [বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র] থেকে আগত, যে সকল সমাজকর্মী ধর্মপরায়ণতা-মানবপ্রেম-কর্তব্যজ্ঞানকে আশ্রয় করে আমাদের দেশে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কাছে সহানুভূতি ও সহযোগিতা কামনা করে, তারা মূলত ওই জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে চায়। এ রকম আস্থা বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পলিসি প্রচারের সাথে মারাত্মতভাবে জড়িত; এমন চিন্তাও লেখকের ভাবনারাজিকে আন্দেলিত করে; তিনি এমন তথ্যও পরিবেশন করেছেন যে, এই সমাজ-উন্নয়নকর্মীরা সরকার এবং নির্বাচন-ব্যবস্থার সাথেও নানান রকম আঁতাত করে, আমজনতাকে প্রকৃতপে তারা ভালোবাসে না।
জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার আর ভিনদেশী চাটুকারিতাজনিত নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তির জন্য যে জাগরণ দরকার, তার অনুভব সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে নাড়া দিয়েছে প্রবলভাবে। সে অনুভবেরই শৈল্পিক প্রয়াস তাঁর কদর্য এশীয়।
তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক-সংস্কৃতি এবং আমেরিকানির্ভরতার বিশ্বস্ত ছাপচিত্র তাঁর এই উপন্যাস; ভিন্নভাবে দেখলে অনুধাবন করা যায় যে, এশিয়ার যেকোনো দেশই এর ক্যানভাস। জাতি হিশেবে আমরাÑ এশীয়রা যে পিছিয়ে-পড়া, স্মৃতিরোমন্থনপ্রিয়Ñ অহেতুক অতীতচারী, আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জনের আগেই মৃত্যুবরণ করে থাকি, আমাদের হাতে থাকে না কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান, নিজের সংস্কৃতিকে কেবল গান-বাজনার মাধ্যমেই প্রকাশ করতে অভ্যস্ত, আর ঝিমানোর ফাঁকে ফাঁকে কোকাকোলা খেয়ে ঠোঁট ভেজানোয় আমাদের আনন্দ, ভিনদেশী মনোভঙ্গি বিষয়ে আমাদের যে স্পষ্ট কোনো অভিমত নেই; ঐতিহাসিক কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে আমরা যে অহেতুক লম্বা বক্তব্য দিতে পারঙ্গমÑ এমন কিছু জটিল অথচ জরুরি বিষয়ে সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্মের অনেক আগেই আমরা যেন এই দেশটির একটি সাবলীল পরিচয়ও পাঠ করতে থাকি। “একটা দেশকে আসলে কিভাবে চেনা যায়? কোথায় দেশের শুরু?”Ñ এসব প্রশ্ন আর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রবাহে মানবমনের বিচিত্র ওঠানামার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে থাকে উপন্যাসটির আবহ।
এক ধনাঢ্য-প্রভাবশালী ব্যক্তির আতিথ্য গ্রহণকারী আমেরিকান এক সাংবাদিক মি. জনসনকে ঘিরে তৈরি ও আবর্তিত হয়েছে বর্তমান উপন্যাসের কাহিনীবলয়; যে কিনা তার দেশের একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রয়োজনে তথ্য-উদঘাটনের মিশনে এখানে এসেছেন। কাহিনীকার গল্পের পটভূমি এই দেশকে কল্পনা করেছেন একটি উত্তপ্ত-গুমোট-ঘনতমসাঘেরা ঘর হিশেবে; সেখানে অবস্থানের এবং পরিকল্পনা-আঁটার স্বাভাবিক পরিবেশ নেই। আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন পশ্চিমা পুরাতন পরাশক্তিগুলোর বেহাল দশা, সমাজতন্ত্রের জাল যখন মানুষকে অনেকাংশে ঘিরে ফেলেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়ে গেছে একমাত্র পরাশক্তি রূপে। এই পরাশক্তির নতুন পররাষ্ট্রনীতিÑ বিশেষত আফ্রিকা এবং এশিয়া বিষয়ে রাষ্ট্রটির পলিসি কী, তা পর্যবেণ এবং মানুষের মর্যাদা, মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পরে শক্তি হিসেবে কাজ করার প্রয়োজনীয় পরামর্শ তৈরির জন্য ’অপিনিয়ন’ নামক পত্রিকার অ্যাসাইনম্যান্ট নিয়ে এখানকার প্রকৃত অবস্থা অবলোকন করতেই মূলত আগমন ঘটেছে মি. জনসনের। আমেরিকার মদদ এবং সহযোগিতা কোন ধরনের ব্যক্তি কিংবা দলের প্রতি থাকা উচিৎÑ এমন ভাবনাও তাঁর পর্যবেণ-কর্মসূচির অন্বিষ্ট বিষয়। সদ্যস্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিকাশমান অর্থনীতির এবং নবতর রাজনীতির অতি প্রয়োজনীয় কতিপয় বিষয় উপন্যাসটির ফ্রেম নির্মাণ করেছে। আর কাহিনী-পরিসরের ফ্রেমে প্রবেশ করেছেন ইতিহাসের অধ্যাপক, অর্থনীতির অধ্যাপক, ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্মকর্তা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, চিত্রশিল্পী, তরুণ শিার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অধ্যাপক [আহসান নামের এই প্রফেসরকে মার্কিনিরা অপছন্দ করে; দেশের পে অনেক কিছু ভাবতে গিয়ে, ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি তিনবার জেল খেটেছেন; আমেরিকানদের দেশভ্রমণের আমন্ত্রণ তিনি প্রত্যাখান করেছেন; তাদের দেশে যাবার ইচ্ছা তার নেই, তারা এদেশে কী করছে সে বিষয়ে তার আগ্রহ] ও তাঁর ভক্ত ছাত্রী, প্রধানমন্ত্রী, ঝিমিয়ে-পড়া কোনো এক সচিব, শিল্পকারখানার বিদ্রোহী শ্রমিক, বিােভরত শিার্থী, উপাচার্য, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সংবাদকর্মী, ভিনদেশী এনজিও কর্মী, জাদরেল ব্যবসায়ী, মার্কিন গোয়েন্দা-উপদেষ্টা, পুলিসপ্রধান, গোয়েন্দাপ্রধান, তরুণ সেনাকর্মকর্তা, জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মী তরুণী আর পরিপার্শে¦র কোনো কোনো প্রাসঙ্গিক চরিত্র। পরিবেশিত হয়েছে মানুষের বিচিত্র প্রবণতা; যা সমাজ-রাজনীতিকে প্রত্য-পরোভাবে প্রতিভাত করে।
আমেরিকার বিভিন্ন তথ্য-সংগ্রহকারী সংস্থা এশিয়াতে কাজ করে চলেছে, তাদের দেশের অভিপ্রায় সম্বন্ধে ধারণা প্রদানের মিশন নিয়ে; ভিশনও আছে নিশ্চয়ই। ’মানুষের মর্যাদা, মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পরে শক্তি’ হিশেবে নিজেদেরকে জাহির করে তারা মূলত রাষ্ট্রীয় ফায়দা অর্জনের চেষ্টায় রাতদিন ব্যস্ত। বৃটিশ শাসকদের এ দেশ ছেড়ে যাবার প্রায় দুই দশক আগে তাদের আনুকূল্য পাওয়া স্বায়ত্তশাসিত সরকারের একজন মন্ত্রী, পরে যিনি স্বৈরশাসক ও দুর্নীতিবাজ হিশেবে পরিচয় লাভ করেছেন, তাঁর [কাল্পনিক হলেও তিনি ভারতের নেতা; তাকে দিয়েই চিনতে পারা যায় আমাদের জাতীয় নেতাদের চরিত্র] সাথে সাাৎ করে একজন আমেরিকান সাংবাদিক যে তথ্য আবিষ্কার করেছেন, তা আমাদের জন্য দারুণ শিণীয় বারতা বহন করে।
অবশ্য তিনি লন্ডন থেকে জামাকাপড় বানিয়ে আনতেন, তার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতো ইংল্যান্ডের সেরা সেরা স্কুলে, অবকাশ যাপনের জন্য সেদেশে একটা সুরম্য বাড়িও কিনেছিলেন। মুশকিল হলো দেশ স্বাধীনের পর, যখন তাকে নতুন জন্ম-নেয়া একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের দায়িত্ব নিতে হলো। তিনি স্বাভাবিকভাবেই কিছু স্বার্থান্বেষী লোকের দ্বারা পরিবেষ্টিত হলেন। কেননা, ’নেতা নিজ দেশ সম্পর্কে অনাসক্ত থাকলে, তার চারপাশে এমন সব লোকজন ভিড় করে, যাদের একমাত্র আসক্তি ব্যক্তিস্বার্থে।’
নির্বাচনে তার ভরাডুবির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমেরিকান সাংবাদিক বের করে ফেলেন তাঁর দুর্বলতার আর নির্ভরতার জায়গাগুলি। যখন, আজকের বিশ্বে, দূরদৃষ্টি কিংবা দুরভিসন্ধিই হলো রাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রনীতির চাবিকাঠি, সেখানে এমন ব্যক্তির নেতৃত্ব একটা ভূখণ্ডের জন্য কতোটা তিকর হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক আমাদেরকে কৌশলে জানাতে চেয়েছেন আমাদের জাতীয় এবং ঐতিহ্যিক দুর্ভাগ্যের ইতিহাস। বলছেন : “একটি নতুন দেশ, যার সামনে অনেক সংস্কারের কাজ পড়ে আছে, যাকে বহু কিছু তৈরি করে নিতে হবে, সে দেশে এসব লোক কোনো উপকারে আসে না।”
’নিরপেতা’ নামক যে নিদ্রাবটিকা খেয়ে আমরা [ভারতীয়] রাষ্ট্রনীতিকে পরিহাস করি, তার সত্যাসত্যের কিছু ইঙ্গিতবারতা সৈয়দ ওয়ালীউলাহ্ পাঠিয়েছেন বর্তমান কাহিনির মাধ্যমে। উপন্যাসে বর্ণিত কাহিনিতে দেখা যায়, আমেরিকান নীতির অন্ধ-অনুসারী নানাভিকে পরাজিত করে নির্বাচনে আব্দুল কাদের জয়ী হয়েছেন সমাজবাদীদের ওই ’নিরপেতা’ নীতিকে সমর্থনের কথা প্রচার করে।
’নিরপেতা’র আড়ালে আমরা যে আমেরিকানদের চিন্তাচেতনাকেই ধারণ ও লালন করি, সে সত্যই লেখক পরিবেশন করতে চেয়েছেন। আমরা জানি, রাষ্ট্রশাসনের জন্য একজন নেতাকে অনেক গুণে ও শিায় আলোকিত মানুষে পরিণত হতে হয়; তাঁকে জানতে হয় জনগোষ্টীর দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতার শতাব্দিপ্রাচীন সমস্যাবলি, সংসদ ও সরকার-ব্যবস্থার যাবতীয় খুঁটিনাটি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিভিন্ন অর্থনৈতিক তত্ত্ব, সমকালীন বিশ্বের পরিস্থিতি; তাঁকে বুঝতে হয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সম্ভাবনা ও ঝুঁকিসমূহ।
শিল্পকারখানায় শ্রমিকনির্যাতন আর শ্রমিকবিদ্রোহ দমনের অমানবিক-অগণতান্ত্রিক নিয়মধারা বিষয়ক কিছু রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে পাঠক ধারণা লাভ করেন এই উপন্যাসটির পাঠ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থীদের প্রাসঙ্গিক দাবি ও বিােভ এবং প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দেশী-বিদেশী শাসক ও নিয়ন্ত্রকদের জুলুম-অন্যায়ের ছবিও ওয়ালীউল্লাহ এঁকেছেন দতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে। সরকারের কোনো দায়িত্বশীল [মতাশীলও নিশ্চয়] ব্যক্তির বক্তব্যের সমালোচনা করার জন্য সংবাদকর্মীর ওপর অবিচারের খড়গ চাপানোর যে দৃশ্য আমরা আজও অবলোকন করি, আজ থেকে চল্লিশ কিংবা ষাট বছর আগের সে রকম পরিস্থিতির কথাই লেখক আমাদের সামনে হাজির করেছেন। কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে আমরা বুঝতে পারবো দেশের প্রতি নিমগ্ন মানুষের অসহায়তা, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের অস্পষ্ট অবস্থান, সচেতন মানুষের বিভ্রম আর বিভ্রম-উত্তরণ-ভাবনার কথামালা :
[ক] “বিকেলে ছাত্ররা জড়ো হলে তিনটি ভ্যানবোঝাই বেয়নেটধারী পুলিশ নীরবে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে অবস্থান নেয়। স্তব্ধ ও অশুভদর্শন খাকি পোশাকের সশস্ত্র পুলিশ দেখে কিছু যুবকের মনে ভীতি সঞ্চারিত হয়, বাকিদের মনে পোস্টার-কথিত রহস্য আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে। এরপর আর পিছু হটা চলে না।”
[খ] “উপাচার্য নিজে পুলিশকে দায়মুক্ত করেছেন। বলেছেন, পুলিশ ভুল করেনি।”
বিরাট ক্যানভাসের এই উপন্যাসটিতে মর্যাদার সাথে উপস্থাপিত হয়েছে ভিনদেশী উন্নয়নসংস্থার ল্য ও কার্যাবলি, তাদের কাজ সম্বন্ধে দেশের মানুষের ভাবনা ও মত-প্রকাশে অংশগ্রহণ; প্রসঙ্গত, স্পষ্টভাবেই, রূপলাভ করেছে লেখকের অভিপ্রায়। কথানির্মাতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ধারণা শিা-সমাজ-কৃষি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ইচ্ছার কথা বলে, দূরদেশ [বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র] থেকে আগত, যে সকল সমাজকর্মী ধর্মপরায়ণতা-মানবপ্রেম-কর্তব্যজ্ঞানকে আশ্রয় করে আমাদের দেশে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কাছে সহানুভূতি ও সহযোগিতা কামনা করে, তারা মূলত ওই জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে চায়। এ রকম আস্থা বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পলিসি প্রচারের সাথে মারাত্মতভাবে জড়িত; এমন চিন্তাও লেখকের ভাবনারাজিকে আন্দেলিত করে; তিনি এমন তথ্যও পরিবেশন করেছেন যে, এই সমাজ-উন্নয়নকর্মীরা সরকার এবং নির্বাচন-ব্যবস্থার সাথেও নানান রকম আঁতাত করে, আমজনতাকে প্রকৃতপে তারা ভালোবাসে না।
জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার আর ভিনদেশী চাটুকারিতাজনিত নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তির জন্য যে জাগরণ দরকার, তার অনুভব সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে নাড়া দিয়েছে প্রবলভাবে। সে অনুভবেরই শৈল্পিক প্রয়াস তাঁর কদর্য এশীয়।
No comments