ভারতের বিশেষ আইন এবং বাংলাদেশী হত্যা by মঈনুল আলম
বাংলাদেশে এখন অহরহ বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং পুলিশের হাতে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির কথিত ‘ক্রসফায়ার’এ নিহত হওয়ার ঘটনার পদ্ধতি এবং প্রচলন কি প্রতিবেশী দেশ থেকেই এখানে আমদানি হয়েছে? বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে কথিত ভারতে ব্রিটিশ আমল থেকে চালু রাখা ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ নামের একটি আইনের প্রশ্রয়ে সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ সদস্যরা যেভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে, তা দেখে বাংলাদেশের মানুষের মনে এই প্রশ্নই আসা স্বাভাবিক।
ভারতে এসব লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড, অপরাধ এবং তাতে ভারতীয়দের মনের ােভ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রভাবশালী এবং বিশ্বে সর্বাধিক সংখ্যক দেশে পঠিত সংবাদপত্র দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ (৯ আগস্ট/২০১৪ সংখ্যা) একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এ প্রতিবেদন পাঠ করে বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারবেন বিএসএফ কর্তৃক অকারণে এবং চরম নিষ্ঠুরভাবে বাংলাদেশের কিশোরী ফেলানীকে হত্যার বিচারে কেন হত্যাকারী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ ‘নির্দোষ’ বলে খালাস পেয়ে যায়। এই কুখ্যাত আইনটি ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তর প্রান্ত এবং পূর্ব প্রান্তে সীমান্তরেখা থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতীয় এলাকায় চালু রাখা হয়েছে। স্পষ্টত এ আইনের প্রশ্রয়ে ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে বেপরোয়াভাবে গুলি করে বাংলাদেশী গরু ব্যবসায়ী, চাষি এবং সাধারণ নাগরিককে হত্যা করছে।
এ আইনের প্রশ্রয়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ভারতে কেমন বেপরোয়াভাবে নারী ধর্ষণ, গুম এবং হত্যা ইত্যাদি জঘন্য অপরাধ করে যাচ্ছে, তার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়া হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এই বিশেষ প্রতিবেদনে। এর শুরুতেই বর্ণিত হয়েছে ‘ভারতের ফেলানী’ (আমার ভাষায়) থাংজাম মনোরমাকে কিভাবে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং কী নিদারুণ নির্যাতনের চিহ্ন সংবলিত ও বুলেট জর্জরিত তার মৃতদেহ পাওয়া যায় রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায়। ভারতের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘মেয়েই লেইকাই’ জনবসতিতে মধ্যরাতে সশস্ত্র বাহিনীর এক ডজন সদস্য একটি ছোট্ট কুটিরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। তারা থাংজাম মনোরমা নামের কুমারী যুবতীটিকে কুটিরের একটি কে নিয়ে গিয়ে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। মনোরমার ভাই তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে তাকে পিটিয়ে আহত করে। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য মা এগিয়ে এলে তাকে আঘাত করে অচেতন করে ফেলা হয়। কে এক ঘণ্টা ধরে ধর্ষণসহ নানাবিধ নির্যাতন করে সশস্ত্র সদস্যরা মনোরমাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যায়। পর দিন সকালে মনোরমার বুলেটে তবিত মৃতদেহ রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দাবি করে যে, মনোরমা একজন সন্ত্রাসী এবং সে তাদের হাত থেকে পালাতে গেলে গুলিতে মারা যায়। মেডিক্যাল একজামিনার তার রিপোর্টে বলেন, মনোরমাকে শায়িত অবস্থায় অতি কাছ থেকে অনেক গুলি করা হয় এবং তার কাপড়ে যেসব দাগ দেখা যায় তা বীর্যের দাগ। মনোরমার গোপনাঙ্গে সরাসরি গুলি করে তা ছিন্নভিন্ন করে ফেলায় তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না, তা নির্ধারণ করা যায়নি। যদিও এই নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড কারা করেছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়; কিন্তু মনোরমাকে পাকড়াওকারী সশস্ত্র ব্যক্তিরা নির্দ্বিধায় তাদের চেহারা দেখিয়ে বেড়ায়।
ওই ঘটনার পর এক দশক পার হয়ে গেলেও এমন একটি জঘন্যতম অপরাধের জন্য কাউকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি। মানবাধিকার কর্মী, আইনবিদ এবং সমাজের সজ্জন ব্যক্তিরা বলছেন ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকা অবস্থায় প্রবর্তিত ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ এখনো ভারতের প্রত্যন্ত এবং সীমান্ত অঞ্চলে প্রচলিত রাখা হয়েছে। তার প্রশ্রয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের কোনো অপরাধে বিচারের সম্মুখীন করা যায় না।
কাশ্মিরে অজানা অসংখ্য কবরস্থানে হাজার হাজার মানুষের নাম-চিহ্নহীন কবরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশের সদস্যরা তাদের ঘৃণিত অপরাধ ও কুকর্মগুলোর প্রমাণকে কবরস্থ করেছে, বলা হয়েছে ‘টাইম্স’-এর এ প্রতিবেদনে। বেসামরিক কর্মকর্তারা যখন নিশ্চিত করেন যে, এখানে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে কবর দেয়া হয়েছে, তারপরও ভারত সরকার এ সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। ব্যাংককের ‘এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’-এর চেয়ারম্যান হেনরি ঠিফাগনে বলেছেন, ‘শুধু কাশ্মিরে নয়, সমগ্র ভারতে এ ধরনের চিহ্ন (নিহতদের গোপন কবরস্থান) ছড়িয়ে রয়েছে।’
ভারতের বহু মানবাধিকার সংস্থার দাবিতে সরকার একাধিক কমিশন গঠন করে বারবার আইনটি বাতিল করার জন্য সুপারিশ করেছে; কিন্তু ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কঠোর বিরোধিতায় এই আইন বাতিল করা যায়নি। এই নিবর্তক আইন চালু রাখার পে কঠোর অবস্থান নিয়ে ২০০৫ সালে ভারতের তৎকালীন সেনাবাহিনীর চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল জে জে সিং এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমাদের জন্য সংবিধান প্রদত্ত এই সুরা যদি না থাকে, যেকোনো ছোটখাটো অপরাধের জন্য আমাদের আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়া কি আপনারা পছন্দ করবেন?’ ভারতের দেশরামন্ত্রী অরুণ জেটলি ১৫ জুন বলেছেন, ‘শান্তি সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই দায়মুক্তি আইন চালু থাকবে।’
মনিপুরের ইম্ফলে মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস অ্যালার্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা বাবুল লয়টনবাম বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বিচার বিভাগ যৌথভাবে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হত্যাকাণ্ড নিয়মিতভাবে ঘটছে। এখানে সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ সদস্যরা যখন খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি দুষ্কর্ম করে তারা দুষ্কর্মের আলামতগুলো গোপন করারও গরজ বোধ করে না। তারা হত্যাকাণ্ড গোপন করে না এবং এটা করতেই থাকে।’
মনিপুরে সংঘটিত এ ধরনের ছয়টি হত্যাকাণ্ড তদন্ত করে দেখার জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত একটি তদন্ত কমিটি দেখেছে, এসব হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সরকারিভাবে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা কমনসেন্স বা সহজাত যুক্তির সাথে খাপ খায় না। যেসব প্রমাণ সরকারের প থেকে এ ক্ষেত্রে পেশ করা হয়েছে তা থেকে তদন্ত কমিটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, এসবই হচ্ছে ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড যার মধ্যে একটি ঘটনায় মা-বাবার চোখের সামনেই তাদের ১২ বছর বয়সের কিশোর সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে।
মনিপুরে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের স্বামীহারা স্ত্রীরা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বলি পরিবার সমিতি, মনিপুর’ (এক্সট্রা জুডিশিয়াল এক্সিকিউশন ভিকটিম ফ্যামিলিজ অ্যাসোসিয়েশন, মনিপুর) নামে একটি সংগঠন করেছে। এটা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের দ্বারা বিধবা হওয়া স্ত্রীলোকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সাহায্য করছে। এ সংগঠন ১৯৭৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে মনিপুরে (মোট অধিবাসীর সংখ্যা ২৭ লাখ) পুলিশ কর্তৃক ১৫২৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটার একটা হিসাব করেছে। তবে একই সময়ে কাশ্মিরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এর বহু গুণ।
বাংলাদেশে কয়েক বছর থেকে পুলিশ ও র্যাব কর্তৃক যেসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে, তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রাথমিক দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। হত্যাকাণ্ডের বলি পরিবারগুলো যাতে ন্যায়বিচার পায় সে জন্য দেশে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদও অনুভূত হচ্ছে।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, প্রবাসী
moyeenulalam@hotmail.com
ভারতে এসব লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড, অপরাধ এবং তাতে ভারতীয়দের মনের ােভ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রভাবশালী এবং বিশ্বে সর্বাধিক সংখ্যক দেশে পঠিত সংবাদপত্র দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ (৯ আগস্ট/২০১৪ সংখ্যা) একটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এ প্রতিবেদন পাঠ করে বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারবেন বিএসএফ কর্তৃক অকারণে এবং চরম নিষ্ঠুরভাবে বাংলাদেশের কিশোরী ফেলানীকে হত্যার বিচারে কেন হত্যাকারী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ ‘নির্দোষ’ বলে খালাস পেয়ে যায়। এই কুখ্যাত আইনটি ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তর প্রান্ত এবং পূর্ব প্রান্তে সীমান্তরেখা থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতীয় এলাকায় চালু রাখা হয়েছে। স্পষ্টত এ আইনের প্রশ্রয়ে ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে বেপরোয়াভাবে গুলি করে বাংলাদেশী গরু ব্যবসায়ী, চাষি এবং সাধারণ নাগরিককে হত্যা করছে।
এ আইনের প্রশ্রয়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ভারতে কেমন বেপরোয়াভাবে নারী ধর্ষণ, গুম এবং হত্যা ইত্যাদি জঘন্য অপরাধ করে যাচ্ছে, তার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়া হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এই বিশেষ প্রতিবেদনে। এর শুরুতেই বর্ণিত হয়েছে ‘ভারতের ফেলানী’ (আমার ভাষায়) থাংজাম মনোরমাকে কিভাবে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং কী নিদারুণ নির্যাতনের চিহ্ন সংবলিত ও বুলেট জর্জরিত তার মৃতদেহ পাওয়া যায় রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায়। ভারতের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘মেয়েই লেইকাই’ জনবসতিতে মধ্যরাতে সশস্ত্র বাহিনীর এক ডজন সদস্য একটি ছোট্ট কুটিরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। তারা থাংজাম মনোরমা নামের কুমারী যুবতীটিকে কুটিরের একটি কে নিয়ে গিয়ে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। মনোরমার ভাই তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে তাকে পিটিয়ে আহত করে। মেয়েকে বাঁচানোর জন্য মা এগিয়ে এলে তাকে আঘাত করে অচেতন করে ফেলা হয়। কে এক ঘণ্টা ধরে ধর্ষণসহ নানাবিধ নির্যাতন করে সশস্ত্র সদস্যরা মনোরমাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যায়। পর দিন সকালে মনোরমার বুলেটে তবিত মৃতদেহ রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দাবি করে যে, মনোরমা একজন সন্ত্রাসী এবং সে তাদের হাত থেকে পালাতে গেলে গুলিতে মারা যায়। মেডিক্যাল একজামিনার তার রিপোর্টে বলেন, মনোরমাকে শায়িত অবস্থায় অতি কাছ থেকে অনেক গুলি করা হয় এবং তার কাপড়ে যেসব দাগ দেখা যায় তা বীর্যের দাগ। মনোরমার গোপনাঙ্গে সরাসরি গুলি করে তা ছিন্নভিন্ন করে ফেলায় তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না, তা নির্ধারণ করা যায়নি। যদিও এই নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড কারা করেছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়; কিন্তু মনোরমাকে পাকড়াওকারী সশস্ত্র ব্যক্তিরা নির্দ্বিধায় তাদের চেহারা দেখিয়ে বেড়ায়।
ওই ঘটনার পর এক দশক পার হয়ে গেলেও এমন একটি জঘন্যতম অপরাধের জন্য কাউকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি। মানবাধিকার কর্মী, আইনবিদ এবং সমাজের সজ্জন ব্যক্তিরা বলছেন ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকা অবস্থায় প্রবর্তিত ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ এখনো ভারতের প্রত্যন্ত এবং সীমান্ত অঞ্চলে প্রচলিত রাখা হয়েছে। তার প্রশ্রয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের কোনো অপরাধে বিচারের সম্মুখীন করা যায় না।
কাশ্মিরে অজানা অসংখ্য কবরস্থানে হাজার হাজার মানুষের নাম-চিহ্নহীন কবরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশের সদস্যরা তাদের ঘৃণিত অপরাধ ও কুকর্মগুলোর প্রমাণকে কবরস্থ করেছে, বলা হয়েছে ‘টাইম্স’-এর এ প্রতিবেদনে। বেসামরিক কর্মকর্তারা যখন নিশ্চিত করেন যে, এখানে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে কবর দেয়া হয়েছে, তারপরও ভারত সরকার এ সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। ব্যাংককের ‘এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’-এর চেয়ারম্যান হেনরি ঠিফাগনে বলেছেন, ‘শুধু কাশ্মিরে নয়, সমগ্র ভারতে এ ধরনের চিহ্ন (নিহতদের গোপন কবরস্থান) ছড়িয়ে রয়েছে।’
ভারতের বহু মানবাধিকার সংস্থার দাবিতে সরকার একাধিক কমিশন গঠন করে বারবার আইনটি বাতিল করার জন্য সুপারিশ করেছে; কিন্তু ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কঠোর বিরোধিতায় এই আইন বাতিল করা যায়নি। এই নিবর্তক আইন চালু রাখার পে কঠোর অবস্থান নিয়ে ২০০৫ সালে ভারতের তৎকালীন সেনাবাহিনীর চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল জে জে সিং এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমাদের জন্য সংবিধান প্রদত্ত এই সুরা যদি না থাকে, যেকোনো ছোটখাটো অপরাধের জন্য আমাদের আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়া কি আপনারা পছন্দ করবেন?’ ভারতের দেশরামন্ত্রী অরুণ জেটলি ১৫ জুন বলেছেন, ‘শান্তি সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই দায়মুক্তি আইন চালু থাকবে।’
মনিপুরের ইম্ফলে মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস অ্যালার্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা বাবুল লয়টনবাম বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বিচার বিভাগ যৌথভাবে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হত্যাকাণ্ড নিয়মিতভাবে ঘটছে। এখানে সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ সদস্যরা যখন খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি দুষ্কর্ম করে তারা দুষ্কর্মের আলামতগুলো গোপন করারও গরজ বোধ করে না। তারা হত্যাকাণ্ড গোপন করে না এবং এটা করতেই থাকে।’
মনিপুরে সংঘটিত এ ধরনের ছয়টি হত্যাকাণ্ড তদন্ত করে দেখার জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত একটি তদন্ত কমিটি দেখেছে, এসব হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সরকারিভাবে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা কমনসেন্স বা সহজাত যুক্তির সাথে খাপ খায় না। যেসব প্রমাণ সরকারের প থেকে এ ক্ষেত্রে পেশ করা হয়েছে তা থেকে তদন্ত কমিটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, এসবই হচ্ছে ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড যার মধ্যে একটি ঘটনায় মা-বাবার চোখের সামনেই তাদের ১২ বছর বয়সের কিশোর সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে।
মনিপুরে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের স্বামীহারা স্ত্রীরা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বলি পরিবার সমিতি, মনিপুর’ (এক্সট্রা জুডিশিয়াল এক্সিকিউশন ভিকটিম ফ্যামিলিজ অ্যাসোসিয়েশন, মনিপুর) নামে একটি সংগঠন করেছে। এটা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের দ্বারা বিধবা হওয়া স্ত্রীলোকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সাহায্য করছে। এ সংগঠন ১৯৭৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে মনিপুরে (মোট অধিবাসীর সংখ্যা ২৭ লাখ) পুলিশ কর্তৃক ১৫২৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটার একটা হিসাব করেছে। তবে একই সময়ে কাশ্মিরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এর বহু গুণ।
বাংলাদেশে কয়েক বছর থেকে পুলিশ ও র্যাব কর্তৃক যেসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে, তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রাথমিক দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। হত্যাকাণ্ডের বলি পরিবারগুলো যাতে ন্যায়বিচার পায় সে জন্য দেশে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদও অনুভূত হচ্ছে।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, প্রবাসী
moyeenulalam@hotmail.com
No comments