উৎসবগুলো দিক মিলনের দীক্ষা by আনিসুল হক
ফুটপাতে পড়ে আছে শিউলি ফুল। শিশিরভেজা
সাদা ফুল কুড়িয়ে নিই। আকাশে তাকাই। নীল আকাশ। ছেঁড়াখোঁড়া মেঘ। আশ্বিন
মাস চলে যাচ্ছে। বাংলার বিখ্যাত শরৎকাল চলে যাওয়ার আগে ডেকে আনছে আরেক
বিখ্যাত হেমন্তকে। জীবনানন্দ দাশের প্রিয় কার্তিক মাস সমাগত প্রায়। এই রকম
কার্তিকের নবান্নের দেশে জীবনানন্দ দাশ শঙ্খচিল কিংবা শালিকের বেশে ফিরে
আসতে চেয়েছিলেন।
নরম আলোয় পৃথিবীটাকে স্নাত করে প্রবারণা পূর্ণিমা চলে গেল। কোজাগরি পূর্ণিমা যেন কাকে বলে! কবি জীবনানন্দ দাশ এমনই জোছনাভরা রাতে দেখেছিলেন মহিনের ঘোড়াগুলো ঘাসের লোভে চরছে, প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন! তারপর আরেক কার্তিকে, ৬০ বছর আগের ২২ অক্টোবরে, তিনি মারা গেলেন। তারও কয়েক দিন আগে ট্রামের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল তাঁর, কলকাতার ইতিহাসে একমাত্র ঘটনা, এমন ধীরগতির ট্রামের সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্ট করে নাকি আগে-পরে আর কেউ মারা যায়নি। এমনই উদাস ছিলেন, অন্যমনস্ক ছিলেন জীবনানন্দ।
আমাদের ঢাকায় তো অতটা অন্যমনস্কতার সুযোগ নেই। ফুটপাত ধরে হাঁটতে পারি না। খানাখন্দ। ঢাকনাহীন ম্যানহোল। তবু উৎসবের ছুটিতে নির্জন পথে হাঁটি। ধানমন্ডি মাঠের দিকে তাকাই। দুটো শালিক চরছে। দুই শালিকে সুখ। এই রকম বাংলায় কি ফিরে আসা যায়, জীবনানন্দ দাশ? তিনটা বড় উৎসব বাংলাদেশে প্রায় একই সময়ে ঘটে গেল। ঈদুল আজহা। দুর্গাপূজা। আর প্রবারণা পূর্ণিমা!
ঈদুল আজহার কী বিপুল কর্মযজ্ঞ। এই রাজধানীতেই কত গরু-ছাগলের হাট, একটা হাট তো আবার হাসপাতালের প্রবেশপথ বন্ধ করেই বসে গেল রীতিমতো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী পর্যন্ত আপত্তি জানালেন, অন্তত প্রবেশপথটা ছাড়ুন। কে শোনে কার কথা।
ঈদের দিনে রাস্তায় রাস্তায় চলল কোরবানি। সিটি করপোরেশন ঘোষণা দিয়েছিল, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সব সাফসুতরা করে ফেলা হবে, ঈদের সন্ধ্যা থেকেই তারা শুরু করে দিয়েছিল কর্মযজ্ঞ। আমি সিটি করপোরেশনের গাড়ি আর কর্মীদের সে রাতে ঐকান্তিকভাবে কাজ করে যেতে দেখেছি। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশন নাগরিকদের ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে।
তবে এই ভাবনাও মনে উঁকি দিচ্ছে, আমাদের কাজ কি নোংরা করে রাখা, আর সিটি করপোরেশনের কাজ সেগুলো পরিষ্কার করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। গাড়িতে যখন যাই, চিনাবাদাম বা কলার খোসাটা গাড়িতে যদি কেউ ফেলে, আরেকজন তাকে বকুনি লাগায়, এই, রাস্তায় ফেলতে পারলি না! রাস্তাঘাট আমাদের ডাস্টবিন। আমরা রাস্তাঘাট, ফুটপাত নোংরা করবই। আমাদের কাজ নোংরা করা। আর তোমাদের কাজ সেটা পরিষ্কার করা। আমরা কোনো দিনও নাগরিক ভব্যতা শিখব না, যদিও আমাদের গাড়ির দাম কোটি টাকা, বাড়ির দাম কয়েক কোটি। আমরা গাড়ি ধোব রাস্তায়, পিচের প্রধান শত্রু পানি, বাড়ির সামনের রাস্তা খানাখন্দে ভরে যাবে, যাক, ওটা তো আমার নয়, গাড়িটা আমার, বাড়িটা আমার!
ঈদের আগে হয়ে গেল দুর্গাপূজা। দেশব্যাপী। ঢাকাতেও বেশ জমেছিল উৎসব। একটা-দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সারা দেশে দুর্গোৎসব সম্পন্ন হয়েছে নির্বিঘ্নেই। আর হয়ে গেল প্রবারণা পূর্ণিমা। বেশ একটা স্লোগান দেখছি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে—ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। উৎসব মানে তো মিলন, উৎসব মানে তো প্রাণের সঙ্গে যোগ প্রাণের। আমাদের উৎসবগুলো আমাদের দিক মিলনের দীক্ষা, আমরা যেন ঐক্যের সূত্র খুঁজি, বিভেদের অজুহাত নয়।
বাংলাদেশে লোকসংখ্যা বেশি। খুবই বেশি। অস্ট্রেলিয়া আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে ৬৫ গুণ বড়, লোকসংখ্যা আমাদের আট ভাগের এক ভাগ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বে যদি সারা পৃথিবীর মানুষকে বসানো হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ভাগে পৃথিবীর সব মানুষ এঁটে যাবে, আরও এক ভাগ আমেরিকা ফাঁকা পড়ে থাকবে। আমাদের দেশটা একটা মৌচাকের মতো, এখানে মানুষের ওপরে বসে আছে মানুষ। সামান্য উসকানি এখানে মৌচাকে ঢিল মারার মতো। খড়ের গাদায়জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি ছুড়ে মারার মতো। কিন্তু আমরা প্রমাণ করেছি—আমরা শান্তিপ্রিয়, শান্তিবাদী, সবাই মিলেমিশে বসবাস করতে পারি, উৎসব আয়োজন করতে পারি। সুন্দরভাবে নির্বিঘ্নভাবে উৎসবের দিনগুলো পার করার জন্য বাংলাদেশের মানুষেরা অভিনন্দন পেতেই পারেন।
তবে উৎসবের অবকাশের দিনগুলো যে পুরোপুরিই নির্বিঘ্ন গেছে, তা নয়। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। নৌ-দুর্ঘটনার খবর পাইনি, হাজার শুকরিয়া। তবে ঘটেছে মেয়েদের ওপরে অ্যাসিড ছুড়ে মারার ঘটনা। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটা ঘটেছে টাঙ্গাইলে। বাড়ির দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দাহ্য তরল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে নারী আর শিশুদের। খবরে প্রকাশ, এক সিঙ্গাপুরফেরত পুরুষ সিংহ ক্লাস নাইনের এক মেয়েকে বিয়ে করতে চান। এই বিয়েতে পাত্রীপক্ষ মত পাল্টেছে, তাই তিনি পেট্রল কিনে এনে বাড়ির দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে এই নৃশংস কাণ্ড ঘটিয়েছেন! উফ্। এই খবর পড়াও কঠিন। এই ছবি দেখাও কঠিন।
ভাই রে, তোমার মাপে হয়নি সবাই, তুমিও হওনি সবার মাপে। সবার তরে নহে সবাই। এই জীবনে চলার পথে নারীর ভালো লাগবে পুরুষকে, পুরুষের পছন্দ হবে কোনো নারীকে। তার মানেই প্রেমে রাজি হতে হবে, বিয়েতে রাজি হতে হবে, তা তো নয়। তাই বলে আক্রমণ করে বসতে হবে ওই নারীটিকে, বা শিশুটিকে, তাকে উত্ত্যক্ত করতে হবে, হয়রানি করতে হবে, আক্রমণ করতে হবে, নির্যাতন করতে হবে, দেখে নিতে হবে, অ্যাসিড মারতে হবে, আগুন দিতে হবে, গায়ের ওপরে মোটরসাইকেল তুলে দিতে হবে—এই বর্বরতা, এই পাশবিকতা কেন?
আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা, অপরাধবিজ্ঞানীরা, মনোবিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যা দিতে পারেন। তাঁরা ভাবুন। ভেবে সমাধান বের করুন। পুরুষ নামের এই উন্মত্ত দানবের হাত থেকে এই সমাজটাকে, এই দেশটাকে, আমাদের নারীদের, শিশুদের রক্ষা করতে পারতে হবে। ৩৫ বছরের মায়ের পাশে ঘুমাচ্ছিল তিনজন শিশু—১৪, ১০ আর ৭ বছর বয়সের বালিকারা। ছোটটা পড়ে স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলের নার্সারি ক্লাসে। চারজনই পুড়ে অঙ্গার। ঘুম ভেঙে আগুনের লেলিহান শিখার প্রচণ্ড তাপের মুখে ৭ বছরের শিশুকন্যাটি কী করছিল? শেষবারের মতো আগুনের ছোবল থেকে বাঁচাতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কী ভেবেছিলেন মা? আমি ভাবতে পারি না, আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, আমি উন্মাদ হয়ে যাব, আমি কাঁদব, নাকি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকব, নাকি চিৎকার করব!
নারীকে সম্মান করতে পারতে হবে। কোনো সম্পর্কই তো জোর করে স্থাপিত হয় না, প্রেম-বিয়ে তো নয়ই। আমরা তো বিশ্বাসই করি, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে আল্লাহর হাতে। আমরা তো বলিই, হাজার কথার নিচে বিয়ে হয় না। আমি জানি না, কবে এই উন্মত্ত জিঘাংসু পুরুষ পশুদের হাত থেকে সমাজ রক্ষা পাবে, কী করলে পাবে। নারীকে সম্মান জানানো, তাঁর কাজকে স্বীকৃতি জানানো নিশ্চয়ই সমাধানের পথে এক ধাপ অগ্রগতি। আর চাই আইনের শাসন। আর চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
সমাজের সর্বত্রই তো দেখি অসহিষ্ণুতা। কারও ভিন্নমত আমরা সহ্য করি না। ধরা যাক, একজন একটা ভুল কথা বলেছেন, অন্যায় কথা বলেছেন, সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলছেন, তার মাথা কেটে নাও। আরেকজন বলছেন, ও কেন মাথা কাটার কথা বলবে, ওরই মাথা কেটে ফেলো। মাথা কাটার চেয়ে কম মাত্রার কোনো প্রতিবিধান আমরা ভাবতেই পারছি না। আমরা সামষ্টিক হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছি না তো? আমাদের বহু লক্ষণ হলো টোটেমের লক্ষণ, জাতির লক্ষণ নয়। রবীন্দ্রনাথ তো বহু আগেই বলে রেখেছেন, ‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।’ আমাদের আচার-আচরণে সেই না-মানুষ কিংবা অমানুষের আস্ফালন। মানবিক বোধ-বিবেচনা-বুদ্ধির কোনো বালাই যেন আমাদের থাকতে নেই।
না। হতাশার কথা বলব না। আশার কথাই বলব। সবুজ ঘাসে শিশির জমছে। চাঁদের আলো সেই শিশিরের কানে কানে কী কথা যেন কয়ে চলেছে। আশ্বিনের সবুজ ধানখেতে বয়ে চলেছে বাতাস। আমরা সম্প্রীতিপূর্ণ উৎসবের কাল অতিক্রম করেছি। আমরা টোটেম থেকে জাতিও হয়ে উঠছি। এটা আমাদের গড়ে উঠবার কাল। আমরা মানুষ হব। একদিন।
এই বাংলায়, এই চিরকালের অপরূপ বাংলায় বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছা কারই বা না করবে।
এ রকম শান্ত-নিরিবিলি ভোরেই পড়তে হবে জীবনানন্দ দাশ:
তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও—আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে।
কিংবা
মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হত অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে।
পৃথিবীব্যাপীই তো হানাহানি, এত অন্যায়, এত যুদ্ধ, এত নিরপরাধ মানুষ হত্যা। মাঝেমধ্যে তাই জীবনানন্দের মতো করে ভাবি, মানুষ হয়ে না জন্ম নিতে পারলেই ভালো হতো! তারপর জীবনানন্দের মতোই উপলব্ধি হয়, এসে গভীরতর কোনো একটা লাভ হয়েছে।
শরতের আকাশ যে বড় নীল, সাদা মেঘের নিচে এই পৃথিবীতে যে অনেক আলো।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments