রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেন না ভাষা মতিন
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা জোটেনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সেনাপতি আবদুল মতিনের ভাগ্যে। নানা শ্রেণী-পেশার সর্বস্তরের মানুষ তাকে ফুলেল শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় জানালেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হয়নি তার প্রতি। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা তার প্রতি শ্রদ্ধা জানালেও ছিল না সরকারের তরফে কোন শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের আয়োজন। এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আবদুল মতিনের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া বিশিষ্টজনরা। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এই ভাষা সেনাপতি একদিন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় সোচ্চার হয়েছিলেন। তবে তার চিরবিদায়ে তিনি নিজে পেলেন না সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ সম্মান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল উল্লেখ করে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি যদি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না পান তবে আর কে পাবেন? রাষ্ট্র তাকে সম্মান জানাতে পারলো না এটা রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এ অগ্রপথিককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গতকাল সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। বুধবার সকালে মারা যাওয়ার পর থেকে গতকাল বেলা ১২টায় শহীদ মিনারে আনা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানেই ছিল আবদুল মতিনের মরদেহ। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত পরিবারের চাওয়া মোতাবেক সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগের মর্গে পাঠানোর মাধ্যমে তাকে শেষ বিদায় জানানো হয়। বেলা ১২টার পর বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আবদুল মতিনের মরদেহ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল থেকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের সামনে আমতলায়, যেখানে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। সেখান থেকে তার কফিন নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ফুলে ফুলে মোড়ানো অ্যাম্বুলেন্সের পাশ দিয়ে হেঁটে শহীদ মিনারে পৌঁছান তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা। তার আগেই বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হন আজীবন সংগ্রামী আবদুল মতিনকে শ্রদ্ধা জানাতে। প্রথমে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের পক্ষ থেকে এবং এরপর ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ কয়েকজন আইনজীবী এই ভাষা সেনাপতির কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে ফুল দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। এরপর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান, শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। একে একে শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বিএনপির পক্ষ থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্রিগেডিয়ার অব. হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। শ্রদ্ধা জানান জাতীয় পার্টি, জাসদ, সম্মিলিত নারী পরিষদ, বাংলা একাডেমি, সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরামের পক্ষ থেকে কেএম সফিউল্লাহ, ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংবাদিক সমাজ, ছাত্রদল, জাসাস, ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সম্মিলিত আইনজীবী পরিষদের ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সৈয়দ হাসান ইমাম, পীযূষ বান্দ্যোপাধ্যায়, স্বাধীনতা পরিষদ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, চীন-মৈত্রী সমিতি, সাম্যবাদী দল, তথ্যমন্ত্রীর পক্ষে শহিদুল হক স্বপন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী পরিষদের পক্ষ থেকে এডভোকেট মাহবুব উদ্দিন খোকন, গণসংহতি আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, ছাত্র ফেডারেশন, ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, স্বাধীনতা ফোরাম, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) শফিউল আলম প্রধান, গণজাগরণ মঞ্চ, ছাত্রমৈত্রী, খেলাঘর, এশিয়াটিক সোসাইটি, ন্যাপ, আবদুল মতিনের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালি উপজেলার মানুষ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মিডিয়া সোসাইটি, ভাষা বিজ্ঞানী ড. মনসুর মুসা, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বৃহত্তর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, কৃষক-খেত মজুর সমিতি, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বিএসএমএমইউ-এর চিকিৎসকগণ, সাংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, গণগ্রন্থাগার, ভাষা আন্দোলন স্কুলসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে হাজারো মানুষ কমরেড আবদুল মতিনের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আবদুল মতিনের উদ্দেশ্যে শোক বইও খোলা হয় শহীদ মিনারে।
মরদেহ হস্তান্তর: বিএসএমএমইউ’র পক্ষ থেকে প্রো ভিসি প্রফেসর শহীদুল্লাহ শিকদার আবদুল মতিনের মরদেহ তার স্ত্রী গুলবদন্নেসা মনিকার কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় তিনি বলেন, মহান এ ভাষা সেনাপতির পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্যন্ত তাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারা এমন একজন ব্যক্তির এ দায়িত্ব পেয়ে গর্বিত। এরপর মিসেস মতিন আবদুল মতিনের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক শফিকুল আলম, ঢামেক এনাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামীম আরা ও চিকিৎসকদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করেন। এ সময় বিপ্লবী এ নেতার সহধর্মিণী সকল প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। তিনি দেশবাসীকে অনুরোধ করেন তার অবদান যেন কেউ ভুলে না যান। তার আদর্শকে ধারণ করে তা বাস্তবায়নের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, আবদুল মতিন ২০০৬ সালে সজ্ঞানে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মরদেহ দান করার ইচ্ছা পোষণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, আবদুল মতিনের মরদেহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য উপকার হবে। এরপর আবদুল মতিনের উদ্দেশ্যে ১ মিনিট নিরবতা পালন করার পর দুপুর ২টার দিকে বিএসএমএমইউ’র অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ নিয়ে ঢামেকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সটি বিভিন্ন সংগঠনের মিছিল সহকারে ঢামেকের এনাটমি বিভাগের মর্গে পৌঁছায়। এনাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামীম আরা বলেন, ভাষা মতিনের মরদেহ এনাটমি বিভাগে রাখা হয়েছে। তার পরিবারের সম্মতিতে তার মরদেহ সংরক্ষণ করা হবে। গতকাল থেকেই এই সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে এবং সাত থেকে আট দিন সময় লাগবে এ-কাজ শেষ হতে। অধ্যাপক শামীম আরা বলেন, পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দুই মাস লেগে যাবে। এরপর মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য তা ব্যবহৃত হবে।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেয়ায় ক্ষোভ: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মাহসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা মতিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দিয়ে সরকার ভুল করেছে। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিনে ফুল দিতে গিয়ে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, মহান এ নেতাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া সরকারের দায়িত্ব ছিল। বিএনপিসহ গোটা দেশের মানুষ এটা আশা করেছিল। কিন্তু কেন দেয়নি এটা সরকার জানে। ফখরুল বলেন, আবদুল মতিন ছিলেন কিংবদন্তির নেতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তার এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এ ধরনের ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান দেখানো হয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুকসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু মনে করেন, আবদুল মতিনের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাওয়া উচিত ছিল। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মতিন ভাই ছিলেন চেতনাসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষ। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে, তার মতো মানুষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাবে না। এটা রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, কেন রাষ্ট্র তাকে সম্মাননা জানায়নি তা এই মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছেন। রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বা স্বীকৃতি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আবদুল মতিনকে যদি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেয়া হয় তবে কাকে দেয়া হবে এটা আমার একটা প্রশ্ন। কলামনিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আজকে তার শ্রদ্ধা জানাতে যে লোক সমাগম ঘটেছে, তা প্রমাণ করে তার অবস্থান কোথায়। রাষ্ট্র তাকে সম্মান না জানালেও তার কিছু যাই-আসে না। তবে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। রাষ্ট্র তাকে সম্মান জানাতে পারেনি এটা রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা। তিনি বলেন ভাষা মতিন একটি অধ্যায়ের নায়ক। তার চলে যাওয়ার মাধ্যমে আজ সেই অধ্যায়ের অবসান ঘটলো। তিনি বলেন, তার সঙ্গে শহীদ মিনারকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। তার মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, তিনি চেয়েছিলেন একটি জাতীয়তাবাদী, অসামপ্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার। তিনি বলেন, ব্যক্তির মৃত্যু হলেও কখনও আদর্শের মৃত্যু হয় না। আদর্শের ভিতর দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন। এছাড়া ক্ষোভ জানিয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তবে রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের অভাবে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ভাষা সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নাসিম বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের অভাব ছিল। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া না হলেও প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের পক্ষ থেকে সম্মান জানানো হয়েছে। নাসিম বলেন, ভাষা মতিন রাষ্ট্রের সম্পদ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব আন্দোলনে তার অবদান রাষ্ট্র ও জনগণ ভুলবে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল উল্লেখ করে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি যদি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না পান তবে আর কে পাবেন? রাষ্ট্র তাকে সম্মান জানাতে পারলো না এটা রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের এ অগ্রপথিককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গতকাল সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। বুধবার সকালে মারা যাওয়ার পর থেকে গতকাল বেলা ১২টায় শহীদ মিনারে আনা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানেই ছিল আবদুল মতিনের মরদেহ। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত পরিবারের চাওয়া মোতাবেক সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগের মর্গে পাঠানোর মাধ্যমে তাকে শেষ বিদায় জানানো হয়। বেলা ১২টার পর বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আবদুল মতিনের মরদেহ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল থেকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের সামনে আমতলায়, যেখানে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। সেখান থেকে তার কফিন নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ফুলে ফুলে মোড়ানো অ্যাম্বুলেন্সের পাশ দিয়ে হেঁটে শহীদ মিনারে পৌঁছান তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা। তার আগেই বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হন আজীবন সংগ্রামী আবদুল মতিনকে শ্রদ্ধা জানাতে। প্রথমে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের পক্ষ থেকে এবং এরপর ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ কয়েকজন আইনজীবী এই ভাষা সেনাপতির কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে ফুল দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। এরপর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান, শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। একে একে শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বিএনপির পক্ষ থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্রিগেডিয়ার অব. হান্নান শাহ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। শ্রদ্ধা জানান জাতীয় পার্টি, জাসদ, সম্মিলিত নারী পরিষদ, বাংলা একাডেমি, সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরামের পক্ষ থেকে কেএম সফিউল্লাহ, ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংবাদিক সমাজ, ছাত্রদল, জাসাস, ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সম্মিলিত আইনজীবী পরিষদের ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সৈয়দ হাসান ইমাম, পীযূষ বান্দ্যোপাধ্যায়, স্বাধীনতা পরিষদ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, চীন-মৈত্রী সমিতি, সাম্যবাদী দল, তথ্যমন্ত্রীর পক্ষে শহিদুল হক স্বপন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী পরিষদের পক্ষ থেকে এডভোকেট মাহবুব উদ্দিন খোকন, গণসংহতি আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, ছাত্র ফেডারেশন, ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, স্বাধীনতা ফোরাম, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) শফিউল আলম প্রধান, গণজাগরণ মঞ্চ, ছাত্রমৈত্রী, খেলাঘর, এশিয়াটিক সোসাইটি, ন্যাপ, আবদুল মতিনের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালি উপজেলার মানুষ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মিডিয়া সোসাইটি, ভাষা বিজ্ঞানী ড. মনসুর মুসা, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বৃহত্তর পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, কৃষক-খেত মজুর সমিতি, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বিএসএমএমইউ-এর চিকিৎসকগণ, সাংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, গণগ্রন্থাগার, ভাষা আন্দোলন স্কুলসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে হাজারো মানুষ কমরেড আবদুল মতিনের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আবদুল মতিনের উদ্দেশ্যে শোক বইও খোলা হয় শহীদ মিনারে।
মরদেহ হস্তান্তর: বিএসএমএমইউ’র পক্ষ থেকে প্রো ভিসি প্রফেসর শহীদুল্লাহ শিকদার আবদুল মতিনের মরদেহ তার স্ত্রী গুলবদন্নেসা মনিকার কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় তিনি বলেন, মহান এ ভাষা সেনাপতির পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্যন্ত তাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারা এমন একজন ব্যক্তির এ দায়িত্ব পেয়ে গর্বিত। এরপর মিসেস মতিন আবদুল মতিনের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক শফিকুল আলম, ঢামেক এনাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামীম আরা ও চিকিৎসকদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করেন। এ সময় বিপ্লবী এ নেতার সহধর্মিণী সকল প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। তিনি দেশবাসীকে অনুরোধ করেন তার অবদান যেন কেউ ভুলে না যান। তার আদর্শকে ধারণ করে তা বাস্তবায়নের অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, আবদুল মতিন ২০০৬ সালে সজ্ঞানে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মরদেহ দান করার ইচ্ছা পোষণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, আবদুল মতিনের মরদেহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য উপকার হবে। এরপর আবদুল মতিনের উদ্দেশ্যে ১ মিনিট নিরবতা পালন করার পর দুপুর ২টার দিকে বিএসএমএমইউ’র অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ নিয়ে ঢামেকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সটি বিভিন্ন সংগঠনের মিছিল সহকারে ঢামেকের এনাটমি বিভাগের মর্গে পৌঁছায়। এনাটমি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামীম আরা বলেন, ভাষা মতিনের মরদেহ এনাটমি বিভাগে রাখা হয়েছে। তার পরিবারের সম্মতিতে তার মরদেহ সংরক্ষণ করা হবে। গতকাল থেকেই এই সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে এবং সাত থেকে আট দিন সময় লাগবে এ-কাজ শেষ হতে। অধ্যাপক শামীম আরা বলেন, পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দুই মাস লেগে যাবে। এরপর মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য তা ব্যবহৃত হবে।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেয়ায় ক্ষোভ: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মাহসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা মতিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দিয়ে সরকার ভুল করেছে। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিনে ফুল দিতে গিয়ে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, মহান এ নেতাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া সরকারের দায়িত্ব ছিল। বিএনপিসহ গোটা দেশের মানুষ এটা আশা করেছিল। কিন্তু কেন দেয়নি এটা সরকার জানে। ফখরুল বলেন, আবদুল মতিন ছিলেন কিংবদন্তির নেতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তার এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এ ধরনের ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান দেখানো হয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুকসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু মনে করেন, আবদুল মতিনের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাওয়া উচিত ছিল। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মতিন ভাই ছিলেন চেতনাসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষ। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে, তার মতো মানুষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাবে না। এটা রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, কেন রাষ্ট্র তাকে সম্মাননা জানায়নি তা এই মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছেন। রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বা স্বীকৃতি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আবদুল মতিনকে যদি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেয়া হয় তবে কাকে দেয়া হবে এটা আমার একটা প্রশ্ন। কলামনিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আজকে তার শ্রদ্ধা জানাতে যে লোক সমাগম ঘটেছে, তা প্রমাণ করে তার অবস্থান কোথায়। রাষ্ট্র তাকে সম্মান না জানালেও তার কিছু যাই-আসে না। তবে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। রাষ্ট্র তাকে সম্মান জানাতে পারেনি এটা রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা। তিনি বলেন ভাষা মতিন একটি অধ্যায়ের নায়ক। তার চলে যাওয়ার মাধ্যমে আজ সেই অধ্যায়ের অবসান ঘটলো। তিনি বলেন, তার সঙ্গে শহীদ মিনারকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। তার মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, তিনি চেয়েছিলেন একটি জাতীয়তাবাদী, অসামপ্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার। তিনি বলেন, ব্যক্তির মৃত্যু হলেও কখনও আদর্শের মৃত্যু হয় না। আদর্শের ভিতর দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন। এছাড়া ক্ষোভ জানিয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তবে রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের অভাবে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ভাষা সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নাসিম বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের অভাব ছিল। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া না হলেও প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের পক্ষ থেকে সম্মান জানানো হয়েছে। নাসিম বলেন, ভাষা মতিন রাষ্ট্রের সম্পদ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব আন্দোলনে তার অবদান রাষ্ট্র ও জনগণ ভুলবে না।
No comments