হংকংয়ের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ by ক্রিস প্যাটেন
এটা বলা পুরোপুরি ঠিক হবে না যে সারা দুনিয়ার দৃষ্টি এখন হংকংয়ের দিকে নিবদ্ধ। চীনের মূল ভূখণ্ডের মানুষেরা যদি জানতেন, তাঁদের সবচেয়ে সফল শহরে কী ঘটছে, তাহলে হয়তো তা সম্ভব হতো। কিন্তু চীনা সরকার হংকংয়ের কোনো খবর যেন তাদের দেশের অন্যত্র পৌঁছাতে না পারে, সে লক্ষ্যে সব রকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে চীনা সরকার নিজেরাই তাদের কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারব্যবস্থায় তেমন একটা আস্থা রাখে না।
হংকংয়ের অপটু কর্তৃপক্ষকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোনো পরামর্শ দেওয়ার আগে তিনটি বিষয় পরিষ্কার হওয়ার দরকার। হংকংয়ের জনগণ বাইরের শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, এ কথা বলা তাদের সততা ও নীতিপরায়ণতার গায়ে কলঙ্ক লেপন করার শামিল। হংকংয়ের জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তারা নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তারা শাসক নির্বাচিত করবে—এই আশায় বুক বেঁধে তারা হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে এসেছে আর নিজেদের দাবির ব্যাপারে এখনো অটল রয়েছে। এমনকি তারা সড়কেই রাত কাটাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, হংকংয়ের বাইরের মানুষদেরও হংকংয়ে কী ঘটছে, সে বিষয়ে আগ্রহ থাকার বৈধতা রয়েছে। হংকং একটি মহান আন্তর্জাতিক শহর, জাতিসংঘে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির মাধ্যমে এর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়েছিল। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, সিনো-ব্রিটিশ জয়েন্ট ডিক্লেয়ারেশনের অপর পক্ষ হিসেবে ব্রিটেন এ নিশ্চয়তা চেয়েছিল যে হংকংয়ের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন অন্তত ৫০ বছরের জন্য নিশ্চিত করা হবে। তাদের সে নিশ্চয়তা দেওয়াও হয়েছিল।
ফলে ব্রিটিশ মন্ত্রী ও সাংসদদের হংকংয়ের বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করা হাস্যকর দেখায়। বস্তুত চীন তাদের কথা রাখছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা তাদের অধিকার এবং একই সঙ্গে নৈতিক বাধ্যবাধকতাও বটে। আর সত্যভাষণ হলো, চীন তার সিংহভাগ প্রতিশ্রুতি রেখেছে।
কিন্তু তৃতীয়ত ও সবচেয়ে বড় সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে অন্য আরেকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে: হংকংয়ের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের জন্য যে পথ প্রতিশ্রুত ছিল, সেটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, আর কখনোই বা তা ঘটবে। হংকংয়ের অধিবাসীদের কেউ বলেনি যে কখন তাদের সর্বজনীন ভোটাধিকার দেওয়া হবে, আর এর মানে হবে তারা তাদের পছন্দের মানুষদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারবে না। কেউই বলেনি যে গণতান্ত্রিক মডেল হিসেবে চীনের আমলাতন্ত্রের মনে ছিল ইরানের কথা, আর চীনা কর্তৃপক্ষ সেখানে প্রার্থীদের ক্ষেত্রে না ভোট প্রয়োগ করতে পারবে।
বস্তুত চীনের মনে আসলে সেটা ছিল না। সেই ১৯৯৩ সালেই হংকং বিষয়ক চীনের প্রধান নেগোশিয়েটর লু পুঙ পিপলস ডেইলি পত্রিকায় বলেছিলেন, সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিষয়টির রেকর্ড রাখার জন্য তা চীনের সংসদে পেশ করা উচিত, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ঐকমত্য জরুরি নয়। ভবিষ্যতে হংকং কীভাবে তার গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাবে, সেটা হংকংয়ের একদম নিজস্ব বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকার সে ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে না। পরের বছর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা নিশ্চিত করে।
হংকং বিষয়ে ২০০০ সালে যে প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছিল, ব্রিটিশ সংসদ তার সারসংক্ষেপ করে রেখেছিল। ‘চীনা সরকার সে কারণে এটা আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিয়েছে যে হংকংয়ের গণতন্ত্রের ধরন ও প্রকৃতি কেমন হবে তা হংকং সরকারই নির্ধারণ করবে।’
তারপর কী?
হংকংয়ের সড়কে প্রতিবাদকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছেন, তাঁরা মাথায় ছাতা ও হাতে ব্যাগ নিয়ে সড়কে রাত কাটাচ্ছেন, যেটা আগেও বলেছি। সারা দুনিয়ার মানুষই টিভির পর্দায় তা দেখছে। আর যা-ই হোক, তাঁদের সড়কের ময়লার মতো ঝেড়ে ফেলা যাবে না বা টিয়ার গ্যাস ও মরিচের গুঁড়া মেরে বশে আনা যাবে না। তেমনটা করার চেষ্টা করা হলে দুনিয়ার সামনে চীন ও হংকংয়ের এক অতিকায় ও হানিকর রূপ প্রকাশিত হবে। ফলে চীনের জন্য তা একরকম অপমানই হবে। সেটা কারোর জন্যই ভালো হবে না।
হংকং কর্তৃপক্ষ তাদের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। কনফুসিয়াস একধরনের সভাসদদের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন—এই মানুষেরা বেইজিংয়ে গিয়ে রাজার মর্জিমতো কথা বলেছিলেন, তাঁকে মূল ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেননি। এরূপ মানুষদের সম্পর্কে আবারও ভাবা উচিত।
বিদ্যমান পরিকল্পনা অনুসারে, এখন গণতান্ত্রিক বিকাশের লক্ষ্যে দ্বিতীয় ধাপের পরামর্শ শুরু হওয়ার কথা। হংকংয়ের সরকারের উচিত হবে, তার জনগণের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনার সূত্রপাত করা, এর ধরন হবে উন্মুক্ত আর উদ্দেশ্য হবে সৎ। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে যৌক্তিক পন্থা হচ্ছে এই আলোচনা। হংকংয়ের জনগণ নিশ্চয়ই অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন নন। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ভদ্রোচিত সমঝোতা হওয়ার পথ খোলা আছে বলেই আমি মনে করি; অন্তত মানুষ যেন সেটা গড়াপেটার নির্বাচন বলতে না পারে।
হংকংয়ের সড়কে যে তরুণ ও বয়স্ক মানুষেরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁরাই হংকংয়ের ভবিষ্যৎ। তাঁরা একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ জীবন কামনা করেন। যে স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের প্রতিশ্রুতি তাঁদের দেওয়া হয়েছিল, সেটা তাঁরা বাস্তবায়িত হতে দেখতে চান। সেটা শুধু এই শহরের জন্যই নয়, চীনের ভবিষ্যতের জন্যও তা প্রয়োজনীয়। হংকংয়ের ভবিষ্যৎই মূল কথা, কিন্তু একই সঙ্গে চীনের মর্যাদা ও দুনিয়ার কাছে তার ভাবমূর্তিও গুরুত্বপূর্ণ।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ক্রিস প্যাটেন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য।
হংকংয়ের অপটু কর্তৃপক্ষকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোনো পরামর্শ দেওয়ার আগে তিনটি বিষয় পরিষ্কার হওয়ার দরকার। হংকংয়ের জনগণ বাইরের শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, এ কথা বলা তাদের সততা ও নীতিপরায়ণতার গায়ে কলঙ্ক লেপন করার শামিল। হংকংয়ের জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তারা নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তারা শাসক নির্বাচিত করবে—এই আশায় বুক বেঁধে তারা হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে এসেছে আর নিজেদের দাবির ব্যাপারে এখনো অটল রয়েছে। এমনকি তারা সড়কেই রাত কাটাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, হংকংয়ের বাইরের মানুষদেরও হংকংয়ে কী ঘটছে, সে বিষয়ে আগ্রহ থাকার বৈধতা রয়েছে। হংকং একটি মহান আন্তর্জাতিক শহর, জাতিসংঘে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির মাধ্যমে এর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়েছিল। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, সিনো-ব্রিটিশ জয়েন্ট ডিক্লেয়ারেশনের অপর পক্ষ হিসেবে ব্রিটেন এ নিশ্চয়তা চেয়েছিল যে হংকংয়ের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন অন্তত ৫০ বছরের জন্য নিশ্চিত করা হবে। তাদের সে নিশ্চয়তা দেওয়াও হয়েছিল।
ফলে ব্রিটিশ মন্ত্রী ও সাংসদদের হংকংয়ের বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করা হাস্যকর দেখায়। বস্তুত চীন তাদের কথা রাখছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা তাদের অধিকার এবং একই সঙ্গে নৈতিক বাধ্যবাধকতাও বটে। আর সত্যভাষণ হলো, চীন তার সিংহভাগ প্রতিশ্রুতি রেখেছে।
কিন্তু তৃতীয়ত ও সবচেয়ে বড় সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে অন্য আরেকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে: হংকংয়ের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের জন্য যে পথ প্রতিশ্রুত ছিল, সেটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, আর কখনোই বা তা ঘটবে। হংকংয়ের অধিবাসীদের কেউ বলেনি যে কখন তাদের সর্বজনীন ভোটাধিকার দেওয়া হবে, আর এর মানে হবে তারা তাদের পছন্দের মানুষদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারবে না। কেউই বলেনি যে গণতান্ত্রিক মডেল হিসেবে চীনের আমলাতন্ত্রের মনে ছিল ইরানের কথা, আর চীনা কর্তৃপক্ষ সেখানে প্রার্থীদের ক্ষেত্রে না ভোট প্রয়োগ করতে পারবে।
বস্তুত চীনের মনে আসলে সেটা ছিল না। সেই ১৯৯৩ সালেই হংকং বিষয়ক চীনের প্রধান নেগোশিয়েটর লু পুঙ পিপলস ডেইলি পত্রিকায় বলেছিলেন, সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিষয়টির রেকর্ড রাখার জন্য তা চীনের সংসদে পেশ করা উচিত, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ঐকমত্য জরুরি নয়। ভবিষ্যতে হংকং কীভাবে তার গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাবে, সেটা হংকংয়ের একদম নিজস্ব বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকার সে ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে না। পরের বছর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা নিশ্চিত করে।
হংকং বিষয়ে ২০০০ সালে যে প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছিল, ব্রিটিশ সংসদ তার সারসংক্ষেপ করে রেখেছিল। ‘চীনা সরকার সে কারণে এটা আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিয়েছে যে হংকংয়ের গণতন্ত্রের ধরন ও প্রকৃতি কেমন হবে তা হংকং সরকারই নির্ধারণ করবে।’
তারপর কী?
হংকংয়ের সড়কে প্রতিবাদকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছেন, তাঁরা মাথায় ছাতা ও হাতে ব্যাগ নিয়ে সড়কে রাত কাটাচ্ছেন, যেটা আগেও বলেছি। সারা দুনিয়ার মানুষই টিভির পর্দায় তা দেখছে। আর যা-ই হোক, তাঁদের সড়কের ময়লার মতো ঝেড়ে ফেলা যাবে না বা টিয়ার গ্যাস ও মরিচের গুঁড়া মেরে বশে আনা যাবে না। তেমনটা করার চেষ্টা করা হলে দুনিয়ার সামনে চীন ও হংকংয়ের এক অতিকায় ও হানিকর রূপ প্রকাশিত হবে। ফলে চীনের জন্য তা একরকম অপমানই হবে। সেটা কারোর জন্যই ভালো হবে না।
হংকং কর্তৃপক্ষ তাদের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। কনফুসিয়াস একধরনের সভাসদদের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন—এই মানুষেরা বেইজিংয়ে গিয়ে রাজার মর্জিমতো কথা বলেছিলেন, তাঁকে মূল ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেননি। এরূপ মানুষদের সম্পর্কে আবারও ভাবা উচিত।
বিদ্যমান পরিকল্পনা অনুসারে, এখন গণতান্ত্রিক বিকাশের লক্ষ্যে দ্বিতীয় ধাপের পরামর্শ শুরু হওয়ার কথা। হংকংয়ের সরকারের উচিত হবে, তার জনগণের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনার সূত্রপাত করা, এর ধরন হবে উন্মুক্ত আর উদ্দেশ্য হবে সৎ। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে যৌক্তিক পন্থা হচ্ছে এই আলোচনা। হংকংয়ের জনগণ নিশ্চয়ই অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন নন। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ভদ্রোচিত সমঝোতা হওয়ার পথ খোলা আছে বলেই আমি মনে করি; অন্তত মানুষ যেন সেটা গড়াপেটার নির্বাচন বলতে না পারে।
হংকংয়ের সড়কে যে তরুণ ও বয়স্ক মানুষেরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁরাই হংকংয়ের ভবিষ্যৎ। তাঁরা একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ জীবন কামনা করেন। যে স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের প্রতিশ্রুতি তাঁদের দেওয়া হয়েছিল, সেটা তাঁরা বাস্তবায়িত হতে দেখতে চান। সেটা শুধু এই শহরের জন্যই নয়, চীনের ভবিষ্যতের জন্যও তা প্রয়োজনীয়। হংকংয়ের ভবিষ্যৎই মূল কথা, কিন্তু একই সঙ্গে চীনের মর্যাদা ও দুনিয়ার কাছে তার ভাবমূর্তিও গুরুত্বপূর্ণ।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ক্রিস প্যাটেন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য।
No comments