বোকা বুদ্ধুর কুচকাওয়াজ by আলমগীর মহিউদ্দিন
গত শতাব্দীর প্রথম পাদেই গবেষকেরা এক অভাবনীয় বিষয়ের সম্মুখীন হন। অবশ্য মানুষের অজ্ঞাতে ও অনিচ্ছায় অনেক কিছু ঘটে। এমনি একটি বিষয় তাদের অজান্তে, অতি সঙ্গোপনে গত ৫২২ বছর ধরে ঘটছে। পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ ক্রমেই বোবা, বোকা ও বুদ্ধু হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিচার, চিন্তা ও ভাবনার ক্ষমতা ধীরে লোপ পাচ্ছে। তারা ুদ্র গোষ্ঠীর ক্রীড়নক হয়ে পড়ছে। মজার কথা যারা তাদের এমন বোকা-বুদ্ধুর কুচকাওয়াজে ঠেলে দিচ্ছে বা এ মিছিলে শামিল হতে সাহায্য করছে তারাও জানে না এটি তাদের কর্মকাণ্ডের ফল।
বিজ্ঞানী ও অনুসন্ধানকারীরা এই অভাবনীয় অবস্থা অবলোকন করে আরো অনুসন্ধানে ব্যাপৃত রয়েছেন। তারা লক্ষ করলেন, তথাকথিত আধুনিক জীবনধারা এমন অবস্থা নানা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করে চলেছে। আধুনিক জীবনধারা মূলত পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা-প্রযুক্তিনির্ভর যার গোড়াপত্তন ঘটে স্পেনের মুসলমানদের পরাজয়ের পরে।
এটি সত্য, পশ্চিমা প্রযুক্তি মুসলিম প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু তাদের জীবন ধারণের ধ্যান-ধারণা প্রতিনিয়ত মুসলিম জীবনবোধের বিপরীতে থাকত। এমন কি সে যুগকে তারা মধ্যযুগ নাম দিয়ে ‘অসভ্য বর্বরতার’ সময় বলে আখ্যায়িত করে।
পশ্চিমের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক মানুষ অসভ্য বা বর্বর নয় ধরে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর গবেষণা চালায়। তারা লক্ষ করে পশ্চিমের মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা স্থূূলতর হচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে ‘রবোটিক’ হয়ে পড়ছে। ফলে ুদ্র ক্ষমতাবানদের ক্রীড়নক হয়ে ক্রমান্বয়ে মানবীয় গুণ হারিয়ে ফেলছে। তাদের অনেকেই নিষ্ঠুরতায় বেশি আনন্দ পেতে দেখা যায়। কেন এমনটি হচ্ছে? এর জবাবের অনুসন্ধানে প্রথম সাড়া আসে জার্মানি থেকে। তারা লক্ষ্য করলেন প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাবলিসহ বিশ্বব্যাপী অনৈতিক, অনাচার ও অত্যাচারের রাজ্য ক্রমান্বয়ে কায়েম হচ্ছে। সামাজিক অন্যায় কাজগুলো বিস্তার লাভ করছে। এর প্রতিবাদীরা বিশেষকরে সত্য বিশেষভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে। নানা প্রশ্ন জন্ম হতে থাকে। অন্যায়কারীরা কি বুঝতেই পারছে না, তারা অন্যায় করছে অন্যের কথায়, প্ররোচনায়? এটা কি বুদ্ধিহীনতার কারণে?
জার্মানির মনস্তত্ত্ববিদ উইলিয়াম স্টার্ন ১৯১২ সালে মানুষের বুদ্ধিমত্তার ওপর একটি বইতে জার্মান শব্দ Intelligenz-quotien ব্যবহার করেন বুদ্ধি মাপা বা বুদ্ধাঙ্ক হিসেবে। তাৎক্ষণিকভাবে এটি সবার কাছে গ্রহণীয় হয় এবং ইংরেজিতেও শব্দটি অবিকৃতভাবে গ্রহণ করা হয়। এরপর অন্যান্য বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা স্টার্নের পথ অনুসরণ করে নানা মানদণ্ড নিরূপণ করতে থাকেন। দু’জনের নাম সবার আগে আসে। প্রথম জন হলেন ফরাসি মনস্তত্ত্ববিদ আলফ্রেড বিনো (Alfred Binet) এবং দ্বিতীয় জন হলেন থিওডোর সাইমন (Theodore Simon)। এরা প্রধানত শিশুদের মানসিক ক্ষমতা ও দক্ষতা মাপকাঠি তৈরি করেন। এর উদ্দেশ্য স্কুলের শিক্ষাক্রমে তাদের কী ধরনের সাহায্য প্রয়োজন তা পরিমাপ করা। এরপর মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ডেভিড ওয়েশ্লার (David Wechsler) ১৯৩০ সালে বয়স্কদের বুদ্ধিমত্তা নিরূপণের জন্য মাপকাঠি তৈরি করেন। অন্য অনেক মাপকাঠি থাকলেও ওয়েশ্লার এডাল্ট ইনটেলিজেন্স স্কেল (Wechslar Adult Intelligence Scale-WAIS) এবং ওয়েশ্লার ইনটেলিজেন্স স্কেল ফর চিল্ড্রেন (Wechsler Intelligence Scale for Children-WISC) এখন সর্বজনীনতা পেয়েছে। এ দু’টি পরীক্ষার মধ্যে পার্থক্য হলো বিনো-থিও মানদণ্ডে বয়সটাকে প্রধান ধরা হয়েছে। যেমন একটি শিশুর আসল বয়স (Chronological age) ১০ বছর। কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা-কর্মকাণ্ড ১২ বছরের। এ শিশুর বুদ্ধি (ওছ) মাপতে হতো ১২স্ট১০দ্ধ১০০ = ১২০ অর্থাৎ তার ওছ হলো ১২০। ১০০ কে কেন্দ্র করে পরিমাপ করা হতো। কিন্তু ওয়েশ্লার বয়সকে প্রধান না করে কতকগুলো প্রশ্ন এবং কাজ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে এ পরিমাপ মানদণ্ড স্থির করেন। যেমন WAIS স্কেলের ১৪টি ভাগ। সাতটি মৌখিক যথাÑ Information, Comprehension, Arithmatic, Similarities, Vocabulary, Digit Span, and Letter-Number Sequencing) ও অপর সাতটি কর্ম সম্পাদনের (performance) Digit-Symbol Coding, Block design, matrix reasoning, Picture Completion Picture arrangement Symbol Search, and Object Assembly). অবশ্য ১০০ পয়েন্টকে স্থির রাখা হয়। মূল লক্ষ্য হলো জন্মগত এবং সমগ্রোত্রীয় অভিজ্ঞতা দিয়ে জ্ঞান ও ধারণাকে পরিমাপ করা। গবেষণায় দেখা গেল পরিবেশ, লালন-পালন, মা-বাবার মনোযোগ এবং পরিবারের সামাজিক মর্যাদা IQ -এর ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া শৈশবকালীন খাদ্যাভ্যাস ও মায়ের দুধ এবং পরিবেশও বোধশক্তি উন্মেষে সাহায্য করে। এমনকি একজন বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন মা-বাবার IQ এ অবস্থায় সহায়ক শক্তি। তবে উত্তরাধিকত্ব কতখানি দায়ী তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে।
বুদ্ধি পরিমাপের বিষয়টি আবিষ্কৃত হওয়ার পরেই এ নিয়ে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে গবেষণা শুরু হয়। এখানে যে বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হয়, একজন মানুষ কত জ্ঞানের অধিকারী তার ওপরে নয়, বরং মুখোমুখি সমস্যা ও বিষয়গুলো বোঝার কতখানি ক্ষমতার তার ওপর জোর দেয়া হয়। এর প্রথম গবেষণা করেন ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেমস ফিন। তিনি লক্ষ করেন ১৯৩০ এবং ১৯৮০ মধ্যে তিন পয়েন্ট করে মার্কিনিদের IQ বেড়েছে। তিনি স্থির করেন ভালো খাবার এবং বাসস্থানের কারণে এই বৃদ্ধি। মনস্তত্ত্বে এর নাম হলো ‘ফিন এফেক্ট’।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো এর পরের গবেষণায় দেখা গেল এই স্কোর ক্রমান্বয়ে কমছে। গবেষণাগুলো ব্রিটেন, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালনা করা হয়। এরপর আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রিচার্ড লিন (Richard Lynn) এবং বেলজিয়ামের ড. মাইকেল উডলে (Michael Woodley of Free University of Brussels, Belgium) বড় আকারের গবেষণাতেও একই অবস্থা দেখতে পান। তারা দেখেন মানুষ ভিক্টোরিয়ার সময়ের চেয়েও অনেক পেছনে। তাদের বিবেচনা বোধটি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ‘আমরা কি ক্রমান্বয়ে বোকা-বুদ্ধু হয়ে যাচ্ছি’, প্রশ্ন করেছেন ডেইলি মেইলের সারাহ গ্রিফিথ তার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
তার এই আশঙ্কার কারণ ড. জান তে নিজেনহুইর (Jan te Nigenhuis- Amsterdam University) হাফিংটন পোস্টের এক নিবন্ধ। এ নিবন্ধে তিনি তার গবেষণা প্রকাশ করেন। এ গবেষণায় দেখা গেছে ইউরোপীয়দের IQ ভিক্টোরিয়ার সময়ের চেয়ে ১৪ পয়েন্ট কম।
কয়েকজন মনস্তত্ত্ববিদ এসব গবেষণাকে একত্র করে মন্তব্য করেছেন, ‘সম্ভবত মানবসমাজ বুদ্ধিমত্তার স্কেলের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছার পর এই অবনতি শুরু হয়েছে।’
কারণ নিয়ে তর্ক শুরু হয়েছে। তবে সবাই দু-একটি বিষয়ে প্রায় একমত। প্রথমত বর্তমান প্রযুক্তি মানুষকে ভাবতে দেয় নাÑ প্রার্থিত বস্তুটি পৌঁছে দেয়। শুধু কিছু লোক ভাবে। আগে সবাইকে ভাবতে হতো এবং সে মোতাবেক কর্ম সম্পাদন করতে হতো। যেমন ডেইলি টেলিগ্রাফের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘ব্রিটেনের কিশোররা (টিনএজ) ১৯৮০ সালে ২০০৮ সালের চেয়ে দুই পয়েন্ট বেশি চালাক ছিল। বিশেষ করে যারা বুদ্ধিমত্তার স্কেলের ওপরের অর্ধাংশে ছিল। তাই পত্রিকাটি প্রশ্ন করেছে, ‘ব্রিটিশরা কি বোকা-বুদ্ধু হয়ে পড়ছে’?
ড. জেরাল্ড ক্রাবট্রি (Gerald Crabtree, Professor Of Pathology Stamford University) মন্তব্য করেছেন, ‘মানবকুলের বুদ্ধিমত্তার ক্রমাবনতি সম্ভবত ৫০০০ থেকে ১২০০০ বছর আগ থেকেই শুরু হয়েছে। তখন তারা কৃষি আবিষ্কার করে এবং সামাজিকভাবে বসবাস করতে শুরু করায় অনেক চিন্তাভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে পড়ে।’ তার সাথে যোগ দিয়েছেন নিজেনহুই। অধ্যাপক নিজেনহুই ১৮৮৪-২০০৪ মধ্যের ১৪টি গবেষণা (যার মধ্যে ডারউইনের ভাই স্যার ফ্রান্সিস গালটনের গবেষণা অন্তর্ভুক্ত) আলোচনা করে এই একই সিদ্ধান্ত পৌঁছান। তবে এই ক্রমের দ্রুতায়ন হতে থাকে পাঁচ শ’ বছর আগে।
‘টিনএজার’দের IQ ক্রমাবনতির কারণ হিসেবে বর্তমানের যুবকার্যক্রম (Youth Culture) দায়ী বলে তারা মন্তব্য করেছেন। তারা পড়াশোনার চেয়ে কম্পিউটার গেম এবং ‘ফেসবুক চ্যাটিং’ পছন্দ করে। তাদের পড়াশোনার অভ্যাস (রিডিং হ্যাবিট) একেবারেই কমে গেছে। আবার শিক্ষা কারিকুলামে তথাকথিত Teach to the test পদ্ধতি (প্রশ্নোত্তর ও সৃজনশীল) শিশুদের চিন্তাভাবনা সীমিত করে ফেলছে। টেলিভিশন এবং কম্পিউটার এই ক্রমাবনতির গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
ড. ফিন অবশ্য আশা প্রকাশ করেছেন ভালো খাদ্য এবং প্রযুক্তির আরো উন্নতি এই ক্রমাবনতির গতিকে থামিয়ে দেবে। তবে ড. জন রাভেন (Dr. John Raven, Edinburgh-Psychologist) এবং ড. রিচার্ড হাউস এতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ‘হয়তো আসল বিষয়টি ঢাকা পড়লেও এই ক্রমাবনতি থামবে না। কারণ, জনসংখ্যা যত বাড়বে তার প্রভাব এর অনুকূলে যাবে না।
ফলে আগামী দিনগুলোতে উন্নত সমাজ বলে পরিচিত জনগোষ্ঠীকে ক্রমান্বয়ে স্বল্পসংখ্যক মেধাবী মানুষের ফসলকে বুদ্ধিহীন শক্তিমান গোষ্ঠী ব্যবহার করে বোকা-বুদ্ধুর কুচকাওয়াজকে জীবন্ত রাখবে। এ প্রশ্ন আসছে, তাহলে কি জনভারাক্রান্ত সমাজে সেই ‘শক্তি যার অধিকার তার’ রাজ্যটি পুরোপুরি চালু হবে? অবশ্য এর চিহ্ন ক্রমে ক্রমে প্রকট হতে চলেছে। তাহলে এটা কি প্রাগৈতিহাসিক বর্বর যুগের প্রযুক্তিগত চেহারা হবে। অর্থাৎ অত্যন্ত সরলীকরণ করে বলা যায় এই পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের সময় সঙ্কীর্ণ হওয়ার চিহ্ন?
এ অবস্থা উন্নত সমাজের হলে, অন্যত্র এর চেহারা কেমন হতে পারে? যেহেতু এই প্রশ্নের ওপর কোনো গবেষণা হয়নি, তাই স্পষ্ট কোনো মন্তব্য সম্ভব নয়। তবে যেহেতু বলা হয়েছে ভিক্টোরিয়ার আমলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা আজকের দিনের চেয়ে কয়েক ধাপ ওপরে ছিল, সে হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের অবস্থা সেই ভিক্টেরিয়ার আমলের চেয়ে ভালো নয়। এ থেকে আরো বলা যায়, সেই সময়ের উন্নত সমাজের সাম্রাজ্যবাদীরা বিশাল সাম্রাজ্য গঠনে সক্ষম হয়েছিল। এখন তার বিস্তার আরো বেশি সম্ভব এবং নজরদারি হয়তো হবে আরো কঠোর। এবং বোকা-বুদ্ধুর কুচকাওয়াজের আওয়াজ ও উপস্থিতি হবে তীব্রতর।
বিজ্ঞানী ও অনুসন্ধানকারীরা এই অভাবনীয় অবস্থা অবলোকন করে আরো অনুসন্ধানে ব্যাপৃত রয়েছেন। তারা লক্ষ করলেন, তথাকথিত আধুনিক জীবনধারা এমন অবস্থা নানা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করে চলেছে। আধুনিক জীবনধারা মূলত পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা-প্রযুক্তিনির্ভর যার গোড়াপত্তন ঘটে স্পেনের মুসলমানদের পরাজয়ের পরে।
এটি সত্য, পশ্চিমা প্রযুক্তি মুসলিম প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু তাদের জীবন ধারণের ধ্যান-ধারণা প্রতিনিয়ত মুসলিম জীবনবোধের বিপরীতে থাকত। এমন কি সে যুগকে তারা মধ্যযুগ নাম দিয়ে ‘অসভ্য বর্বরতার’ সময় বলে আখ্যায়িত করে।
পশ্চিমের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক মানুষ অসভ্য বা বর্বর নয় ধরে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর গবেষণা চালায়। তারা লক্ষ করে পশ্চিমের মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা স্থূূলতর হচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে ‘রবোটিক’ হয়ে পড়ছে। ফলে ুদ্র ক্ষমতাবানদের ক্রীড়নক হয়ে ক্রমান্বয়ে মানবীয় গুণ হারিয়ে ফেলছে। তাদের অনেকেই নিষ্ঠুরতায় বেশি আনন্দ পেতে দেখা যায়। কেন এমনটি হচ্ছে? এর জবাবের অনুসন্ধানে প্রথম সাড়া আসে জার্মানি থেকে। তারা লক্ষ্য করলেন প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাবলিসহ বিশ্বব্যাপী অনৈতিক, অনাচার ও অত্যাচারের রাজ্য ক্রমান্বয়ে কায়েম হচ্ছে। সামাজিক অন্যায় কাজগুলো বিস্তার লাভ করছে। এর প্রতিবাদীরা বিশেষকরে সত্য বিশেষভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে। নানা প্রশ্ন জন্ম হতে থাকে। অন্যায়কারীরা কি বুঝতেই পারছে না, তারা অন্যায় করছে অন্যের কথায়, প্ররোচনায়? এটা কি বুদ্ধিহীনতার কারণে?
জার্মানির মনস্তত্ত্ববিদ উইলিয়াম স্টার্ন ১৯১২ সালে মানুষের বুদ্ধিমত্তার ওপর একটি বইতে জার্মান শব্দ Intelligenz-quotien ব্যবহার করেন বুদ্ধি মাপা বা বুদ্ধাঙ্ক হিসেবে। তাৎক্ষণিকভাবে এটি সবার কাছে গ্রহণীয় হয় এবং ইংরেজিতেও শব্দটি অবিকৃতভাবে গ্রহণ করা হয়। এরপর অন্যান্য বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা স্টার্নের পথ অনুসরণ করে নানা মানদণ্ড নিরূপণ করতে থাকেন। দু’জনের নাম সবার আগে আসে। প্রথম জন হলেন ফরাসি মনস্তত্ত্ববিদ আলফ্রেড বিনো (Alfred Binet) এবং দ্বিতীয় জন হলেন থিওডোর সাইমন (Theodore Simon)। এরা প্রধানত শিশুদের মানসিক ক্ষমতা ও দক্ষতা মাপকাঠি তৈরি করেন। এর উদ্দেশ্য স্কুলের শিক্ষাক্রমে তাদের কী ধরনের সাহায্য প্রয়োজন তা পরিমাপ করা। এরপর মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ডেভিড ওয়েশ্লার (David Wechsler) ১৯৩০ সালে বয়স্কদের বুদ্ধিমত্তা নিরূপণের জন্য মাপকাঠি তৈরি করেন। অন্য অনেক মাপকাঠি থাকলেও ওয়েশ্লার এডাল্ট ইনটেলিজেন্স স্কেল (Wechslar Adult Intelligence Scale-WAIS) এবং ওয়েশ্লার ইনটেলিজেন্স স্কেল ফর চিল্ড্রেন (Wechsler Intelligence Scale for Children-WISC) এখন সর্বজনীনতা পেয়েছে। এ দু’টি পরীক্ষার মধ্যে পার্থক্য হলো বিনো-থিও মানদণ্ডে বয়সটাকে প্রধান ধরা হয়েছে। যেমন একটি শিশুর আসল বয়স (Chronological age) ১০ বছর। কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা-কর্মকাণ্ড ১২ বছরের। এ শিশুর বুদ্ধি (ওছ) মাপতে হতো ১২স্ট১০দ্ধ১০০ = ১২০ অর্থাৎ তার ওছ হলো ১২০। ১০০ কে কেন্দ্র করে পরিমাপ করা হতো। কিন্তু ওয়েশ্লার বয়সকে প্রধান না করে কতকগুলো প্রশ্ন এবং কাজ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে এ পরিমাপ মানদণ্ড স্থির করেন। যেমন WAIS স্কেলের ১৪টি ভাগ। সাতটি মৌখিক যথাÑ Information, Comprehension, Arithmatic, Similarities, Vocabulary, Digit Span, and Letter-Number Sequencing) ও অপর সাতটি কর্ম সম্পাদনের (performance) Digit-Symbol Coding, Block design, matrix reasoning, Picture Completion Picture arrangement Symbol Search, and Object Assembly). অবশ্য ১০০ পয়েন্টকে স্থির রাখা হয়। মূল লক্ষ্য হলো জন্মগত এবং সমগ্রোত্রীয় অভিজ্ঞতা দিয়ে জ্ঞান ও ধারণাকে পরিমাপ করা। গবেষণায় দেখা গেল পরিবেশ, লালন-পালন, মা-বাবার মনোযোগ এবং পরিবারের সামাজিক মর্যাদা IQ -এর ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া শৈশবকালীন খাদ্যাভ্যাস ও মায়ের দুধ এবং পরিবেশও বোধশক্তি উন্মেষে সাহায্য করে। এমনকি একজন বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন মা-বাবার IQ এ অবস্থায় সহায়ক শক্তি। তবে উত্তরাধিকত্ব কতখানি দায়ী তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে।
বুদ্ধি পরিমাপের বিষয়টি আবিষ্কৃত হওয়ার পরেই এ নিয়ে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে গবেষণা শুরু হয়। এখানে যে বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হয়, একজন মানুষ কত জ্ঞানের অধিকারী তার ওপরে নয়, বরং মুখোমুখি সমস্যা ও বিষয়গুলো বোঝার কতখানি ক্ষমতার তার ওপর জোর দেয়া হয়। এর প্রথম গবেষণা করেন ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেমস ফিন। তিনি লক্ষ করেন ১৯৩০ এবং ১৯৮০ মধ্যে তিন পয়েন্ট করে মার্কিনিদের IQ বেড়েছে। তিনি স্থির করেন ভালো খাবার এবং বাসস্থানের কারণে এই বৃদ্ধি। মনস্তত্ত্বে এর নাম হলো ‘ফিন এফেক্ট’।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো এর পরের গবেষণায় দেখা গেল এই স্কোর ক্রমান্বয়ে কমছে। গবেষণাগুলো ব্রিটেন, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালনা করা হয়। এরপর আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রিচার্ড লিন (Richard Lynn) এবং বেলজিয়ামের ড. মাইকেল উডলে (Michael Woodley of Free University of Brussels, Belgium) বড় আকারের গবেষণাতেও একই অবস্থা দেখতে পান। তারা দেখেন মানুষ ভিক্টোরিয়ার সময়ের চেয়েও অনেক পেছনে। তাদের বিবেচনা বোধটি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ‘আমরা কি ক্রমান্বয়ে বোকা-বুদ্ধু হয়ে যাচ্ছি’, প্রশ্ন করেছেন ডেইলি মেইলের সারাহ গ্রিফিথ তার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
তার এই আশঙ্কার কারণ ড. জান তে নিজেনহুইর (Jan te Nigenhuis- Amsterdam University) হাফিংটন পোস্টের এক নিবন্ধ। এ নিবন্ধে তিনি তার গবেষণা প্রকাশ করেন। এ গবেষণায় দেখা গেছে ইউরোপীয়দের IQ ভিক্টোরিয়ার সময়ের চেয়ে ১৪ পয়েন্ট কম।
কয়েকজন মনস্তত্ত্ববিদ এসব গবেষণাকে একত্র করে মন্তব্য করেছেন, ‘সম্ভবত মানবসমাজ বুদ্ধিমত্তার স্কেলের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছার পর এই অবনতি শুরু হয়েছে।’
কারণ নিয়ে তর্ক শুরু হয়েছে। তবে সবাই দু-একটি বিষয়ে প্রায় একমত। প্রথমত বর্তমান প্রযুক্তি মানুষকে ভাবতে দেয় নাÑ প্রার্থিত বস্তুটি পৌঁছে দেয়। শুধু কিছু লোক ভাবে। আগে সবাইকে ভাবতে হতো এবং সে মোতাবেক কর্ম সম্পাদন করতে হতো। যেমন ডেইলি টেলিগ্রাফের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘ব্রিটেনের কিশোররা (টিনএজ) ১৯৮০ সালে ২০০৮ সালের চেয়ে দুই পয়েন্ট বেশি চালাক ছিল। বিশেষ করে যারা বুদ্ধিমত্তার স্কেলের ওপরের অর্ধাংশে ছিল। তাই পত্রিকাটি প্রশ্ন করেছে, ‘ব্রিটিশরা কি বোকা-বুদ্ধু হয়ে পড়ছে’?
ড. জেরাল্ড ক্রাবট্রি (Gerald Crabtree, Professor Of Pathology Stamford University) মন্তব্য করেছেন, ‘মানবকুলের বুদ্ধিমত্তার ক্রমাবনতি সম্ভবত ৫০০০ থেকে ১২০০০ বছর আগ থেকেই শুরু হয়েছে। তখন তারা কৃষি আবিষ্কার করে এবং সামাজিকভাবে বসবাস করতে শুরু করায় অনেক চিন্তাভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে পড়ে।’ তার সাথে যোগ দিয়েছেন নিজেনহুই। অধ্যাপক নিজেনহুই ১৮৮৪-২০০৪ মধ্যের ১৪টি গবেষণা (যার মধ্যে ডারউইনের ভাই স্যার ফ্রান্সিস গালটনের গবেষণা অন্তর্ভুক্ত) আলোচনা করে এই একই সিদ্ধান্ত পৌঁছান। তবে এই ক্রমের দ্রুতায়ন হতে থাকে পাঁচ শ’ বছর আগে।
‘টিনএজার’দের IQ ক্রমাবনতির কারণ হিসেবে বর্তমানের যুবকার্যক্রম (Youth Culture) দায়ী বলে তারা মন্তব্য করেছেন। তারা পড়াশোনার চেয়ে কম্পিউটার গেম এবং ‘ফেসবুক চ্যাটিং’ পছন্দ করে। তাদের পড়াশোনার অভ্যাস (রিডিং হ্যাবিট) একেবারেই কমে গেছে। আবার শিক্ষা কারিকুলামে তথাকথিত Teach to the test পদ্ধতি (প্রশ্নোত্তর ও সৃজনশীল) শিশুদের চিন্তাভাবনা সীমিত করে ফেলছে। টেলিভিশন এবং কম্পিউটার এই ক্রমাবনতির গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
ড. ফিন অবশ্য আশা প্রকাশ করেছেন ভালো খাদ্য এবং প্রযুক্তির আরো উন্নতি এই ক্রমাবনতির গতিকে থামিয়ে দেবে। তবে ড. জন রাভেন (Dr. John Raven, Edinburgh-Psychologist) এবং ড. রিচার্ড হাউস এতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ‘হয়তো আসল বিষয়টি ঢাকা পড়লেও এই ক্রমাবনতি থামবে না। কারণ, জনসংখ্যা যত বাড়বে তার প্রভাব এর অনুকূলে যাবে না।
ফলে আগামী দিনগুলোতে উন্নত সমাজ বলে পরিচিত জনগোষ্ঠীকে ক্রমান্বয়ে স্বল্পসংখ্যক মেধাবী মানুষের ফসলকে বুদ্ধিহীন শক্তিমান গোষ্ঠী ব্যবহার করে বোকা-বুদ্ধুর কুচকাওয়াজকে জীবন্ত রাখবে। এ প্রশ্ন আসছে, তাহলে কি জনভারাক্রান্ত সমাজে সেই ‘শক্তি যার অধিকার তার’ রাজ্যটি পুরোপুরি চালু হবে? অবশ্য এর চিহ্ন ক্রমে ক্রমে প্রকট হতে চলেছে। তাহলে এটা কি প্রাগৈতিহাসিক বর্বর যুগের প্রযুক্তিগত চেহারা হবে। অর্থাৎ অত্যন্ত সরলীকরণ করে বলা যায় এই পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের সময় সঙ্কীর্ণ হওয়ার চিহ্ন?
এ অবস্থা উন্নত সমাজের হলে, অন্যত্র এর চেহারা কেমন হতে পারে? যেহেতু এই প্রশ্নের ওপর কোনো গবেষণা হয়নি, তাই স্পষ্ট কোনো মন্তব্য সম্ভব নয়। তবে যেহেতু বলা হয়েছে ভিক্টোরিয়ার আমলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা আজকের দিনের চেয়ে কয়েক ধাপ ওপরে ছিল, সে হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের অবস্থা সেই ভিক্টেরিয়ার আমলের চেয়ে ভালো নয়। এ থেকে আরো বলা যায়, সেই সময়ের উন্নত সমাজের সাম্রাজ্যবাদীরা বিশাল সাম্রাজ্য গঠনে সক্ষম হয়েছিল। এখন তার বিস্তার আরো বেশি সম্ভব এবং নজরদারি হয়তো হবে আরো কঠোর। এবং বোকা-বুদ্ধুর কুচকাওয়াজের আওয়াজ ও উপস্থিতি হবে তীব্রতর।
No comments