১৬০০ রাজনীতিক ও আমলার দায়মুক্তি by নিয়াজ মাহমুদ
ঢাকঢোল পিটিয়ে সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী রাজনীতিক এবং আমলাদের দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের জন্য নিয়মিত ব্রিফিংও করা হয় সময়ে সময়ে। কিন্তু তদন্তাধীন এসব ঘটনায় বেশির ভাগই দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। অনেকটা গোপনেই মামলা নথিভুক্ত করে দায়মুক্তির ‘সনদ’ দিচ্ছে কমিশন। তিন বছর আট মাসে কমিশন বিলুপ্ত ব্যুরোসহ ৫৩৪৯টি দুর্নীতির অনুসন্ধান নথিভুক্ত করে আসামিদের দায়মুক্তি দিয়েছে। এর মধ্যে শুধু চলতি বছর আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ১৬০০ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এই আট মাসে ৯০৪টি দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে ৮৭০ জনের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের হয়নি। এছাড়া, ৩০৭টি মামলায় ৭১৮ জন আসামির বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়ায় তাদেরকে দায়মুক্তি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগ থেকে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ ১০ জনকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- মামলার যথার্থতা না থাকা, তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য, সাক্ষী না পাওয়ায় মামলাটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে নথিভুক্ত করেছে কমিশন। সর্বশেষ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হককেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে দুদক। এছাড়া, আট মাসে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়াদের মধ্যে আরও রয়েছেন-জাতীয় সংসদের উপনেতা ও সাবেক বনমন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সাবেক এমপি এইচবিএম ইকবাল, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মোহাম্মদ নাসিম, ফিলিপাইনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাজেদা রফিকুন নেসা, পেট্রোবাংলার জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) আইয়ুব খান চৌধুরী, সিআইডি’র সাবেক পুলিশ সুপার এম রফিকুল ইসলাম, রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক এম আবু তাহের, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক কর কমিশনার এমদাদুল হক প্রমুখ। এমনকি রেলের নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধাও দুদকের করা পাঁচটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
রুহুল হক ছাড়া আরও যেসব সাবেক মন্ত্রী-এমপিকে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে দুদক অনুসন্ধান করে তাদের মধ্যে সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, সরকারি দলের এমপি আসলামুল হক, এনামুল হক ও আবদুর রহমান বদি, বিএনপির দুই সাবেক এমপি শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও মসিউর রহমান এবং জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আবদুল জব্বার। তাদের মধ্যে আবদুল মান্নান খান, মাহবুবুর রহমান ও আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও আবদুল জব্বারের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর আসলামুল হককে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অনেকটা ঘোষণা দিয়ে দুদক এসব অনুসন্ধান শুরু করলেও দায়মুক্তি দিয়েছে অনেকটা নিভৃতে। এর আগে উচ্চ আদালতের আদেশে ২০৫টি রুল কমিশনের বিপক্ষে গেছে বলে দুদক জানিয়েছে। এতে শেখ হাসিনার ৯টি মামলা রয়েছে (২০০৯ থেকে ২০১২) সালের মধ্যে। তবে মহাজোট সরকারের আমলে কোন মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি বলে দাবি করেছে দুদক। অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে দুদকের মামলা দায়েরের সংখ্যা খুবই কম এমন প্রশ্নে দুদকের উপ-পরিচালক জনসংযোগ প্রণব কুমার মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, মামলা দায়েরের সহায়ক নথিপত্রের অপ্রাপ্যতা, অভিযোগের সত্যতা ও অনেক সময় সাক্ষী খুঁজে না পাওয়া, অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় অভিযোগকারীর সহায়তা করতে না চাওয়া, মৃত্যু মূল কারণ। এছাড়া, অনেক প্রশাসনিক কার্যালয় দাপ্তরিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নথিপত্র ধ্বংস করা। মামলার অনুসন্ধান প্রমাণে এসব আবশ্যিক। কিন্তু নথি পাওয়া যাচ্ছে না। দুদকের মামলার বেশির ভাগ সাক্ষী সরকারি কর্মকর্তা। দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলায় সাক্ষী দিতে আসেন না তারা। আর নথিপত্র ধ্বংস তো রয়েছেই। এসব কারণে অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে দুদকের মামলা দায়েরের সংখ্যা কম। তবে দুদকের মামলায় শাস্তির সংখ্যা নেহায়েত কম নয় বলে দাবি করেন জনসংযোগ কর্মকর্তা। তিনি বলেন- ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, হল-মার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভিরসহ দুর্নীতির মামলায় অনেকেই কারাগারে। তবে একটি সূত্র জানায়, দুদকের মামলায় দুর্বল চার্জশিট ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শাস্তির সংখ্যা কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বলেন, বর্তমান কমিশন কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেনি। অনুসন্ধানে যা পাওয়া যায় তার ভিত্তিতেই মামলা হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দুদক কাজ করছে যারা এমন অভিযোগ করছেন তারা না জেনেই বলছেন। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, কে সরকারি দল কে বিরোধী দল তা আমাদের কাছে মুখ্য নয়। আমরা যে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা পাবো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। ওদিকে, দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ১৬২৪টি অভিযোগের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন পেশের আগেই ১২১৫টি দুর্নীতির অভিযোগ বাতিল হয়ে যায়। ৪০৯টি অভিযোগ বাতিল করা হয় প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর। গত বছর ৩৫০টি অভিযোগ গ্রহণ করে দুদক এবং ১০৫ জনকে সম্পদের হিসাব দাখিলের নোটিশ দেয়া হয়। ২০১৩ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও দলটির সঙ্গে সংশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগসমূহ আনা হয়েছিল, সেগুলো খারিজ করে দিয়েছে কমিশন। এর মধ্যে এইচবিএম ইকবাল ছাড়াও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর দুর্নীতির দু’টি অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয় কমিশন। ২০০২ সালে অবৈধ সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ দু’টি আনা হয়েছিল। ২০১৩ সালের জুন মাসে মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে দুর্নীতির একটি অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয় দুদক। ২০০১ সালে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে জাতীয় আদমশুমারি প্রকল্পে ৯৪ কোটি টাকা অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালে কমিশন অভিযোগটি দাখিল করেছিল। ২০১৩ সালে দুদক যাদের অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিল, সে তালিকায় আরও রয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী এটিএম গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, সাবেক আইনপ্রণেতা আবদুল কাদের খান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী সচিব এম আবদুল মতিন ও চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ইফতেখার আহমেদ। অন্যদিকে কিছু রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে দুদক। এ তালিকায় রয়েছেন বিএনপির মওদুদ আহমদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার, এম মোর্শেদ খান, আলী আসগর লবি ও তার পরিবারের সদস্য, মোসাদ্দেক আলী ফালু, এহছানুল হক মিলন, একেএম মোশাররফ হোসেন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার পরিবারের সদস্যরা।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মানবজমিনকে এ বিষয়ে বলেন, হলফনামা অনুযায়ী সম্পদ বাড়ার অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে অব্যাহতি দিলে (কারও সম্পদ পাঁচ গুণ, ১০ গুণ) প্রশ্ন থেকেই যাবে। তিনি বলেন, দুর্নীতি বেড়েছে। এসব অনুসন্ধান করতে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে কমিশন। তাদের উচিত হবে একটি নীতিমালা করে যে সব বিষয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত করা।
আলোচিত পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলার ফাইল ক্লোজড: পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলায় গত ৩রা সেপ্টেম্বর দশ আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দিয়েছে দুদক। মামলার যথার্থতা না থাকা, তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য, সাক্ষী না পাওয়ায় এ মামলাটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে নথিভুক্ত করেছে কমিশন। তবে কানাডা থেকে লাভালিন কর্মকর্তা রমেশের ডায়েরি অথবা কানাডা থেকে মামলা প্রমাণের মতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত কিংবা নতুন করে দায়ের করা হবে বলে দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১২ সালের ১৭ই ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থানায় এ মামলা দায়ের করে দুদক। এ মামলায় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেইন ভূঁইয়া, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইপিসি’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা, কানাডীয় প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন। এছাড়া, মামলার এজাহারে সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। পরে সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, প্রাথমিক সত্যতা আর চূড়ান্ত সত্যতা এক নয়। পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তি ছিল পত্রিকার তথ্য ও বিশ্বব্যাংকের আশ্বাস। বিশ্বব্যাংকের আশ্বাসের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হলেও মামলা প্রমাণের জন্য দাতা সংস্থা ও কানাডা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হলো। এদিকে, দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৩ ও আগস্ট-২০১৪ পর্যন্ত প্রতিবেদন-এ বলা হয়েছে বিলুপ্ত ব্যুরোরসহ মোট ১২৩০০টি অনুসন্ধান হাতে নেয় সংস্থাটি। তিন বছরে বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন ৩৬৭২টি দুর্নীতির মামলায় শাস্তি হয়েছে মাত্র ৬৯০টিতে। এর মধ্যে দুদকের মামলা ২৩৮০টি। বিলুপ্ত ব্যুরোর ১২৯২টি। এছাড়া, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুদকের ১৫৯৮টি মামলা বিশেষ জজ আদালতে নিষ্পত্তি হয়। এরমধ্যে ৯০৮টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। সাজা হয়েছে মাত্র ৬৯০টি মামলায়। একই সময়ে স্থগিত হয়েছে ৭৫৪টি মামলা। এছাড়া, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে যাচাই-বাছাই করে ৬৯১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে দুদক। এরমধ্যে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ১৪৬টি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়। আগস্ট মাসে কমিশন ১৮টি মামলা ও ১৭টি চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে। পাশাপাশি জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৯৩টি মামলা, ৩৩৮টি চার্জশিট দাখিল ও ৩০৪টি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। এছাড়া, আগস্ট মাসে ১০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে দু’টিতে সাজা ও আটটি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে।
রুহুল হক ছাড়া আরও যেসব সাবেক মন্ত্রী-এমপিকে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে দুদক অনুসন্ধান করে তাদের মধ্যে সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, সরকারি দলের এমপি আসলামুল হক, এনামুল হক ও আবদুর রহমান বদি, বিএনপির দুই সাবেক এমপি শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও মসিউর রহমান এবং জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আবদুল জব্বার। তাদের মধ্যে আবদুল মান্নান খান, মাহবুবুর রহমান ও আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও আবদুল জব্বারের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর আসলামুল হককে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অনেকটা ঘোষণা দিয়ে দুদক এসব অনুসন্ধান শুরু করলেও দায়মুক্তি দিয়েছে অনেকটা নিভৃতে। এর আগে উচ্চ আদালতের আদেশে ২০৫টি রুল কমিশনের বিপক্ষে গেছে বলে দুদক জানিয়েছে। এতে শেখ হাসিনার ৯টি মামলা রয়েছে (২০০৯ থেকে ২০১২) সালের মধ্যে। তবে মহাজোট সরকারের আমলে কোন মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি বলে দাবি করেছে দুদক। অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে দুদকের মামলা দায়েরের সংখ্যা খুবই কম এমন প্রশ্নে দুদকের উপ-পরিচালক জনসংযোগ প্রণব কুমার মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, মামলা দায়েরের সহায়ক নথিপত্রের অপ্রাপ্যতা, অভিযোগের সত্যতা ও অনেক সময় সাক্ষী খুঁজে না পাওয়া, অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় অভিযোগকারীর সহায়তা করতে না চাওয়া, মৃত্যু মূল কারণ। এছাড়া, অনেক প্রশাসনিক কার্যালয় দাপ্তরিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নথিপত্র ধ্বংস করা। মামলার অনুসন্ধান প্রমাণে এসব আবশ্যিক। কিন্তু নথি পাওয়া যাচ্ছে না। দুদকের মামলার বেশির ভাগ সাক্ষী সরকারি কর্মকর্তা। দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলায় সাক্ষী দিতে আসেন না তারা। আর নথিপত্র ধ্বংস তো রয়েছেই। এসব কারণে অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে দুদকের মামলা দায়েরের সংখ্যা কম। তবে দুদকের মামলায় শাস্তির সংখ্যা নেহায়েত কম নয় বলে দাবি করেন জনসংযোগ কর্মকর্তা। তিনি বলেন- ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, হল-মার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভিরসহ দুর্নীতির মামলায় অনেকেই কারাগারে। তবে একটি সূত্র জানায়, দুদকের মামলায় দুর্বল চার্জশিট ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শাস্তির সংখ্যা কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বলেন, বর্তমান কমিশন কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেনি। অনুসন্ধানে যা পাওয়া যায় তার ভিত্তিতেই মামলা হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে দুদক কাজ করছে যারা এমন অভিযোগ করছেন তারা না জেনেই বলছেন। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, কে সরকারি দল কে বিরোধী দল তা আমাদের কাছে মুখ্য নয়। আমরা যে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা পাবো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। ওদিকে, দুদকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ১৬২৪টি অভিযোগের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন পেশের আগেই ১২১৫টি দুর্নীতির অভিযোগ বাতিল হয়ে যায়। ৪০৯টি অভিযোগ বাতিল করা হয় প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর। গত বছর ৩৫০টি অভিযোগ গ্রহণ করে দুদক এবং ১০৫ জনকে সম্পদের হিসাব দাখিলের নোটিশ দেয়া হয়। ২০১৩ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও দলটির সঙ্গে সংশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগসমূহ আনা হয়েছিল, সেগুলো খারিজ করে দিয়েছে কমিশন। এর মধ্যে এইচবিএম ইকবাল ছাড়াও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর দুর্নীতির দু’টি অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয় কমিশন। ২০০২ সালে অবৈধ সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ দু’টি আনা হয়েছিল। ২০১৩ সালের জুন মাসে মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে দুর্নীতির একটি অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয় দুদক। ২০০১ সালে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে জাতীয় আদমশুমারি প্রকল্পে ৯৪ কোটি টাকা অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালে কমিশন অভিযোগটি দাখিল করেছিল। ২০১৩ সালে দুদক যাদের অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিল, সে তালিকায় আরও রয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী এটিএম গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, সাবেক আইনপ্রণেতা আবদুল কাদের খান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী সচিব এম আবদুল মতিন ও চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ইফতেখার আহমেদ। অন্যদিকে কিছু রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে দুদক। এ তালিকায় রয়েছেন বিএনপির মওদুদ আহমদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার, এম মোর্শেদ খান, আলী আসগর লবি ও তার পরিবারের সদস্য, মোসাদ্দেক আলী ফালু, এহছানুল হক মিলন, একেএম মোশাররফ হোসেন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার পরিবারের সদস্যরা।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মানবজমিনকে এ বিষয়ে বলেন, হলফনামা অনুযায়ী সম্পদ বাড়ার অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে অব্যাহতি দিলে (কারও সম্পদ পাঁচ গুণ, ১০ গুণ) প্রশ্ন থেকেই যাবে। তিনি বলেন, দুর্নীতি বেড়েছে। এসব অনুসন্ধান করতে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে কমিশন। তাদের উচিত হবে একটি নীতিমালা করে যে সব বিষয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত করা।
আলোচিত পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলার ফাইল ক্লোজড: পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলায় গত ৩রা সেপ্টেম্বর দশ আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দিয়েছে দুদক। মামলার যথার্থতা না থাকা, তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য, সাক্ষী না পাওয়ায় এ মামলাটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে নথিভুক্ত করেছে কমিশন। তবে কানাডা থেকে লাভালিন কর্মকর্তা রমেশের ডায়েরি অথবা কানাডা থেকে মামলা প্রমাণের মতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত কিংবা নতুন করে দায়ের করা হবে বলে দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১২ সালের ১৭ই ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থানায় এ মামলা দায়ের করে দুদক। এ মামলায় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেইন ভূঁইয়া, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইপিসি’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা, কানাডীয় প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন। এছাড়া, মামলার এজাহারে সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। পরে সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, প্রাথমিক সত্যতা আর চূড়ান্ত সত্যতা এক নয়। পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তি ছিল পত্রিকার তথ্য ও বিশ্বব্যাংকের আশ্বাস। বিশ্বব্যাংকের আশ্বাসের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হলেও মামলা প্রমাণের জন্য দাতা সংস্থা ও কানাডা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হলো। এদিকে, দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৩ ও আগস্ট-২০১৪ পর্যন্ত প্রতিবেদন-এ বলা হয়েছে বিলুপ্ত ব্যুরোরসহ মোট ১২৩০০টি অনুসন্ধান হাতে নেয় সংস্থাটি। তিন বছরে বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন ৩৬৭২টি দুর্নীতির মামলায় শাস্তি হয়েছে মাত্র ৬৯০টিতে। এর মধ্যে দুদকের মামলা ২৩৮০টি। বিলুপ্ত ব্যুরোর ১২৯২টি। এছাড়া, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুদকের ১৫৯৮টি মামলা বিশেষ জজ আদালতে নিষ্পত্তি হয়। এরমধ্যে ৯০৮টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। সাজা হয়েছে মাত্র ৬৯০টি মামলায়। একই সময়ে স্থগিত হয়েছে ৭৫৪টি মামলা। এছাড়া, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে যাচাই-বাছাই করে ৬৯১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে দুদক। এরমধ্যে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ১৪৬টি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়। আগস্ট মাসে কমিশন ১৮টি মামলা ও ১৭টি চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে। পাশাপাশি জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৯৩টি মামলা, ৩৩৮টি চার্জশিট দাখিল ও ৩০৪টি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। এছাড়া, আগস্ট মাসে ১০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে দু’টিতে সাজা ও আটটি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে।
No comments