সংবিধান ও রাজনীতি- বিদায় লতিফ, স্বাগতম মহররম by মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক

 মহররমের আগমনী বার্তা এসে গেছে। পাঠক এই কলাম পড়ছেন বুধবার ১৫ অক্টোবর ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ, ৩০ আশ্বিন ১৪২১ বঙ্গাব্দ তথা বাংলাদেশের হিসাবে ১৯ জিলহজ ১৪৩৫ হিজরি। বাংলাদেশের হিসাবে, আর দশ বা এগারো দিন পর নতুন হিজরি বছর শুরু হবে। সৌদি আরবের হিসাব মোতাবেক, আজ বুধবার ২১ জিলহজ ১৪৩৫ হিজরি। সৌদি আরব রাষ্ট্রীয়ভাবেই, মূলত হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে এবং সম্পূরকভাবে খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। সৌদি আরব সরকার, বছরের শুরুতেই ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে, অর্থাৎ আমরা যেমন খ্রিষ্টীয় তারিখ এবং বাংলা তারিখ নির্দিষ্ট করে ক্যালেন্ডার ছাপাই, অনুরূপ তারা হিজরি এবং খ্রিষ্টীয় তারিখ নির্দিষ্ট করেই ক্যালেন্ডার ছাপায়। পবিত্র হজ সম্পাদনের প্রথম আবশ্যকীয় অপরিহার্য কর্ম হচ্ছে, মক্কা নগরীর অদূরে আরাফাতের ময়দানে ৯ জিলহজ তারিখের সূর্য উদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা। এবার সৌদি আরবের আরাফাতের ময়দানে পবিত্র হজ সম্পাদিত হয়েছে ৩ অক্টোবর। পরের দিন ৪ অক্টোবর সৌদি আরবে ঈদুল আজহা পালিত হয়। সৌদি আরবকে অনুসরণ করে বা সৌদি আরবের ক্যালেন্ডারের সাথে সমন্বয় করে পৃথিবীর আরো অনেক দেশে একই তারিখে অর্থাৎ ৪ অক্টোবর ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু আমরা আমাদের দেশে কোরবানির ঈদ পালন করেছি ৬ অক্টোবর ২০১৪। সৌদি আরব এবং আমাদের মধ্যে সচরাচর ২৪ ঘণ্টার তফাৎ হয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। এবার তফাৎ হয়েছে ৪৮ ঘণ্টা। এটা অনেকের কাছে বৈসাদৃশ্য বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা ব্যতিক্রমধর্মী বা খটকা মনে হয়েছে। বিজ্ঞানের তথা এসট্রোনোমির বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বা নভোমণ্ডলের বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে, আমাদের এ বিষয়টির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
আজ থেকে সাত-আট বছর আগে ইসলামিক টিভির তৎকালীন চেয়ারম্যান (বর্তমানে মরহুম) অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাইদ এস্কান্দর আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছিলেন একটি বিশেষ ইসলামি অনুষ্ঠান তাদের টিভিতে করার জন্য। অনুষ্ঠানটি ছিল এরূপ। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোকে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করা। তবে উপস্থাপন করতে গিয়ে দু’টি আঙ্গিক খেয়াল রাখতেই হবে। একটি হলো এই যে, কয়েকটি যুদ্ধ প্রসঙ্গে, পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে। মহানবী সা:-এর আমলের সব যুদ্ধ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদিসে উল্লেখ আছে। অতএব পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে উল্লিখিত ইশারা বা ব্যাখ্যা খেয়াল রাখতেই হবে। তার সাথে যুক্ত হবে সামরিক ব্যাখ্যা বা যুদ্ধ-বিদ্যার যে বিজ্ঞান, সেই বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা। সাইদ এস্কান্দরের মতে, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যেহেতু একজন গ্রহণযোগ্য সামরিক বিশ্লেষক এবং তিনি কষ্ট করে চেষ্টা করলে ইসলামি আঙ্গিক যুক্ত করতে পারবেন, তাই সাইদ এস্কান্দর ইবরাহিমকেই অনুরোধ করেছিলেন ওই অনুষ্ঠানমালা করতে। অতএব ১৩টি ধারাবাহিক সপ্তাহে, ১৩টি ভিন্ন পর্বে, ইসলামের ১৩টি যুদ্ধের বর্ণনা বাংলাভাষী টেলিভিশন দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি মনে করি এটি মহান আল্লাহতায়ালার প থেকে একটি বিশেষ দয়া ছিল। কারণ, মহানবী সা:-এর আমলের যুদ্ধগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে, আমাকে সবিশেষভাবে জানতে হয়েছে এবং আমার সেই ুদ্র অর্জিত জ্ঞান দেশবাসীর সাথে শেয়ার করতে পেরেছি। ক’জনের সৌভাগ্য হয় মহানবী সা:-এর যুদ্ধের নেতৃত্ব অন্যের সামনে উপস্থাপন করার। শতভাগ আদবের সাথে, শতভাগ রাসূল-প্রেমের সাথে না-ও হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু অনিচ্ছাকৃত ভুলত্র“টি নিশ্চিতভাবেই মহান আল্লাহ তায়ালা মা করতে পারেন। সেই ১৩টি টেলিভিশনের মৌখিক উপস্থাপনা, পরে লিখিতভাবে বইয়ে প্রকাশ করার মতো করে সাজানো হয়েছিল। ঢাকা মহানগরের বিখ্যাত প্রকাশক ‘অনন্যা’ ওই বইটি প্রকাশ করেছিল। বইটির নাম ‘দি ব্যাটেলস অফ ইসলাম’ (বা ইসলামের যুদ্ধগুলো)। সেই বইয়ে ১২তম অধ্যায় হচ্ছে কারবালার ময়দানের যুদ্ধ। আমি বিশদভাবে প্রোপটসহ বইটির পরিচয় দিলাম একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্মানিত পাঠককুল, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়, ইসলামের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যেন জানতে চেষ্টা করেন। যেসব ছাত্রছাত্রী স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ইসলামের ইতিহাস পড়েন বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের স্টাডিজ পড়েন বা মাদরাসায় পড়েন, শুধু তারা জানলে হবে না। ইতিহাসের উত্তরাধিকারী আমরা সবাই। কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১০ মহররম। আজ থেকে ১৯ বা ২০ দিন পর বাংলাদেশে ১০ মহররম পালিত হবে। পৃথিবীর অন্যত্র দিবসটিকে কীরূপ গুরুত্ব দেয়া হবে বা হবে না, আমি সে সম্পর্কে মন্তব্য করছি না; কিন্তু আমি কামনা করি যে, বাংলাদেশের তরুণেরা যেন কারবালার যুদ্ধকে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করেন। কারবালার যুদ্ধের তাৎপর্য অনুধাবন করেন।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে ব্রিটিশরা বাংলা-উড়িষ্যা নামক প্রদেশ বা ভূখণ্ডের ওপর ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী ১০০ বছরে তৎকালীন ভারতের বৃহদংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ তথা সিপাহি বিদ্রোহ ঘটে যাওয়ার পর লন্ডন থেকে ভারত শাসনের জন্য প্রত্য পদপে নেয়া হয়। এই সময়ে ভারতের মুসলমানেরা শিা-দীা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে পিছিয়ে পড়েছিল। রাজ-ভাষা বা সরকারি ভাষা হিসেবে মোঘল আমল থেকে পরিচিত ফার্সি ভাষার বদলে ইংরেজি ভাষা চালু হয়েছিল। এরূপ বিপজ্জনক অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের আগ্রহে তৎকালীন কলকাতা মহানগরীতে সরকারি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সাধারণভাবে এগুলোকে আলিয়া মাদরাসা বলা হতো এবং এখনো ওই ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলোকে আলিয়া মাদরাসা বলা হয় যেমন, ঢাকা মহানগরের বকশিবাজারে অবস্থিত ঢাকা আলিয়া মাদরাসা বা চট্টগ্রাম মহানগরে অবস্থিত আলিয়া মাদরাসা। ওই আলিয়া মাদরাসাগুলোতে ধর্মীয় শিার পাশাপাশি সাধারণ শিার কিছু অংশ সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকত এবং আছে। এরূপ প্রোপটে অন্য কিছু ধর্মীয় নেতা, শুধু ধর্মীয় শিা অনুসরণ ও আহরণের ল্েয ভিন্নমাত্রার মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এখন থেকে দেড়শো-পৌনে দুই শ’ বছর আগে। এই ভিন্নমাত্রার মাদরাসার মধ্যে প্রথম এবং প্রধানতম মাদরাসাটির নাম দারুল উলুম দেওবন্দ। দেওবন্দ নামক জায়গাটি বর্তমান ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত। এই দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার ধারায় বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো পরিচালিত। আলিয়া মাদরাসা ও কওমি মাদরাসা থেকে শিতি আলেমদের মধ্যে তো বটেই, আলেমদের অনুসারীদের চিন্তা-চেতনার মধ্যে বিস্তর দূরত্ব আছে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিকে। কওমি মাদরাসার ধারাকে সাধারণত কওমি ধারা বা খারেজি ধারা বলা হয় বা ওহাবি ধারা বলা হয়। এই বিভাজনটি মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র বিভাজন নয়। মাজহাব মোতাবেক পৃথিবীতে মুসলমানেরা মোটামুটি চারটি মাজহাবে বিভক্ত। যথাÑ হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি; যদিও বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান হানাফি মাজহাবের অনুসারী। অর্থাৎ তারা ইমাম আবু হানিফা রহ: কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যাগুলোকে অনুসরণ করেন। যাই হোক না কেন এবং যত ধরনের বিভাজনই থাকুক না কেন, ঈমান ও দ্বীন ইসলামের স্তম্ভগুলো অনুসরণে কোনো বড় রকমের পার্থক্য নেই। যথাÑ পাঁচটি স্তম্ভের চতুর্থটি হলো হজ। যেসব মুসলমানের আর্থিক সঙ্গতিতে কুলাবে এবং শারীরিক সমতায় কুলাবে, তাদের জীবনে একবার অবশ্যই পবিত্র হজ সম্পাদন করতে হবে। এই হজ এবং হজের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কোনো দ্বিমত কোনো মাজহাব বা গোষ্ঠী বা মতবাদীদের মধ্যে নেই। দ্বীন ইসলামে হজ নামে ফরজ কাজটি, সব ধর্মের তুলনামূলক প্রসঙ্গে, একটি ব্যতিক্রমধর্মী মানবতাবাদী কর্ম। মহান আল্লাহ তায়ালা কেন এটি ফরজ করেছিলেন, তার হুবহু কারণ আমাদের ব্যাখ্যার জন্য অপোয় নেই। আমরা এই মহান কাজের উপকারিতা পাচ্ছি।
আঠারো-বিশ মাস আগে হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে ওঠা শাহবাগ বা গণজাগরণ মঞ্চ এবং এর মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমান-আকিদার ওপর আক্রমণ প্রসঙ্গে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখেছি। ১৮ মার্চ ২০১৩ দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় লেখা কলামের শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সভ্যতার সঙ্কট’! বাংলাদেশের বিদ্যমান তরুণসমাজের একটি অংশ কী নিয়মে ধীরে ধীরে ধর্মবিরোধিতায় নেমেছে বা নাস্তিকতার পথে পা দিয়েছে ইত্যাদি বিষয় আমি আলোচনা করেছিলাম। অতি সম্প্রতি আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মতো একজন দায়িত্বশীল (অথবা আপাতদৃষ্টিতে দায়িত্বশীল) আওয়ামী রাজনীতিবিদ যে বক্তব্য দিয়েছেন, এটাকে যদি আমরা নমুনা মনে করি, তাহলে আমাদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে আর কারা কারা লুক্কায়িত অবস্থায় আছে। অতএব আজকে সময় এসেছে বাংলাদেশের সচেতন জনগণের (যাদের মনে ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা কাজ করে), তাদের সবার একটি সমন্বিত চিন্তার মঞ্চে একত্র হওয়ার।
বাকস্বাধীনতার নামে দ্বীন ইসলামের মূলনীতি সম্পর্কে এবং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষদের প্রধানতম ব্যক্তিত্ব হজরত মোহাম্মদ সা:কে নিয়ে কটুবাক্য করার রেওয়াজ বন্ধ করতে হবে। এই আন্দোলনের বা এই প্রচেষ্টায় আলেমসমাজ অগ্রণী ভূমিকা নেবেন, এটাই আমাদের কামনা। আমি আশা করি, আলেমসমাজের মধ্যে বিভিন্ন কারণে যে মতপার্থক্য আছে সেটাকে স্বাভাবিক মনে করে মেনে নিয়েই, এই একটি ইস্যুতে নিজ নিজ মঞ্চ থেকেই আন্দোলনে শরিক হওয়া যায় বা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায় বা জনগণের কাছে আবেদন রাখা যায়। বিভিন্ন সম্মানিত পীর-মাশায়েখের সম্মানিত মুরিদরা মহানবী সা:কে ভালোবাসেন। বারো আউলিয়ার দেশ খ্যাত চট্টগ্রামে বা ৩৬০ আউলিয়ার দেশ খ্যাত সিলেটে লাখ লাখ লোক মাজারভক্ত। খুলনা, রাজশাহী, রংপুর এবং ঢাকা মহানগরেও অতীতের আল্লাহর আউলিয়াদের মাজার আছে। মাজারভক্ত লাখ লাখ জনগণের মনে যে রাসূল-প্রেমের শিখা জ্বলন্ত, তা বলার অপো রাখে না। অতএব আমি (একজন সাধারণ শিার মাধ্যমে শিতি ব্যক্তি হলেও) মনে করি, ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনাকে বে ধারণ করতেই হবে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ধারণ করি; কিন্তু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি যে, মুক্তিযুদ্ধ ও দ্বীন ইসলাম পরস্পরবিরোধী। অতএব, চিন্তার জগতে পথভ্রষ্ট তরুণসমাজকে সঠিক ও সৎপথে ফেরত আনার জন্য চেষ্টা করতেই হবে এবং পথভ্রষ্টদের মধ্যে যারা আগ্রাসী তাদের প্রতিরোধ করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। এই কাজ করতে গিয়ে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের চেতনা এবং দ্বীন ইসলামের মূল্যবোধের চেতনাকে এবং নেতৃস্থানীয় আলেম-ওলামাদের মধ্যে মতের পার্থক্যকে এলোমেলোভাবে মিশিয়ে ফেলা সমীচীন হবে না।
দ্বীন ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ধর্ম এবং জীবন পরিচালনার পদ্ধতি। দ্বীন ইসলামের মূল নীতির অলঙ্ঘনীয়, প্রশ্নের অতীত রেকর্ড হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী, পবিত্র কুরআন। এই পবিত্র কুরআনে বিধৃত কোনো নির্দেশকে মানুষ পরিবর্তন করার অধিকার রাখে না। এ প্রসঙ্গে, এই কলামের সব সম্মানিত পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি পবিত্র কুরআনের পঞ্চম সূরার (সূরা মাইদাহ) ৪৪ নম্বর আয়াতে।
হজরত ইমাম মুহাম্মদ আহমদ রেযা খান বেরলভী রহ: কর্তৃক পেশকৃত পবিত্র কুরআনের অনুবাদ যার নাম কান্যুল ঈমান এবং হাকীমুল উম্মত আল্লামা মুফ্তি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহ: কর্তৃক পেশকৃত তাফসির দুই খণ্ডে বাঁধাইকৃত মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান কর্তৃক পেশ করা বঙ্গানুবাদের প্রথম খণ্ড প্রকাশকাল ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৪ দ্রষ্টব্য। আরেকটি বিখ্যাত কুরআনের অনুবাদ ও তাফসির গ্রন্থের নাম ‘তাফসীর মাআরেফুল কুরআন’। এটি পেশ করেছেন হজরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শাফী রহ:। বাংলাদেশের মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এই তফসিরের সংপ্তি বাংলা অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন এবং ১৪৯০ পৃষ্ঠার একটি খণ্ডে বাঁধাই করে প্রথম প্রকাশ করা হয়েছে সৌদি আরবের মাহামান্য শাসক খাদেমুল-হারামাইনিশ্ শরিফাইন বাদশাহ ফাহদ ইবনে আবদুল আজীজের নির্দেশে ও পৃষ্ঠপোষকতায়। এই অনুবাদকৃত প্রকাশনার নাম পবিত্র কুরআনুল করীম (বাংলা অনুবাদ ও সংপ্তি তফসির)। এখানে সূরা মাইদাহর ৪৪ নম্বর আয়াতের বঙ্গানুবাদ এরূপ করা হয়েছে : ‘আমি তওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। আল্লাহর আজ্ঞাবহ পয়গম্বর, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ইহুদিদের ফয়সালা দিতেন। কেননা, তাদের এ খোদায়ী গ্রন্থের দেখাশোনা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং তারা এর রণাবেণে নিযুক্ত ছিলেন। অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না এবং আমাকে ভয় করো এবং আমার আয়াতগুলোর বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই কাফের।’
উপরে উল্লিখিত দু’টি অনুবাদ ও সংপ্তি তাফসির গ্রন্থ ছাড়াও আমি পবিত্র কুরআনের আরো দু-একটি অনুবাদ গ্রন্থ বা তাফসির গ্রন্থ ঘেঁটেছি আলোচ্য সূরা মাইদাহর ৪৪ নম্বর আয়াতের তাৎপর্য প্রসঙ্গে। শুধু একটি অনুবাদ থেকে অর্থ উপরে উদ্ধৃত করেছি। এই একটি আয়াতেই অন্তত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব (থিউরি) আছে। উদাহরণস্বরূপ আমি চারটি উল্লেখ করছি। প্রথমত, খোদায়ী গ্রন্থের দেখাশোনা করার ও রণাবেণের দায়িত্বের প্রসঙ্গ আছে; এই প্রসঙ্গটি আজ ২০১৪ সালেও প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, মানুষকে ভয় না করার জন্য বলা হয়েছে বরং আল্লাহকে ভয় করার জন্য বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, আল্লাহ তায়ালার প থেকে নাজিল করা নির্দেশ মোতাবেক যারা দুনিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে ফয়সালা করে না, তারাই কাফের। চতুর্থ, আল্লাহর আজ্ঞাবহ পয়গম্বর এখন আর নেই কিন্তু আল্লাহর আজ্ঞাবহ দরবেশ ও আলেমগণ (জ্ঞানী ব্যক্তিগণ) এখনো পৃথিবীতে আছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন; তাদের দায়িত্ব বিদ্যমান খোদায়ী গ্রন্থের আলোকে ফয়সালা দেয়া।
আমি নিজে হাটহাজারীর সন্তান। আমি বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি জন্মদিন থেকেই যেই স্লোগান প্রচার করছে সেটি হলোÑ (ইংরেজি ভাষায়) পলিটিক্স ফর চেইঞ্জ অথবা (বাংলা ভাষায়) পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি। আমার কণ্ঠ ছোট, আমার দলের কণ্ঠ ছোট। আমাদের দলের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি সর্বসাকল্যে ২২টি জেলায় এবং ১০০টি উপজেলায়। আমরা জোটনেত্রীর আহ্বানে আন্দোলনে এবং সব পদেেপ জড়িত। আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন চাই। সেই পরিবর্তনের মানদণ্ড কী? আমার উত্তর হচ্ছে, মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টি করা মানবজাতির জন্য যেসব বিধান মঙ্গলজনক মনে করেছেন, সেই বিধানগুলোকে আমরা অনুসরণ করতে হবে। যুগের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে, করতালির আওয়াজে গা ভাসিয়ে, তথাকথিতভাবে উন্নত বিশ্বের আহ্বানে গা ভাসিয়ে এমন কোনো পরিবর্তন আমরা সমর্থন করি না, যা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের লালনকর্তা ও পালনকর্তার নির্দেশের পরিপন্থী এবং এইরূপ নির্দেশের মধ্যে একটি নির্দেশ হচ্ছে মানুষের জান ও মালকে সম্মান করা এবং হেফাজত করা। আরেকটি নির্দেশ হচ্ছে প্রত্যেককে তার নিজের ধর্ম অনুসরণ ও পালন করার জন্য পরিবেশ ও সহায়তা প্রদান করা; কেউ কাউকে আক্রমণ না করে। আলেম-ওলামারা এবং সাধারণ দ্বীনদার মুসলমানরা, খেটে খাওয়া সর্বস্তরের মানুষ সবার ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ২০১৪ সালের শেষাংশে, রাজনৈতিক আন্দোলনের ব্যস্ততায়, এই কথাগুলো ভুলে গেলে চলবে না। যদি ভুলে যাই তাহলে মানুষের কল্যাণ সম্ভব হবে না এবং রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না।
সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে সৃষ্ট ঘটনাবলি এবং আপাতদৃষ্টিতে তার সমাধানের প্রসঙ্গে পাঠককুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কারণ বাংলাদেশে এমন আইন আছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অশোভনভাবে সমালোচনা করলে তার সাত বছর জেল হবে, বাস্তবে একজন ব্যক্তির হয়েছেও। অপর পে বাংলাদেশের এই মুহূর্তে বিদ্যমান আইন মোতাবেক মহানবী সা: এবং পবিত্র হজের অশোভন সমালোচনার মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর মনে আঘাত দেয়ার কারণে, অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছর জেল। তাই বলছিলাম, আইনটিকে যুগোপযোগীভাবে সংশোধন করে, অতঃপর দ্রুতগতিতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিচার হওয়া প্রয়োজন। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী একা নন, তার মতো হাজারো লতিফ সিদ্দিকী সমাজে ঘাপটি মেরে আছেন। পত্রিকার পৃষ্ঠা উল্টালেই, অনৈতিক কাজের অশোভন কাজের সংবাদে মাথা ঘুরে যায়, হৃদয় ফেটে যায়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছেলেমেয়েরা ঢাকা মহানগরে শত শত ঘরে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকছে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে। অথচ তারা স্বামী-স্ত্রী নয়। পাশ্চাত্যের ভাষায় এটার নাম ‘লিভিং টুগেদার’ বা লিভ টুগেদার অর্থাৎ একসাথে বাস করা। চার-পাঁচ দিন আগে উত্তরায় যুবায়ের নামে এক কিশোর নিহত হয়েছে একজন বিকৃত রুচির বিদেশীর যৌন লালসার শিকার হয়ে। ইসলাম ধর্মের মূলনীতিগুলো এবং মূল শিাগুলোকে উদারভাবে সহজভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করা প্রয়োজন এবং যারা বিকৃতভাবে করবে তাদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। আমি মনে করি, মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় দেয়া কোনো শাস্তি নয়। এটি একটি প্রশাসনিক পদপে। আমি মনে করি, প্রচলিত আইনে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিচার হওয়া অতি আবশ্যক। আমি আরো মনে করি যে, সেই প্রচলিত আইনটি জরুরি ভিত্তিতে সংশোধন করে যুগের উপযোগী করতে হবে। যারা মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রদত্ত মূলনীতির বিরোধিতা করে, তাদের কর্মকে বলা যায় সৃষ্টিকর্তার প্রতি চ্যালেঞ্জ। যারা মহান সৃষ্টিকর্তাকে চ্যালেঞ্জ করেন তাদের বিদায় কোনো দিনই সম্মানজনক হয়নি। চ্যালেঞ্জকারীরা যদি রাজা হন বা রাজার পারিষদ হন, তাহলে তাদের বিদায় রাজকীয় হয়; চ্যালেঞ্জকারীরা যদি মুখে মুখে ঈমান রাখেন এবং অন্তরে চ্যালেঞ্জকারী হন তাদের বিদায় অধিকতর মর্মান্তিক হয়। আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিদায় এখনো হয়নি, প্রক্রিয়া মাত্র শুরু হয়েছে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

No comments

Powered by Blogger.