বিধানসভা নির্বাচন- মহারাষ্ট্র-হরিয়ানা মোদি-শাহ জুটির ললাটলিখন by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের মতো মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনও শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াল নরেন্দ্র মোদি বনাম অবশিষ্টের লড়াই। লোকসভা ভোটে অন্যদের পর্যুদস্ত করে মোদি শেষ হাসিটি হেসেছিলেন। ১৯ অক্টোবর ফলাফল গণনার পর তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না, তা দেখতে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার জনতার সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। লোকসভা ভোটের তুলনায় ১৫ অক্টোবরের দুই রাজ্যের বিধানসভা ভোটের গুণগত কিছু পার্থক্য অবশ্য আছে। সেবারের ভোটে বিজেপি ছিল এনডিএ জোটের নেতা। জোটবদ্ধ হয়ে তারা লড়লেও কার্যত দেখা যায়, জনতা পুরোপুরি মোদির নেতৃত্বকে বরণ করে নিয়েছে। ২০ বছর ধরে দিল্লি দখলের লড়াইয়ে যা দেখা যায়নি, সেবার তা-ই ঘটে যায়। জোটবদ্ধ হয়ে লড়লেও একা বিজেপিই পায় নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা। মোদি হয়ে যান দেশের প্রধান ‘আইকন’।
বিধানসভা ভোটে ছবিটা বদলে গেল। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপি তার এত দিনের সঙ্গীদের হেলায় ছেড়ে দিয়ে মোদির কাঁধে চেপে একার ক্ষমতায় রাজ্য দখলের বাজিটা খেলে ফেলেছে। মহারাষ্ট্রে তারা ত্যাগ করল সিকি শতকের বিশ্বস্ত ‘স্বাভাবিক মিত্র’ শিবসেনাকে। হরিয়ানায় তারা টোকা-মেরে-পোকা-সরানোর ঢঙে ছেঁটে দিল তিন বছরের জোটসঙ্গী হরিয়ানা জনহিত কংগ্রেসকে। ফলে হলো কী, দুটি রাজ্যেই ভোট হচ্ছে পঞ্চমুখী। শিকে শেষ পর্যন্ত কার ভাগ্যে ছিঁড়বে, জল্পনা আপাতত তা নিয়েই।
লোকসভা ভোটের সময় যেসব সংস্থা নির্বাচনী সমীক্ষা বা জরিপ চালিয়েছিল, তাদেরই কেউ কেউ এবার এই দুই রাজ্যের সম্ভাব্য ফলের একটা আভাস দিয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, দুই রাজ্যেই একক গরিষ্ঠ দল হিসেবে উঠে আসবে বিজেপি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একার ক্ষমতায় বিজেপি হয়তো কোনো রাজ্যেই (মহারাষ্ট্রে কানের পাশ দিয়ে তির বেরোলেও বেরোতে পারে) সরকার গড়তে পারবে না। অন্যভাবে বলতে গেলে, বিজেপিই হবে সরকার গড়ার প্রধান দাবিদার; তবে সে জন্য তাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্য থেকে কাউকে না কাউকে বেছে নিতে হবে। তেমন হলে বিজেপির পক্ষে সেটাই কিন্তু প্রবল জয় বলে গণ্য হবে এবং প্রমাণিত হবে, উপনির্বাচনগুলোয় বিশেষ ভালো না করলেও শেষ বিচারে মোদির ভাবমূর্তি এখনো অম্লান। বোঝা যাবে, অমিত শাহর সাংগঠনিক শক্তির ওপর আস্থা রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে বিরাট ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না।
এটা ঠিক যে এই দুই রাজ্যেই গত লোকসভা ভোটে জোটবদ্ধ বিজেপি সব প্রতিরোধ ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক যে এই দুই রাজ্যে বিজেপি কখনো সেই অর্থে জোটের নেতৃত্ব দেয়নি। মহারাষ্ট্রে নিতিন গড়কড়ি ও গোপীনাথ মুন্ডের মতো নেতা থাকা সত্ত্বেও জোটের রাশ ছিল শিবসেনার হাতে। শিবসেনার তুলনায় বিজেপি বেশি আসন জিতেছিল ঠিকই, কিন্তু সাংগঠনিক শক্তি বেশি ছিল শিবসেনারই। তা ছাড়া শিবসেনার নেতৃত্ব ছিল বালাসাহেব ঠাকরের মতো এক অবিসংবাদিত নেতার হাতে। হরিয়ানাতেও জনহিত কংগ্রেস নেতা কুলদীপ বিষ্ণোইয়ের আবেদন ছিল বেশি। অথচ মোদির নামে ভোট হওয়ায় মোদির নাম-মাহাত্ম্যই বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীদের শেষ পর্যন্ত তরিয়ে দেয়। এই সাফল্যই মোদি-শাহ জুটিকে সাহসী করে তোলে। তাঁদের ধারণায়, দলের ডানা মেলার এটাই সেরা সময়। এখনো মোদি-হাওয়ার রেশ মেলায়নি। ঝুঁকি এখন না নিলে আর কোনো দিনই নেওয়া যাবে না, বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে। শিবসেনাকে চাপে না রাখলে শিবসৈনিকেরাই ছড়ি ঘোরাবে। বড় তরফ হয়েও ছোট তরফকে জি হুজুর, জি আজ্ঞে করে চলতে হবে। সেখান থেকে ঝটকা মেরে বেরিয়ে আসা দরকার ছিল বিজেপির। মোদি-শাহ জুটি দলের প্রবীণদের (আদভানি ও যোশি) আরজিতে কান না দিয়ে জোট ভেঙে নিজেরাই নিজেদের চ্যালেঞ্জ জানালেন।
চ্যালেঞ্জটা অবশ্যই বিরাট। কারণ, গোপীনাথ মুন্ডের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে মহারাষ্ট্রে বিজেপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো আর কেউ থাকলেন না। হরিয়ানাতে আগেও কেউ ছিলেন না, এখনো নেই। তুলনায় বিজেপির বিরুদ্ধ দলগুলোর প্রতিটিতেই মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদারেরা চিহ্নিত। যেমন কংগ্রেস। ঘোষিত না হলেও গোটা রাজ্য জানে, কংগ্রেস জিতলে তার মুখ্যমন্ত্রী হবেন পৃথ্বীরাজ চৌহানই। শিবসেনার প্রধান উদ্ধব ঠাকরে নিজেই নিজেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। বিজেপির সঙ্গে তাঁদের মনোমালিন্যের অন্যতম কারণও এই। এনসিপি দলে শারদ পাওয়ার ছাড়াও রয়েছেন তাঁর ভাইপো অজিত পাওয়ার। মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা ক্ষমতা পেলে রাজ ঠাকরেই যে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তাও সবারই জানা। হরিয়ানাতেও একই ছবি। কংগ্রেসের প্রচারে সোনিয়া-রাহুল এলেও রাজ্যবাসী জানে, জিতলে ভূপিন্দর সিং হুডাই আবার হবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ভারতীয় জাতীয় লোক দলের নেতা ওমপ্রকাশ চৌটালা অনেক দিন হলো সপুত্র তিহারে বন্দী। রাজ্যে ক্ষমতাসীন থাকাকালে একটি দুর্নীতির মামলায় অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন তাঁরা দুজনেই। অসুস্থতার কারণে প্যারোলে মুক্ত হয়ে ওমপ্রকাশ চৌটালা চুটিয়ে প্রচার করলেন। এ নিয়ে হইহই হতে শেষ পর্যন্ত ফের তাঁকে তিহার জেলে যেতে হয়েছে। যদিও বারবার তিনি বলেছেন, ভোটে জিতে তিহারে বসেই তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেবেন। কুলদীপ বিষ্ণোইয়ের সঙ্গে বিজেপির খটাখটিও যে লেগেছিল, তা ওই মুখ্যমন্ত্রীর পদকে ঘিরেই। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে একমাত্র অনিশ্চিত বিজেপি। বিজেপির এই কমজোরিতাই অন্য সব দলের আক্রমণের লক্ষ্য। কিন্তু বিজেপিও জানে, তাদের তুরুপের তাস নরেন্দ্র মোদি। রাজ্যস্তরের নেতা না থাকার অভাব মোদিকে খাড়া করেই তারা পুষিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। মোদি তাই এই দুই রাজ্য চষে ফেললেন। ৩০টির বেশি জনসভা করে ভোট চেয়েছেন নিজের নামে।
এই বিরাট ঝুঁকি নিয়ে মোদি-শাহ জুটি কি ঠিক করেছেন? প্রশ্নটা এখনো বিজেপিকে দুলিয়ে রেখেছে। ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে যে যুক্তিটা মোদি-শাহ জুটি দিয়েছেন, তা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। মোদি-হাওয়ায় মহারাষ্ট্রে ৪৮টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ২৩টি, শিবসেনা ১৮টি। তবে কেন শিবসেনার নেতৃত্বে বিজেপি ময়দানে নামবে? কেন নিজের শক্তি কতখানি, তা পরখ করবে না? হরিয়ানাতেও ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে লোকসভা ভোটে বিজেপি এগিয়ে ছিল ৫২টিতে। তবে কেন কুলদীপ বিষ্ণোইয়ের পেছন পেছন ঘুরবে তারা? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মোক্ষম মুহূর্ত এটাই। কারণ, মোদি-শাহ জুটি মনে করে, এর চেয়ে ভালো সময় আর হতে পারে না। মোদি-ম্যাজিক এখনো অটুট। লোহা এখনো গনগনে গরম। ঘা দেওয়ার প্রকৃত সময় এটাই। নানান সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে মোদি এখনো সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা রয়ে গেছেন। বিদেশিরা তাঁকে মাথায় তুলে নাচছে। অতএব, শক্তি যাচাইয়ের এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ।
তবু শেষ বিচারে বলতেই হবে, ভারতীয় ভোটারদের চরিত্র নির্ভুল বোঝা কারও কর্ম নয়। লোকসভা ও বিধানসভার ভোটের চরিত্রও সম্পূর্ণ আলাদা। লোকসভা ভোটের পরপরই তিন দফার উপনির্বাচনে মোদি-শাহ জুটির প্রায় ভরাডুবি আমরা লক্ষ করেছি। দেখেছি, কীভাবে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি। দেখেছি, যে জনতা জাতপাত ভুলে লোকসভায় মোদিকে কোল পেতে দিয়েছে, সেই জনতাই উপনির্বাচনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হরিয়ানার ভোট বরাবরই জাট বনাম অন্য জাতের লড়াই হয়ে এসেছে। এই রাজ্যে বিজেপি কখনো জাটদের দল ছিল না। চৌটালার জাট ভোট কতটা ভাঙাতে তারা পারবে, তার ওপরেই ঝুলে থাকছে বিজেপির ভোটভাগ্য। মহারাষ্ট্রেও বহু বিভক্ত ভোটের কতটা মোদির নামে বিজেপিতে আসে, তার ওপর নির্ভর করছে সেই রাজ্যে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রিত্ব আদায় করতে পারে কি না।
জরিপ ঠিক আভাস দিলে জোট-ভাঙা বিজেপিকে এই দুই রাজ্যে আবার প্রকৃত জোটসঙ্গীর খোঁজে নামতে হতে পারে। একদিকে সেটা যদি হয় মোদি-শাহ জুটির কাছে কিল খেয়ে কিল হজম করার মতো, অন্যদিকে একক গরিষ্ঠ দল হিসেবে মুখ্যমন্ত্রিত্ব লাভ হবে এই জুটির পাগড়ির নতুন পালক। দলীয় প্রাধান্য বিস্তারে ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। ঝুঁকি তো সাহসীরাই নেয়। কিন্তু ওলট-পালট হয়ে গেলে বিজেপি সভাপতি হিসেবে অমিত শাহকে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদির একচ্ছত্র শাসন চাপে পড়ে যাবে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
বিধানসভা ভোটে ছবিটা বদলে গেল। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপি তার এত দিনের সঙ্গীদের হেলায় ছেড়ে দিয়ে মোদির কাঁধে চেপে একার ক্ষমতায় রাজ্য দখলের বাজিটা খেলে ফেলেছে। মহারাষ্ট্রে তারা ত্যাগ করল সিকি শতকের বিশ্বস্ত ‘স্বাভাবিক মিত্র’ শিবসেনাকে। হরিয়ানায় তারা টোকা-মেরে-পোকা-সরানোর ঢঙে ছেঁটে দিল তিন বছরের জোটসঙ্গী হরিয়ানা জনহিত কংগ্রেসকে। ফলে হলো কী, দুটি রাজ্যেই ভোট হচ্ছে পঞ্চমুখী। শিকে শেষ পর্যন্ত কার ভাগ্যে ছিঁড়বে, জল্পনা আপাতত তা নিয়েই।
লোকসভা ভোটের সময় যেসব সংস্থা নির্বাচনী সমীক্ষা বা জরিপ চালিয়েছিল, তাদেরই কেউ কেউ এবার এই দুই রাজ্যের সম্ভাব্য ফলের একটা আভাস দিয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, দুই রাজ্যেই একক গরিষ্ঠ দল হিসেবে উঠে আসবে বিজেপি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একার ক্ষমতায় বিজেপি হয়তো কোনো রাজ্যেই (মহারাষ্ট্রে কানের পাশ দিয়ে তির বেরোলেও বেরোতে পারে) সরকার গড়তে পারবে না। অন্যভাবে বলতে গেলে, বিজেপিই হবে সরকার গড়ার প্রধান দাবিদার; তবে সে জন্য তাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্য থেকে কাউকে না কাউকে বেছে নিতে হবে। তেমন হলে বিজেপির পক্ষে সেটাই কিন্তু প্রবল জয় বলে গণ্য হবে এবং প্রমাণিত হবে, উপনির্বাচনগুলোয় বিশেষ ভালো না করলেও শেষ বিচারে মোদির ভাবমূর্তি এখনো অম্লান। বোঝা যাবে, অমিত শাহর সাংগঠনিক শক্তির ওপর আস্থা রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে বিরাট ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না।
এটা ঠিক যে এই দুই রাজ্যেই গত লোকসভা ভোটে জোটবদ্ধ বিজেপি সব প্রতিরোধ ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক যে এই দুই রাজ্যে বিজেপি কখনো সেই অর্থে জোটের নেতৃত্ব দেয়নি। মহারাষ্ট্রে নিতিন গড়কড়ি ও গোপীনাথ মুন্ডের মতো নেতা থাকা সত্ত্বেও জোটের রাশ ছিল শিবসেনার হাতে। শিবসেনার তুলনায় বিজেপি বেশি আসন জিতেছিল ঠিকই, কিন্তু সাংগঠনিক শক্তি বেশি ছিল শিবসেনারই। তা ছাড়া শিবসেনার নেতৃত্ব ছিল বালাসাহেব ঠাকরের মতো এক অবিসংবাদিত নেতার হাতে। হরিয়ানাতেও জনহিত কংগ্রেস নেতা কুলদীপ বিষ্ণোইয়ের আবেদন ছিল বেশি। অথচ মোদির নামে ভোট হওয়ায় মোদির নাম-মাহাত্ম্যই বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীদের শেষ পর্যন্ত তরিয়ে দেয়। এই সাফল্যই মোদি-শাহ জুটিকে সাহসী করে তোলে। তাঁদের ধারণায়, দলের ডানা মেলার এটাই সেরা সময়। এখনো মোদি-হাওয়ার রেশ মেলায়নি। ঝুঁকি এখন না নিলে আর কোনো দিনই নেওয়া যাবে না, বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে। শিবসেনাকে চাপে না রাখলে শিবসৈনিকেরাই ছড়ি ঘোরাবে। বড় তরফ হয়েও ছোট তরফকে জি হুজুর, জি আজ্ঞে করে চলতে হবে। সেখান থেকে ঝটকা মেরে বেরিয়ে আসা দরকার ছিল বিজেপির। মোদি-শাহ জুটি দলের প্রবীণদের (আদভানি ও যোশি) আরজিতে কান না দিয়ে জোট ভেঙে নিজেরাই নিজেদের চ্যালেঞ্জ জানালেন।
চ্যালেঞ্জটা অবশ্যই বিরাট। কারণ, গোপীনাথ মুন্ডের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে মহারাষ্ট্রে বিজেপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো আর কেউ থাকলেন না। হরিয়ানাতে আগেও কেউ ছিলেন না, এখনো নেই। তুলনায় বিজেপির বিরুদ্ধ দলগুলোর প্রতিটিতেই মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদারেরা চিহ্নিত। যেমন কংগ্রেস। ঘোষিত না হলেও গোটা রাজ্য জানে, কংগ্রেস জিতলে তার মুখ্যমন্ত্রী হবেন পৃথ্বীরাজ চৌহানই। শিবসেনার প্রধান উদ্ধব ঠাকরে নিজেই নিজেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। বিজেপির সঙ্গে তাঁদের মনোমালিন্যের অন্যতম কারণও এই। এনসিপি দলে শারদ পাওয়ার ছাড়াও রয়েছেন তাঁর ভাইপো অজিত পাওয়ার। মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা ক্ষমতা পেলে রাজ ঠাকরেই যে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তাও সবারই জানা। হরিয়ানাতেও একই ছবি। কংগ্রেসের প্রচারে সোনিয়া-রাহুল এলেও রাজ্যবাসী জানে, জিতলে ভূপিন্দর সিং হুডাই আবার হবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ভারতীয় জাতীয় লোক দলের নেতা ওমপ্রকাশ চৌটালা অনেক দিন হলো সপুত্র তিহারে বন্দী। রাজ্যে ক্ষমতাসীন থাকাকালে একটি দুর্নীতির মামলায় অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন তাঁরা দুজনেই। অসুস্থতার কারণে প্যারোলে মুক্ত হয়ে ওমপ্রকাশ চৌটালা চুটিয়ে প্রচার করলেন। এ নিয়ে হইহই হতে শেষ পর্যন্ত ফের তাঁকে তিহার জেলে যেতে হয়েছে। যদিও বারবার তিনি বলেছেন, ভোটে জিতে তিহারে বসেই তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেবেন। কুলদীপ বিষ্ণোইয়ের সঙ্গে বিজেপির খটাখটিও যে লেগেছিল, তা ওই মুখ্যমন্ত্রীর পদকে ঘিরেই। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে একমাত্র অনিশ্চিত বিজেপি। বিজেপির এই কমজোরিতাই অন্য সব দলের আক্রমণের লক্ষ্য। কিন্তু বিজেপিও জানে, তাদের তুরুপের তাস নরেন্দ্র মোদি। রাজ্যস্তরের নেতা না থাকার অভাব মোদিকে খাড়া করেই তারা পুষিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। মোদি তাই এই দুই রাজ্য চষে ফেললেন। ৩০টির বেশি জনসভা করে ভোট চেয়েছেন নিজের নামে।
এই বিরাট ঝুঁকি নিয়ে মোদি-শাহ জুটি কি ঠিক করেছেন? প্রশ্নটা এখনো বিজেপিকে দুলিয়ে রেখেছে। ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে যে যুক্তিটা মোদি-শাহ জুটি দিয়েছেন, তা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। মোদি-হাওয়ায় মহারাষ্ট্রে ৪৮টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ২৩টি, শিবসেনা ১৮টি। তবে কেন শিবসেনার নেতৃত্বে বিজেপি ময়দানে নামবে? কেন নিজের শক্তি কতখানি, তা পরখ করবে না? হরিয়ানাতেও ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে লোকসভা ভোটে বিজেপি এগিয়ে ছিল ৫২টিতে। তবে কেন কুলদীপ বিষ্ণোইয়ের পেছন পেছন ঘুরবে তারা? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মোক্ষম মুহূর্ত এটাই। কারণ, মোদি-শাহ জুটি মনে করে, এর চেয়ে ভালো সময় আর হতে পারে না। মোদি-ম্যাজিক এখনো অটুট। লোহা এখনো গনগনে গরম। ঘা দেওয়ার প্রকৃত সময় এটাই। নানান সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে মোদি এখনো সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা রয়ে গেছেন। বিদেশিরা তাঁকে মাথায় তুলে নাচছে। অতএব, শক্তি যাচাইয়ের এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ।
তবু শেষ বিচারে বলতেই হবে, ভারতীয় ভোটারদের চরিত্র নির্ভুল বোঝা কারও কর্ম নয়। লোকসভা ও বিধানসভার ভোটের চরিত্রও সম্পূর্ণ আলাদা। লোকসভা ভোটের পরপরই তিন দফার উপনির্বাচনে মোদি-শাহ জুটির প্রায় ভরাডুবি আমরা লক্ষ করেছি। দেখেছি, কীভাবে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টি। দেখেছি, যে জনতা জাতপাত ভুলে লোকসভায় মোদিকে কোল পেতে দিয়েছে, সেই জনতাই উপনির্বাচনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হরিয়ানার ভোট বরাবরই জাট বনাম অন্য জাতের লড়াই হয়ে এসেছে। এই রাজ্যে বিজেপি কখনো জাটদের দল ছিল না। চৌটালার জাট ভোট কতটা ভাঙাতে তারা পারবে, তার ওপরেই ঝুলে থাকছে বিজেপির ভোটভাগ্য। মহারাষ্ট্রেও বহু বিভক্ত ভোটের কতটা মোদির নামে বিজেপিতে আসে, তার ওপর নির্ভর করছে সেই রাজ্যে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রিত্ব আদায় করতে পারে কি না।
জরিপ ঠিক আভাস দিলে জোট-ভাঙা বিজেপিকে এই দুই রাজ্যে আবার প্রকৃত জোটসঙ্গীর খোঁজে নামতে হতে পারে। একদিকে সেটা যদি হয় মোদি-শাহ জুটির কাছে কিল খেয়ে কিল হজম করার মতো, অন্যদিকে একক গরিষ্ঠ দল হিসেবে মুখ্যমন্ত্রিত্ব লাভ হবে এই জুটির পাগড়ির নতুন পালক। দলীয় প্রাধান্য বিস্তারে ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। ঝুঁকি তো সাহসীরাই নেয়। কিন্তু ওলট-পালট হয়ে গেলে বিজেপি সভাপতি হিসেবে অমিত শাহকে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদির একচ্ছত্র শাসন চাপে পড়ে যাবে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments