যুক্তরাষ্ট্র-তেল বিপর্যয়ের দায় কাদের? by পিটার কাস্টার্স
ঘটনাটি দেখা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ পরিবেশ বিপর্যয় হিসেবে। গত ২০ এপ্রিল মেক্সিকো উপসাগরের ডিপওয়াটার হরাইজন নামে পরিচিত এলাকার একটি তেলকূপ খননের জন্য তৈরি পাটাতনে বিস্ফোরণ ঘটে।
সমুদ্রের মঝখানে তৈরি উত্তোলনমঞ্চটি ডুবে যায় এবং এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক গভীরে খোঁড়া তেলকূপ থেকে তেল বের হয়ে যেতে শুরু করে। ওই উত্তোলনমঞ্চ ও তেলকূপ খননের কাজে নিয়োজিত করপোরেশন বিপি (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম) ভাবমূর্তি বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। এর জন্য তারা তেল নির্গমণের মাত্রা কমিয়ে দেখায়। দিন পার হতে থাকে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কূপ থেকে অশোধিত তেল ছড়াতেই থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই ধরা পড়ে যে তেল ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা আসলে ব্যাপক। জুলাইয়ের মাঝামাঝি পরিমাপ করা হয়, তেল নিঃসরণের পরিমাণ সাত হাজার লাখ লিটার। অবশ্যম্ভাবীভাবে এই তেল নিঃসরণের ঘটনা অর্থনীতি ও প্রকৃতির বিপুল ক্ষতির কারণ হয়েছে। শুধু এপ্রিলের ওই বিস্ফোরণেই উত্তোলনমঞ্চের আট কর্মী মারা যান। বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের শত শত কিলোমিটারজুড়ে মাছ ধরা শিল্প ও পর্যটনব্যবসা। বিপি যখন সর্বশক্তি দিয়ে বিপর্যয়কে চোখের আড়ালেরাখার চেষ্টা করছে, কোনো সন্দেহ নেই, ততক্ষণে মেক্সিকো উপসাগরের বেশির ভাগই সামুদ্রিক মরুভূমিতে পরিণত হয়। ধ্বংস হয়ে যায় অজস্র প্রজাতির সামুদ্রিক জীবন।
তিন মাস আগে তেল নিঃসরণ বিপর্যয় শুরু হওয়ার সময়ই বিপির বিরুদ্ধে গণবিদ্বেষ চরমে পৌঁছে। এই করপোরেশন তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে কর্মরত বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বৃহত্তম হিসেবে খ্যাত। যে পরিমাণ সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞান তারা কাজে লাগাতে পারে, বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে খুব কম রাষ্ট্রেরই সেই সামর্থ্য রয়েছে। তার পরও এপ্রিলের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় বিপির প্রস্তুতি নগণ্য বলেই দেখা গেছে। স্পষ্টত এটা ঘটেছে তাদের উপর্যুপরি ব্যর্থতার জন্য। প্রথমত, কূপের চারদিকের আচ্ছাদন কাজ করেনি; দ্বিতীয়ত, তেল নিঃসরণ ঠেকানোয় কূপের আঁটুনিও ব্যর্থ হয়েছে; তৃতীয়ত, ‘বিস্ফোরণ (ব্লো-আউট) প্রতিরোধকও’ ত্রুটিপূূর্ণ ছিল; চতুর্থত, কূপের নিরাপত্তার প্রাথমিক কার্যকৌশল ব্যর্থ হলে বিশেষ ব্যবস্থা সক্রিয় হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। তেল নিঃসরণ শুরু হওয়ার পর এ কথাটি বারবার উঠে এসেছে যে ডিপওয়াটার হরাইজনে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা আগেভাগেই বিপিকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, সেখানে বিস্ফোরণের ঝুঁকি বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রদ্ধাভাজন বিশ্লেষক মাইকেল ক্লেয়ার যেমন দেখিয়েছেন, তার পরও বিপি খনন-কূপ বন্ধ করে উত্তোলনমঞ্চটি অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চরম তাড়াহুড়ো করছিল। তাদের কাছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও পরিবেশের বিবেচনা থেকে মুনাফাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। ১৯৮৪ সালে ভারতের ভোপালে পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ইউনিয়ন কারবাইডের মতো এখন বিপিকেও অতিমাত্রায় ঝুঁকি নিয়ে ফেলার দোষে দোষী করা হচ্ছে।
যাই হোক, বিপর্যয়ের কার্যকারণ বুঝতে কেবল বিপির কাজের ধরন এবং দুর্ঘটনাটি ঘটার সময় উত্তোলনমঞ্চ ও কূপের কার্যক্রমের বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা খুবই ভুল হবে। যেমন অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, এই তেলদানবের ইতিহাস দায়িত্বহীনতার ইতিহাস। জার্মান সাময়িকী ডেয়ার স্পিগেল উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছে, গত এক দশকে বিপির একটি তেল স্থাপনাতেই বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ও প্রায়-দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। ২০০২ সালে ওশেন কিং নামে বিপির আরেকটি তেল উত্তোলনমঞ্চের নিচে বিস্ফোরণ প্রায় হতে যাচ্ছিল। এ ছাড়া ২০০৫ সালে টেক্সাস সিটিতে কোম্পানির একটি তেল শোধনকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটলে ১৫ জন কর্মী মারা যান। দুটি ঘটনায়ই বিপির বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ ওঠে। দ্বিতীয় ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সনদ প্রদানকারী সরকারি সংস্থা দুর্ঘটনার পরে অভিযোগ করে, জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়ে বিপি কোনো নির্দেশনা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া আগের ওই প্রায়-বিস্ফোরণের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের কেমিক্যাল সেফটি বোর্ড বিপির বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করে। তদন্তে ‘প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই করপোরেশনটির ব্যর্থতা’ ধরা পড়ে। আমার জানা মতে, মাত্র অল্প কয়েকটি পশ্চিমা গণমাধ্যমে এসব ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যদিও দেখা যাচ্ছে, মেক্সিকো উপসাগরের এই ঘটনাটি বিপির অদক্ষতার একমাত্র উদাহরণ নয়।
এপ্রিলের সেই ঘটনার পরের কয়েক সপ্তাহজুড়ে সবার নজর মূলত ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের ওপরই ছিল। তার পরও, দিনে দিনে এবং বিশেষত গত মাসে এসে এ ঘটনায় মার্কিন সরকারের আচরণ ও ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকে। প্রথমেই আসে সরকারি সংস্থা মিনারেলস ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের (এমএমএস) ভূমিকার কথা। অতিকায় তেল কোম্পানিগুলোর তেলকূপ ও উত্তোলনমঞ্চের কার্যক্রমের ওপর রয়্যালটি আদায়ের দায়িত্ব এরই। একই সঙ্গে তেল করপোরেশনগুলো নিরাপদ কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করছে কি না এবং তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে কি না, তা দেখার দায়িত্বও এদের। তাহলেও, তেল কোম্পানিগুলোর প্রতি নমনীয়তা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত চালচলনের জন্য এমএমএসের বেশ কুখ্যাতি রয়েছে। এর বেশির ভাগ পরিদর্শকই অতীতে তেল কোম্পানির কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। এঁদের বেশিরভাগই তাঁদের অতীতের নিয়োগকর্তাদের প্রতি নতজানু। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক হলো, বেশ কিছু বছর ধরে এমএমএস গভীর সমুদ্রের তেল উত্তোলনের ব্যাপারে কোম্পানিগুলোকে ছাড় দিয়ে আসছে। তেল উত্তোলনের সময় তেল কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের আইন নির্দেশিত পরিবেশগত বাধ্যবাধকতা পালন করছে কি না, সে ব্যাপারে উদাসীন থাকছে। সুতরাং, বিপি এতটা অসতর্ক হতে পেরেছে তাদের ওপর নজরদারি করার সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাফলতির জন্যই। তেল বিপর্যয় মোকাবিলার কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপের সময় ওবামা নিজেও তিক্ততার সঙ্গে এটা স্বীকার করেছেন।
তাহলেও কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিদায় থাকতে পারেন? এ জন্য গত এক দশকে গভীর সমুদ্রে কূপ খননকাজে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কীভাবে মদদ দিয়েছে, তার খতিয়ান হওয়া দরকার। এ থেকেই ধরা পড়ে, পশ্চিমা গণমাধ্যমে মেক্সিকো উপসাগরের তেল বিপর্যয়ের ঘটনার কারণ বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, আসল কারণ রয়েছে তার থেকেও গভীরে। ১৯৯০-এর দশকে আলাস্কার মতো স্থলভাগের তেলখনিগুলো শুকিয়ে আসতে থাকলে মার্কিন সিনেটরদের ওপরে গভীর সমুদ্রে তেল অনুসন্ধানের জন্য চাপ বাড়তে থাকে। ওবামার পূর্বসূরি রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সময় নতুন নতুন এলাকায় কূপ খননের অনুমতি দেওয়া হয়। কূপ খননের অনুমতি দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় এমএমএসের ওপর। ওবামার ডেমোক্র্যাট সরকারের দায়িত্ব ছিল গভীর সমুদ্রে তেল অনুসন্ধান স্থগিত করা এবং অনুসন্ধান পদ্ধতি নিরাপদ করার। অথচ তারা বিপরীত কাজটাই করে। তেল বিস্ফোরণের ঠিক আগে আগে, এ বছরেরই মার্চে ওবামা ঘোষণা করেন, তিনি গভীর সমুদ্রে তেল অনুসন্ধানের মাত্রা বাড়িয়ে দেবেন। এর মধ্যে মেক্সিকো উপসাগরের মতো জায়গা রয়েছে, যেখানে মার্কিন পরিবেশবাদীরা তেলকূপ খনন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। অতএব, এ থেকে প্রশ্ন ওঠে, কী সেই মৌলিক কারণ যার জন্য তেল করপোরেশনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্র বিরাট ঝুঁকি নিয়েও গভীর সমুদ্র থেকে তেল আহরণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
ড. পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি; গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ।
তিন মাস আগে তেল নিঃসরণ বিপর্যয় শুরু হওয়ার সময়ই বিপির বিরুদ্ধে গণবিদ্বেষ চরমে পৌঁছে। এই করপোরেশন তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে কর্মরত বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে বৃহত্তম হিসেবে খ্যাত। যে পরিমাণ সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞান তারা কাজে লাগাতে পারে, বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে খুব কম রাষ্ট্রেরই সেই সামর্থ্য রয়েছে। তার পরও এপ্রিলের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় বিপির প্রস্তুতি নগণ্য বলেই দেখা গেছে। স্পষ্টত এটা ঘটেছে তাদের উপর্যুপরি ব্যর্থতার জন্য। প্রথমত, কূপের চারদিকের আচ্ছাদন কাজ করেনি; দ্বিতীয়ত, তেল নিঃসরণ ঠেকানোয় কূপের আঁটুনিও ব্যর্থ হয়েছে; তৃতীয়ত, ‘বিস্ফোরণ (ব্লো-আউট) প্রতিরোধকও’ ত্রুটিপূূর্ণ ছিল; চতুর্থত, কূপের নিরাপত্তার প্রাথমিক কার্যকৌশল ব্যর্থ হলে বিশেষ ব্যবস্থা সক্রিয় হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। তেল নিঃসরণ শুরু হওয়ার পর এ কথাটি বারবার উঠে এসেছে যে ডিপওয়াটার হরাইজনে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা আগেভাগেই বিপিকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, সেখানে বিস্ফোরণের ঝুঁকি বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রদ্ধাভাজন বিশ্লেষক মাইকেল ক্লেয়ার যেমন দেখিয়েছেন, তার পরও বিপি খনন-কূপ বন্ধ করে উত্তোলনমঞ্চটি অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চরম তাড়াহুড়ো করছিল। তাদের কাছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও পরিবেশের বিবেচনা থেকে মুনাফাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। ১৯৮৪ সালে ভারতের ভোপালে পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ইউনিয়ন কারবাইডের মতো এখন বিপিকেও অতিমাত্রায় ঝুঁকি নিয়ে ফেলার দোষে দোষী করা হচ্ছে।
যাই হোক, বিপর্যয়ের কার্যকারণ বুঝতে কেবল বিপির কাজের ধরন এবং দুর্ঘটনাটি ঘটার সময় উত্তোলনমঞ্চ ও কূপের কার্যক্রমের বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা খুবই ভুল হবে। যেমন অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, এই তেলদানবের ইতিহাস দায়িত্বহীনতার ইতিহাস। জার্মান সাময়িকী ডেয়ার স্পিগেল উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছে, গত এক দশকে বিপির একটি তেল স্থাপনাতেই বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ও প্রায়-দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। ২০০২ সালে ওশেন কিং নামে বিপির আরেকটি তেল উত্তোলনমঞ্চের নিচে বিস্ফোরণ প্রায় হতে যাচ্ছিল। এ ছাড়া ২০০৫ সালে টেক্সাস সিটিতে কোম্পানির একটি তেল শোধনকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটলে ১৫ জন কর্মী মারা যান। দুটি ঘটনায়ই বিপির বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ ওঠে। দ্বিতীয় ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সনদ প্রদানকারী সরকারি সংস্থা দুর্ঘটনার পরে অভিযোগ করে, জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়ে বিপি কোনো নির্দেশনা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া আগের ওই প্রায়-বিস্ফোরণের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের কেমিক্যাল সেফটি বোর্ড বিপির বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করে। তদন্তে ‘প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই করপোরেশনটির ব্যর্থতা’ ধরা পড়ে। আমার জানা মতে, মাত্র অল্প কয়েকটি পশ্চিমা গণমাধ্যমে এসব ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যদিও দেখা যাচ্ছে, মেক্সিকো উপসাগরের এই ঘটনাটি বিপির অদক্ষতার একমাত্র উদাহরণ নয়।
এপ্রিলের সেই ঘটনার পরের কয়েক সপ্তাহজুড়ে সবার নজর মূলত ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের ওপরই ছিল। তার পরও, দিনে দিনে এবং বিশেষত গত মাসে এসে এ ঘটনায় মার্কিন সরকারের আচরণ ও ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকে। প্রথমেই আসে সরকারি সংস্থা মিনারেলস ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের (এমএমএস) ভূমিকার কথা। অতিকায় তেল কোম্পানিগুলোর তেলকূপ ও উত্তোলনমঞ্চের কার্যক্রমের ওপর রয়্যালটি আদায়ের দায়িত্ব এরই। একই সঙ্গে তেল করপোরেশনগুলো নিরাপদ কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করছে কি না এবং তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে কি না, তা দেখার দায়িত্বও এদের। তাহলেও, তেল কোম্পানিগুলোর প্রতি নমনীয়তা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত চালচলনের জন্য এমএমএসের বেশ কুখ্যাতি রয়েছে। এর বেশির ভাগ পরিদর্শকই অতীতে তেল কোম্পানির কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। এঁদের বেশিরভাগই তাঁদের অতীতের নিয়োগকর্তাদের প্রতি নতজানু। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক হলো, বেশ কিছু বছর ধরে এমএমএস গভীর সমুদ্রের তেল উত্তোলনের ব্যাপারে কোম্পানিগুলোকে ছাড় দিয়ে আসছে। তেল উত্তোলনের সময় তেল কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের আইন নির্দেশিত পরিবেশগত বাধ্যবাধকতা পালন করছে কি না, সে ব্যাপারে উদাসীন থাকছে। সুতরাং, বিপি এতটা অসতর্ক হতে পেরেছে তাদের ওপর নজরদারি করার সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাফলতির জন্যই। তেল বিপর্যয় মোকাবিলার কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপের সময় ওবামা নিজেও তিক্ততার সঙ্গে এটা স্বীকার করেছেন।
তাহলেও কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিদায় থাকতে পারেন? এ জন্য গত এক দশকে গভীর সমুদ্রে কূপ খননকাজে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কীভাবে মদদ দিয়েছে, তার খতিয়ান হওয়া দরকার। এ থেকেই ধরা পড়ে, পশ্চিমা গণমাধ্যমে মেক্সিকো উপসাগরের তেল বিপর্যয়ের ঘটনার কারণ বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, আসল কারণ রয়েছে তার থেকেও গভীরে। ১৯৯০-এর দশকে আলাস্কার মতো স্থলভাগের তেলখনিগুলো শুকিয়ে আসতে থাকলে মার্কিন সিনেটরদের ওপরে গভীর সমুদ্রে তেল অনুসন্ধানের জন্য চাপ বাড়তে থাকে। ওবামার পূর্বসূরি রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সময় নতুন নতুন এলাকায় কূপ খননের অনুমতি দেওয়া হয়। কূপ খননের অনুমতি দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় এমএমএসের ওপর। ওবামার ডেমোক্র্যাট সরকারের দায়িত্ব ছিল গভীর সমুদ্রে তেল অনুসন্ধান স্থগিত করা এবং অনুসন্ধান পদ্ধতি নিরাপদ করার। অথচ তারা বিপরীত কাজটাই করে। তেল বিস্ফোরণের ঠিক আগে আগে, এ বছরেরই মার্চে ওবামা ঘোষণা করেন, তিনি গভীর সমুদ্রে তেল অনুসন্ধানের মাত্রা বাড়িয়ে দেবেন। এর মধ্যে মেক্সিকো উপসাগরের মতো জায়গা রয়েছে, যেখানে মার্কিন পরিবেশবাদীরা তেলকূপ খনন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। অতএব, এ থেকে প্রশ্ন ওঠে, কী সেই মৌলিক কারণ যার জন্য তেল করপোরেশনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্র বিরাট ঝুঁকি নিয়েও গভীর সমুদ্র থেকে তেল আহরণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
ড. পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি; গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ।
No comments