দূরদেশ-বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট by আলী রীয়াজ

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১০০ কোটি ডলারের একটি ঋণচুক্তি সম্পাদন ও এই চুক্তি সইয়ের অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জির উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলাপ-আলোচনা এখন তুঙ্গে। ভারত বাংলাদেশকে এই ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এ বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়।


ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে কোনো দেশকে দেওয়া ভারতের এটাই সর্বোচ্চ ঋণ। চুক্তিটি সইয়ের আগের দিন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিল যেন এই চুক্তি সই না করা হয়। চুক্তির বিভিন্ন শর্ত, বিশেষত সুদের এবং কমিটমেন্ট ফির হার নিয়ে তারা প্রবল আপত্তি উত্থাপন করে। এসব খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর জোর দিলেও বিএনপির আপত্তির মূল কারণ হলো এই চুক্তি করা হচ্ছে ভারতের সঙ্গে। শুধু বিএনপি সমর্থক নয়, বাংলাদেশের আরও অনেক নাগরিকও এই নিয়ে আপত্তি করতে পারেন। কেননা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে।
তবে এই চুক্তিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হওয়ার ঘটনাকে আমি ইতিবাচক বলেই মনে করি। সামগ্রিক বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন এবং বাংলাদেশের বিবেচ্য বিষয়গুলো কী হওয়া উচিত তা নিয়ে খোলামেলা বিতর্কের প্রয়োজন আছে। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির এই সফর এবং এই ঋণচুক্তি এমন সময় সম্পাদিত হলো যখন এমনকি ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোও বলতে শুরু করেছে যে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের পদক্ষেপগুলোর বিপরীতে ভারতের ইতিবাচক পদক্ষেপ প্রায় কিছুই নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গোড়া থেকেই সমর্কোন্নয়নে আগ্রহী এবং এ জন্য সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মতো নয়। তাই এই বিষয়ে সাধারণ জনগণেরও উৎসাহ লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চারটি দিক বা মাত্রা রয়েছে। প্রথম মাত্রাটি হচ্ছে দ্বিপক্ষীয়। বাংলাদেশ কার্যত ভারত দিয়ে বেষ্টিত। ভৌগোলিকভাবে একটি বড় দেশের প্রতিবেশী হিসেবে যেকোনো ছোট দেশের যেসব সীমাবদ্ধতা থাকে বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। তা ছাড়া এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত সক্রিয় সমর্থন জুগিয়েছিল। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে দিকগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই দুই দেশের মধ্যে কতকগুলো অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমানা নির্ধারণ, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের প্রাপ্য সীমানার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, ছিটমহল, বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা হ্রাসের অনুকূল পরিবেশ তৈরি—এসব অমীমাংসিত বিষয়ের অন্যতম। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য উভয় পক্ষেরই প্রয়োজন আন্তরিকতা ও সক্রিয় চেষ্টা। বড় দেশ হিসেবে ভারতের এ কথা মনে করার সুযোগ নেই যে এসব বিষয়ের মীমাংসা না করে সুসম্পর্ক তৈরি করা যাবে। এ কথাও মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের জন্ম ১৯৭১ সালের পর—যাদের কাছে ভারতের বর্তমান ভূমিকাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিষয়ে তাদের মনোভাব তৈরি করবে। অন্যদিকে ভারতের যেসব অভিযোগ তার মধ্যে অন্যতম হলো ভারতের বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় এবং বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে বহু লোক ভারতের অভিবাসন করে। এই দুই অভিযোগ, বিশেষ করে প্রথমটির ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছে বলেই গত দেড় বছরের কার্যক্রম প্রমাণ করে। এসব অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধানের জন্য দুই পক্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা অত্যাবশ্যক। তবে সে সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য ভারতের ভূমিকা হতে হবে অগ্রণী। ভারতীয় গণমাধ্যমে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে যে তারা এ ব্যাপারে উদেযাগী নন।
এই দুই দেশের সম্পর্কের দ্বিতীয় মাত্রাটি হলো দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া মিলে যে অঞ্চল সেখানে প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতা। এই অঞ্চলে ভারত ও চীন উভয়ই তাদের প্রভাব বাড়াতে সক্রিয়। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতিযোগিতা থেকেই এটা স্পষ্ট। চীন এটা নিশ্চিত করতে তৎপর যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনে বিশেষ করে চীনের পূর্বাঞ্চলীয় শিল্পোন্নত এলাকায় তেল সরবরাহের যে নৌপথ সেটা যেন তাদের প্রভাবের মধ্যে থাকে। সে লক্ষ্যেই চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিয়েছে। চীনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়ে চীনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি এবং চীনা ভাইস প্রেসিডেন্ট লি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে তাদের সাহায্যের সুস্পষ্ট ঘোষণা থেকেও এটা বোঝা যায়। মনে রাখা দরকার যে চীন পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গোয়াদারে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করেছে। একইভাবে শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা বন্দর স্থাপনের অর্থের ৮৫ শতাংশ জুগিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল খুবই সীমিত, এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ভারতের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে আমদানিপণ্যের সবচেয়ে বড় উৎস এখন চীন। এই বন্দরগুলো তৈরির পাশাপাশি চীন সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নেও সাহায্য করছে। ভারত চীনের এই প্রচেষ্টাকে খুব ভালোভাবে দেখছে না। আর সে বিবেচনায়ই বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারত আগ্রহ দেখিয়েছে। ঢাকায় ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সইয়ের পর প্রণব মুখার্জি স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন যে ভারত বাংলাদেশকে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পাঠানোর জন্য ট্রানজিট দেবে।
বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক কখনোই সরল ছিল না। চীন যে কেবল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই করেছে তা নয়, ১৯৭৫ সালের ক্ষমতার পরিবর্তনের আগে সে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিও দেয়নি। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের উদেযাগ শুরু হয় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। চীন বাংলাদেশে সমরাস্ত্র সরবরাহ করে থাকে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে চীন সফর করে শেখ হাসিনা চীনা সরকারের কাছে এই ইঙ্গিতই দিতে চেয়েছিলেন যে তাঁর সরকার চীনের অতীতের ভূমিকার চেয়ে ভবিষ্যতের ব্যাপারেই উৎসাহী। সে সময় চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব বেশি সাফল্য আসেনি তার অন্যতম কারণ চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের ভূমিকা নির্ধারণ করেনি। খালেদা জিয়া ২০০২ সালে তাঁর সফরের সময় প্রতিরক্ষাবিষয়ক সহযোগিতার যে চুক্তি সই করেন তা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হয়নি বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। এই ইতিহাস থেকে এটা স্পষ্ট যে অতীতে বাংলাদেশ চীনকে ভারতের প্রভাবের ভারসাম্য-শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে। তখন এটা যতটা অস্পষ্ট ছিল এখন ততটা নয়। কেননা চীন ও ভারত সে সময় তাদের প্রতিযোগিতাকে সামরিক বলেই বিবেচনা করত। এখন এই দুই দেশই তাদের প্রভাব বলয়ের জন্য ‘নরম শক্তি’ (সফট পাওয়ার) ব্যবহারেই আগ্রহী এবং তারা বুঝতে পারে যে এই কৌশল অগ্রহণযোগ্য নয়।
চীন ও ভারতের এই প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশকে দুই দেশের সঙ্গে তার সম্পর্কের মাত্রা ও প্রকৃতি নির্ধারণ করতে হবে। ভারত ও চীনের এই প্রতিযোগিতা ও সম্পর্কের টানাপোড়েনের একটি উৎস হচ্ছে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন। অনেকেরই জানা যে চীন ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রায় উৎসমুখে একাধিক বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহ পরিবর্তনের পরিকল্পনা করছে। এত দিন ধরে চীনা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে না চাইলেও এ বছরের এপ্রিলে তারা স্বীকার করেছে যে জাংমুতে তারা একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ তৈরি করছে ও আরও চারটি বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা আছে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সব মিলিয়ে ২৮টি বাঁধ তৈরি হয়েছে, হচ্ছে বা পরিকল্পনাধীন। তা ছাড়া চীন ব্রহ্মপুত্রের পানির প্রবাহও পরিবর্তনে উৎসাহী। সেটা ভারত ও বাংলাদেশ—উভয়ের জন্যই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। চীনা কর্তৃপক্ষ ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে যে তারা ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ নিয়ে তথ্য বিনিময় করবে। এই প্রশ্নে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভারতের সহযোগিতা। ভারত ও বাংলাদেশের সম্মিলিত চেষ্টা ছাড়া চীনের এই প্রচেষ্টাকে মোকাবিলা করা অসম্ভব।
সংক্ষেপে বললে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে চীন ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। কিন্তু এই দুই দেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো এই দুই দেশের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা।
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে তৃতীয় মাত্রা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সময়ই ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তাননির্ভরনীতি এখন পরিবর্তিত হয়েছে বলেই ধারণা করা যায়। বারাক ওবামা প্রশাসন গোড়াতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে খুব উৎসাহ না দেখালেও ক্রমেই তাঁরা ভারতকে আস্থার মধ্যে নিচ্ছেন। এ বছরের শেষ দিকে প্রেসিডেন্ট ওবামার ভারত সফরেরও কথা আছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকাকে কীভাবে বিবেচনা করে।
সর্বশেষ যে মাত্রাটির দিকে আমি মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই তা হলো ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। অনেক বিশ্লেষকেরই ধারণা যে পাকিস্তান এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার একটি উৎস হিসেবে কাজ করছে। এই মতের সঙ্গে সর্বাংশে একমত না হয়েও বলা যায় যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ও টানাপোড়েন অব্যাহত থাকলে তার প্রতিক্রিয়া গোটা অঞ্চলেই পড়ে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশেষ করে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতারও প্রভাব বাংলাদেশকে বইতে হয়। অন্যদিকে ভারতের মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় উত্তেজনা, কাশ্মীরে অব্যাহত দমন-পীড়ন বাংলাদেশের ভেতরে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করে। সে রকম পরিস্থিতিতে সরকার ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত না হয়ে পারে না।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ঋণচুক্তিকে সামনে রেখে এই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আলোচনায় কেবল এই দুই দেশকে বিবেচনায় রাখলেই চলবে না, এই দুই দেশের সম্পর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশ ও ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলোও বিশ্লেষণ করা দরকার। অন্যথায় আমরা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হব।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.