অরণ্যে রোদন-পুকুরচুরি বিলচুরি নদীচুরি by আনিসুল হক

পুকুরচুরির গল্পটা আমরা জানি। একটা পুকুর কাটা হবে। বরাদ্দ হলো লাখ টাকা। সেই টাকা ওঠানো হলো। কাজ চলছে, এই রকমই ধারণা কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কাজ আসলে হয়নি। এক ফোঁটা মাটিও কাটা হয়নি। তারপর কর্তৃপক্ষ জানাল, পুকুরটা কেমন হয়েছে, দেখার জন্য ইন্সপেক্টর আসছে।


তখন এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হলো। পুকুরটা এলাকায় বড় সমস্যা করছে। পচা পানিতে মশা উৎপন্ন হচ্ছে। এটা বোজাতে হবে। আবার লাখ টাকা বরাদ্দ হলো। তারপর একসময় ইন্সপেক্টর এলেন। এসে দেখলেন, কাজ হয়েছে পাকা। পুকুরটা এমন করে ভরাট করা হয়েছে, মনে হচ্ছে এখানে আদৌ কোনো পুকুর ছিলই না।
এটা আগের কালের গল্প। আজকের দিনের গল্প এই রকম হয় না। আগের দিনে এই অভিযোগ উঠত ঠিকাদারের বিরুদ্ধে, কিছুটা প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধেও। আজকের দিনে গল্পটা এই রকম:
এলাকায় একটা পুকুর কাটতে হবে। এলাকার প্রতিনিধি তদবিরে নামলেন। এক কোটি টাকা দরকার। এই প্রকল্প অনুমোদনের জন্য দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবানদের একজনের কাছে যেতে হলো। তিনি বললেন, কী প্রজেক্ট বানায়া আনছেন। গাধা নাকি! এক কোটি টাকায় পুকুর হয়! পাঁচ কোটি টাকার প্রজেক্ট বানান।
প্রতিনিধি সাহেব প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ দেখালেন পাঁচ কোটি টাকা। চার কোটি টাকা ওই বড় ভাই নিয়ে নিলেন। এক কোটি টাকা নিয়ে নিলেন প্রতিনিধি সাহেব। প্রকল্প এলাকায় কেউ গেলেন না। কাগজে-কলমে ওই পুকুর এলাকায় আছে। কেউ জানে না। জানার দরকার পড়ে না।
এই কৌতুকটাই এখন এই দেশে প্রচলিত হয়েছে। সেদিনও একজন কলাম লেখক তা পরিবেশন করেছেন। বাংলাদেশের এক কর্তাব্যক্তি বিদেশে গিয়ে সে দেশের সমপর্যায়ের এক কর্তাব্যক্তির বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেলেন। বিশাল প্রাসাদ দেখে তাঁর চক্ষুস্থির। কেমন করে করলে এই বাড়ি? কয় টাকা বেতন পাও? তিনি জানালা দিয়ে দেখিয়ে বললেন, একটা সেতু দেখতে পাও?
হ্যাঁ।
ওই সেতুর ফিফটি পারসেন্ট দিয়ে এই বাড়ি।
ফিরতি সফরে সেই বিদেশি কর্তাব্যক্তি বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তির বাড়িতে উঠে একই প্রশ্ন করলেন। এই বাড়ি তো আমারটার চেয়েও বড় আর সৌকর্যময়। কয় টাকা বেতন পাও? করলে কী করে?
দেশি ব্যক্তি বিদেশিকে জানালার কাছে এনে বললেন, নদীর ওপর সেতু দেখতে পাও?
না।
ওই সেতুর হানড্রেড পারসেন্ট দিয়ে এই বাড়ি।
সবচেয়ে মজা হয় নদীতে বাঁধ দেওয়ার জন্য মাটি ফেলার সময়, বালুর বস্তা ফেলার সময়। কত বস্তা ফেলা হলো, আর তা প্রমত্তা নদী ভেঙেচুরে নিয়ে গেল, কে খোঁজ রাখবে। একই গল্প প্রযোজ্য হতে পারে কোনো শুকনো খাল পুনঃখননের বেলাতেও। কতটা মাটি কাটা হলো, কে রাখে তার খোঁজ।
কোম্পানির মাল দরিয়া মে ঢাল। দুর্নীতি সেই কোন অতীত আমল থেকে চলে আসছে এই দেশে। আকবর আলি খান তাঁর পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন এই অঞ্চলে দুর্নীতি কত প্রাচীন। দুই হাজার বছর আগের মনুস্মৃতিতে আছে, ‘প্রজাদের রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে রাজা যাদের নিয়োগ করেন, তারাই ভণ্ডামি করে অন্যদের সম্পত্তি গ্রাস করে। রাজাকে এ ধরনের কর্মকর্তাদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে হবে। রাজার দায়িত্ব হলো যেসব দুষ্ট লোক মামলায় বিভিন্ন পক্ষ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে তাদের নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া এবং তাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।’
দুই হাজার বছর আগের চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে লেখা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারীরা দুভাবে বড়লোক হয়: হয় তারা সরকারকে প্রতারণা করে, অন্যথায় প্রজাদের অত্যাচার করে।’ চাণক্য লিখেছেন, আকবর আলি খানের ইংরেজি থেকে অনূদিত বাংলায়, ‘জিহ্বার ডগায় বিষ বা মধু থাকলে তা না চেটে থাকা যেমন অবাস্তব, তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে লেনদেন করে একটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা। জলে বিতরণরত মাছ কখন জল পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব, তেমনি নির্ণয় সম্ভব নয় কখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা তহবিল তছরুপ করে।’
আকবর আলি খান দেখিয়েছেন, বাদশাহি আমলে এই দেশে দুর্নীতি হয়েছে, ব্রিটিশ আমলে হয়েছে। আর এই আমলে?
আমার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের পাড়াতেই থাকতেন এমপি সাহেব। আমি তখন হাফপ্যান্ট পরি। মামা চাকরির জন্য দরখাস্ত করবেন। তাঁর দরখাস্তে এমপির সুপারিশ লাগবে। আমি হাফপ্যান্ট পরে চলে গেলাম সকালবেলা এমপি সাহেবের বাসায়, তিনি দরখাস্ত দেখেই হাত বাড়িয়ে তাতে সুপারিশ করে দিলেন। আমিও হাসিমুখে চলে এলাম। এমপি নিয়োগ দিয়ে ঘুষ খান, এমপি স্কুলে ছাত্র ভর্তি করিয়ে ঘুষ খান, এ ধরনের ঘটনা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারত না।
আমার খুব দুর্ভাবনা হয়। দুর্নীতির কত ধরনের মুখরোচক গল্প যে শুনি। এই যে ৫০ কোটি টাকার কাজকে ৫০০ কোটি টাকার কাজ বানানোর গল্প শুনি, বাস্তবে তা-ই যদি ঘটে থাকে, তার প্রতিক্রিয়াটা কী হবে? ধরা যাক, সরকার একটা হেলিকপ্টার বা ট্রাক্টর কিনবে। তার দাম ১০ কোটি টাকা। সেটা কেনা হলো ১০০ কোটি টাকা দিয়ে। ৯০ কোটি টাকা চলে গেল কারও পকেটে। আচ্ছা, সেই ৯০ কোটি টাকা তিনি কোথায় রাখেন? ব্যাংকে নাকি বালিশের ভেতরে? ব্যাংকে রাখলে কোন ব্যাংক? দেশি ব্যাংক, নাকি বিদেশি ব্যাংক? নাকি সুইস ব্যাংক?
সরকারের এই টাকা সরকার পায় কোত্থেকে? গরিব মানুষ একটা সিনেমা দেখলে কর দেয়। একটা বিড়ি খেলে তাকে ট্যাক্স গুনতে হয়। আয়কর দেন জনগণ। আমদানি-রপ্তানি কেনাকাটা করতে খাজনা, শুল্ক, কর, ভ্যাট দিতে হয়। তার প্রতিটির প্রভাব পড়ে গরিব জনগণের ওপর। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাব। হায়, আমার গরিব দেশের গরিব কৃষক-শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষ! তুমি কি জানো, তুমি নুন খেতে গিয়ে যে কর দিচ্ছ, তা তোমার দেশের রাজরাজড়ারা চুরি করছে!
কোনো পেশার দুর্নীতি নিয়ে দুর্নাম বহু পুরোনো। কাস্টমস, ট্যাক্সে যাঁরা চাকরি করেন, তহসিলদার সাহেব, প্রকৌশলী, দারোগা সাহেব, তাঁদের বাড়িটা পাকা হবে, তা এই দেশের মানুষ বহুদিন থেকে দেখে আসছে। কিন্তু সর্বস্তরে এমন সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কথা কি চল্লিশ বছর আগে কেউ ভাবতে পারত?
সর্বস্তরে দুর্নীতি। আগে ছিল পুকুরচুরি, এখন বিল-হ্রদচুরি, নদীচুরি, সমুদ্রচুরি চলছে। দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় কেনাকাটায়, লাইসেন্স দিতে, পারমিট দিতে। পুলিশ যদি ধরে তাহলে টাকা, যদি ছেড়ে দেয় তাহলে টাকা। যেখানেই কোনো সরকারি সার্টিফিকেট লাগবে, সেখানেই টাকা। ভাঙা গাড়ি ফিটনেস সার্টিফিকেট পাবে, টাকা থাকলেই। যে কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারে, টাকা খরচ করলেই। টেলিভিশনের পারমিশন থেকে শুরু করে পরিবেশ ছাড়পত্র, টাকা। নিয়োগের জন্য টাকা। বদলির জন্য টাকা। আর আছে জবরদখল। সরকারি জমি তো দখল হবেই, যেকোনো মানুষের জমি দখল করে টাকা নেওয়া যেতে পারে। নিজের জমিতে বাড়ি করবেন, টাকা গুনুন।
আশ্চর্য নয় যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার আর কোনো কথা বলে না। অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুমুখী শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ক্ষমতাবান লোকেরা প্রতিবছর সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে বাধ্য থাকবেন। দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি ইত্যাদির নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেসব কথা আওয়ামী লীগ ভুলে গেছে। অর্থমন্ত্রী হতাশ, নাহ, আর হলো না।
কত টাকা লাগে একজন মানুষের, এক জীবনে? কেন একজন নেতা দুর্নীতি করবেন? কেন একজন এমপি এলাকার লোকদের কাছ থেকে নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে টাকা নেবেন?
কোথাও কোনো জবাবদিহি নেই। শুধু বলতে চাই, পাওয়ার করাপ্টস অ্যান্ড অ্যাবসোলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলুটলি। ক্ষমতা যত কেন্দ্রীভূত হবে, দুর্নীতি তত বাড়বে। কিন্তু ক্ষমতার শীর্ষ থেকে একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতির উন্মুক্ত ও উন্মত্ত চর্চা—আমরা যে অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। এখন এই দেশে শিক্ষকেরা পর্যন্ত দুর্নীতি করেন, চিকিৎসকেরা করেন, মাদ্রাসা প্রশাসনে পর্যন্ত দুর্নীতি হয়, আমরা যাব কই।
দুর্নীতি না হলে আমাদের রাস্তাঘাট ভালো থাকত। দুর্নীতি না হলে আমাদের বাস-ট্রেন সুন্দর হতো। দুর্নীতি না হলে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যেত, সেগুলোর পরিবেশ উন্নত থাকত। দুর্নীতি না হলে মানুষ থানায় গিয়ে ভরসা পেত, বিচার পেত। দুর্নীতি না হলে কৃষক সস্তায় সার পেত, কৃষিপণ্য পেত। দুর্নীতি না হলে মানুষ বিদ্যুৎ পেত। দুর্নীতি না হলে জমিজমা নিয়ে এত মামলা-মোকদ্দমা হতো না। দুর্নীতি না হলে আমাদের ফলে কারবাইড বা ফরমালিন থাকত না, আমাদের নদীতে পানির বদলে আলকাতরা প্রবাহিত হতো না, আমাদের জমিজমা-নদ-নদী রাস্তাঘাট বেদখল হতো না।
আমি জানি না, এই সমস্যার সমাধান কী? আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘নিজেদের দুর্নীতি হ্রাসে সরকারি কর্মচারীদের সাধারণত কোনো আগ্রহ থাকে না, তাদের অনেকেই হচ্ছে দুর্নীতির প্রধান পোষক। রাজনৈতিক নেতারা অনেকেই দুর্নীতি দূর করতে চান। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের প্রতিরোধের মুখে তাঁরা অকার্যকর, অনেক সময় তাঁরা নিজেরাও একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।’
আমি তো রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দুর্নীতি দূর করার কোনো প্রতিজ্ঞা দেখি না। আমরা কি দেশটাকে চুষে শুষে ফুলবনে মত্তহস্তির মতো সবকিছু পায়ে দলে শেষ করে দেব বলেই প্রতিজ্ঞা করে নেমেছি?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.