ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস-বাসমতি বনাম বাংলামতি
বাংলাদেশে কালিজিরা, গোবিন্দভোগ, বাদশাভোগ, খাসকানি, রাঁধুনি-পাগোল, রানি-স্যালুট, চিনিগুঁড়াসহ হাজার রকমের ধানের জাত আছে। কিন্তু বাসমতির মতো গুণাগুণসম্পন্ন একটা ধানের জাত নেই। বাসমতির নিজস্ব কিছু বিশেষত্ব আছে, যা ভারত এবং পাকিস্তানেরও নিজস্ব।
তার পরও ভারত-পাকিস্তানের এ বাসমতিকে একবার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে আমেরিকার টেঙ্াসকেন্দ্রিক কম্পানি RiceTec 'Basmati rice lines and grains' শিরোনামে একটি প্যাটেন্ট করে ফেলে। এই প্যাটেন্ট যে শুধু আসল বাসমতির জন্য প্রযোজ্য, এমন নয়। এটা ছিল যেকোনো ধরনের সরু চালের জন্য প্রযোজ্য। আসলে ওই কম্পানির ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য খুব একটা ভালো ছিল না। তারা তাদের উৎপাদিত বাসমতি-সদৃশ চালকে কাশমতি ও টেঙ্মতি বলে ব্যবসা করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানে তেমন সফলতা না আসায় তারা বাসমতির নাম প্যাটেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমেরিকার প্রচলিত প্যাটেন্ট আইনের কিছু দুর্বলতাকে তারা কাজে লাগায়। এরপর ভারতের টনক নড়ে। একসময় পাকিস্তানও যোগ দেয়। কারণ এ প্যাটেন্টের কারণে ভারত ও পাকিস্তান তখনকার আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে বাসমতির বাজার হারাতে পারত। ভারতের মতে, ইউএস সরকারের এ সিদ্ধান্ত International Treaty on Trade Related Intellectual Property Rights (TRIPS)-এর বরখেলাপ। সেখানকার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দেয়। ভারতের পক্ষে যুক্তি হলো, যা অনাদিকাল ধরে ভারতের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে জন্মাচ্ছে, যা তার ঐতিহ্যের অংশ, যা নতুন কোনো আবিষ্কার নয়, তার আবার প্যাটেন্ট কিসের। তা ছাড়া ঞজওচঝ-এর ভাষায়, 'a good originating in the territory of a member, or a region or locality in that territory, where a given quality, reputation, or other characteristic of the good is essentially attributable to its geographical origin.' আর প্রকারান্তরে ভারত ও পাকিস্তান তাদের বাসমতিকে নিজেদের ঘরে ফিরে পায়।
বাসমতির এ দ্রব্যগুণের কারণেই এ ধান নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। আজও চলছে। এর ফলে সরু চালের বিশেষ সুগন্ধির বৈশিষ্ট্যধারী একাধিক বাসমতির সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ পাঞ্জাব বাসমতি, কর্নেল বাসমতি, দেরাদুন বাসমতি, বাসমতি ২১৭, বাসমতি ১৯৮, বাসমতি ৩৭০, বাসমতি ৩৮৫, পুষা বাসমতি ১, পুষা বাসমতি ২, পুষা বাসমতি ৩, সুপার বাসমতি ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশেও এই চেষ্টা কম হয়নি। তবে সরাসরি বাসমতি নিয়ে না; অন্য কোনো সুগন্ধি জাত নিয়ে। আমাদের দেশের সুগন্ধি চালগুলো আকারে ছোট। চিনিগুঁড়া, কালিজিরা টাইপ। এগুলো আমাদের পোলাওয়ের চাল। ধান গবেষণার প্রথম পর্যায়ে খাবারের তীব্র অভাবের কথা বিবেচনায় রাখা হতো। তার পরও বহু জাতের ফলন যাচাই-বাছাই এবং নির্বাচনের পর বিআর ৫ (দুলাভোগ) নাম দিয়ে একটি জাত অবমুক্ত করা হয়। একসময় আমাদের খাবারের অভাব কিছুটা প্রশমিত হলে চাল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চিন্তা মাথায় আসে। ফলে বিশেষ গবেষণা হাতে নেওয়া হয়। যশোরের প্রচলিত জাত খাসকানি থেকে বাছাই করে ব্রি ধান ৩৪ তৈরি করা হয়। তবে এগুলোর গুণাগুণ প্রচলিত সুগন্ধি চাল থেকে তেমন আলাদা কিছু না। শুধু ফলন কিছুটা বেশি এই যা। পরে বাশমতির সঙ্গে ক্রস করে কিছু কৌলিক সারি তৈরি করা হয়। সেখান থেকে ব্রি ধান ৩৭ এবং ব্রি ধান ৩৮ নামে দুটি কৌলিক সারি অবমুক্ত করা হয়। এগুলোর কিছুটা সুগন্ধ আছে এবং চালের আকৃতি সরু হলেও বাসমতির মতো অতটা সরু নয়। তাই বাইরের বাজারে রপ্তানি করার যথেষ্ট সম্ভাবনা তৈরি করা যায়নি। আর করলেও তার ক্রেতা প্রবাসে অবস্থানরত বাঙালি ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যাবে না। তাই চেষ্টা চলতে থাকে। এর পর সত্যিকারের বাসমতির মতো দেখতে এক ধরনের জাত উদ্ভাবন করা হয়। এই জাতটি বোরো মৌসুমে উৎপাদনের উপযোগী এবং হেক্টরপ্রতি ৬-৬.৫ টন ফলন দেওয়ার উপযুক্ত। সত্যিকার অর্থে কোনো বাসমতির জাতই এ মাপের ফলন দেওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এটা আমাদের ধান গবেষণার জন্য একটা ব্রেক থ্রু বলা যায়। তার পরও বলে রাখা ভালো, এ জাতের ধান বা চাল অবিকল বাসমতির মতো বা তার চেয়েও দেখতে একটু ভালো হলেও রান্নার পরে কিছুটা মোটা হয়ে যায়। তাই রপ্তানির বাজারে কেমন কতটা সফল হবে তা বলা যায় না। এ ব্যাপারে পরবাসী বাংলাদেশিরা এগিয়ে আসতে পারেন। চেহারাসুরতে বাসমতির মতো হলেও এটাকে বাসমতি বলায় বিপত্তি দেখা দেয়। তার প্রমাণও পাওয়া গেছে হাড়ে হাড়ে। এই জাতটি অবমুক্তির প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো এক মিডিয়ায় বাসমতি-টাইপ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাস থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়।
ভারতের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক কিছুটা টানাপড়েনের কথা জেনেছিলাম বাসমতির প্যাটেন্ট নিয়ে। ভারত সেই কথাটিই মনে রেখেছে। ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের সঙ্গে মাঝেমধ্যে উত্তপ্ত আচরণ করলেও বাসমতির ব্যাপারে তারা এক ছিল। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক একটা বিশেষ মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তারা বাসমতির ব্যাপারে আমাদের একটুও ছাড় দেয়নি। অন্য সময় তারা যতই বলুক যে আমরা একই ঐতিহ্যের ধারক-বাহক, কিন্তু আমাদের ধানের জাত বাসমতি নামে চলুক তা তারা মেনে নিতে নারাজ। তাই আমাদের এ বাসমতি-সদৃশ জাতটিকে আমরা আর বাসমতি বলে ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। আমরা আমাদের জাতকে এখন বাংলামতি বলেই খুশি। আর এই বাংলামতি নিয়ে আমাদের সাধারণ চাষিরা বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমরা আশা করি, এ নামেই হয়তো একদিন বিশ্ববাজারে এ চাল তার জায়গা করে নেবে। আর আমরা চাল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা কামাই করতে পারব।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর
বাসমতির এ দ্রব্যগুণের কারণেই এ ধান নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। আজও চলছে। এর ফলে সরু চালের বিশেষ সুগন্ধির বৈশিষ্ট্যধারী একাধিক বাসমতির সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ পাঞ্জাব বাসমতি, কর্নেল বাসমতি, দেরাদুন বাসমতি, বাসমতি ২১৭, বাসমতি ১৯৮, বাসমতি ৩৭০, বাসমতি ৩৮৫, পুষা বাসমতি ১, পুষা বাসমতি ২, পুষা বাসমতি ৩, সুপার বাসমতি ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশেও এই চেষ্টা কম হয়নি। তবে সরাসরি বাসমতি নিয়ে না; অন্য কোনো সুগন্ধি জাত নিয়ে। আমাদের দেশের সুগন্ধি চালগুলো আকারে ছোট। চিনিগুঁড়া, কালিজিরা টাইপ। এগুলো আমাদের পোলাওয়ের চাল। ধান গবেষণার প্রথম পর্যায়ে খাবারের তীব্র অভাবের কথা বিবেচনায় রাখা হতো। তার পরও বহু জাতের ফলন যাচাই-বাছাই এবং নির্বাচনের পর বিআর ৫ (দুলাভোগ) নাম দিয়ে একটি জাত অবমুক্ত করা হয়। একসময় আমাদের খাবারের অভাব কিছুটা প্রশমিত হলে চাল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চিন্তা মাথায় আসে। ফলে বিশেষ গবেষণা হাতে নেওয়া হয়। যশোরের প্রচলিত জাত খাসকানি থেকে বাছাই করে ব্রি ধান ৩৪ তৈরি করা হয়। তবে এগুলোর গুণাগুণ প্রচলিত সুগন্ধি চাল থেকে তেমন আলাদা কিছু না। শুধু ফলন কিছুটা বেশি এই যা। পরে বাশমতির সঙ্গে ক্রস করে কিছু কৌলিক সারি তৈরি করা হয়। সেখান থেকে ব্রি ধান ৩৭ এবং ব্রি ধান ৩৮ নামে দুটি কৌলিক সারি অবমুক্ত করা হয়। এগুলোর কিছুটা সুগন্ধ আছে এবং চালের আকৃতি সরু হলেও বাসমতির মতো অতটা সরু নয়। তাই বাইরের বাজারে রপ্তানি করার যথেষ্ট সম্ভাবনা তৈরি করা যায়নি। আর করলেও তার ক্রেতা প্রবাসে অবস্থানরত বাঙালি ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যাবে না। তাই চেষ্টা চলতে থাকে। এর পর সত্যিকারের বাসমতির মতো দেখতে এক ধরনের জাত উদ্ভাবন করা হয়। এই জাতটি বোরো মৌসুমে উৎপাদনের উপযোগী এবং হেক্টরপ্রতি ৬-৬.৫ টন ফলন দেওয়ার উপযুক্ত। সত্যিকার অর্থে কোনো বাসমতির জাতই এ মাপের ফলন দেওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এটা আমাদের ধান গবেষণার জন্য একটা ব্রেক থ্রু বলা যায়। তার পরও বলে রাখা ভালো, এ জাতের ধান বা চাল অবিকল বাসমতির মতো বা তার চেয়েও দেখতে একটু ভালো হলেও রান্নার পরে কিছুটা মোটা হয়ে যায়। তাই রপ্তানির বাজারে কেমন কতটা সফল হবে তা বলা যায় না। এ ব্যাপারে পরবাসী বাংলাদেশিরা এগিয়ে আসতে পারেন। চেহারাসুরতে বাসমতির মতো হলেও এটাকে বাসমতি বলায় বিপত্তি দেখা দেয়। তার প্রমাণও পাওয়া গেছে হাড়ে হাড়ে। এই জাতটি অবমুক্তির প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো এক মিডিয়ায় বাসমতি-টাইপ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাস থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়।
ভারতের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক কিছুটা টানাপড়েনের কথা জেনেছিলাম বাসমতির প্যাটেন্ট নিয়ে। ভারত সেই কথাটিই মনে রেখেছে। ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের সঙ্গে মাঝেমধ্যে উত্তপ্ত আচরণ করলেও বাসমতির ব্যাপারে তারা এক ছিল। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক একটা বিশেষ মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তারা বাসমতির ব্যাপারে আমাদের একটুও ছাড় দেয়নি। অন্য সময় তারা যতই বলুক যে আমরা একই ঐতিহ্যের ধারক-বাহক, কিন্তু আমাদের ধানের জাত বাসমতি নামে চলুক তা তারা মেনে নিতে নারাজ। তাই আমাদের এ বাসমতি-সদৃশ জাতটিকে আমরা আর বাসমতি বলে ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। আমরা আমাদের জাতকে এখন বাংলামতি বলেই খুশি। আর এই বাংলামতি নিয়ে আমাদের সাধারণ চাষিরা বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমরা আশা করি, এ নামেই হয়তো একদিন বিশ্ববাজারে এ চাল তার জায়গা করে নেবে। আর আমরা চাল রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা কামাই করতে পারব।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর
No comments