কালান্তরের কড়চা-অ-রূপকথার যুগের এক রানির গল্প by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আমি রানি ভিক্টোরিয়াকে দেখিনি, কিন্তু রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে দেখেছি। একবার নয়, কয়েকবার দেখেছি। দূর থেকে দেখেছি দুবার। সামনাসামনি দেখেছি দুবার। তাঁর সঙ্গে শেক হ্যান্ডও করেছি একবার, একেবারে তাঁর বাকিংহাম প্যালেসের দরবারকক্ষে দাঁড়িয়ে। ভিক্টোরিয়ার মতোই তিনি অল্প বয়সে সিংহাসনে বসেছেন।
ভিক্টোরিয়ার মতোই দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন এবং এ বছর তাঁর রাজত্বের ৬০ বছর পূর্ণ হলো। এই জুন মাসের গোড়ায় আজ কদিন ধরে চলছে তাঁর সরকারি ডায়মন্ড জুবিলি উৎসব। আজ চার দিন ধরে (২ থেকে ৫ জুন) সারা লন্ডন শহর উৎসব ও উল্লাসমুখর (৪ ও ৫ জুন সরকারি ছুটি)।
১৮৩৮ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া ব্রিটিশ সিংহাসনে বসেন। সেটা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উদয়কাল। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও ১৯৫২ সালে যখন পিতা ষষ্ঠ জর্জের আকস্মিক মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন, তখন তাঁর বয়স ২৬ বছর। সদ্যঃবিবাহিতা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তখন পড়ন্তকাল। ভিক্টোরিয়াকে সাম্রাজ্য শাসন করতে হয়নি। তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অসীম শক্তিশালী। সাম্রাজ্যের সম্পদ ও শক্তিতেই সাম্রাজ্য চলেছে। কিন্তু দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন সিংহাসনে বসেছেন, তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভাঙন শুরু হয়ে গেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সারা বিশ্ব টালমাটাল। বিশ্বশক্তির আসন থেকে ব্রিটেন নেমে যাচ্ছে। এই সময় ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিস্থাপকতা রক্ষা এবং এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য হাতছাড়া উপনিবেশগুলো ব্রিটেনের নৈতিক প্রভাব রক্ষার কাজে একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথ সেই তরুণ বয়সেই যে ধৈর্য, সাহস ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তা অতুলনীয়।
১৯৫২ সালে আমি ঢাকায় কলেজের ছাত্র এবং দৈনিক সংবাদে খণ্ডকালীন সাংবাদিক। এ সময় একদিন খবর এলো, রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা গেছেন। তাঁর পুত্রসন্তান নেই। দুই মেয়ে এলিজাবেথ ও মার্গারেট। এলিজাবেথ রানি হচ্ছেন। ২৬ বছরের তরুণী রানি। সুন্দরী তো বটেই। তাঁর স্বামী গ্রিক রাজবংশের প্রিন্স ফিলিপ (ডিউক অব এডিনবরা) দীর্ঘদেহী, সুশ্রী পুরুষ। আমি ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক পরিবারে জন্মেছি। আমার বাবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জেলে গেছেন। আমি যখন স্কুলে নিচের ক্লাসে পড়ি, তখন সারা অবিভক্ত ভারত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। আমরা ছাত্ররা রাস্তায় নেমে স্লোগান দিচ্ছি- 'ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক', 'হিন্দু-মুসলিম এক আওয়াজ/খতম করো ব্রিটিশরাজ' ইত্যাদি। স্বভাবতই উপমহাদেশে ব্রিটিশরাজ খতম হওয়ার পরও ব্রিটিশবিরোধী চেতনা মনে জাগ্রত ছিল।
তাই ব্রিটেনের কোন রাজা মারা গেলেন, কে নতুন রাজা বা রানি হলেন, তা নিয়ে তখন মাথা ঘামাইনি। কেবল নতুন রানির রূপসী চেহারা অনেকের মতো আমার তরুণ মনেও একটা ছাপ ফেলেছিল। তারপর এই রানিকে চাক্ষুষ দেখি ১৯৫৯ কি ১৯৬০ সালে। তখন তাঁর ভরযৌবন। তিনি তখন শুধু ব্রিটেনের রানি নন, কমনওয়েলথ-প্রধানও। পাকিস্তানে আইয়ুবের সামরিক শাসন চলছে। রানি পাকিস্তান সফরে এসেছেন। পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষে পূর্ব পাকিস্তানেও এসেছেন। রানির এই সফর উপলক্ষ করেই তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দর থেকে ঢাকা শহরে আসার প্রশস্ত সড়কটি তৈরি করা হয়। রমনায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িটি ভেঙে রাতারাতি রানির বাসোপযোগী বিরাট দ্বিতল ভবন গড়ে ওঠে। আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার আমলে এটি ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম নাম হয় 'গণভবন'।
তখন ছিলাম একেবারেই জুনিয়র সাংবাদিক। রানির জন্য দেওয়া ঢাকার কোনো সরকারি বা বেসরকারি পার্টিতেই দাওয়াতের কার্ড পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করিনি। রমনা গ্রীনের সিভিক রিসেপশনে রানি ও ডিউককে একঝলক দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। তাও বহু দূর থেকে। একেবারে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হলো এক দুপুরে, হাটখোলা রোড ও রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ক্রসিংয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ('ইত্তেফাক'-এর পুরনো অফিসের কোনায়)।
রাণী ও ডিউক ওই সফরের সময় সদলবলে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের কাছে আদমজীনগরে আদমজী জুট মিল পরিদর্শনে। সেখান থেকে এই পথেই তিনি ঢাকা শহরে ফিরে আসবেন। সেদিন প্রচণ্ড গরম। মাথার চাঁদি ফাটানো রোদের তাপ। তবু হাজার হাজার লোক হাটখোলা রোডের দুপাশের ফুটপাথে জড়ো হয়েছে রানিকে একনজর দেখার জন্য। নিরাপত্তার কঠোর বেষ্টনী ভেঙে পড়ছে। আমিও সেই জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে শরীর ঝলসানো রোদের মধ্যে অপেক্ষা করেছি রানিকে খুব কাছ থেকে একনজর দেখার আশায়।
একটা ছাদখোলা বড় পিকআপ ধরনের গাড়িতে রানি দাঁড়িয়ে আছেন। পথিপাশ্র্বের জনতার অভিবাদন গ্রহণ করার জন্য তিনি হাত কপালে ঠেকিয়ে রেখেছেন। গাড়িতে তাঁর পেছনে আরো লোক। সিকিউরিটির লোক, এমনকি ডিউকও বসে আছেন। তিনি কুইনের কনসোর্ট। রানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল। শুনলাম, সেই আদমজী থেকে রানি এভাবে গাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মাথার ওপর একটা ছাতি ধরাও হয়নি। অন্তত আমার মনে পড়ছে না। শীতের দেশের রানি। বাংলাদেশের এই প্রচণ্ড গরমে প্রখর রোদে দিনি আদমজী থেকে ঢাকা- এই ১০ মাইল পথ রোদ মাথায় খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন, এই দৃশ্যটি এখনো আমার চোখে ভাসে। এখন জানি, এ যুগে রাজা-রানি হওয়াটা যতটা সুখের বলে আমরা ভাবি, তা ততটা সুখের নয়।
ব্রিটেনের মহামান্যা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে একেবারে মুখোমুখি দেখার এবং তাঁর সঙ্গে শেক হ্যান্ড করার বিরল সৌভাগ্যের কথাটা বলি। এখন তো হচ্ছে তাঁর ডায়মন্ড জুবিলি উৎসব; গত শনিবার (২ জুন) ইপসমে ডার্বির ঘোড়দৌড় দেখার মধ্য দিয়ে যে উৎসবের শুরু, তা শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার (৫ জুন) লন্ডনের সেন্ট পলস গির্জায় থ্যাংকস গিভিং সার্ভিসের মধ্য দিয়ে। মাঝখানে দুদিন রবি ও সোমবার শুধু লন্ডন নয়, সারা ব্রিটেন আনন্দে-উল্লাসে, আলোকসজ্জায় মেতে উঠেছিল। টেমস নদীতে নৌমহড়া ও রানির নৌবিহার দেখতে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ চোখে দেখার মতো ঘটনা। ব্রিটেনের মানুষ যে এই রানিকে এবং রাজতন্ত্রকে এখনো ভালোবাসে, এটা তার প্রমাণ।
যা হোক, আমি বলছি রানির আগের সিলভার জুবিলির সময়ের কথা। আমি তখন লন্ডনে এসেছি বছর কয়েক হয়। একটা বাংলা সাপ্তাহিক কাগজ সম্পাদনা করি। বাকিংহাম প্যালেসে ব্রিটেনের এথনিক কমিউনিটির প্রতিনিধি ও এথনিক কাগজের সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রানির সঙ্গে দেখা করার জন্য। সৌভাগ্যক্রমে আমিও একটা কার্ড পেলাম। কিন্তু প্যালেসে ঢোকার জন্য যে স্যুট-টাই পরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা আমার নেই। আমার গাড়িতে সামনের কাচে লাগানোর জন্য স্টিকার এবং সিকিউরিটি পেপার দেওয়া হয়েছে। আমার তো গাড়িই নেই।
প্রবীণ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল মতিন তখন লন্ডনে ইউকেআইএএসের (ইউনাইটেড কিংডম ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজরি সার্ভিস) অফিসে চাকরি করেন। তিনি বুদ্ধি বাতলে দিলেন। কভেন গার্ডেনের কাছে মোস ব্রাদার্স বলে একটা দোকান আছে; তারা দামি স্যুট-টাই ভাড়া দেয়। আমি এক দিনের জন্য রানির দরবারে যাওয়ার ড্রেসকোড অনুযায়ী ড্রেস ভাড়া করতে পারি। তারপর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে গাড়ি ধার পাওয়া না গেলে ট্রাফালগার স্কয়ারের কাছ থেকে একটা ক্যাব (ব্ল্যাক ট্যাক্সি নয়) ভাড়া করে তাতে স্টিকার ইত্যাদি লাগিয়ে প্যালেসে ঢুকলেই চলবে। ক্যাব ড্রাইভারকেও সেভাবেই শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে। আমি মতিন ভাইয়ের পরামর্শ মেনে সেবার এভাবেই বাকিংহাম প্যালেসে ঢুকেছিলাম।
অনুষ্ঠানের প্রথমেই ছিল দরবারকক্ষে রানির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ। রানি আনুষ্ঠানিক পোশাক পরে তাঁর আসনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছি। এক এক করে তাঁর সামনে গিয়ে করমর্দন করে ফিরে আসছি। আমি আনাড়ি। রানির সঙ্গে করমর্দন (আসলে তাঁর গ্লাভস পরা আঙুল ছোঁয়া) সেরে ফিরে আসতে যাচ্ছি, কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা এক প্যালেস প্রহরী আমাকে পেছন ফিরতে দিলেন না। নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। রানির দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াতে নেই। তাঁর দিকে মাথা নিচু রেখে এবং একপা-দুপা করে পেছনে হেঁটে এসে তারপর পেছন ঘুরতে হবে। এই ভুলটা করে লজ্জা পেয়েছিলাম। দেখি, পাশে দাঁড়ানো প্রিন্স ফিলিপ মৃদু মৃদু হাসছেন।
দরবার হলের বাইরে প্রশস্ত বারান্দায় টেবিলে স্ন্যাকস ও পানীয় সাজানো। দরবার হল থেকে ফিরে এসে সবাই তা খাচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রানি এই আমন্ত্রিতদের ভিড়ের কাছে চলে আসেন। এবার তাঁর একেবারে সাদাসিধে পোশাক। সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছেন; সেই রাজকীয় দূরত্ব আর নেই। সেই সমাবেশে সাদা-কালো সব বর্ণের নরনারী ছিলেন। তাঁরা কেউ কেউ রানির গায়ে হাত দিয়ে পর্যন্ত কথা বলছেন। কেউ কেউ গায়ে গা লাগিয়ে কথা বলছেন। তিনি কিছু মনে করছেন না। খুবই অন্তরঙ্গভাবে কথা বলছেন। আমাদের মতো দেশগুলোর প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীদের এত কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যায় না। এখন না হয় সিকিউরিটির কড়াকড়ির যুগ। কিন্তু এত সিকিউরিটির কড়াকড়ি যখন ছিল না, তখনো অনেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঘেঁষা সহজ ছিল না।
প্রিন্স ফিলিপকে ঘিরেও তখন অনেক ভিড়। আমি সেই ভিড় এড়িয়ে রানির কাছে এগোনোর চেষ্টা করলাম। ইচ্ছা তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলি। অনেক কষ্টে তাঁর একটু কাছাকাছি গিয়ে বললাম, হার ম্যাজেস্টি, আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ। বিস্ময়ের কথা। রানি বাংলাদেশ কথাটি শুনেই আমার দিকে ফিরে তাকালেন। বললেন, 'আর ইউ? হোয়াট'স দ্য নিউজ অব ইওর কান্ট্রি?' বাংলাদেশে তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। দেশটিতে যে এখনো গণতন্ত্র নেই, সে কথাই রাণীকে বলতে যাচ্ছিলাম। অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন দোহা সাহেব। শামসুদ্দোহা। তখন ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার। তিনি আমার কথায় বাধা দিতে রানিকে অন্য কী বলতে যাচ্ছিলেন। রাণী স্মিত হাসি হেসে তাঁকে বললেন, 'আই অ্যাম লিসেনিং টু হিম।' বলে আমাকে দেখালেন। আমি অবশ্য আর কথা বলিনি। দোহা সাহেবও চুপ।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে তার পরও একবার আমি কিছুটা কাছে থেকে দেখেছি। এ বছরেও বাকিংহাম প্যালেসে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। যেতে পারিনি। শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। এ মাসে তাঁর ডায়মন্ড জুবিলি উপলক্ষে চার দিন ধরে লন্ডনসহ সারা যুক্তরাজ্যে যে আনন্দ-উল্লাসের প্লাবন দেখলাম, তাতে বিস্মিত হয়ে ভাবছি, যেখানে নির্বাচিত ক্যামেরন সরকারের জনপ্রিয়তা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়, সেখানে ৬০ বছর ধরে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জনপ্রিয়তা এখনো তুঙ্গে। রহস্যটা কোথায়?
আমি রাজতন্ত্র পছন্দ করি না। কিন্তু ব্রিটিশ মনার্কিকে রাজতন্ত্র বলা চলে না। এটা একটা বিস্ময়কর ইনস্টিটিউশন। রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের সম্মিলনে এটা একটা মানবিক প্রতিষ্ঠান। এটা ঠিক গণতন্ত্র নয়, কিন্তু গণতন্ত্রের মাথার ওপর একটি নির্ভরযোগ্য ছাতা। ব্রিটিশ মনার্কের মাথায় মুকুট আছে, ক্ষমতা নেই। তাঁরা প্রজাদের শাসন করেন না, সার্ভিস দেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৬০ বছর ধরে ব্রিটিশ ও কমনওয়েলথের জনগণকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সেই সেবা দিয়ে এক গৌরবোজ্জ্বল রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।
প্রাচীনকালে হতো, এখন আর ব্রিটিশ রাজা-রানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা ক্যু হয় না। আরব স্প্রিং তো নয়ই। ব্রিটিশ রাজা বা রানিরাও আবার নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করেন না। যেমন করা হয়ে থাকে এশিয়া-আফ্রিকার বহু তথাকথিত প্রজাতান্ত্রিক দেশে। অতীতের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের লিগ্যাসি বহন করে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রও। কিন্তু রাজতন্ত্রবিহীন, গণতন্ত্রের লেবেল আঁটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বর্তমান চেহারার কাছে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের চেহারা এখনো অনেক বেশি মানবিক। তাই কৈশোরে যেখানে স্লোগান দিয়েছি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক, সেখানে এখন মনে মনে বলি (স্লোগান দেওয়ার বয়স নেই), ব্রিটিশ গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক। এই গণতন্ত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল হিউম্যানফেস ব্রিটিশ রাজতন্ত্র।
লন্ডন, ৪ জুন সোমবার, ২০১২
১৮৩৮ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া ব্রিটিশ সিংহাসনে বসেন। সেটা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উদয়কাল। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও ১৯৫২ সালে যখন পিতা ষষ্ঠ জর্জের আকস্মিক মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন, তখন তাঁর বয়স ২৬ বছর। সদ্যঃবিবাহিতা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তখন পড়ন্তকাল। ভিক্টোরিয়াকে সাম্রাজ্য শাসন করতে হয়নি। তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অসীম শক্তিশালী। সাম্রাজ্যের সম্পদ ও শক্তিতেই সাম্রাজ্য চলেছে। কিন্তু দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন সিংহাসনে বসেছেন, তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভাঙন শুরু হয়ে গেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সারা বিশ্ব টালমাটাল। বিশ্বশক্তির আসন থেকে ব্রিটেন নেমে যাচ্ছে। এই সময় ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিস্থাপকতা রক্ষা এবং এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য হাতছাড়া উপনিবেশগুলো ব্রিটেনের নৈতিক প্রভাব রক্ষার কাজে একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথ সেই তরুণ বয়সেই যে ধৈর্য, সাহস ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তা অতুলনীয়।
১৯৫২ সালে আমি ঢাকায় কলেজের ছাত্র এবং দৈনিক সংবাদে খণ্ডকালীন সাংবাদিক। এ সময় একদিন খবর এলো, রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা গেছেন। তাঁর পুত্রসন্তান নেই। দুই মেয়ে এলিজাবেথ ও মার্গারেট। এলিজাবেথ রানি হচ্ছেন। ২৬ বছরের তরুণী রানি। সুন্দরী তো বটেই। তাঁর স্বামী গ্রিক রাজবংশের প্রিন্স ফিলিপ (ডিউক অব এডিনবরা) দীর্ঘদেহী, সুশ্রী পুরুষ। আমি ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক পরিবারে জন্মেছি। আমার বাবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জেলে গেছেন। আমি যখন স্কুলে নিচের ক্লাসে পড়ি, তখন সারা অবিভক্ত ভারত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। আমরা ছাত্ররা রাস্তায় নেমে স্লোগান দিচ্ছি- 'ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক', 'হিন্দু-মুসলিম এক আওয়াজ/খতম করো ব্রিটিশরাজ' ইত্যাদি। স্বভাবতই উপমহাদেশে ব্রিটিশরাজ খতম হওয়ার পরও ব্রিটিশবিরোধী চেতনা মনে জাগ্রত ছিল।
তাই ব্রিটেনের কোন রাজা মারা গেলেন, কে নতুন রাজা বা রানি হলেন, তা নিয়ে তখন মাথা ঘামাইনি। কেবল নতুন রানির রূপসী চেহারা অনেকের মতো আমার তরুণ মনেও একটা ছাপ ফেলেছিল। তারপর এই রানিকে চাক্ষুষ দেখি ১৯৫৯ কি ১৯৬০ সালে। তখন তাঁর ভরযৌবন। তিনি তখন শুধু ব্রিটেনের রানি নন, কমনওয়েলথ-প্রধানও। পাকিস্তানে আইয়ুবের সামরিক শাসন চলছে। রানি পাকিস্তান সফরে এসেছেন। পশ্চিম পাকিস্তান সফর শেষে পূর্ব পাকিস্তানেও এসেছেন। রানির এই সফর উপলক্ষ করেই তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দর থেকে ঢাকা শহরে আসার প্রশস্ত সড়কটি তৈরি করা হয়। রমনায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িটি ভেঙে রাতারাতি রানির বাসোপযোগী বিরাট দ্বিতল ভবন গড়ে ওঠে। আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার আমলে এটি ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম নাম হয় 'গণভবন'।
তখন ছিলাম একেবারেই জুনিয়র সাংবাদিক। রানির জন্য দেওয়া ঢাকার কোনো সরকারি বা বেসরকারি পার্টিতেই দাওয়াতের কার্ড পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করিনি। রমনা গ্রীনের সিভিক রিসেপশনে রানি ও ডিউককে একঝলক দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। তাও বহু দূর থেকে। একেবারে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হলো এক দুপুরে, হাটখোলা রোড ও রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ক্রসিংয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ('ইত্তেফাক'-এর পুরনো অফিসের কোনায়)।
রাণী ও ডিউক ওই সফরের সময় সদলবলে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের কাছে আদমজীনগরে আদমজী জুট মিল পরিদর্শনে। সেখান থেকে এই পথেই তিনি ঢাকা শহরে ফিরে আসবেন। সেদিন প্রচণ্ড গরম। মাথার চাঁদি ফাটানো রোদের তাপ। তবু হাজার হাজার লোক হাটখোলা রোডের দুপাশের ফুটপাথে জড়ো হয়েছে রানিকে একনজর দেখার জন্য। নিরাপত্তার কঠোর বেষ্টনী ভেঙে পড়ছে। আমিও সেই জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে শরীর ঝলসানো রোদের মধ্যে অপেক্ষা করেছি রানিকে খুব কাছ থেকে একনজর দেখার আশায়।
একটা ছাদখোলা বড় পিকআপ ধরনের গাড়িতে রানি দাঁড়িয়ে আছেন। পথিপাশ্র্বের জনতার অভিবাদন গ্রহণ করার জন্য তিনি হাত কপালে ঠেকিয়ে রেখেছেন। গাড়িতে তাঁর পেছনে আরো লোক। সিকিউরিটির লোক, এমনকি ডিউকও বসে আছেন। তিনি কুইনের কনসোর্ট। রানির পাশে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল। শুনলাম, সেই আদমজী থেকে রানি এভাবে গাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মাথার ওপর একটা ছাতি ধরাও হয়নি। অন্তত আমার মনে পড়ছে না। শীতের দেশের রানি। বাংলাদেশের এই প্রচণ্ড গরমে প্রখর রোদে দিনি আদমজী থেকে ঢাকা- এই ১০ মাইল পথ রোদ মাথায় খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন, এই দৃশ্যটি এখনো আমার চোখে ভাসে। এখন জানি, এ যুগে রাজা-রানি হওয়াটা যতটা সুখের বলে আমরা ভাবি, তা ততটা সুখের নয়।
ব্রিটেনের মহামান্যা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে একেবারে মুখোমুখি দেখার এবং তাঁর সঙ্গে শেক হ্যান্ড করার বিরল সৌভাগ্যের কথাটা বলি। এখন তো হচ্ছে তাঁর ডায়মন্ড জুবিলি উৎসব; গত শনিবার (২ জুন) ইপসমে ডার্বির ঘোড়দৌড় দেখার মধ্য দিয়ে যে উৎসবের শুরু, তা শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার (৫ জুন) লন্ডনের সেন্ট পলস গির্জায় থ্যাংকস গিভিং সার্ভিসের মধ্য দিয়ে। মাঝখানে দুদিন রবি ও সোমবার শুধু লন্ডন নয়, সারা ব্রিটেন আনন্দে-উল্লাসে, আলোকসজ্জায় মেতে উঠেছিল। টেমস নদীতে নৌমহড়া ও রানির নৌবিহার দেখতে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ চোখে দেখার মতো ঘটনা। ব্রিটেনের মানুষ যে এই রানিকে এবং রাজতন্ত্রকে এখনো ভালোবাসে, এটা তার প্রমাণ।
যা হোক, আমি বলছি রানির আগের সিলভার জুবিলির সময়ের কথা। আমি তখন লন্ডনে এসেছি বছর কয়েক হয়। একটা বাংলা সাপ্তাহিক কাগজ সম্পাদনা করি। বাকিংহাম প্যালেসে ব্রিটেনের এথনিক কমিউনিটির প্রতিনিধি ও এথনিক কাগজের সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রানির সঙ্গে দেখা করার জন্য। সৌভাগ্যক্রমে আমিও একটা কার্ড পেলাম। কিন্তু প্যালেসে ঢোকার জন্য যে স্যুট-টাই পরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা আমার নেই। আমার গাড়িতে সামনের কাচে লাগানোর জন্য স্টিকার এবং সিকিউরিটি পেপার দেওয়া হয়েছে। আমার তো গাড়িই নেই।
প্রবীণ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল মতিন তখন লন্ডনে ইউকেআইএএসের (ইউনাইটেড কিংডম ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজরি সার্ভিস) অফিসে চাকরি করেন। তিনি বুদ্ধি বাতলে দিলেন। কভেন গার্ডেনের কাছে মোস ব্রাদার্স বলে একটা দোকান আছে; তারা দামি স্যুট-টাই ভাড়া দেয়। আমি এক দিনের জন্য রানির দরবারে যাওয়ার ড্রেসকোড অনুযায়ী ড্রেস ভাড়া করতে পারি। তারপর বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে গাড়ি ধার পাওয়া না গেলে ট্রাফালগার স্কয়ারের কাছ থেকে একটা ক্যাব (ব্ল্যাক ট্যাক্সি নয়) ভাড়া করে তাতে স্টিকার ইত্যাদি লাগিয়ে প্যালেসে ঢুকলেই চলবে। ক্যাব ড্রাইভারকেও সেভাবেই শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে। আমি মতিন ভাইয়ের পরামর্শ মেনে সেবার এভাবেই বাকিংহাম প্যালেসে ঢুকেছিলাম।
অনুষ্ঠানের প্রথমেই ছিল দরবারকক্ষে রানির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ। রানি আনুষ্ঠানিক পোশাক পরে তাঁর আসনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছি। এক এক করে তাঁর সামনে গিয়ে করমর্দন করে ফিরে আসছি। আমি আনাড়ি। রানির সঙ্গে করমর্দন (আসলে তাঁর গ্লাভস পরা আঙুল ছোঁয়া) সেরে ফিরে আসতে যাচ্ছি, কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা এক প্যালেস প্রহরী আমাকে পেছন ফিরতে দিলেন না। নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। রানির দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াতে নেই। তাঁর দিকে মাথা নিচু রেখে এবং একপা-দুপা করে পেছনে হেঁটে এসে তারপর পেছন ঘুরতে হবে। এই ভুলটা করে লজ্জা পেয়েছিলাম। দেখি, পাশে দাঁড়ানো প্রিন্স ফিলিপ মৃদু মৃদু হাসছেন।
দরবার হলের বাইরে প্রশস্ত বারান্দায় টেবিলে স্ন্যাকস ও পানীয় সাজানো। দরবার হল থেকে ফিরে এসে সবাই তা খাচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রানি এই আমন্ত্রিতদের ভিড়ের কাছে চলে আসেন। এবার তাঁর একেবারে সাদাসিধে পোশাক। সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছেন; সেই রাজকীয় দূরত্ব আর নেই। সেই সমাবেশে সাদা-কালো সব বর্ণের নরনারী ছিলেন। তাঁরা কেউ কেউ রানির গায়ে হাত দিয়ে পর্যন্ত কথা বলছেন। কেউ কেউ গায়ে গা লাগিয়ে কথা বলছেন। তিনি কিছু মনে করছেন না। খুবই অন্তরঙ্গভাবে কথা বলছেন। আমাদের মতো দেশগুলোর প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীদের এত কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যায় না। এখন না হয় সিকিউরিটির কড়াকড়ির যুগ। কিন্তু এত সিকিউরিটির কড়াকড়ি যখন ছিল না, তখনো অনেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঘেঁষা সহজ ছিল না।
প্রিন্স ফিলিপকে ঘিরেও তখন অনেক ভিড়। আমি সেই ভিড় এড়িয়ে রানির কাছে এগোনোর চেষ্টা করলাম। ইচ্ছা তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলি। অনেক কষ্টে তাঁর একটু কাছাকাছি গিয়ে বললাম, হার ম্যাজেস্টি, আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ। বিস্ময়ের কথা। রানি বাংলাদেশ কথাটি শুনেই আমার দিকে ফিরে তাকালেন। বললেন, 'আর ইউ? হোয়াট'স দ্য নিউজ অব ইওর কান্ট্রি?' বাংলাদেশে তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। দেশটিতে যে এখনো গণতন্ত্র নেই, সে কথাই রাণীকে বলতে যাচ্ছিলাম। অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন দোহা সাহেব। শামসুদ্দোহা। তখন ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার। তিনি আমার কথায় বাধা দিতে রানিকে অন্য কী বলতে যাচ্ছিলেন। রাণী স্মিত হাসি হেসে তাঁকে বললেন, 'আই অ্যাম লিসেনিং টু হিম।' বলে আমাকে দেখালেন। আমি অবশ্য আর কথা বলিনি। দোহা সাহেবও চুপ।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে তার পরও একবার আমি কিছুটা কাছে থেকে দেখেছি। এ বছরেও বাকিংহাম প্যালেসে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। যেতে পারিনি। শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। এ মাসে তাঁর ডায়মন্ড জুবিলি উপলক্ষে চার দিন ধরে লন্ডনসহ সারা যুক্তরাজ্যে যে আনন্দ-উল্লাসের প্লাবন দেখলাম, তাতে বিস্মিত হয়ে ভাবছি, যেখানে নির্বাচিত ক্যামেরন সরকারের জনপ্রিয়তা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়, সেখানে ৬০ বছর ধরে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জনপ্রিয়তা এখনো তুঙ্গে। রহস্যটা কোথায়?
আমি রাজতন্ত্র পছন্দ করি না। কিন্তু ব্রিটিশ মনার্কিকে রাজতন্ত্র বলা চলে না। এটা একটা বিস্ময়কর ইনস্টিটিউশন। রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের সম্মিলনে এটা একটা মানবিক প্রতিষ্ঠান। এটা ঠিক গণতন্ত্র নয়, কিন্তু গণতন্ত্রের মাথার ওপর একটি নির্ভরযোগ্য ছাতা। ব্রিটিশ মনার্কের মাথায় মুকুট আছে, ক্ষমতা নেই। তাঁরা প্রজাদের শাসন করেন না, সার্ভিস দেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৬০ বছর ধরে ব্রিটিশ ও কমনওয়েলথের জনগণকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সেই সেবা দিয়ে এক গৌরবোজ্জ্বল রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।
প্রাচীনকালে হতো, এখন আর ব্রিটিশ রাজা-রানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা ক্যু হয় না। আরব স্প্রিং তো নয়ই। ব্রিটিশ রাজা বা রানিরাও আবার নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করেন না। যেমন করা হয়ে থাকে এশিয়া-আফ্রিকার বহু তথাকথিত প্রজাতান্ত্রিক দেশে। অতীতের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের লিগ্যাসি বহন করে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রও। কিন্তু রাজতন্ত্রবিহীন, গণতন্ত্রের লেবেল আঁটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের বর্তমান চেহারার কাছে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের চেহারা এখনো অনেক বেশি মানবিক। তাই কৈশোরে যেখানে স্লোগান দিয়েছি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক, সেখানে এখন মনে মনে বলি (স্লোগান দেওয়ার বয়স নেই), ব্রিটিশ গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক। এই গণতন্ত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল হিউম্যানফেস ব্রিটিশ রাজতন্ত্র।
লন্ডন, ৪ জুন সোমবার, ২০১২
No comments