চিরকুট-দেয়ালশিল্প by শাহাদুজ্জামান
দেয়ালকে মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়ার উদাহরণ প্রাচীন। মানুষের আদিম শিল্প গুহাচিত্র আঁকা হয়েছিল গুহার দেয়ালেই। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান নগরেও নানা রকম দেয়াললিখন ও দেয়ালচিত্রের নিদর্শন পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মান নািস বাহিনী ইহুদি-বিদ্বেষ ছড়াতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে দেয়াললিখন।
পরবর্তী কালে পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিপ্লব বিদ্রোহেও দেয়াললিখন পালন করে শক্তিশালী ভূমিকা। আমাদের দেশে দেয়াল লেখা আটপৌরে অভিজ্ঞতার অংশ। সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ বিভিন্ন কালপর্বে দেয়াল হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের প্রতিবাদ জানানোর ক্যানভাস। সক্রিয় রাজনীতি যাঁরা করেছেন, দেয়ালে ‘চিকা মারা’ তাঁদের কর্মকাণ্ডেরই অনিবার্য অঙ্গ।
পশ্চিমা দেশে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে পপ আর্টের সূত্র ধরে দেয়ালে ছবি আঁকার একটা হিড়িক পড়ে। বিশেষ করে নিউইয়র্কের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনগুলোকে, বার্লিনের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোকে রঙে-রেখায় ভরিয়ে দেয় কিছু তরুণ-তরুণী। এখন দেয়াললিখন ও দেয়ালচিত্রকে কেন্দ্র করে ‘গ্রাফিতি’ নামে আলাদা একটি শিল্পধারাই সৃষ্টি হয়েছে। শুধু বাড়ির দেয়াল নয়, বাস, ট্রামের দেয়াল, এমনকি রাস্তাকেও চিত্রময় করে তোলার চর্চা শুরু হয়েছে অনেক জায়গায়। দীর্ঘতম পথচিত্র এঁকে ডেনমার্কপ্রবাসী আমাদের দেশেরই শিল্পী কাজল রীতিমতো গিনেস বুকে নাম উঠিয়েছেন। অবশ্য গ্রাফিতিকে অনেকে কোনো উঁচু মাপের শিল্প ভাবতে রাজি নন, কেউ কেউ একে নগর আইনের পরিপন্থী একটি কাজ হিসেবেও বিবেচনা করেন। তবে নানা বিতর্ক সত্ত্বেও গ্রাফিতি আর্ট শিল্পের একটি বিশেষ শাখা হিসেবেই এখন বিবেচিত। সামপ্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত গ্রাফিতি শিল্পী ব্রিটেনের বাংকসি (Banksy)। বাংকসিকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্যময়তা। ঘনিষ্ঠজন ছাড়া তাঁকে কেউ কখনো দেখেননি, তিনি কখনো কোনো গণমাধ্যমে আসেন না কিন্তু তাঁর ছবি ছড়িয়ে রয়েছে লন্ডনসহ নানা শহরের অলিগলিতে। কখনো রাতের আঁধারে, কখনো ছদ্মবেশে স্প্রেপেইন্টে অতি দ্রুত ছবি এঁকে সটকে পড়েন তিনি। পুলিশ বাংকসিকে খুঁজে বেড়ায়। কারণ, তাঁর ছবিগুলো ঘোর রাজনৈতিক। মেট্রো স্টেশনে, বাড়ির দেয়ালে, আন্ডারপাসে, ওভারব্রিজে নানা অভিনব দেয়াললিখন আর বিচিত্র দেয়ালচিত্রে তিনি যুদ্ধ আর মুনাফায় ব্যস্ত রাষ্ট্রকে নিয়ে নানা ব্যঙ্গ করেন। তিনি মোনালিসার হাতে ধরিয়ে দেন রকেটলাঞ্চার, যিশুকে আঁকেন সুইসাইড বোম্বার হিসেবে। পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা বাংকসির গ্রাফিতিগুলো নিয়ে যে বইটি বেরিয়েছে, সেটি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বিস্মিত হয়েছি তাঁর বিষয় উপস্থাপনের সৃজনশীলতায় আর আঁকার দক্ষতায়। পৃথিবীর ছোট-বড় সব শহরের রাস্তার ধার আর দেয়ালগুলো এখন ছেয়ে আছে পণ্যের বিজ্ঞাপনে। ঘর থেকে বেরোলেই নগরবাসীকে গ্রাস করে বাহারি পণ্যের বিজ্ঞাপনী মিছিল। নগরবাসীকে এই বার্তা দেয় যে যতক্ষণ তোমার ঘরে ওসব পণ্য না পৌঁছাচ্ছে, ততক্ষণ তুমি ব্যর্থ, ক্ষুদ্র। বাংকসি বলেন, নগরদিগন্তকে তিনি এই বাজারি উত্পাত থেকে রক্ষা করে ভরিয়ে দিতে চান বিকল্প নান্দনিকতায়। তিনি তাঁর নগর দেয়ালে আঁকা ছবিগুলোকে উন্মুক্ত চিত্রকলা প্রদর্শনী বলেই দাবি করেন, যে প্রদর্শনী দেখতে যাওয়ার কোনো প্রবেশমূল্যের প্রয়োজন নেই, যে চিত্রকলার কোনো বিক্রয়মূল্যও নেই।
দেয়ালচিত্র তেমনভাবে বিকশিত না হলেও দেয়াললিখনের চর্চা আমাদের দেশে রমরমা। ঘর, বাড়ি, রাস্তার প্রকাশ্য দেয়াল থেকে শুরু করে টয়লেটের গোপন দেয়াল—সবই আমাদের মনের ভাব প্রকাশের অবারিত স্থান। অবশ্য শৌচাগারের নিভৃতে বসে মনের গোপন কথাগুলো জগেক জানানোর এই প্রবণতা আন্তর্জাতিক। পৃথিবীর বহু দেশের টয়লেটে আমি শুধু অশ্লীল বাক্য নয়, রাজনৈতিক ও দার্শনিক বার্তাও দেখেছি। আমাদের দেশে এমনকি বাস, ট্রাক, মিশুকের দেয়ালও সাহিত্যচর্চার জায়গা হিসেবে ব্যবহূত হয়। সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে থাকা এই বাক্যগুলো থেকেও একটি জনপদের মানুষের মনোজগতের একটি ধারণা পওয়া সম্ভব। জানা যেতে পারে তাদের প্রবণতা, ক্ষোভ, ভালোবাসা, আনন্দের কথা। আমাদের দেশের দেয়াললিখনের যে ভাষা তা হয়েতো কোনোভাবেই মেলানো যাবে না প্যারিস, নিউইয়র্ক বা সিডনির কোনো দেয়াললিখনের সঙ্গে। আমাদের রাজপথের প্রকাশ্য দেয়ালে যখন স্পষ্ট লেখা থাকে কোনো নেতার চামড়া তুলে নেওয়ার অভিপ্রায়, তখন এই জনপদের রাজনীতির হিংস্র চেহারাটিই তাতে স্পষ্ট হয়। এখানে বাসের ভেতর লেখা থাকে বিবিধ নীতিবাক্য, উপদেশ, লেখা থাকে ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’। বোঝা যায়, এ জাতি উপদেশ দেওয়ার বেলায় পারঙ্গম, সেই সঙ্গে এও বোঝা যায় যে বংশ বিষয়টি এই জনপদের অনেক গভীরে প্রোথিত। ট্রাকের ডিজেলের ট্যাংকে লেখা ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, এই জনপদের শ্রমজীবী মানুষের কঠিন জীবনের ফাঁকে উঁকি দেওয়া রসবোধটিই প্রকাশ করে। মিশুকের গায়ে যখন লেখা থাকে ‘আমি ছোট, আমাকে মেরো না’ তখন বুঝতে হয়, এটি এমন এক জনপদ, যার প্রতিটি স্তর ছোট ও বড়তে বিভক্ত এবং ছোটকে বেঁচে থাকতে হয় বড়দের কৃপায়ই। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে লেখা একটি ব্যতিক্রমী শব্দবন্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আমার। লেখা ছিল ‘কষ্টে আছি’। কোনো দাবি নয়, আক্রোশ নয়, কারও গুণকীর্তন নয়, কোনো স্লোগান নয়, শুধু ছোট্ট একটি সংবাদ। এই ছোট দুটো শব্দে যেন একটি জনপদের মনের গোপন কথা ফুটে উঠেছে। কষ্টে আছে সবাই। নানা রকম কষ্ট। দেখতে পাচ্ছি দেয়াল নামের প্রাচীন এই ক্যানভাসের ব্যবহার চলছে অবিরাম। যদিও তা গুহাবাসীদের মতো আত্মপ্রকাশের জন্য যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে আত্মপ্রচারের জন্য।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
পশ্চিমা দেশে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে পপ আর্টের সূত্র ধরে দেয়ালে ছবি আঁকার একটা হিড়িক পড়ে। বিশেষ করে নিউইয়র্কের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনগুলোকে, বার্লিনের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোকে রঙে-রেখায় ভরিয়ে দেয় কিছু তরুণ-তরুণী। এখন দেয়াললিখন ও দেয়ালচিত্রকে কেন্দ্র করে ‘গ্রাফিতি’ নামে আলাদা একটি শিল্পধারাই সৃষ্টি হয়েছে। শুধু বাড়ির দেয়াল নয়, বাস, ট্রামের দেয়াল, এমনকি রাস্তাকেও চিত্রময় করে তোলার চর্চা শুরু হয়েছে অনেক জায়গায়। দীর্ঘতম পথচিত্র এঁকে ডেনমার্কপ্রবাসী আমাদের দেশেরই শিল্পী কাজল রীতিমতো গিনেস বুকে নাম উঠিয়েছেন। অবশ্য গ্রাফিতিকে অনেকে কোনো উঁচু মাপের শিল্প ভাবতে রাজি নন, কেউ কেউ একে নগর আইনের পরিপন্থী একটি কাজ হিসেবেও বিবেচনা করেন। তবে নানা বিতর্ক সত্ত্বেও গ্রাফিতি আর্ট শিল্পের একটি বিশেষ শাখা হিসেবেই এখন বিবেচিত। সামপ্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত গ্রাফিতি শিল্পী ব্রিটেনের বাংকসি (Banksy)। বাংকসিকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্যময়তা। ঘনিষ্ঠজন ছাড়া তাঁকে কেউ কখনো দেখেননি, তিনি কখনো কোনো গণমাধ্যমে আসেন না কিন্তু তাঁর ছবি ছড়িয়ে রয়েছে লন্ডনসহ নানা শহরের অলিগলিতে। কখনো রাতের আঁধারে, কখনো ছদ্মবেশে স্প্রেপেইন্টে অতি দ্রুত ছবি এঁকে সটকে পড়েন তিনি। পুলিশ বাংকসিকে খুঁজে বেড়ায়। কারণ, তাঁর ছবিগুলো ঘোর রাজনৈতিক। মেট্রো স্টেশনে, বাড়ির দেয়ালে, আন্ডারপাসে, ওভারব্রিজে নানা অভিনব দেয়াললিখন আর বিচিত্র দেয়ালচিত্রে তিনি যুদ্ধ আর মুনাফায় ব্যস্ত রাষ্ট্রকে নিয়ে নানা ব্যঙ্গ করেন। তিনি মোনালিসার হাতে ধরিয়ে দেন রকেটলাঞ্চার, যিশুকে আঁকেন সুইসাইড বোম্বার হিসেবে। পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা বাংকসির গ্রাফিতিগুলো নিয়ে যে বইটি বেরিয়েছে, সেটি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বিস্মিত হয়েছি তাঁর বিষয় উপস্থাপনের সৃজনশীলতায় আর আঁকার দক্ষতায়। পৃথিবীর ছোট-বড় সব শহরের রাস্তার ধার আর দেয়ালগুলো এখন ছেয়ে আছে পণ্যের বিজ্ঞাপনে। ঘর থেকে বেরোলেই নগরবাসীকে গ্রাস করে বাহারি পণ্যের বিজ্ঞাপনী মিছিল। নগরবাসীকে এই বার্তা দেয় যে যতক্ষণ তোমার ঘরে ওসব পণ্য না পৌঁছাচ্ছে, ততক্ষণ তুমি ব্যর্থ, ক্ষুদ্র। বাংকসি বলেন, নগরদিগন্তকে তিনি এই বাজারি উত্পাত থেকে রক্ষা করে ভরিয়ে দিতে চান বিকল্প নান্দনিকতায়। তিনি তাঁর নগর দেয়ালে আঁকা ছবিগুলোকে উন্মুক্ত চিত্রকলা প্রদর্শনী বলেই দাবি করেন, যে প্রদর্শনী দেখতে যাওয়ার কোনো প্রবেশমূল্যের প্রয়োজন নেই, যে চিত্রকলার কোনো বিক্রয়মূল্যও নেই।
দেয়ালচিত্র তেমনভাবে বিকশিত না হলেও দেয়াললিখনের চর্চা আমাদের দেশে রমরমা। ঘর, বাড়ি, রাস্তার প্রকাশ্য দেয়াল থেকে শুরু করে টয়লেটের গোপন দেয়াল—সবই আমাদের মনের ভাব প্রকাশের অবারিত স্থান। অবশ্য শৌচাগারের নিভৃতে বসে মনের গোপন কথাগুলো জগেক জানানোর এই প্রবণতা আন্তর্জাতিক। পৃথিবীর বহু দেশের টয়লেটে আমি শুধু অশ্লীল বাক্য নয়, রাজনৈতিক ও দার্শনিক বার্তাও দেখেছি। আমাদের দেশে এমনকি বাস, ট্রাক, মিশুকের দেয়ালও সাহিত্যচর্চার জায়গা হিসেবে ব্যবহূত হয়। সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে থাকা এই বাক্যগুলো থেকেও একটি জনপদের মানুষের মনোজগতের একটি ধারণা পওয়া সম্ভব। জানা যেতে পারে তাদের প্রবণতা, ক্ষোভ, ভালোবাসা, আনন্দের কথা। আমাদের দেশের দেয়াললিখনের যে ভাষা তা হয়েতো কোনোভাবেই মেলানো যাবে না প্যারিস, নিউইয়র্ক বা সিডনির কোনো দেয়াললিখনের সঙ্গে। আমাদের রাজপথের প্রকাশ্য দেয়ালে যখন স্পষ্ট লেখা থাকে কোনো নেতার চামড়া তুলে নেওয়ার অভিপ্রায়, তখন এই জনপদের রাজনীতির হিংস্র চেহারাটিই তাতে স্পষ্ট হয়। এখানে বাসের ভেতর লেখা থাকে বিবিধ নীতিবাক্য, উপদেশ, লেখা থাকে ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’। বোঝা যায়, এ জাতি উপদেশ দেওয়ার বেলায় পারঙ্গম, সেই সঙ্গে এও বোঝা যায় যে বংশ বিষয়টি এই জনপদের অনেক গভীরে প্রোথিত। ট্রাকের ডিজেলের ট্যাংকে লেখা ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, এই জনপদের শ্রমজীবী মানুষের কঠিন জীবনের ফাঁকে উঁকি দেওয়া রসবোধটিই প্রকাশ করে। মিশুকের গায়ে যখন লেখা থাকে ‘আমি ছোট, আমাকে মেরো না’ তখন বুঝতে হয়, এটি এমন এক জনপদ, যার প্রতিটি স্তর ছোট ও বড়তে বিভক্ত এবং ছোটকে বেঁচে থাকতে হয় বড়দের কৃপায়ই। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে লেখা একটি ব্যতিক্রমী শব্দবন্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আমার। লেখা ছিল ‘কষ্টে আছি’। কোনো দাবি নয়, আক্রোশ নয়, কারও গুণকীর্তন নয়, কোনো স্লোগান নয়, শুধু ছোট্ট একটি সংবাদ। এই ছোট দুটো শব্দে যেন একটি জনপদের মনের গোপন কথা ফুটে উঠেছে। কষ্টে আছে সবাই। নানা রকম কষ্ট। দেখতে পাচ্ছি দেয়াল নামের প্রাচীন এই ক্যানভাসের ব্যবহার চলছে অবিরাম। যদিও তা গুহাবাসীদের মতো আত্মপ্রকাশের জন্য যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে আত্মপ্রচারের জন্য।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments