বাঘা তেঁতুল-নিরাপদ দূরত্ব-তত্ত্ব by সৈয়দ আবুল মকসুদ
এ মাটির মানুষের এমনই নিয়তি যে রাস্তায় বেরোলে গাড়িচাপা পড়ে মরে। গাড়ির যাত্রী হলে গাড়িসহ খাদের মধ্যে গিয়ে পড়ে মরে। আমরা বললাম, চালকদের একটু ভালোমতো যোগ্যতা পরীক্ষা করে লাইসেন্স দিন। চালকদের অকৃত্রিম সুহূদ সে অনুরোধ খারিজ করে দিয়ে মন্ত্রী উপস্থিত করলেন তাঁর ‘গরু-ছাগল চেনা তত্ত্ব’।
রাস্তাঘাট, কোর্টকাচারিতে সাংবাদিকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে পোশাক পরা জনগণের বন্ধুরা তাদের বেদম মারধর করেন। আরজি করা হলো: মারধর ভালো লাগে না, তাদের একটু সামলান। প্রত্যুত্তরে তাদের মালিক উপহার দিলেন ‘নিরাপদ দূরত্ব থিওরি’।
সব চালক মানুষ মারেন না। সব পুলিশও সাংবাদিক ও শিক্ষকদের মারেন না। যাঁরা সড়কে দুর্ঘটনা ঘটান ও সংবাদমাধ্যম কর্মীদের মারেন, শিক্ষকদের পেটান, আমরা শুধু তাদেরই সামলাতে বলেছিলাম। পরিণামে জাতি উপহার পেয়েছে দুই তত্ত্ব: গরু-ছাগল চেনা তত্ত্ব এবং নিরাপদ দূরত্ব-তত্ত্ব। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের মতো এ দুই তত্ত্বও মানুষ মনে রাখবে বহুকাল।
মাননীয় ঠিকই বলেছেন, দূরত্বটা হতে হবে নিরাপদ। যে দূরত্বে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তার চেয়ে বেশ দূরে। তবে সেই নিরাপদ দূরত্ব গজ-ফিতার হিসাবে কতটা, তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। এক শ গজ না আড়াই শ গজ—তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। মাপজোখ করে কোনো অধিবেশনে হয়তো আইন পাস হবে: ‘সংবাদমাধ্যমের লোকদের জনগণের বন্ধুদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা আইন ২০১২’।
নিরাপদ দূরত্ব রক্ষার উপদেশ দেওয়া হয়েছে দুটি কারণে। এক. তাতে সংবাদমাধ্যম কর্মীরা শারীরিকভাবে অক্ষত থাকবেন। হাড্ডি গুঁড়া হবে না। পায়ের মাংসপেশি থেঁতলে যাবে না। ঊরুর হাড় লাথিতে ভাঙবে না। ঘুষিতে ফাটবে না নাক। চড়থাপ্পড়ে মুখমণ্ডল ফুলে হবে না মিষ্টি কুমড়ার মতো গোল।
দুই. জনগণের বন্ধুদের থেকে সংবাদকর্মীরা যত দূরে থাকবেন তত তাঁরা কম দেখবেন। আসল ঘটনা কম জানবেন, ফলে জনগণও কম জানবে। নিরাপদ দূরত্বে থেকে ছবি তোলায় প্রকৃত ঘটনা ক্যামেরায় ধরা পড়বে না। জনগণ যত কম জানবে ও দেখবে, তত তারা দূরে থাকবে সত্য থেকে। সত্য থেকে জনগণকে দূরে রাখাই নিরাপদ দূরত্বের মর্মবাণী।
সংবাদকর্মীরা জনগণের বন্ধুদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকলে কোনো পৌরাণিক মহাকাব্য অশুদ্ধ হবে না। কিন্তু কোনো নারীর (বিশেষ করে থুত্থুরে বুড়ি না হয়ে যদি যুবতী হন) বন্ধুদের থেকে দূরত্বটা শুধু নিরাপদ হলে হবে না—তাকে থাকতে হবে নিরাপদতম দূরত্বে। কোনো বিপদে পড়ে যদি তার পুলিশের ও আইনের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তা হলে তাকে আদালতে আরজি পেশ করতে হবে আধা কিলোমিটার দূর থেকে। মাইকযোগে তাকে জানাতে হবে কে তার শ্লীলতাহানি করেছে বা করার আয়োজন করেছিল। পুলিশের কাছে এসে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার শ্লীলতাহানির ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকাই বুদ্ধিমতীর কাজ।
একজন পুরুষের পক্ষে কোনো নারীর শ্লীলতাহানির যন্ত্রণা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু আরেকজন নারীর পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ। সে নারী পর্বতারোহী বা সাংবাদিক বা মন্ত্রী হোন। যদি আদর করেও টেনেহিঁচড়ে কোনো মেয়েকে তার বাপ-মার সামনে তাদের ক্লাবে নেয়, নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা নির্যাতন করে, কোনো কোনো রাষ্ট্রে তা বড় অপরাধমূলক কাজ না হতে পারে, কিন্তু কাজটা যে জঘন্য তা কোনো নারী মন্ত্রীর পক্ষে না বোঝার কথা নয়। ঘটনাটির কথা তাঁর কানে যাওয়া মাত্র তাঁর বারুদের মতো জ্বলে ওঠার কথা। একটি মেয়ের ইজ্জতের চেয়ে একটি পুলিশের চাকরির মায়া বেশি! বর্বর যুগেও নারীর ওপর নির্যাতন কোনো সমাজই সহ্য করত না।
যে রাষ্ট্রে আদালত প্রাঙ্গণে বিচার চাইতে গিয়ে নারীকে সম্ভ্রম হারাতে হয়, সে রাষ্ট্র আইয়ামে জাহেলিয়াতের চেয়ে জঘন্য। তারপর ইজ্জত হারানোর প্রতিকার তো দূরের কথা, নির্যাতিতা যদি প্রভুদের মৌখিক সান্ত্বনাটুকুও না পায়, তারচেয়ে নিষ্ঠুরতা আর হতে পারে না। এ ধরনের অপরাধীর বিচার হওয়া উচিত তাৎক্ষণিক, যেমন হরতালের দিনে মোবাইল কোর্টে হয়। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অল্পসংখ্যক চালক। সাংবাদিক, শিক্ষক ও নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত অল্প কয়েকজন জনগণের বন্ধু। সেই ঘাতক চালক ও নির্যাতক পুলিশের পক্ষে অবস্থান নিলে দক্ষ ও ভালো চালক এবং দক্ষ ও সজ্জন পুলিশকেই অপমান করা হয়।
এ মাটিতে অযোগ্য, অদক্ষ ও অসাধু পান উচ্চাসন। সভা-সমাবেশ-গোলটেবিলে বাচাল ও বেসৎ মানুষের কথা দেশবাসী আড়িপেতে শোনে। এক প্রসিদ্ধ মন্ত্রী বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে পদত্যাগ করতে। কারণ তিনি ব্যর্থ। কিন্তু মাননীয় তো খুব ভালো জানেন, বাংলার মাটিতে পদত্যাগ করলেও তা গৃহীত হয় না। সাংসদের পদত্যাগ গৃহীত হয় না। প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয় না। মন্ত্রীরটা হয় না। বিরোধীদলীয় নেত্রী যদি পদত্যাগ করেনও তা গৃহীত হবে না। তাঁর বেতন-ভাতা-বাড়িভাড়া জমা হবে ব্যাংকে। সংসদ সচিবালয় থেকে বলা হবে: পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে করা হলো দপ্তরবিহীন বিরোধীদলীয় নেত্রী।
উঁচু আসনে বসা ব্যক্তিদের কথাবার্তা হুঁশ করে বলা ভালো। নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ ঘটে তেমন বক্তব্য না দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সব চালক মানুষ মারেন না। সব পুলিশও সাংবাদিক ও শিক্ষকদের মারেন না। যাঁরা সড়কে দুর্ঘটনা ঘটান ও সংবাদমাধ্যম কর্মীদের মারেন, শিক্ষকদের পেটান, আমরা শুধু তাদেরই সামলাতে বলেছিলাম। পরিণামে জাতি উপহার পেয়েছে দুই তত্ত্ব: গরু-ছাগল চেনা তত্ত্ব এবং নিরাপদ দূরত্ব-তত্ত্ব। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের মতো এ দুই তত্ত্বও মানুষ মনে রাখবে বহুকাল।
মাননীয় ঠিকই বলেছেন, দূরত্বটা হতে হবে নিরাপদ। যে দূরত্বে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তার চেয়ে বেশ দূরে। তবে সেই নিরাপদ দূরত্ব গজ-ফিতার হিসাবে কতটা, তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। এক শ গজ না আড়াই শ গজ—তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। মাপজোখ করে কোনো অধিবেশনে হয়তো আইন পাস হবে: ‘সংবাদমাধ্যমের লোকদের জনগণের বন্ধুদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা আইন ২০১২’।
নিরাপদ দূরত্ব রক্ষার উপদেশ দেওয়া হয়েছে দুটি কারণে। এক. তাতে সংবাদমাধ্যম কর্মীরা শারীরিকভাবে অক্ষত থাকবেন। হাড্ডি গুঁড়া হবে না। পায়ের মাংসপেশি থেঁতলে যাবে না। ঊরুর হাড় লাথিতে ভাঙবে না। ঘুষিতে ফাটবে না নাক। চড়থাপ্পড়ে মুখমণ্ডল ফুলে হবে না মিষ্টি কুমড়ার মতো গোল।
দুই. জনগণের বন্ধুদের থেকে সংবাদকর্মীরা যত দূরে থাকবেন তত তাঁরা কম দেখবেন। আসল ঘটনা কম জানবেন, ফলে জনগণও কম জানবে। নিরাপদ দূরত্বে থেকে ছবি তোলায় প্রকৃত ঘটনা ক্যামেরায় ধরা পড়বে না। জনগণ যত কম জানবে ও দেখবে, তত তারা দূরে থাকবে সত্য থেকে। সত্য থেকে জনগণকে দূরে রাখাই নিরাপদ দূরত্বের মর্মবাণী।
সংবাদকর্মীরা জনগণের বন্ধুদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকলে কোনো পৌরাণিক মহাকাব্য অশুদ্ধ হবে না। কিন্তু কোনো নারীর (বিশেষ করে থুত্থুরে বুড়ি না হয়ে যদি যুবতী হন) বন্ধুদের থেকে দূরত্বটা শুধু নিরাপদ হলে হবে না—তাকে থাকতে হবে নিরাপদতম দূরত্বে। কোনো বিপদে পড়ে যদি তার পুলিশের ও আইনের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তা হলে তাকে আদালতে আরজি পেশ করতে হবে আধা কিলোমিটার দূর থেকে। মাইকযোগে তাকে জানাতে হবে কে তার শ্লীলতাহানি করেছে বা করার আয়োজন করেছিল। পুলিশের কাছে এসে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার শ্লীলতাহানির ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকাই বুদ্ধিমতীর কাজ।
একজন পুরুষের পক্ষে কোনো নারীর শ্লীলতাহানির যন্ত্রণা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু আরেকজন নারীর পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ। সে নারী পর্বতারোহী বা সাংবাদিক বা মন্ত্রী হোন। যদি আদর করেও টেনেহিঁচড়ে কোনো মেয়েকে তার বাপ-মার সামনে তাদের ক্লাবে নেয়, নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা নির্যাতন করে, কোনো কোনো রাষ্ট্রে তা বড় অপরাধমূলক কাজ না হতে পারে, কিন্তু কাজটা যে জঘন্য তা কোনো নারী মন্ত্রীর পক্ষে না বোঝার কথা নয়। ঘটনাটির কথা তাঁর কানে যাওয়া মাত্র তাঁর বারুদের মতো জ্বলে ওঠার কথা। একটি মেয়ের ইজ্জতের চেয়ে একটি পুলিশের চাকরির মায়া বেশি! বর্বর যুগেও নারীর ওপর নির্যাতন কোনো সমাজই সহ্য করত না।
যে রাষ্ট্রে আদালত প্রাঙ্গণে বিচার চাইতে গিয়ে নারীকে সম্ভ্রম হারাতে হয়, সে রাষ্ট্র আইয়ামে জাহেলিয়াতের চেয়ে জঘন্য। তারপর ইজ্জত হারানোর প্রতিকার তো দূরের কথা, নির্যাতিতা যদি প্রভুদের মৌখিক সান্ত্বনাটুকুও না পায়, তারচেয়ে নিষ্ঠুরতা আর হতে পারে না। এ ধরনের অপরাধীর বিচার হওয়া উচিত তাৎক্ষণিক, যেমন হরতালের দিনে মোবাইল কোর্টে হয়। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অল্পসংখ্যক চালক। সাংবাদিক, শিক্ষক ও নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত অল্প কয়েকজন জনগণের বন্ধু। সেই ঘাতক চালক ও নির্যাতক পুলিশের পক্ষে অবস্থান নিলে দক্ষ ও ভালো চালক এবং দক্ষ ও সজ্জন পুলিশকেই অপমান করা হয়।
এ মাটিতে অযোগ্য, অদক্ষ ও অসাধু পান উচ্চাসন। সভা-সমাবেশ-গোলটেবিলে বাচাল ও বেসৎ মানুষের কথা দেশবাসী আড়িপেতে শোনে। এক প্রসিদ্ধ মন্ত্রী বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে পদত্যাগ করতে। কারণ তিনি ব্যর্থ। কিন্তু মাননীয় তো খুব ভালো জানেন, বাংলার মাটিতে পদত্যাগ করলেও তা গৃহীত হয় না। সাংসদের পদত্যাগ গৃহীত হয় না। প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয় না। মন্ত্রীরটা হয় না। বিরোধীদলীয় নেত্রী যদি পদত্যাগ করেনও তা গৃহীত হবে না। তাঁর বেতন-ভাতা-বাড়িভাড়া জমা হবে ব্যাংকে। সংসদ সচিবালয় থেকে বলা হবে: পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে করা হলো দপ্তরবিহীন বিরোধীদলীয় নেত্রী।
উঁচু আসনে বসা ব্যক্তিদের কথাবার্তা হুঁশ করে বলা ভালো। নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ ঘটে তেমন বক্তব্য না দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments