বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত রাহুমুক্ত করতে হবে-এখনো গেল না আঁধার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুঃখের গান ‘এখনো গেল না আঁধার’ যেন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জনিত হতাশার উপযুক্ত ভাষা। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এখনই অসহনীয়, রোজায় যে তা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সন্দেহ কেবল সরকারের এ যাবৎকালের প্রতিশ্রুতিতে।


গত শুক্রবারের প্রথম আলোর সংবাদ বলছে, বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা ও ঘাটতির পরিমাণও জানা নেই কারও। বর্তমান ঘাটতি দুই হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু পিডিবি বলছে, ঘাটতি এক হাজার ২৯০ মেগাওয়াট। রমজান মাসে উৎপাদন দৈনিক সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার কথা হলেও তার বাস্তবায়ন বরাবরের মতোই অনিশ্চিত। বিদ্যুতের ঘাটতি ও উৎপাদনের বিপরীত গতি যেন বাঁদরের তৈলাক্ত লাঠি বেয়ে ওঠা আর পিছলে পড়ার গল্প। এবং মনে হচ্ছে, এই গল্পের কোনো শেষ নেই!
প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে চাহিদা বাড়লেও পুরোনো কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা কমছে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের গতিও শামুকের মতোই ধীর। সংকট মেটাতে সরকার বাণিজ্যিক ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পথ নিয়েছে। এতে সময় লাগবে তিন থেকে নয় মাস এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ থেকে মাত্র ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য খরচ হবে ছয় থেকে আট হাজার কোটি টাকা। অথচ বর্তমানে গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে ৮০০ মেগাওয়াট। চুক্তিমাফিক বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশীয় ক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহ করলে এই ঘাটতি থাকত না। তখন এই অর্থ নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ব্যয় করা যেত। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর নবায়ন ও মেরামত, ক্যাপাসিটর স্থাপন এবং সারা দেশে বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী বাতি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করলে বিদ্যুতের জোগান বর্তমান ঘাটতি মেটানোর কাছাকাছি হতে পারে।
বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত ভুল পরিকল্পনা, দুর্নীতি, অপচয় ও অব্যবস্থাপনার শিকার। গত প্রায় দুই দশকে নিজস্ব অর্থে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেনি কোনো সরকার। অথচ কেবল খুুঁটি পুঁতেই শত শত কোটি টাকার অপচয় হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) কোনো বিনিয়োগকারী সংস্থা বিদ্যুৎ খাতে কোনো আর্থিক সহায়তা তো দেয়ইনি, উল্টো তাদের অনেক শর্ত এই খাতের বিকাশে বাধা হয়েছে। এদিকে সংস্কারের অভাবে সরকারিভাবে স্থাপিত বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতাও কমছে, সেগুলো এখন জরাজীর্ণ অবস্থায়। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্যাস-সংকট। বাংলাদেশের মোট গ্যাস উৎপাদনের অর্ধেকটাই বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে। তারা চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন করছে না। উল্লেখ্য, ১৯৯৭-৯৮ সাল পর্যন্ত দেশের মোট গ্যাস জোগাত দেশীয় সংস্থা পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স; বেশির ভাগ সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্রগুলোও তাদেরই আবিষ্কার। কিন্তু ক্রমেই এ খাতে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ায় সার্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে।
নিজস্ব অর্থায়নে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা সদিচ্ছা ও পরিকল্পনার ব্যাপার। এ বিষয়ে আর কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। গ্যাসক্ষেত্রগুলো ইজারা নেওয়া কোম্পানিগুলো চুক্তিমাফিক গ্যাস সরবরাহ না করলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। অবিলম্বে পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মেরামত ও নবায়ন করতে হবে। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে নিজস্বভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দিতে হবে এবং তাদের উৎপাদিত বিদ্যুতের বাড়তি অংশ জাতীয় গ্রিডে আনার ব্যবস্থাও করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.