বাজেট ২০১২-১৩-মানুষের কষ্ট বেড়েছে by আবুল হাসনাত
মো. কামরুল ইসলাম একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। মাস শেষে বাসায় নিতে পারেন ৩০ হাজার ৮১৫ টাকা। বাসায় ফিরেই এই আয়ের প্রায় অর্ধেক দিয়ে আসতে হয় বাড়িওয়ালাকে। এরপর যা থাকে তা দিয়ে মাসের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খেতে হয়। কামরুল ইসলাম অবশ্য খানিকটা ভাগ্যবান।
দুই ঈদের বোনাসের বাইরে বছরে আড়াইটা বোনাস পান। তাতে আসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তিনি বললেন, ‘এই টাকা দিয়েই বাড়তি ব্যয় নির্বাহ করার চেষ্টা করি। তা-ও পারি না।’
ব্যয়বহুল এই রাজধানীতে কিছুটা মধ্যবিত্ত সরকারি চাকরিজীবীর জীবনযাপনেরই যখন এই অবস্থা, তখন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন অনেক বেশি দুর্বিষহ। পান্থপথে একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টের হিসাবরক্ষক সাহাদাত হোসেন সাড়ে আট হাজার টাকা বেতনের সঙ্গে বকশিশ (টিপস) হিসেবে আরও সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো পান। সাড়ে ছয় হাজার টাকা বাড়িভাড়া। বিদ্যুৎ ও গ্যাস বাবদ ব্যয় আরও এক হাজার টাকা। ডিশ, ময়লা ও পত্রিকার বিল এবং কাজের বুয়ার বেতন দিতে হয় এক হাজার ৬০০ টাকা। তিনজনের সংসারে খাবার খরচে চলে যায় বাকি টাকা। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে কিংবা বাসায় মেহমান এলেই ঘটে বিপত্তি।
বেশির ভাগ পণ্যের দামই সহনীয় পর্যায়ে নেই। ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তরিতরকারির দাম আজ কমছে তো কাল বাড়ছে। আপাতত চালের দাম স্থির। সামগ্রিকভাবে গত অর্থবছরের পুরোটা সময়েই নিত্যপণ্যের বাজার ছিল বেসামাল। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবহন এবং লাগামহীন বাড়িভাড়া বৃদ্ধিও সাধারণ মানুষকে কম ভোগাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ২০১১-১২ অর্থবছরে মূল্যবৃদ্ধির খড়্গ পড়েছে ভোক্তার ঘাড়ে। অনেকে অতি কষ্টের সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে। বেড়েছে ধার-কর্জনির্ভর জীবন। আগের চেয়ে কম খাওয়ার প্রবণতা গরিব মানুষদের মধ্যেই বেশি।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১১.৯৬ শতাংশ। ২০১১ সালে গড়ে বাড়িভাড়া বেড়েছে ১৫.৮৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত এপ্রিলে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট (আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়) ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, খাদ্যবহির্ভূত খাতে এখন মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাকাল: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে গত এক বছরে কেবল চালের দামই বাড়েনি। তাতে কিন্তু ভাত-মাছ খাওয়ার ইচ্ছার সুরাহা হয়নি। ১০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না কোনো মাছ। ডাল-ভাত কিংবা সবজি-ভাত যে খাবেন, তারও উপায় নেই। একদিকে হঠাৎ ডালের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে বর্ষাকালীন সবজি পুরোপুরি বাজারে না আসায় সবজির বাজারও গরম।
বাজারের যখন এই অবস্থা তখন দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারের নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। গত রমজানের পর চিনি কিংবা ভোজ্যতেলের দামও বেঁধে দেয়নি সরকার। এই সুযোগে আইনের তোয়াক্কা না করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বাড়িভাড়া লাগামহীন: ঢাকার বাসিন্দাদের বড় যাতনার নাম বাড়িভাড়া। শহরের সব প্রান্তেই বাড়িভাড়া লাগামহীন। ব্যাংক কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, মিরপুরের তালতলায় তিনি এখন যে বাসায় ভাড়া থাকেন, তার ভাড়া (গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎসহ) ২০০৬ সালে ছিল চার হাজার ৭০০ টাকা। এখন সব মিলিয়ে দিতে হয় ১১ হাজার ২৩০ টাকা। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর আমার বেতন বাড়ে ১২০০ টাকা। আর বছরে ওই সমান বাড়িভাড়াই বাড়ে।’
পরিবহন খাতে অরাজকতা: গত ২০ মে মতিঝিলের কার্যালয়ে কথা হয় চাকরিজীবী হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে। জানালেন, ‘সকালে মতিঝিল থেকে দয়াগঞ্জে যাব, সিএনজি ভাড়া চায় ১০০ টাকা। শেষ পর্যন্ত ৮০ টাকায় গেলাম। ফেরার পথে ঠিক ১০০ টাকাই নিয়েছে। অথচ, এই জায়গার দূরত্ব পৌনে দুই কিলোমিটারের বেশি হবে না।’
গত অর্থবছরে সরকার তিন দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। এতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগ। সিএনজি অটোরিকশায় চড়াই তো মুশকিল। এমনিতে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। তার ওপর ভাড়া ঠিক করে ওঠানোর পর যাত্রীদের কাছে চালকের অনুরোধ, ‘সার্জেন্ট ধরলে কইয়েন মিটারে যাইতাছেন।’
তদারকি নেই খাদ্যবহির্ভূত খাতে: খাদ্যপণ্যের বাজারে সরকারের কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা দেখা গেলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো সংস্থারই নিয়ন্ত্রণ কিংবা তদারকি নেই। যে কারণে খাদ্যবহির্ভূত খাতে ব্যয় বাড়ছে লাগামহীন।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। প্রাইভেট চেম্বারে কোনো চিকিৎসকই ৫০০ টাকার নিচে রোগী দেখেন না। রোগনির্ণয়ের নামেও নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। তা ছাড়া এক বছরে শিক্ষাব্যয়ও বেড়েছে কয়েক গুণ।
হারুন-অর-রশিদের বড় ছেলে সপ্তম ও ছোট ছেলে পড়ে কেজিতে। দুই ছেলের স্কুলের বেতন বাবদ মাসে দিতে হয় আড়াই হাজার টাকা। বড় ছেলের গৃহশিক্ষক ও প্রাইভেট পড়ার পেছনে দিতে হচ্ছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা।
নীলক্ষেত কর্মজীবী হোস্টেলের বাসিন্দা সাদিয়া আবেদিন বলেন, গত বছর বৈশাখে যে শাড়ি ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এ বছর তা-ই ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত সাত বছরের মধ্যে এবারই প্রথম বৈশাখ উদ্যাপনে শাড়ি কেনা হয়নি।
জীবন চলাই দায়: গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে দুই মাস সাহাদাত হোসেনের চাকরি ছিল না। ওই সময়েই তাঁর আড়াই বছর বয়সী ছেলেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। উপায় না দেখে সন্তানের চিকিৎসার জন্য তাঁকে স্ত্রীর কিছু গয়না বিক্রি করতে হয়।
সাহাদাত হোসেনের বক্তব্যের সত্যতা মেলে ক্যাবের প্রতিবেদনেও। তাতে বলা হয়, বাঁচার তাগিদে গত বছর অধিকাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। অনেকে অতি কষ্টের সঞ্চয়ও ভেঙে ফেলে। ফলে বাড়ে ধার-কর্জনির্ভর জীবন।
স্ত্রী-সন্তানদের একটু সুখে রাখতে রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে এসে ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন মো. হাসান আলী। রিকশার জমা বাদ দিয়ে গড়ে মাসে আয় হয় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। জানালেন, এক বছর আগেও তাঁর আয় হতো চার হাজার টাকার মতো। তখনো কোনো না-কোনোভাবে সংসার চলে যেত। এখন আয় বাড়লেও সংসার চালানোর কষ্ট আরও বেড়েছে।
সংকটে গরিব মানুষ: গত মার্চে এক গবেষণায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি বাংলাদেশ ও ভারতের বেশিসংখ্যক মানুষকে দরিদ্রসীমার নিচে নিয়ে যায়।
‘দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি: একটি গভীর এবং ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়, খাদ্যের মূল্য ১০ শতাংশ বাড়লে বাংলাদেশে আড়াই শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যায়, আর ৩০ শতাংশ দাম বাড়লে দরিদ্রসীমার নিচে নামে সাড়ে ৭ শতাংশ মানুষ। ভারতে এই হার যথাক্রমে ২ দশমিক ৭ শতাংশ ও ৮ দশমিক ১ শতাংশ।
এডিবি মনে করে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে খাদ্যের দাম বাড়লে দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। এ কারণে সরকারগুলোর উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বা খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।
নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগও বলেছিল, ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে।’ তিন বছরেও এই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে অর্থমন্ত্রীর জন্য এই চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে।
No comments