পরিবেশ ভাবনায় সবুজ দর্শন by কানন পুরকায়স্থ
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) 'সবুজ অর্থনীতি'কে এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেছে। তাদের ভাষায়- �Green economy : Does it include you?� এই সবুজ অর্থনীতি কী? এর সঙ্গে সবুজ দর্শনের সম্পর্ক কী? বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই অর্থনীতি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
ইউএনইপির ভাষায় সবুজ অর্থনীতি হচ্ছে সেই অর্থনীতি, যার ফলাফল হবে পরিবেশের ওপর ঝুঁকি এবং প্রতিবেশে (ecology) ঘাটতি না বাড়িয়ে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সামাজিক সমতার উন্নয়ন। অন্যভাবে বলা যায় যে সবুজ অর্থনীতিতে সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহার, নিম্নকার্বন অর্থনীতি এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ (social inclusiveness) নিশ্চিত হবে। তাই সবুজ অর্থনীতিতে সমাজের প্রতিটি মানুষ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না- এই সামাজিক মাত্রা নিয়ে আমরা এখন ভাবছি।
সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে পরিবেশ সাশ্রয়ী উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের আলোকে। তাই এ বছর ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিতব্য রিওভূমণ্ডলীয় সম্মেলনের বিংশতম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে আমরা অনুসন্ধান করব, সবুজ অর্থনীতি এবং পরিবেশ সাশ্রয়ী উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক কতটুকু। আমরা সাধারণভাবে বলি, সম্পর্ক রয়েছে; কিন্তু এই সম্পর্কের ব্যাপ্তি কতটুকু এবং তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কিভাবে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়নের একটি সাধারণ কাঠামো প্রণয়ন করা হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিরিখে কিভাবে এই কাঠামোর মধ্য থেকে নতুন পরিকাঠামো নির্মাণ করবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে, তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে রয়েছে এক সামাজিক দ্বন্দ্ব। তাই প্রস্তাব উঠেছে সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণের। এই দ্বন্দ্ব নতুন কোনো বিষয় নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪২ অব্দে রোমান কবি ভার্জিল (virgil) পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এ ধরনের সামাজিক দ্বন্দ্ব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ভার্জিল তাঁর �Ecologies� গ্রন্থে বর্ণনা করেন, কিভাবে জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর ভূমি দখল করে ক্ষমতাবানরা অপরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপন করেছিল। উল্লেখ্য, প্রাচীন ইতিহাসবিদদের মতে, ভার্জিলের পিতার কৃষিজমিও এভাবে বসতি স্থাপনের জন্য জোরপূর্বক দখল করা হয়।
দার্শনিক স্পিনোজা (Spinoza, 1632-77)-এর নৈতিক তত্ত্বে এবং ধারণাতত্ত্বে পরিবেশ বিষয়ে চিন্তাভাবনা প্রত্যক্ষ করি। স্পিনোজার দৃষ্টিতে এই প্রকৃতিতে 'সব কিছুই সব কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত'। তাঁর ধারণাতত্ত্বে আমরা পাই �degrees of rationality and degree of reality must be linked at every stage�। কিন্তু এ ধরনের সংযোগ থেকে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তা সহজে অনুধাবন করা যায়। একদিকে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে আর্থিক উন্নয়ন ও দেশের শ্রীবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা, অপরদিকে পরিবেশ সাশ্রয়ী উন্নয়ন বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রত্যয়। একে অপরের সম্পূরক ও পরিপূরক হতে পারে, কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক (geopolitical) বাস্তবতার কারণে এর বাস্তবায়ন সঠিকভাবে সম্ভব হয় না। সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের গ্রাস করলেও পরিবেশ নিয়ে ভার্জিলের কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্পিনোজার বাস্তবতা ও যুক্তির সমন্বয় সাধন আজও প্রাসঙ্গিক। এই সমন্বয় সাধনের ধারণা থেকে আমরা পাই সবুজ দর্শনের ধারণা, যে ধারণায় সবুজ অর্থনীতি একটি উপাদান মাত্র।
টমাস মালথাস (Thomus Malthus) অনুধাবন করেছিলেন যে মানুষের চাহিদা যে হারে ক্রমে বাড়ছে, সে হারে সম্পদের বৃদ্ধি সম্ভব নয়। কারণ প্রবৃদ্ধির একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মার্কস এবং এঙ্গেল মালথাসের এই ধারণাকে বলেছিলেন 'বালকসুলভ'। যদিও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্যের জোগান বাড়ানো সম্ভব এবং সেই অর্থে মালথাসের ধারণা অনেকে মনে করেন সঠিক নয়, কিন্তু আমাদের এই গ্রহের �Carrying capacity� বা সামর্থ্যের একটি সীমা রয়েছে, সেই অর্থে মালথাস সঠিক। ১৯৭৬ সালে ফ্রেড হার্স (Fred Hirsch) যুক্তি দেখান যে প্রাচুর্য যখন বৃদ্ধি পায়, তখন অন্তরঙ্গতা এবং প্রতিশ্রুতি হ্রাস পায়। এ থেকে জন্ম নেয় 'প্রবৃদ্ধির সামাজিক সীমাবদ্ধতা'। জন স্টুয়ার্ট মিল (John stuart Mill) এ বিষয়টি থেকে জাত বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন। তাই তিনি রাজ অর্থনৈতিক কাঠামোতে স্থিতাবস্থার অর্থনীতির (Steady state economy) ধারণা অন্তর্ভুক্ত করেন। মিল বিশ্বাস করতেন যে ভোক্তার চাহিদা স্থির থাকলে জোগান স্থির থাকবে। এই স্থিতাবস্থা না থাকলে আমরা সমাগত জরুরি অবস্থার মধ্যে থাকব। মিলের এই ধারণাটি এই সময়ে হারমান ডেলি (Herman Daley) পরিবেশ সংরক্ষণে শেষ ব্যবহার করেন। হারমানের মতে, সত্যিকার অর্থে পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হলে আমাদের এমন অর্থনীতি দরকার, যেখানে উৎপাদন থেকে ভোগ পর্যন্ত এর প্রতিটি ধাপে বস্তু ও শক্তির কার্যকর প্রবাহ নিম্নতম পর্যায়ে রাখতে হবে। কিন্তু ১৯৮৭ সালে নরওয়ের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারলেস ব্র্যান্ডল্যান্ড এই স্থিতাবস্থার অর্থনীতির ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। �Our common future�- শীর্ষক প্রতিবেদনে ব্র্যান্ডল্যান্ড 'প্রবৃদ্ধির সীমিতকরণ'কে চ্যালেঞ্জ করে বললেন প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু তা হতে হবে পরিবেশসাশ্রয়ী। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জীববিদ এডওয়ার্ড ও উইলসন (Edward O. wilson) উল্লেখ করেন যে জীববিদদের ভাষায় এই গ্রহের প্রতিটি প্রাণ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখানে একটি প্রজাতি ধ্বংস হলে অন্যান্য প্রজাতির ওপর তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। তাই পরিবেশসাশ্রয়ী ধারণার সঙ্গে যুক্ত হলো পরিবেশগত নম্রতা বা �Environmental humility। উইলসন তাঁর সামাজিক জীববিদ্যার (Sociobiology) তত্ত্বে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বসবাস বা �biophilia ধারণা অন্তর্ভুক্ত করেন।
পরিবেশসাশ্রয়ী উন্নয়ন দর্শন বা সবুজ দর্শনে উইলসনের �biophilia� একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়ন পরিকাঠামো এবং আকাঙ্ক্ষায় এর প্রতিফলন প্রয়োজন।
বস্তুত সবুজ অর্থনীতি এবং সবুজ দর্শনের সমন্বিত রূপ হতে পারে সবুজ অর্থনৈতিক দর্শন। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই অর্থনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হবে? এই বাস্তবায়ন নানাভাবে হতে পারে। তবে আমি এখানে উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে একটি প্রক্রিয়ার উল্লেখ করছি, তা হলো- যে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্ভরশীল, সেই সম্পদের বৃদ্ধি এবং উন্নয়নকল্পে সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ এমনভাবে করা দরকার, যাতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমে এবং পরিবেশদূষণ হ্রাস পায়, অথচ শক্তি ও সম্পদের ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব কম পড়ে। পরিবেশসাশ্রয়ী উন্নয়ন হতে হবে সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিকর। তাহলে সবুজ অর্থনীতি সামাজিকভাবে গৃহীত হবে।
আমাদের এই গ্রহ অভিযোজনের হাত ধরে অতীতে বরফযুগ পেরিয়ে এসেছে। জার্মান সমাজতান্ত্রিক ম্যাঙ্ ওয়েবারের মতে, এই গ্রহ এখন আমলাতন্ত্রের লোহার খাঁচায় বন্দি। এই বন্দিদশায় থেকেও আমরা যদি পরিবেশসাশ্রয়ী সংস্কৃতি তথা সবুজ দর্শন নিয়ে জীবন যাপন করতে পারি, তাহলে হয়তো আগামী প্রজন্মকে এই লৌহের খাঁচা থেকে বেরিয়ে পরিবেশদূষণ থেকে তৈরি বিষের খাঁচায় বন্দি হতে হবে না।
লেখক : যুক্তরাজ্যের দ্য ইনস্টিটিউশন অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের একজন ফেলো।
সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে পরিবেশ সাশ্রয়ী উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের আলোকে। তাই এ বছর ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিতব্য রিওভূমণ্ডলীয় সম্মেলনের বিংশতম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে আমরা অনুসন্ধান করব, সবুজ অর্থনীতি এবং পরিবেশ সাশ্রয়ী উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক কতটুকু। আমরা সাধারণভাবে বলি, সম্পর্ক রয়েছে; কিন্তু এই সম্পর্কের ব্যাপ্তি কতটুকু এবং তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কিভাবে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সবুজ অর্থনীতি বাস্তবায়নের একটি সাধারণ কাঠামো প্রণয়ন করা হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিরিখে কিভাবে এই কাঠামোর মধ্য থেকে নতুন পরিকাঠামো নির্মাণ করবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে, তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে রয়েছে এক সামাজিক দ্বন্দ্ব। তাই প্রস্তাব উঠেছে সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণের। এই দ্বন্দ্ব নতুন কোনো বিষয় নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪২ অব্দে রোমান কবি ভার্জিল (virgil) পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এ ধরনের সামাজিক দ্বন্দ্ব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ভার্জিল তাঁর �Ecologies� গ্রন্থে বর্ণনা করেন, কিভাবে জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর ভূমি দখল করে ক্ষমতাবানরা অপরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপন করেছিল। উল্লেখ্য, প্রাচীন ইতিহাসবিদদের মতে, ভার্জিলের পিতার কৃষিজমিও এভাবে বসতি স্থাপনের জন্য জোরপূর্বক দখল করা হয়।
দার্শনিক স্পিনোজা (Spinoza, 1632-77)-এর নৈতিক তত্ত্বে এবং ধারণাতত্ত্বে পরিবেশ বিষয়ে চিন্তাভাবনা প্রত্যক্ষ করি। স্পিনোজার দৃষ্টিতে এই প্রকৃতিতে 'সব কিছুই সব কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত'। তাঁর ধারণাতত্ত্বে আমরা পাই �degrees of rationality and degree of reality must be linked at every stage�। কিন্তু এ ধরনের সংযোগ থেকে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তা সহজে অনুধাবন করা যায়। একদিকে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে আর্থিক উন্নয়ন ও দেশের শ্রীবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা, অপরদিকে পরিবেশ সাশ্রয়ী উন্নয়ন বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রত্যয়। একে অপরের সম্পূরক ও পরিপূরক হতে পারে, কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক (geopolitical) বাস্তবতার কারণে এর বাস্তবায়ন সঠিকভাবে সম্ভব হয় না। সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের গ্রাস করলেও পরিবেশ নিয়ে ভার্জিলের কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্পিনোজার বাস্তবতা ও যুক্তির সমন্বয় সাধন আজও প্রাসঙ্গিক। এই সমন্বয় সাধনের ধারণা থেকে আমরা পাই সবুজ দর্শনের ধারণা, যে ধারণায় সবুজ অর্থনীতি একটি উপাদান মাত্র।
টমাস মালথাস (Thomus Malthus) অনুধাবন করেছিলেন যে মানুষের চাহিদা যে হারে ক্রমে বাড়ছে, সে হারে সম্পদের বৃদ্ধি সম্ভব নয়। কারণ প্রবৃদ্ধির একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মার্কস এবং এঙ্গেল মালথাসের এই ধারণাকে বলেছিলেন 'বালকসুলভ'। যদিও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্যের জোগান বাড়ানো সম্ভব এবং সেই অর্থে মালথাসের ধারণা অনেকে মনে করেন সঠিক নয়, কিন্তু আমাদের এই গ্রহের �Carrying capacity� বা সামর্থ্যের একটি সীমা রয়েছে, সেই অর্থে মালথাস সঠিক। ১৯৭৬ সালে ফ্রেড হার্স (Fred Hirsch) যুক্তি দেখান যে প্রাচুর্য যখন বৃদ্ধি পায়, তখন অন্তরঙ্গতা এবং প্রতিশ্রুতি হ্রাস পায়। এ থেকে জন্ম নেয় 'প্রবৃদ্ধির সামাজিক সীমাবদ্ধতা'। জন স্টুয়ার্ট মিল (John stuart Mill) এ বিষয়টি থেকে জাত বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন। তাই তিনি রাজ অর্থনৈতিক কাঠামোতে স্থিতাবস্থার অর্থনীতির (Steady state economy) ধারণা অন্তর্ভুক্ত করেন। মিল বিশ্বাস করতেন যে ভোক্তার চাহিদা স্থির থাকলে জোগান স্থির থাকবে। এই স্থিতাবস্থা না থাকলে আমরা সমাগত জরুরি অবস্থার মধ্যে থাকব। মিলের এই ধারণাটি এই সময়ে হারমান ডেলি (Herman Daley) পরিবেশ সংরক্ষণে শেষ ব্যবহার করেন। হারমানের মতে, সত্যিকার অর্থে পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হলে আমাদের এমন অর্থনীতি দরকার, যেখানে উৎপাদন থেকে ভোগ পর্যন্ত এর প্রতিটি ধাপে বস্তু ও শক্তির কার্যকর প্রবাহ নিম্নতম পর্যায়ে রাখতে হবে। কিন্তু ১৯৮৭ সালে নরওয়ের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারলেস ব্র্যান্ডল্যান্ড এই স্থিতাবস্থার অর্থনীতির ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। �Our common future�- শীর্ষক প্রতিবেদনে ব্র্যান্ডল্যান্ড 'প্রবৃদ্ধির সীমিতকরণ'কে চ্যালেঞ্জ করে বললেন প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু তা হতে হবে পরিবেশসাশ্রয়ী। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জীববিদ এডওয়ার্ড ও উইলসন (Edward O. wilson) উল্লেখ করেন যে জীববিদদের ভাষায় এই গ্রহের প্রতিটি প্রাণ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখানে একটি প্রজাতি ধ্বংস হলে অন্যান্য প্রজাতির ওপর তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। তাই পরিবেশসাশ্রয়ী ধারণার সঙ্গে যুক্ত হলো পরিবেশগত নম্রতা বা �Environmental humility। উইলসন তাঁর সামাজিক জীববিদ্যার (Sociobiology) তত্ত্বে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বসবাস বা �biophilia ধারণা অন্তর্ভুক্ত করেন।
পরিবেশসাশ্রয়ী উন্নয়ন দর্শন বা সবুজ দর্শনে উইলসনের �biophilia� একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়ন পরিকাঠামো এবং আকাঙ্ক্ষায় এর প্রতিফলন প্রয়োজন।
বস্তুত সবুজ অর্থনীতি এবং সবুজ দর্শনের সমন্বিত রূপ হতে পারে সবুজ অর্থনৈতিক দর্শন। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই অর্থনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হবে? এই বাস্তবায়ন নানাভাবে হতে পারে। তবে আমি এখানে উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে একটি প্রক্রিয়ার উল্লেখ করছি, তা হলো- যে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্ভরশীল, সেই সম্পদের বৃদ্ধি এবং উন্নয়নকল্পে সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ এমনভাবে করা দরকার, যাতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমে এবং পরিবেশদূষণ হ্রাস পায়, অথচ শক্তি ও সম্পদের ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব কম পড়ে। পরিবেশসাশ্রয়ী উন্নয়ন হতে হবে সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিকর। তাহলে সবুজ অর্থনীতি সামাজিকভাবে গৃহীত হবে।
আমাদের এই গ্রহ অভিযোজনের হাত ধরে অতীতে বরফযুগ পেরিয়ে এসেছে। জার্মান সমাজতান্ত্রিক ম্যাঙ্ ওয়েবারের মতে, এই গ্রহ এখন আমলাতন্ত্রের লোহার খাঁচায় বন্দি। এই বন্দিদশায় থেকেও আমরা যদি পরিবেশসাশ্রয়ী সংস্কৃতি তথা সবুজ দর্শন নিয়ে জীবন যাপন করতে পারি, তাহলে হয়তো আগামী প্রজন্মকে এই লৌহের খাঁচা থেকে বেরিয়ে পরিবেশদূষণ থেকে তৈরি বিষের খাঁচায় বন্দি হতে হবে না।
লেখক : যুক্তরাজ্যের দ্য ইনস্টিটিউশন অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের একজন ফেলো।
No comments