মাঠ প্রশাসন-ডিসি-এসপি: কার ওপরে কে? by বদিউল আলম মজুমদার
গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, সমপ্রতি অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে পুলিশের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। একটি অভিযোগ ছিল, ডিসি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হলেও পুলিশ সুপাররা তাঁদের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সব আদেশ মানেন না।
আরও অভিযোগ করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বেই চলে মাদকের ব্যবসা। (প্রথম আলো, ২৬ জুলাই, ২০১০)
ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে ডিসিরা যাতে পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন, সে ক্ষমতা তাঁদের প্রদানের প্রস্তাবও সম্মেলনে করা হয়। এ ছাড়া ডিসি ও কমিশনারদের পুলিশের কর্মতত্পরতার ওপর প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ সম্মেলনে করা হয়। উপরন্তু নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে একজন সহকারী পুলিশ সুপার, দুজন পরিদর্শক, চারজন উপপরিদর্শক ও ৩০ জন কনস্টেবলের সমন্বয়ে ‘প্রশাসনিক ফোর্স’ গঠনের প্রস্তাব করেন ডিসিরা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সংক্ষিপ্ত আদালত গঠন ও মামলা আমলে নিয়ে বিচারের ক্ষমতা দেওয়ার দাবিও সম্মেলনে করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এসব দাবি সমর্থন করলেও প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি।
জেলা প্রশাসকদের এসব অভিযোগ ও প্রস্তাবে পুলিশ কর্তৃপক্ষ চরমভাবে ক্ষুব্ধ হন। বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পরের দিন অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে, যেখানে অনেক পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন, জেলা প্রশাসকদের অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘পুলিশ সম্পর্কে এ রকম ঢালাও মন্তব্য করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা অনভিপ্রেত। কারও কারও মধ্যে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার মতো অবস্থা সৃষ্টির মনোভাব থাকতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের সবাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত—এ রকম ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। আমরা জানি, কে কী করছে।’ (প্রথম আলো, ২৬ জুলাই, ২০১০)
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেন, কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না, তাদের সব লোক সৎ। থানায় দায়ের করা মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ৬০ শতাংশ মামলা হয় জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে। জমিজমার এই বিরোধের পেছনে আছে প্রশাসনের লোকজন। তাদের অনিয়মের কারণেই ৬০ শতাংশ মামলা হচ্ছে।
এ ছাড়া পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জেলা পুলিশ সুপারের অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের দাবি জানানো হয়। মহানগর এলাকার মতো জেলা পর্যায়েও নিজেদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা চেয়েছেন তাঁরা।
এসব অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় যেন প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার বর্তমানে পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে প্রজাতন্ত্রের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি দুর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আর এ দ্বন্দ্ব কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব: জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার—কার ওপরে কে? অথবা কে কার অধস্তন? এ দ্বন্দ্ব বহু দিনের হলেও দুর্ভাগ্যবশত এখন এটি প্রকাশ্য রূপলাভ করেছে।
আমরা মনে করি, প্রশাসন-পুলিশের দ্বন্দ্ব শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, এটি অহেতুকও। আর এর পেছনে রয়েছে আমাদের নেতৃত্বের অপারগতা ও অর্বাচীনতা। কারণ, আমাদের সংবিধানেই এর সমাধান রয়েছে এবং আমাদের অতীতের সরকারগুলো সংবিধান নিয়ে খেলা ও এর নির্দেশনাগুলো নির্বিচারে অমান্য করেছে বলেই এর সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের (adminstrative unit) স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা করা হইবে।’ অর্থাৎ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, সংবিধান অনুযায়ী, জেলায় জেলা পরিষদ, উপজেলায় উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদ ‘স্থানীয় শাসন’ব্যবস্থা পরিচালনা করবে।
বলাবাহুল্য, সর্বস্তরে—শুধু কেন্দ্রে নয়, জনগণের প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠাই গণতান্ত্রিক শাসনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র...।’ অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাদের সংবিধানে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। আর তা বাস্তবায়িত হলেই, প্রশাসনের সব স্তরে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত রচিত হবে। কারণ সংসদকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের উপরি কাঠামোর জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো খুঁটি হিসেবে কাজ করবে। একইসঙ্গে শাসন-প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি ও কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, যা গণতন্ত্রের উন্নততর সংস্করণ।
সংবিধানের ৫৯(২) অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসন পরিচালনার জন্য স্থানীয় সরকারের অধীনে কী কী দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত, তা নির্ধারণ করা হয়েছে: ‘এই সংবিধানের ও অন্য কোন আইন-সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লেখিত অনুরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন এবং অনুরূপ আইনে নিম্নলিখিত বিষয়-সংক্রান্ত দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত হইতে পারিবে: (ক) প্রশাসন ও সরকারী কর্মচারীদের কার্য; (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা; (গ) জনসাধারণের কার্য (public service) ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।’ অর্থাৎ, প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য পরিচালনা, জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং সব জনকল্যাণমূলক সেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আর কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বংলাদেশ মামলার [৪৪ডিএলআর(এডি)(১৯৯২)] রায় অনুযায়ী, সংসদ স্থানীয় সরকার বিষয়ে আইন প্রণয়নের সময়, এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর সংবিধান-অর্পিত দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারে না—আইনে এগুলো অন্তর্ভুক্ত হতেই হবে। প্রসঙ্গত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে সার্কুলারের মাধ্যমে যেসব কমিটি করা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার সবই সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।
সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য হলো, ‘স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা।’ (কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বংলাদেশ) জনগণ প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তার প্রায় সবই স্থানীয় এবং এগুলোর সমাধানও স্থানীয়। তাই সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের অধিকাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও প্রশাসনের সব স্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। কিন্তু ‘দিনবদলের সনদ’ বাস্তবায়ন করতে হলে একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে অধিক সম্পদ, ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব দিয়ে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে যদি নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠন করা হতো—স্বাধীন বাংলাদেশে জেলা পরিষদের নির্বাচন কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি—তাহলে বর্তমানের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের মধ্যকার অনভিপ্রেত উত্তেজনা ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব সম্পূর্ণভাবে এড়ানো যেত। কারণ তখন কর্তৃত্ব থাকত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর, আর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার উভয়ই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধীনে ও তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন। ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যকার আন্তসম্পর্কজনিত সমস্যা, ‘কার ওপরে কে’ সৃষ্টিই হতো না এবং সমন্বয়ের সমস্যাও থাকত না। তবে প্রশাসন ও পুলিশ-ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে জরুরি ভিত্তিতে দুই ক্যাডারকেই সংস্কার ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করা দরকার।
উল্লেখ্য, স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরে নির্বাচনের আয়োজন না করলে, শুধু সংশ্লিষ্ট আইনকেই অমান্য করা হয়। যেমন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে গড়িমসি করে সরকার বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ আইন লঙ্ঘন করছে, কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদ গঠন না করে স্বাধীনতাপরবর্তী প্রায় সব সরকারই সংবিধানকে পদদলিত করেছে। কারণ, আমাদের সংবিধানই [অনুচ্ছেদ ১৫২(১)] জেলাকে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
পরিতাপের বিষয় যে নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদকে বান্তবায়ন করা তো হয়ইনি, বরং ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তা (৬০ ও ১১ অনুচ্ছেদের শেষাংশসহ) বিলুপ্তই করা হয়। সৌভাগ্যবশত দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এসব অনুচ্ছেদ সংবিধানে পুনরায় প্রতিস্থাপন করা হলেও দুর্ভাগ্যবশত গত চার-চারটি নির্বাচিত সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি। শুধু তাই নয়, সংবিধানের এ অনুচ্ছেদকে কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রদত্ত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়কেও একের পর এক সরকার সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯১ সালে উপজেলা পরিষদ বাতিলের পর কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার সর্বসম্মত রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেন: ‘সংবিধানের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব-সংক্রান্ত ৯ অনুচ্ছেদের আলোকে নির্বাচনের মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের পরিবর্তন করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে ৫৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ যথাশীঘ্রই নিতে হবে, তবে কোনো অবস্থায়ই যেন এ সময় এখন থেকে ছয় মাসের অধিক না হয়।’ অর্থাৎ সামরিক শাসকেরাই নন, আমাদের নির্বাচিত সরকারগুলোও সংবিধানকে পদদলিত এবং আদালতের নির্দেশকে ক্রমাগতভাবে অমান্য করেছে। তা না করলে বাংলাদেশের ইতিহাসই হয়তো ভিন্ন হতো। প্রসঙ্গত, এ রায়টি বাস্তবায়নের সময়সীমা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অতীতে সরকার আদালতের দ্বারস্থ হতো এবং অন্তত দুই ডজনবার সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছিল বলেও আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি। কিন্তু এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য আর এখন শোনা যায় না। সংবিধান সমুন্নত রাখার আদালতের বর্তমান বলিষ্ঠ ভূমিকার প্রেক্ষাপটে এ অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির প্রতি সবিনয়ে মহামান্য আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
একটি ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এ লেখা শেষ করছি। আমি জানতে পেরেছি, উপজেলা পরিষদ তথা স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার ব্যাপারে আমার অবস্থানের কারণে অনেক সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপর ক্ষুব্ধ। মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা এখন অত্যন্ত দুর্বিষহ অবস্থায় আছেন। তাঁদের পক্ষে মান-সম্মান নিয়ে দায়িত্ব পালন করাই প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কর্মকর্তাদের ক্ষোভের কারণ অনুধাবন করতে পারি, কিন্তু এর জন্য দায়ী নবম সংসদে সংবিধানকে লঙ্ঘন করে পাস করা উপজেলা পরিষদ আইন, যা স্থানীয় পর্যায়ে একটি অহেতুক দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এর সমাধান, আমার ব্যক্তিগত মতে, সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং আদালতের নির্দেশ, যা আইনের সমতুল্য, মান্য করা—উপেক্ষা বা প্রতিহত করা নয়। কারণ, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি যথেচ্ছাচারেরই জন্ম দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদিভাবে কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেশ কয়েক বছর আগে আমাকে বলেছিলেন, নাক দিয়ে মুখের কাজ করলে সমস্যা সৃষ্টি হবেই। আমার মনে হয়, আমাদের সমস্যাও তা-ই। মাননীয় সাংসদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালন করানোর চেষ্টা করছি, যা থেকেই বর্তমান দ্বন্দ্ব। তবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, পেশাদারিত্ব ও সদাচরণ, যার জন্য প্রয়োজন হবে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ। কর্মকর্তাদেরও আমি অনুরোধ করব, অনুধাবন করার জন্য যে ঔপনিবেশিক আমলের সৃষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো একবিংশ শতাব্দীর একটি স্বাধীন দেশের জন্য উপযোগী হতে পারে না। উপরন্তু কর্মকর্তাদের ওপর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দিলে তা সংবিধানেরই শুধু লঙ্ঘন হবে না, এটি আদালতের রায়েরও পরিপন্থী হবে। কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘যদি সরকারি কর্মকর্তা কিংবা তাঁদের তল্পীবহদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নিযুক্ত করা হয়, তাহলে এগুলোকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাখা যুক্তিযুক্ত হবে না।’ কিন্তু আমরা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে বিলুপ্তও করতে পারব না। কারণ, এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক ।
ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে ডিসিরা যাতে পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন, সে ক্ষমতা তাঁদের প্রদানের প্রস্তাবও সম্মেলনে করা হয়। এ ছাড়া ডিসি ও কমিশনারদের পুলিশের কর্মতত্পরতার ওপর প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ সম্মেলনে করা হয়। উপরন্তু নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে একজন সহকারী পুলিশ সুপার, দুজন পরিদর্শক, চারজন উপপরিদর্শক ও ৩০ জন কনস্টেবলের সমন্বয়ে ‘প্রশাসনিক ফোর্স’ গঠনের প্রস্তাব করেন ডিসিরা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সংক্ষিপ্ত আদালত গঠন ও মামলা আমলে নিয়ে বিচারের ক্ষমতা দেওয়ার দাবিও সম্মেলনে করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এসব দাবি সমর্থন করলেও প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি।
জেলা প্রশাসকদের এসব অভিযোগ ও প্রস্তাবে পুলিশ কর্তৃপক্ষ চরমভাবে ক্ষুব্ধ হন। বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পরের দিন অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে, যেখানে অনেক পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন, জেলা প্রশাসকদের অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘পুলিশ সম্পর্কে এ রকম ঢালাও মন্তব্য করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা অনভিপ্রেত। কারও কারও মধ্যে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার মতো অবস্থা সৃষ্টির মনোভাব থাকতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের সবাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত—এ রকম ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। আমরা জানি, কে কী করছে।’ (প্রথম আলো, ২৬ জুলাই, ২০১০)
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেন, কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না, তাদের সব লোক সৎ। থানায় দায়ের করা মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ৬০ শতাংশ মামলা হয় জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে। জমিজমার এই বিরোধের পেছনে আছে প্রশাসনের লোকজন। তাদের অনিয়মের কারণেই ৬০ শতাংশ মামলা হচ্ছে।
এ ছাড়া পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জেলা পুলিশ সুপারের অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের দাবি জানানো হয়। মহানগর এলাকার মতো জেলা পর্যায়েও নিজেদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা চেয়েছেন তাঁরা।
এসব অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় যেন প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার বর্তমানে পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে প্রজাতন্ত্রের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি দুর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আর এ দ্বন্দ্ব কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব: জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার—কার ওপরে কে? অথবা কে কার অধস্তন? এ দ্বন্দ্ব বহু দিনের হলেও দুর্ভাগ্যবশত এখন এটি প্রকাশ্য রূপলাভ করেছে।
আমরা মনে করি, প্রশাসন-পুলিশের দ্বন্দ্ব শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, এটি অহেতুকও। আর এর পেছনে রয়েছে আমাদের নেতৃত্বের অপারগতা ও অর্বাচীনতা। কারণ, আমাদের সংবিধানেই এর সমাধান রয়েছে এবং আমাদের অতীতের সরকারগুলো সংবিধান নিয়ে খেলা ও এর নির্দেশনাগুলো নির্বিচারে অমান্য করেছে বলেই এর সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের (adminstrative unit) স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা করা হইবে।’ অর্থাৎ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, সংবিধান অনুযায়ী, জেলায় জেলা পরিষদ, উপজেলায় উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদ ‘স্থানীয় শাসন’ব্যবস্থা পরিচালনা করবে।
বলাবাহুল্য, সর্বস্তরে—শুধু কেন্দ্রে নয়, জনগণের প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠাই গণতান্ত্রিক শাসনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র...।’ অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাদের সংবিধানে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। আর তা বাস্তবায়িত হলেই, প্রশাসনের সব স্তরে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত রচিত হবে। কারণ সংসদকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের উপরি কাঠামোর জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো খুঁটি হিসেবে কাজ করবে। একইসঙ্গে শাসন-প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি ও কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, যা গণতন্ত্রের উন্নততর সংস্করণ।
সংবিধানের ৫৯(২) অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসন পরিচালনার জন্য স্থানীয় সরকারের অধীনে কী কী দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত, তা নির্ধারণ করা হয়েছে: ‘এই সংবিধানের ও অন্য কোন আইন-সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লেখিত অনুরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন এবং অনুরূপ আইনে নিম্নলিখিত বিষয়-সংক্রান্ত দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত হইতে পারিবে: (ক) প্রশাসন ও সরকারী কর্মচারীদের কার্য; (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা; (গ) জনসাধারণের কার্য (public service) ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।’ অর্থাৎ, প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য পরিচালনা, জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং সব জনকল্যাণমূলক সেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আর কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বংলাদেশ মামলার [৪৪ডিএলআর(এডি)(১৯৯২)] রায় অনুযায়ী, সংসদ স্থানীয় সরকার বিষয়ে আইন প্রণয়নের সময়, এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর সংবিধান-অর্পিত দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারে না—আইনে এগুলো অন্তর্ভুক্ত হতেই হবে। প্রসঙ্গত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে সার্কুলারের মাধ্যমে যেসব কমিটি করা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার সবই সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।
সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য হলো, ‘স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা।’ (কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বংলাদেশ) জনগণ প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তার প্রায় সবই স্থানীয় এবং এগুলোর সমাধানও স্থানীয়। তাই সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্রের অধিকাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও প্রশাসনের সব স্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। কিন্তু ‘দিনবদলের সনদ’ বাস্তবায়ন করতে হলে একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে অধিক সম্পদ, ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব দিয়ে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে যদি নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠন করা হতো—স্বাধীন বাংলাদেশে জেলা পরিষদের নির্বাচন কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি—তাহলে বর্তমানের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের মধ্যকার অনভিপ্রেত উত্তেজনা ও কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব সম্পূর্ণভাবে এড়ানো যেত। কারণ তখন কর্তৃত্ব থাকত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর, আর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার উভয়ই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধীনে ও তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন। ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যকার আন্তসম্পর্কজনিত সমস্যা, ‘কার ওপরে কে’ সৃষ্টিই হতো না এবং সমন্বয়ের সমস্যাও থাকত না। তবে প্রশাসন ও পুলিশ-ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে জরুরি ভিত্তিতে দুই ক্যাডারকেই সংস্কার ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করা দরকার।
উল্লেখ্য, স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরে নির্বাচনের আয়োজন না করলে, শুধু সংশ্লিষ্ট আইনকেই অমান্য করা হয়। যেমন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে গড়িমসি করে সরকার বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ আইন লঙ্ঘন করছে, কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদ গঠন না করে স্বাধীনতাপরবর্তী প্রায় সব সরকারই সংবিধানকে পদদলিত করেছে। কারণ, আমাদের সংবিধানই [অনুচ্ছেদ ১৫২(১)] জেলাকে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
পরিতাপের বিষয় যে নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদকে বান্তবায়ন করা তো হয়ইনি, বরং ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তা (৬০ ও ১১ অনুচ্ছেদের শেষাংশসহ) বিলুপ্তই করা হয়। সৌভাগ্যবশত দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এসব অনুচ্ছেদ সংবিধানে পুনরায় প্রতিস্থাপন করা হলেও দুর্ভাগ্যবশত গত চার-চারটি নির্বাচিত সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি। শুধু তাই নয়, সংবিধানের এ অনুচ্ছেদকে কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রদত্ত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়কেও একের পর এক সরকার সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯১ সালে উপজেলা পরিষদ বাতিলের পর কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার সর্বসম্মত রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেন: ‘সংবিধানের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব-সংক্রান্ত ৯ অনুচ্ছেদের আলোকে নির্বাচনের মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের পরিবর্তন করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে ৫৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ যথাশীঘ্রই নিতে হবে, তবে কোনো অবস্থায়ই যেন এ সময় এখন থেকে ছয় মাসের অধিক না হয়।’ অর্থাৎ সামরিক শাসকেরাই নন, আমাদের নির্বাচিত সরকারগুলোও সংবিধানকে পদদলিত এবং আদালতের নির্দেশকে ক্রমাগতভাবে অমান্য করেছে। তা না করলে বাংলাদেশের ইতিহাসই হয়তো ভিন্ন হতো। প্রসঙ্গত, এ রায়টি বাস্তবায়নের সময়সীমা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অতীতে সরকার আদালতের দ্বারস্থ হতো এবং অন্তত দুই ডজনবার সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছিল বলেও আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি। কিন্তু এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য আর এখন শোনা যায় না। সংবিধান সমুন্নত রাখার আদালতের বর্তমান বলিষ্ঠ ভূমিকার প্রেক্ষাপটে এ অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির প্রতি সবিনয়ে মহামান্য আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
একটি ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এ লেখা শেষ করছি। আমি জানতে পেরেছি, উপজেলা পরিষদ তথা স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার ব্যাপারে আমার অবস্থানের কারণে অনেক সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপর ক্ষুব্ধ। মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা এখন অত্যন্ত দুর্বিষহ অবস্থায় আছেন। তাঁদের পক্ষে মান-সম্মান নিয়ে দায়িত্ব পালন করাই প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কর্মকর্তাদের ক্ষোভের কারণ অনুধাবন করতে পারি, কিন্তু এর জন্য দায়ী নবম সংসদে সংবিধানকে লঙ্ঘন করে পাস করা উপজেলা পরিষদ আইন, যা স্থানীয় পর্যায়ে একটি অহেতুক দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এর সমাধান, আমার ব্যক্তিগত মতে, সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং আদালতের নির্দেশ, যা আইনের সমতুল্য, মান্য করা—উপেক্ষা বা প্রতিহত করা নয়। কারণ, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি যথেচ্ছাচারেরই জন্ম দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদিভাবে কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেশ কয়েক বছর আগে আমাকে বলেছিলেন, নাক দিয়ে মুখের কাজ করলে সমস্যা সৃষ্টি হবেই। আমার মনে হয়, আমাদের সমস্যাও তা-ই। মাননীয় সাংসদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালন করানোর চেষ্টা করছি, যা থেকেই বর্তমান দ্বন্দ্ব। তবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, পেশাদারিত্ব ও সদাচরণ, যার জন্য প্রয়োজন হবে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ। কর্মকর্তাদেরও আমি অনুরোধ করব, অনুধাবন করার জন্য যে ঔপনিবেশিক আমলের সৃষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো একবিংশ শতাব্দীর একটি স্বাধীন দেশের জন্য উপযোগী হতে পারে না। উপরন্তু কর্মকর্তাদের ওপর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দিলে তা সংবিধানেরই শুধু লঙ্ঘন হবে না, এটি আদালতের রায়েরও পরিপন্থী হবে। কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘যদি সরকারি কর্মকর্তা কিংবা তাঁদের তল্পীবহদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নিযুক্ত করা হয়, তাহলে এগুলোকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাখা যুক্তিযুক্ত হবে না।’ কিন্তু আমরা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে বিলুপ্তও করতে পারব না। কারণ, এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক ।
No comments