আদিবাসী দিবস-সংবিধান সংশোধন ও আদিবাসীদের স্বীকৃতি by ইলিরা দেওয়ান
গত শতকের শেষ দশকে এসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বের আদিবাসীদের অংশীদারিকে স্বীকার করে ১৯৯৩ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা করে। উদ্দেশ্য একটাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আদিবাসীদের নতুন সম্পর্ক স্থাপন করা। ওই বছরেই জাতিসংঘ ১৯৯৫—২০০৪ দশককে ‘আদিবাসী দশক’ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
কিন্তু প্রথম আদিবাসী দশকে কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন পরিলক্ষিত না হওয়ায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আবারও ২০০৪—২০১৪ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় ‘আদিবাসী দশক’ ঘোষণা করে। বর্তমানে দ্বিতীয় আদিবাসী দশক অতিক্রান্ত হচ্ছে। গতকাল ৯ আগষ্ট ছিল আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল—‘আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের অধিকার’।
আন্তর্জাতিকভাবে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ ও স্বীকৃতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশে আজও এ বিষয়টি অস্পষ্ট রয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকার এখনো এ দেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তাগুলোকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি তো দেয়নি, এমনকি এ দেশে যে আদিবাসী আছে—এ কথাটিও বেমালুম অস্বীকার করে চলেছে। পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালিদের ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’-এ এসব জাতিগোষ্ঠী ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’রূপে পরিচিতি পাবে বলে সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশিত হয়। এই প্রজ্ঞাপন ও গেজেট এ দেশের আদিবাসীদের পরিচয়ের সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ কথা চাউর হয় যে বর্তমান সরকার ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাবে। কিন্তু এ দেশের আদিবাসীদের স্বীকৃতির প্রশ্নে ’৭২-এর সংবিধান আর বর্তমান সংবিধানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। স্বাধীনতার পর থেকে সংবিধানে এ পর্যন্ত যতবারই কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, কোনো সময়েই আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিকে আমলে আনা হয়নি। আজ আদিবাসীদের কাছে বর্তমান সংবিধানে স্থির থাকা বা ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কোনোটাই অর্থবহ ফল বয়ে আনে না। এ পর্যন্ত সংবিধানের কোনো সংযোজন-বিয়োজনে তাদের ভাগ্যের কোনো তারতম্য পরিলক্ষিত হয়নি। তবে বর্তমান সরকার যেহেতু তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে (ধারা নম্বর ১৮.১ ও ১৮.২) আদিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি পুনর্বহালের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তাই এ দেশের আদিবাসীরা আবার আশার প্রেরণা খুঁজে পাচ্ছে। যদিও ’৭২-এর সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল, কিন্তু অনেক দায়িত্বশীল সরকারি ব্যক্তিরা আদিবাসীদের স্বীকৃতির প্রশ্নে প্রয়োজনে সংবিধানে নতুন ধারা সংযোজনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। যেমন—গত বছর সাঁওতাল বিদ্রোহবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী বলেছিলেন, ’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় আদিবাসীদের জন্য পরিচয়সংকট তৈরি করলেও ওই সংবিধানকে পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে। প্রয়োজনে আদিবাসীদের জন্য নতুন একটি ধারা সংযোজন করে সংকট দূর করতে হবে। কারণ, বাহাত্তরের সংবিধান অসাম্প্রদায়িক। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
গত জুলাই মাসে আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিকে আবারও জোরালোভাবে তুলে ধরেছে এবং সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির কাছে এ বিষয়টি উত্থাপন করবে বলেও মত ব্যক্ত করেছিল।
বর্তমান সরকার আদিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক গঠিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকর করতে চেয়ারম্যান নিয়োগসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এসব উদ্যোগের আড়ম্বরতার আড়ালে কিছু শুভংকরের ফাঁক রয়ে গেছে বলে অনেকে মনে করছেন। নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করেছিল; ক্ষমতা গ্রহণের পরও প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে দেওয়া শুভেচ্ছাবাণীতে এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো ধরনের জনমতামত ছাড়া অদৃশ্য কারও ইন্ধনে এক প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো ‘উপজাতি’ এবং ২০১০ সালের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল পাসের মধ্য দিয়ে এ দেশের আদিবাসীরা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’রূপে পরিচিত হবে বলে সরকারি তরফ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তড়িঘড়ি এ সিদ্ধান্তে আদিবাসীদের মতামত তো নেওয়াই হয়নি, উপরন্তু ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’-এ অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে মাত্র ২৭টি সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে আইনটি পাস করা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই ত্রুটিপূর্ণ বিলটি পাস করার সময় বর্তমান সংসদে যে পাঁচজন আদিবাসী সরকারি দলের সদস্য রয়েছেন, তাঁদের ভূমিকা কী ছিল! পাঁচজনের মধ্যে চারজনই প্রতিমন্ত্রী ও তার সমমর্যাদার পদাধিকারী। কাজেই এই ত্রুটিপূর্ণ বিল পাসে তাঁরাও নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।
আদিবাসীদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কেবল আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরতা কিংবা পদক্ষেপ গ্রহণই যথাযথ নয়, বরং গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সুচারুভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আদিবাসীদের প্রকৃত উন্নয়ন ও স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে কি না, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। এবার সংসদে আদিবাসী প্রতিনিধিরা ছাড়াও অনেক প্রগতিশীল ও বাম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা রয়েছেন, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে আদিবাসী অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। আদিবাসীবিষয়ক ককাস ও সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটিতে এই প্রগতিশীল ধারার জনপ্রতিনিধিরা রয়েছেন। তাই না-পাওয়ার বেদনার মধ্যেও আমাদের আশা, এবার সংবিধান সংশোধনের সময় আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হবে।
’৭২-এ সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন রয়েছে। কিন্তু এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে যেন পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেদিকে সরকারকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। ’৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় পার্বত্য এলাকার প্রতিনিধি হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বারবার ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন। অথচ তৎকালীন সময়ে তাঁর এ প্রস্তাবনা ও দাবিসমূহকে বিদ্রূপচ্ছলে উপেক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে আজ সেই দাবিগুলোই দিনের আলোর মতো জরুরি হয়ে পড়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার প্রায় চার দশক পর আদিবাসীদের সামনে আবার সেই ক্ষণটি এসেছে। চার দশক ধরে এ দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলো ’৭২-এর ভুলের যে মাশুল গুনে চলছে, আমরা আর সে ভুলের পুনরাবৃত্তি চাই না। বাংলাদেশ যে একটি বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির রাষ্ট্র—এই সত্যটাকে যত দিন স্বীকার করা না হবে, তত দিন বাঙালি ছাড়া অন্য সব জাতিগোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন থাকবে। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের বদলাতে হবে। ভিশন-২০২১-এ পৌঁছাতে হলে এ দেশের অপরাপর সব নাগরিককে নিয়েই আগামীর পথ চলতে হবে। কাজেই আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারি।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী।
No comments