সময়ের প্রেক্ষিত-হিরোশিমা: এক পিতার আকুতি by মনজুরুল হক
জাপানের হিরোশিমা নগর বিশ্বকে অস্ত্রমুক্ত করার মহান যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছে, তা হলো ২০২০ সালের মধ্যে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের ধারণার সফল বাস্তবায়ন। প্রতিবছর আগস্ট মাসের ছয় তারিখে হিরোশিমা এবং এর তিন দিন পর নাগাসাকি ১৯৪৫ সালের বিশেষ সেই দুই দিনে নগরের আণবিক বোমা হামলার শিকার হওয়ার যে বার্ষিকী
উদ্যাপন করছে, বিশ্বকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার ঘোষণা সেখানে নিয়মিতভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। বার্ষিক এই আয়োজনের সঠিক তাত্পর্য সম্পর্কে যাঁরা সন্দিহান, তাঁরা অবশ্য বলে থাকেন, এ হচ্ছে অনেকটাই লোক দেখানো এক আনুষ্ঠানিকতা, বাস্তব জীবনে যার তাত্পর্য একেবারেই গুরুত্বহীন। অনেকটা যেন সে রকম এক অবস্থান থেকেই মার্কিন সরকার এত দিন পর্যন্ত হিরোশিমার বার্ষিকীতে উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করে আসছিল। তবে হাওয়া ইদানীং কিছুটা হলেও ভিন্নমুখী খাতে প্রবাহিত হওয়ায় জাপানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন রুস এ বছরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে বছরের পর বছর ধরে হিরোশিমা আর নাগাসাকির একই বার্তা বিশ্বকে শুনিয়ে যাওয়া যে একেবারেই বিফলে যাচ্ছে, তা তো নয়!
তবে প্রশ্ন হলো, হানাহানি আর ঘৃণার বিষবাষ্পে উত্তপ্ত হয়ে থাকা বিশ্ব পারবে কি হিরোশিমার বার্তা বাস্তবে প্রয়োগ করে সত্যিকার অর্থে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ে নিতে আমাদের আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠায় উদ্বুদ্ধ করতে? হিরোশিমা আর নাগাসাকির মর্মান্তিকতা আমরা যেন ভুলে না যাই—দুই নগরের ধ্বংসের বার্ষিকী উদ্যাপন প্রতিবছর সে কথাই আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির প্রতিনিয়ত লড়াইয়ে আগেই হার মেনে নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে গেলে লাভবান নিশ্চয় তারাই বেশি হবে, মানুষের মৃত্যু যাদের মনে বিন্দুমাত্র আলোড়ন তুলতে ব্যর্থ। ফলে কত বেশি মানুষের ঝটিকা মৃত্যু এক নিমিষে নিশ্চিত করে নেওয়া যায়, সে রকম অবাস্তব ডাকে সাড়া দিয়ে নিবারক ক্ষমতার দোহাই দিয়ে বিশ্বের পরমাণু অস্ত্রভান্ডার যারা ক্রমশ আরও বেশি উন্নত করে নেওয়ার মরণ খেলায় নিয়োজিত, হিরোশিমা তাদের চিহ্নিত করার উপায়ও আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে। সেদিক থেকে বার্ষিক এই আয়োজন আসলেই হচ্ছে বিশ্বের বিবেককে নাড়া দিয়ে যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা, যার ইতিবাচক ফলাফল হয়তো ভোগ করবে সুদূর ভবিষ্যতে আমাদের অনাগত প্রজন্মের প্রতিনিধিরা।
জাপানে প্রতিবছর হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিকতার স্মরণে নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আগস্ট মাস একই সঙ্গে হচ্ছে জাপানের জন্য সবচেয়ে বিষণ্ন একটি মাস। প্রতিটি পরিবারে পূর্ব প্রজন্মের প্রয়াত সবার স্মরণে প্রার্থনা জানানোর বিশেষ সময় নির্ধারিত রয়েছে এই আগস্ট মাসে। এর বাইরে আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেশের আনুষ্ঠানিক পরাজয় নির্ধারিত হয়েছিল এ মাসেই। ফলে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে টোকিওর বিতর্কিত শিন্তো মন্দির ইয়াসুকুনিতে সমবেত হয়ে দেশের লুণ্ঠিত গৌরব পুনরুদ্ধারে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে দেখা যায় উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী জাপানিদের। সেদিক থেকে অবশ্য ইয়াসুকুনির বার্ষিকী উদ্যাপনের সঙ্গে হিরোশিমা-নাগাসাকির রয়েছে যোজন দূরত্ব, জাপানের নাগরিক জীবনেও যার প্রতিফলন সহজেই দৃষ্টিযোগ্য। ইয়াসুকুনিকে ঘিরে রাখঢাক করার অনেক কিছু থেকে গেলেও হিরোশিমা-নাগাসাকির নেই সে রকম কোনো বন্ধন। জাপানের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে দোহাই দিয়ে বলতে হয় না হিরোশিমার অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছেন সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নন। এই বাস্তবতা ১৯৪৫ সালের সেই মর্মান্তিকতার সঙ্গে নাগরিক সম্পৃক্ততার সম্পর্ক সহজেই তুলে ধরে। ফলে জাপানের নাগরিকেরাও যে যার মতো করেও অন্যদের মনে করিয়ে দিতে সচেষ্ট অতীতের সেই দুর্ভাগ্যের কথা, যা কিনা ভবিষ্যতে একই পরিণতি ডেকে আনার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে তাদের অনুপ্রাণিত করবে।
৬ আগস্ট হিরোশিমার আণবিক বোমা হামলার এবারের বার্ষিকীকে সামনে রেখে হূদয়স্পর্শী এক দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া ৮১ বছর বয়সী এক পিতা। আণবিক বোমা হামলার ৬৫তম বার্ষিকীতে নিজের নামহীন কন্যার উদ্দেশ্যে লেখা সেই চিঠিতে ফুটে উঠেছে অসহায় এক পিতার হাহাকার, আণবিক বোমা অজান্তেই বদলে দিয়েছিল যার জীবন এবং যে পরিণতি কিনা ভোগ করতে হয়েছে মৃত অবস্থায় জন্ম নেওয়া তাঁর কন্যাকে।
চিঠির লেখক হচ্ছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত একজন হিবাকুশা বা আণবিক বোমা হামলার ভুক্তভোগী। জাপানের নেতৃস্থানীয় দৈনিক আসাহি শিম্বুন বোমা হামলার ৬৫তম বার্ষিকীকে সামনে রেখে যে বার্তা তারা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজনদের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে, সে রকম কিছু লেখার অনুরোধ ভুক্তভোগীদের প্রতি জানিয়েছিল। পত্রিকার সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে হিবাকুশা পিতা তাঁর মৃত কন্যাকে লেখা সেই চিঠি শুরু করেছেন এভাবে:
‘নামহীন কন্যা আমার,
শুরুতেই তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি, আণবিক বোমা হামলার শিকার আমাকে হতে হয়েছিল বলে তোমার এই জীবন উপভোগ করতে না পারার কারণ আমি হয়ে ওঠার জন্য। মনে পড়ে, হাসপাতালে গিয়ে ইনকিউবেটরের পাশে তোমার ক্ষুদ্র দেহটি নিঃসঙ্গ অবস্থায় শায়িত থাকতে আমি দেখেছিলাম। তুমি তখন আর নিঃশ্বাস নিচ্ছিলে না এবং শুয়েছিলে ঠিক যেন ছোট এক পুতুলের মতো। আমার স্ত্রী তখন চোখ বন্ধ করে কাঁদছিল। এ রকম এক ভাবনা থেকে গভীর দুঃখ আর অনুতাপ সে মুহূর্তে আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে যে, আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আমাকে আসতে হয়েছিল বলেই এই পরিণতি তোমাকে আজ ভোগ করতে হলো।’
ঘটনাটি ঘটেছিল হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলার এক যুগ পর ১৯৫৭ সালের গ্রীষ্মে, পত্রলেখক টোকিওর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করার সময়। সন্তান প্রসবের জন্য যে হাসপাতালে স্ত্রী ভর্তি হয়েছিলেন, সেখান থেকে একটি টেলিফোন স্কুলে আসে। নির্ধারিত সময়ের আগে আট মাসে সন্তানের জন্ম স্ত্রী দিতে যাওয়ায় খুব একটা দুশ্চিন্তা স্বামী শুরুতে করেননি। তবে টেলিফোন পাওয়ার পর হাসপাতালে যেতেই একজন নার্স তাঁকে দেখে বলেছিলেন, শিশুর জন্ম হলেও অবস্থা খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না। এরপরই ইনকিউবেটরের পাশে শায়িত কন্যাকে তিনি দেখতে পান। শিশুটি ছিল এতই ছোট, যেন হাতের তালুতে রেখে দেওয়া যায়। এরপর কী হয়েছিল, তা আর তিনি মনে করতে পারছেন না। ফলে স্মরণে নেই, কেমন ছিল তাঁর সেই কন্যার চেহারা। স্মৃতিতে শুধু রয়ে গেছে, মাত্র জন্ম নেওয়া নামহীন ক্ষুদ্র আকারের এক শিশুকন্যা।
১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে হিরোশিমা শহরের ওপর আণবিক বোমা হামলা হওয়ার সময় পত্রলেখকের বয়স ছিল ১৬ বছর। বিস্ফোরণের কাছাকাছি তিনি অবস্থান না করলেও পরবর্তী সময়ে গ্রাউন্ড জিরোর আশপাশে তিনি গিয়েছিলেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজনকে উদ্ধারে সাহায্য করতে। আশপাশে লুটিয়ে পড়া আহতদের সরিয়ে নেওয়ার সাহায্যের হাত তিনি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যা কিনা অজান্তেই তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতা তাঁর নিজের দেহে ছড়িয়ে দেয়।
এর প্রায় মাসখানেক পর শারীরিক অসুস্থতায় তিনি ভুগতে শুরু করেন। রক্তক্ষরণ, জ্বর, মাথার চুল পড়ে যাওয়া—এসব ছিল অসুস্থতার উপসর্গ। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়ে একসময় শিক্ষকতার পেশায় তিনি যোগ দেন এবং বিয়ে করে ঘর-সংসার গড়ে নেন। প্রথম কন্যাসন্তানের স্বাভাবিক জন্ম অতীতের সেই দুশ্চিন্তা থেকে একসময় তাঁকে মুক্ত করে দেয় এবং তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে যে তিনি এসেছিলেন, সেটাও খুব একটা দুশ্চিন্তায় তাঁকে আর ফেলে না। তবে দ্বিতীয় কন্যাসন্তানের মৃত অবস্থায় জন্ম এবং খুবই অস্বাভাবিক দেহের গঠন আবারও তাকে সেই ভুলে যাওয়া অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং কেন এমন হয়েছে, তা নিয়ে তিনি নতুন করে ভাবতে শুরু করেন।
ভুক্তভোগী সেই পত্রলেখক অবশ্য একসময় আণবিক বোমা হামলার শিকার যাদের হতে হয়েছিল, সেই হিবাকুশাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেও হিবাকুশাদের নিয়মিত আলোচনা সভায় যোগ দেওয়া তাঁর হয়ে ওঠেনি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সে রকম এক সভায় যোগ দিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো জানতে পারেন যে ভুক্তভোগীদের অনেকেই তাঁদের সন্তানদের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। সেই বাস্তবতা মৃত অবস্থায় জন্ম নেওয়া কন্যার স্মৃতি তাঁর মনে আবারও ফিরিয়ে আনে, যদিও জাপানের অলিখিত প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করে পরিবারে মৃত সেই কন্যাকে নিয়ে কোনো রকম কথাবার্তা আর একেবারেই হয়নি। আপন সন্তানের সে রকম অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া পিতাকে বেদনাহত করেছিল, যে বেদনা তিনি সযত্নে চেপে রেখেছেন দীর্ঘ ৫৩ বছর। আসাহি শিম্বুন-এর আবেদন মনের সেই বেদনা লাঘবের সুযোগ তাঁর জন্য করে দেয় এবং গভীর বেদনাভরা মন নিয়ে মৃত সেই কন্যার কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি তিনি লেখেন। চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন:
‘কী রকম অসহায় পিতা আমি, কন্যার নাম রাখার সুযোগও যার কিনা হয়নি। তোমাকে চিঠি লেখার কথা আগেও আমি ভেবেছি, নামহীন কন্যা আমার। তবে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিত্সাধীন থাকায় সেই সুযোগ আমি করে উঠতে পারিনি। তোমার মা আর আমি যখন চলে যাব, তেমন আর কেউ পৃথিবীতে তখন বেঁচে থাকবে না যে কিনা তোমার কথা মনে করতে পারবে।’
হিরোশিমার আণবিক বোমা হামলার ভুক্তভোগী অসহায় সেই পিতা নিজের পরিচয় গোপন রাখার ইচ্ছা পোষণ করায় আসাহি শিম্বুন লেখকের নাম প্রকাশ করেনি। পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, তাঁর কন্যা মাত্র কয়েক মুহূর্ত হলেও নিশ্চয় জীবন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল। আর তাই কেউ তাকে কখনো স্মরণ করবে না, সেভাবে বিস্মৃতির অন্ধকারে কন্যার হারিয়ে যাওয়া তিনি দেখতে চান না বলেই মৃত কন্যাকে উদ্দেশ্য করে তাঁর চিঠি লেখা।
হিরোশিমার আণবিক বোমা হামলার শিকার এই পত্রলেখক নিজের সেই দুর্ভাগ্যের জন্য কেবল নিজেকেই দোষারোপ করে গেলেও, আমরা জানি কারা এর জন্য মূলত দায়ী। ফলে ভবিষ্যতে যেন অসহায় কোনো পিতাকে আর এভাবে কপাল চাপড়াতে না হয়, সে জন্যই তো পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব এতটা দরকার। আর ঠিক সে কথাই তো হিরোশিমা আর নাগাসাকি প্রতিবছর আমাদের শুনিয়ে যাচ্ছে। তবে কথা হলো, আমাদের হূদয়ে পৌঁছাচ্ছে কি সেই বার্তা? চার দিকজুড়ে ধারালো অস্ত্রে সমানে শান দিয়ে যাওয়া আমাদের এই লোকালয় তো বলে না আমরা শুনতে পাচ্ছি হিরোশিমার সেই আর্তি।
টোকিও, ৩ অক্টোবর, ২০১০
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments