গোধূলির ছায়াপথে-‘সব্যসাচী’র ট্রেন আসবেই by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
কাজী নজরুলের জ্যেষ্ঠ সন্তান কাজী সব্যসাচী, আমার সানি ভাই। তাঁর মতো আবৃত্তিকার বিরল। জিজ্ঞেস করলাম, শব্দটির মানে জানা আছে কি? বললেন, যার স্পর্শন স্বর্ণের অভিসারী, তিনিই সব্যসাচী। বললাম, নামটি যদি হতো তোমার পিতৃদেবের, তাহলেই তো হতো মানানসই।
তোমার পিতা, যিনি আমার চাচাজান, সাহিত্যগুণান্বিত সেই প্রতিভা, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’-এর মন্ত্র যাঁর কবিতায়, গানের বাণীতে। তাঁর কাব্য-গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ সত্যবিভাষিত, স্বর্ণমণ্ডিত।
নজরুল গুরুদেব হিসেবে মানতেন যাঁকে, সেই রবিঠাকুরও এই নামকরণের সমধিক দাবিদার। তিনি জীবনের গভীরে প্রবেশ করে পরমাত্মার স্পর্শে হয়েছিলেন ধন্য। সৈয়দ শামসুল হক, কবি-নাট্যকার-ঔপন্যাসিক আমাদের সাহিত্য-গগন স্পর্শ করেছেন। তাঁর ‘সব্যসাচী’ নামকরণ হয়েছে যথার্থ। জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর একটি, খেলারাম খেলে যা, বইমেলায় পাঠকক্রয়ধন্য। লেখক বলেছেন, কেন বইটির এত কাটতি তিনি আজও বুঝে উঠতে পারেননি। খুব সম্ভব কামনাবহ্নির শিল্পিত প্রকাশ। মাইকেল জ্যাকসনের গান ও নাচ একাধারে শিল্প, দর্শক চাহিদার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার কামনাবহ্নিশিখা (সেক্স)। ফুটবল মাঠের নায়িকা-গায়িকা শাকিরারও তাই। শিল্পিত কামনাবহ্নি নভেল, ছায়াছবি, ভিডিও ও নবনাট্যকে জমিয়ে তোলে। জনপ্রিয়তা ছোটে এই বহ্নিশিখার হাত ধরে। সাহিত্যের নির্মল আকাশ ছোঁয় নোবেল। আসল হলো সত্যকে ছোঁয়া, কদাচিৎ নোবেলও সন্ধান পায় তার।
জালালউদ্দিন রুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সমাদৃত সব্যসাচী। কবিতা-গল্প-আখ্যায়িকা-ধর্মকথা পৃথিবীব্যাপী সাহিত্য অন্বেষীদের পাঠকক্ষে আলোড়ন তুলেছে। আমাদের বইমেলায় ‘রুমির অলৌকিক বাগানে’ আবির্ভূত নতুন সাজ পরে। অনেক পাঠক পড়ে স্পর্শ করেছেন সেই বই। রুমির আনন্দভুবনে প্রবেশ করে ধন্য আমি। সব্যসাচী পাওলো কোয়েলো বিশ্ব আদৃত ১৫টিরও বেশি উপন্যাসে খুঁজে পেয়েছেন আধ্যাত্মিকতা। তাঁর লেখা উপন্যাস ও.এলেফ (O.aleph) বেরিয়েছে কদিন আগে, নতুন অভিজ্ঞানসমৃদ্ধ। গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, প্রতি উপন্যাসে ছড়িয়েছেন তিনি নতুন আলোর দীপশিখা। কদিন আগে আলাপ করছিলাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, নিউইয়র্কের লাগোর্ডিয়া এয়ারপোর্ট হোটেলের লবিতে। জিজ্ঞেস করলাম: কোনটা তাড়িত করছে আপনার কলমের অগ্রভাগ? বললেন, ‘রোমান্টিকতা। সর্বমুহূর্তে তারুণ্যের সহচর বলে আমি চলমান। পরমার্থ এসে যোগ দেন কখনোসখনো’।
জালালউদ্দিন রুমি-নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-শীর্ষেন্দুকে সঙ্গে নিলে জীবনের ছন্দ খুঁজে পাওয়া সহজতর। ওঁদের কাছে যেতে হবে। প্রফেসর ইউনুস সেদিন রসিকতা করে বললেন, ‘আমার কথা তেমনটা কেউ শুনত না, প্রাইসটি পাওয়ার পর সবাই আমার কথা শুনছেন।’ রবিঠাকুরের বেলায়ও তাঁর ব্যত্যয় ঘটেনি। নোবেল প্রাপ্তির পরই তাঁর মূল্যায়ন করতে বসেন বাংলার পাঠককুল। ঘাটে বয়স্ক মাঝির সংখ্যা বিলিয়মান, পাঠকও অসংখ্য। তাই আমার পান্ডুলিপিরও নেই বিশ্রাম। যা বলতে চাই, এক্ষুনি। রবিঠাকুরের বয়স যখন হলো আশি, কণ্ঠ ও কলম সর্বোত্তম। চিকিত্সাশাস্ত্র উন্নততর হলে তাঁকে কষ্টের শিকার হতে হতো না। তিনি হতেন শতায়ু এবং আরও অবদানে ভরে উঠত সব্যসাচীর অফুরন্ত ভান্ডার।
শুনেছিলাম ‘রবীন্দ্রট্রেন’ ভিড়বে জয়দেবপুরে। স্টেশনে গিয়ে শুনলাম আসছে না। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন হয়তো কোনো দিন আসবে, আবার নেবে বিদায়। ভূঁইয়া ইকবালের গ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ পাঠের সুযোগ গ্রহণ করলাম বাইশে শ্রাবণের আগেই। বঙ্গ বিভাগ মেনে নিয়েছি, অনেক যত্ন করে আমরা আলাদা করেছি যার যার রান্নাঘর [রাষ্ট্র], ভেবেছিলাম ‘ভাষা বিচ্ছেদ’ হবে না। ৫০ বছরে দেখি, ‘ভাষা বিচ্ছেদ’ও ঘটে গেছে। হওয়ার ছিল। মুসলমানসমাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে ডক্টর ইকবালের গবেষণা এই প্রথম। একজন জিজ্ঞেস করলেন, হিন্দু সমপ্রদায় নিয়ে আমাদের কোনো সাহিত্যিকের এমন কোনো গ্রন্থ বাজারে বেরিয়েছে কি? বললাম, কেন নজরুল ইসলাম? তিনি একাই তো তা পুষিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ২০ বছরের সাহিত্যকর্ম হিন্দু-মুসলিম মিলিত সংস্কৃিতর নির্যাস। কালের অববাহিকায় নজরুলের এই অনন্য স্থান আর কেউ দখল করবেন তা মনে হয় না। কথা ছিল, রবীন্দ্রট্রেনটি এলে সাহিত্য ও সংগীতের আসরে দুই বাংলার মৈত্রীর সেতু হবে আরও মজবুত। ট্রেন আসেনি, তাতে কী? সব্যসাচী রুমি-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সৈয়দ হক ট্রেনের তোয়াক্কা করেন না। তাঁরা আছেন, থাকবেন।
সার্ধশতবর্ষ অথবা দেড় শ বছরের অনুষ্ঠানগুলোতে ওঁদের ‘মেসেজ’ অনুধাবন করতে পারি যেন। বিবাদগুলো খতিয়ে দেখি। কণ্ঠে ঝরুক মমতা, যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসতে অপারগও হন। ১. পানিতে আর্সেনিকের বিষ নির্মূল করি দুই দেশ মিলে। ২. দুই বাংলার সীমান্তে শত ফেনসিডিলের কারখানাগুলো বাইশে শ্রাবণ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই। ৩. চালু হোক সমতা ও সহানুভূতির ভিত্তিতে প্রস্তুত মৈত্রীর পথ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যেটি দেখিয়েছে। ধরলা নদীর বিধ্বস্ত সেতুর দুই পারে বিচ্ছিন্ন বগাবগীকে মিলিয়ে দিই। একসঙ্গেই কেন গেয়ে উঠি না গানটি: ‘তোমার বগা বন্দী হইছে ধরলা নদীর পারেরে/ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’। ৪. সীমান্তের অসহায় মানুষগুলো গুলি খেয়ে না করুক মৃত্যুবরণ। সব্যসাচীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে।
অপেক্ষা করে আছি। সব্যসাচীর ট্রেন আসবেই।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
নজরুল গুরুদেব হিসেবে মানতেন যাঁকে, সেই রবিঠাকুরও এই নামকরণের সমধিক দাবিদার। তিনি জীবনের গভীরে প্রবেশ করে পরমাত্মার স্পর্শে হয়েছিলেন ধন্য। সৈয়দ শামসুল হক, কবি-নাট্যকার-ঔপন্যাসিক আমাদের সাহিত্য-গগন স্পর্শ করেছেন। তাঁর ‘সব্যসাচী’ নামকরণ হয়েছে যথার্থ। জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর একটি, খেলারাম খেলে যা, বইমেলায় পাঠকক্রয়ধন্য। লেখক বলেছেন, কেন বইটির এত কাটতি তিনি আজও বুঝে উঠতে পারেননি। খুব সম্ভব কামনাবহ্নির শিল্পিত প্রকাশ। মাইকেল জ্যাকসনের গান ও নাচ একাধারে শিল্প, দর্শক চাহিদার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার কামনাবহ্নিশিখা (সেক্স)। ফুটবল মাঠের নায়িকা-গায়িকা শাকিরারও তাই। শিল্পিত কামনাবহ্নি নভেল, ছায়াছবি, ভিডিও ও নবনাট্যকে জমিয়ে তোলে। জনপ্রিয়তা ছোটে এই বহ্নিশিখার হাত ধরে। সাহিত্যের নির্মল আকাশ ছোঁয় নোবেল। আসল হলো সত্যকে ছোঁয়া, কদাচিৎ নোবেলও সন্ধান পায় তার।
জালালউদ্দিন রুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সমাদৃত সব্যসাচী। কবিতা-গল্প-আখ্যায়িকা-ধর্মকথা পৃথিবীব্যাপী সাহিত্য অন্বেষীদের পাঠকক্ষে আলোড়ন তুলেছে। আমাদের বইমেলায় ‘রুমির অলৌকিক বাগানে’ আবির্ভূত নতুন সাজ পরে। অনেক পাঠক পড়ে স্পর্শ করেছেন সেই বই। রুমির আনন্দভুবনে প্রবেশ করে ধন্য আমি। সব্যসাচী পাওলো কোয়েলো বিশ্ব আদৃত ১৫টিরও বেশি উপন্যাসে খুঁজে পেয়েছেন আধ্যাত্মিকতা। তাঁর লেখা উপন্যাস ও.এলেফ (O.aleph) বেরিয়েছে কদিন আগে, নতুন অভিজ্ঞানসমৃদ্ধ। গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, প্রতি উপন্যাসে ছড়িয়েছেন তিনি নতুন আলোর দীপশিখা। কদিন আগে আলাপ করছিলাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, নিউইয়র্কের লাগোর্ডিয়া এয়ারপোর্ট হোটেলের লবিতে। জিজ্ঞেস করলাম: কোনটা তাড়িত করছে আপনার কলমের অগ্রভাগ? বললেন, ‘রোমান্টিকতা। সর্বমুহূর্তে তারুণ্যের সহচর বলে আমি চলমান। পরমার্থ এসে যোগ দেন কখনোসখনো’।
জালালউদ্দিন রুমি-নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-শীর্ষেন্দুকে সঙ্গে নিলে জীবনের ছন্দ খুঁজে পাওয়া সহজতর। ওঁদের কাছে যেতে হবে। প্রফেসর ইউনুস সেদিন রসিকতা করে বললেন, ‘আমার কথা তেমনটা কেউ শুনত না, প্রাইসটি পাওয়ার পর সবাই আমার কথা শুনছেন।’ রবিঠাকুরের বেলায়ও তাঁর ব্যত্যয় ঘটেনি। নোবেল প্রাপ্তির পরই তাঁর মূল্যায়ন করতে বসেন বাংলার পাঠককুল। ঘাটে বয়স্ক মাঝির সংখ্যা বিলিয়মান, পাঠকও অসংখ্য। তাই আমার পান্ডুলিপিরও নেই বিশ্রাম। যা বলতে চাই, এক্ষুনি। রবিঠাকুরের বয়স যখন হলো আশি, কণ্ঠ ও কলম সর্বোত্তম। চিকিত্সাশাস্ত্র উন্নততর হলে তাঁকে কষ্টের শিকার হতে হতো না। তিনি হতেন শতায়ু এবং আরও অবদানে ভরে উঠত সব্যসাচীর অফুরন্ত ভান্ডার।
শুনেছিলাম ‘রবীন্দ্রট্রেন’ ভিড়বে জয়দেবপুরে। স্টেশনে গিয়ে শুনলাম আসছে না। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন হয়তো কোনো দিন আসবে, আবার নেবে বিদায়। ভূঁইয়া ইকবালের গ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ পাঠের সুযোগ গ্রহণ করলাম বাইশে শ্রাবণের আগেই। বঙ্গ বিভাগ মেনে নিয়েছি, অনেক যত্ন করে আমরা আলাদা করেছি যার যার রান্নাঘর [রাষ্ট্র], ভেবেছিলাম ‘ভাষা বিচ্ছেদ’ হবে না। ৫০ বছরে দেখি, ‘ভাষা বিচ্ছেদ’ও ঘটে গেছে। হওয়ার ছিল। মুসলমানসমাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে ডক্টর ইকবালের গবেষণা এই প্রথম। একজন জিজ্ঞেস করলেন, হিন্দু সমপ্রদায় নিয়ে আমাদের কোনো সাহিত্যিকের এমন কোনো গ্রন্থ বাজারে বেরিয়েছে কি? বললাম, কেন নজরুল ইসলাম? তিনি একাই তো তা পুষিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ২০ বছরের সাহিত্যকর্ম হিন্দু-মুসলিম মিলিত সংস্কৃিতর নির্যাস। কালের অববাহিকায় নজরুলের এই অনন্য স্থান আর কেউ দখল করবেন তা মনে হয় না। কথা ছিল, রবীন্দ্রট্রেনটি এলে সাহিত্য ও সংগীতের আসরে দুই বাংলার মৈত্রীর সেতু হবে আরও মজবুত। ট্রেন আসেনি, তাতে কী? সব্যসাচী রুমি-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সৈয়দ হক ট্রেনের তোয়াক্কা করেন না। তাঁরা আছেন, থাকবেন।
সার্ধশতবর্ষ অথবা দেড় শ বছরের অনুষ্ঠানগুলোতে ওঁদের ‘মেসেজ’ অনুধাবন করতে পারি যেন। বিবাদগুলো খতিয়ে দেখি। কণ্ঠে ঝরুক মমতা, যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসতে অপারগও হন। ১. পানিতে আর্সেনিকের বিষ নির্মূল করি দুই দেশ মিলে। ২. দুই বাংলার সীমান্তে শত ফেনসিডিলের কারখানাগুলো বাইশে শ্রাবণ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই। ৩. চালু হোক সমতা ও সহানুভূতির ভিত্তিতে প্রস্তুত মৈত্রীর পথ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যেটি দেখিয়েছে। ধরলা নদীর বিধ্বস্ত সেতুর দুই পারে বিচ্ছিন্ন বগাবগীকে মিলিয়ে দিই। একসঙ্গেই কেন গেয়ে উঠি না গানটি: ‘তোমার বগা বন্দী হইছে ধরলা নদীর পারেরে/ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’। ৪. সীমান্তের অসহায় মানুষগুলো গুলি খেয়ে না করুক মৃত্যুবরণ। সব্যসাচীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে।
অপেক্ষা করে আছি। সব্যসাচীর ট্রেন আসবেই।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
No comments