কথা সামান্যই-বই পড়া ও পড়ানো by ফজলুল আলম
একটি ভালো বই অবিনাশী জীবনের অপরিমেয় শক্তি। - জন মিলটন বই একটি উত্তম সৃষ্টি। অন্যভাবে দেখলে এটা মানবজাতির একটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আমাদের সৈয়দ মুজতবা আলী একবার লিখে গেছেন, মার্ক টোয়েনের মতে, বইয়ের মতো অমূল্য সম্পদ বিনা অনুমতিতে হস্তগত করলে কোনো অন্যায় হবে না।
এতে বইয়ের পূজারিরা (যাঁদের মূল উদ্দেশ্য দোষবোধ না রেখে অন্যের বই মেরে দেওয়া) তাঁকে এখনো মাথায় তুলে রেখেছে (অবশ্য মার্ক টোয়েন বই চুরি করতেন না, তাঁকে সবাই বিনা মূল্যে বই দিয়ে যেত; এবং এত বই ভালোভাবে রাখার জন্য আলমারি কেনার ক্ষমতা তাঁর ছিল না)।
বই বিশিষ্ট বিষয় নিয়ে লেখা হয়, তা কাল্পনিকই হোক, প্রবন্ধই হোক বা গবেষণাপ্রসূতই হোক। একটা বইয়ের স্থায়িত্ব ও গুরুত্ব অন্যান্য ছাপা বস্তুর চেয়ে অনেক বেশি। বই বিনোদনের জন্যও হতে পারে, তবে পাঠ্যপুস্তক বা শিক্ষা প্রদানে ব্যবহৃত বই সাধারণ বই থেকে ভিন্ন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। সেসব প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে ধাপে ধাপে জ্ঞান বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা একমাত্র বই দিয়েই স্থায়ীভাবে করা সম্ভব। শিক্ষা ছাড়া আনুষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করা কঠিন হয়তো। আরো কঠিন আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অন্যদের জ্ঞানার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা। একমাত্র বই-ই পারে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রমিতকরণ। এর অর্থ অবশ্য এটা নয় যে একই বিষয়ে সব বই-ই একই কথা লিখে খাকবে। পাঠ্য বই থেকে আহৃত জ্ঞান মনে রাখার বিষয়টা শিক্ষামহলে নানা মতামতের জন্ম দিয়েছে; অনেকে মুখস্থ করার বিরুদ্ধে। তবে এটাও তারা স্বীকার করে যে কিছু বিদ্যা অবশ্যই মুখস্থ করে রাখার দাবিদার- পরীক্ষার খাতায় সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরেও মুখস্থ জ্ঞানের প্রয়োজন রয়ে যায়। আবার কিছু পেশাগত পাঠ আছে, যেসবের প্রায়োগিক ক্ষেত্রের সঙ্গে পুস্তকের জ্ঞানের সম্মিলন (একমাত্র বেসিক বিষয়টি ছাড়া) বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব। অবশ্য এসব ক্ষেত্রেও পাঠ্যপুস্তককে অবহেলা করা যায় না। আবার কিছু বিদ্যা আছে, যেসবে সারা জীবনই পাশে 'রেফারেন্স বই' নিয়ে কাজ করতে হয়।
আমার মনে হয়, আমরা অনেকে মুখস্থ করা আর ধাতস্থ করা- এই দুইয়ের পার্থক্য ভুলতে বসেছি। অনেক জ্ঞান আছে, যা মুখস্থ করতেই হবে, এবং পরবর্তী পর্যায়ে ধাতস্থ করতে হবে। না পড়েই কোনো কিছু ধাতস্থ করার ক্ষমতা কয়জনের থাকতে পারে (সৃজনশীলতাভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সব সময়ই ছিল, ছিল না পরীক্ষক। আমরা কি রাতারাতি সৃজনশীল পরীক্ষক তৈরি করতে পেরেছি?)!
আজকের সুপণ্ডিতরা তো পুরনো মুখস্থ উত্তর ব্যবস্থারই ফসল। চমৎকৃত না হয়ে পারি না যে তাঁরা এই কথা বলতে না বলতেই এক বছরেই সৃজনশীল পরীক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশে সফল হয়ে গেল; ছাত্রছাত্রীরা সৃজনশীল পরীক্ষায় আরো বেশি জিপিএ ৫ পেল। অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হয় না কি!
যা হোক, পাঠ্যপুস্তকের কথা বাদ দিয়ে অন্য বইয়ের কথায় আসি। বই যেমন নিজে নিজেই পড়া যায়, সে রকম বই পড়ানোর একটা জগৎ আছে। একাডেমিক পাঠাগারের কথা বাদ দিলেও সাধারণ নাগরিকদের জন্য কিছু ধরনের পাঠাগার আমাদের দেশেও চালু আছে। তারা বই পড়াতে এগিয়ে এসেছে। বই যদি উত্তম সৃষ্টি হয়, তাহলে বই পড়ানোর ব্রত অবশ্যই অতি উত্তম।
কিন্তু এটা কি পুরোপুরি সমস্যাবিহীন? কারণ বই বিশিষ্ট সৃষ্টি হলেও বইমাত্রই যে কীটহীন তা মনে করা ভুল (চলতি সময়ে একজন বিশিষ্ট জনপ্রিয় বাঙালি লেখকের নতুন বইটির কথা স্মরণ করা যায়)।
যাঁরা বই পড়িয়ে জ্ঞানী নাগরিক তৈরি করবেন বলে কাজ করছেন, তাঁদের নিজেদের জ্ঞানেরও সীমারেখা থাকা সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশেষ বিশেষ বই পড়ানোয় আগ্রহী হতে পারেন। কী বই পড়ানো উচিত, তাও পাঠাগারের নীতিমালাভিত্তিক হতে পারে। তাঁরা কি ধর্মপুস্তকও পড়াবেন? না শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও বিনোদনমূলক (গল্প-উপন্যাস) বই পড়াবেন? শুধু পড়ানো নয়, পড়িয়ে আবার পরীক্ষাও নেওয়া যেতে পারে- পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে। অবশ্য সব বইয়ের ওপর পরীক্ষা নেওয়া অসম্ভব বিধায় তাঁরা নির্বাচিত কিছু বই নিয়ে পরীক্ষার কাজটা সারেন। অবশ্যই এই নির্বাচিত বইয়ের তালিকায় বিশ্বের সেরা বই স্থান পায় এবং তা-ই পাচ্ছে। কিন্তু সেখানেও বিশাল সমস্যা রয়েছে।
আমরা যেসব বইকে আন্তর্জাতিকভাবে শ্রেষ্ঠ বলছি, সেসবের বেশির ভাগই বিশেষ বিশেষ মত ও তত্ত্বসংবলিত (আইডিওলজিক্যাল)। অর্থাৎ কোনো না কোনো কুটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক জ্ঞান বিতরণ সেসব বইয়ের উদ্দেশ্য, সরাসরি নয়, প্রকারান্তরে (ডিকেন্সের 'এ টেল অব টু সিটিজ' একটি চমৎকার জনপ্রিয় উপন্যাস, কিন্তু বইটি পড়ার পর ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশনের মতো একটি যুগান্তকারী ইতিহাস সম্পর্কে বিরূপ ধারণা হতে বাধ্য। 'টারজান', 'লিলিপুট', 'রবিনসন ক্রুসো', 'ট্রেজার আইল্যান্ড', 'অ্যারাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ'- এ ধরনের বইয়ের তালিকা অফুরন্ত)। বই পড়াতে আগ্রহী করানোর জন্য এসব বই পড়াতেই হয়, কারণ এগুলো আন্তর্জাতিকভাবে শ্রেষ্ঠ বই! এই বইগুলোর উদ্দেশ্য কিন্তু একই- গল্পচ্ছলে এগুলো ককেশান ইউরোপিয়ানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের দলিল। এগুলো প্রমাণ করে ইউরোপের মহত্ত্ব, মহানুভবতা, ন্যায়বিচার প্রদান। এসবে আরো থাকে অসভ্য দেশে (আমাদের দেশসহ আফ্রিকা ও অন্যত্র) সভ্যতার আলোক বিস্তারের কথা- তার ওপর থাকে ব্রিটিশদের (বিশেষত ইংরেজদের) বীরত্বগাথা, শৌর্য-বীর্য, কূটনৈতিকতা, যুদ্ধে পারদর্শিতার কথা। এসব নিয়েই এসব বই লেখা হয়েছে বলে সেসব অবশ্যপাঠ্য তালিকাভুক্ত।
ঔপনিবেশিকতার প্রভাব বজায় রাখার কৌশল এসব বই পড়িয়ে বজায় রাখা হয়। তার ওপর আছে সাম্প্রদায়িকতার খেলা। পড়াতে হবে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালংকার- এঁরা কিভাবে ইংরেজদের পথ অনুসরণ করে বঙ্গকে শিক্ষিত ও আধুনিক করে তুললেন। সে সময় মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কথা- সেই দুঃখে দ্বিজাতিতত্ত্ব ও দাঙ্গা, ভারত বিভাগ- সেই দুঃখে আমাদের সব ধনসম্পদ ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে স্বাধীনতা লাভ। বই পড়ানোর নামে- শ্রেষ্ঠ বই পড়ানোর নামে ব্রিটিশ ও উপনিবেশ রাষ্ট্রের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো জ্বলজ্বল করে। আফ্রিকাকে নিঃস্ব বানিয়ে অসভ্য করার কাহিনী- এসবই তো পড়াব! ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতি- এঁদেরও পড়াব, কিন্তু শুধু সেইগুলোতে যাতে ব্রিটিশবিরোধিতা না থাকে, আর মুসলমানদের প্রাধান্য না থাকে! মুসলমানদের প্রাধান্যওয়ালা বই আবার পুরোপুরি হিন্দুবর্জিত হতে হবে (একটি সুবিখ্যাত গণপাঠাগারে চিরস্থায়ী চেয়ারপারসনের আদেশে 'বিষাদসিন্ধু' বাজেয়াপ্ত করা হয়েই আছে)।
এই তো বই পড়ানোর ফর্মুলা। এই ফর্মুলা অনুসরণ করা হচ্ছে বলেই স্বাধীন বাংলাদেশের 'অবক্ষয়তা দূরীকরণে' বই পড়ানোর যজ্ঞ সুন্দরভাবে শুরু হতে পেরেছিল এবং এখনো একই ফর্মুলায় চলছে। উত্তর-ঔপনিবেশিকতা বজায় রাখতে এটাই চালিয়ে যেতে হবে।
পাঠক, আপনারা জানেন যে মিল্টন বইকে মাস্টার স্পিরিট বলেছিলেন। সেটাই আমাদের পণ্ডিতরা বারবার বলছেন। তাঁরা কিন্তু মিল্টন ব্যবহৃত একটা বিশেষ শব্দ বেমালুম বা ইচ্ছা করে ভুলে গেছেন- শব্দটা হলো 'গুড'। মিল্টন লিখেছিলেন, 'এ গুড বুক ইজ দ্য লাইফব্লাড অব এ মাস্টার স্পিরিট...।' 'গুড'টুকু ফেলে দিয়ে বই পড়ে আর পড়িয়ে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারব বলে মনে হয় না।
(এই লেখার শুরুতে মিল্টনের উদ্ধৃতির চমৎকার বঙ্গানুবাদ করে দিয়েছেন বন্ধুবর কবি মোফাজ্জল করিম)
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
বই বিশিষ্ট বিষয় নিয়ে লেখা হয়, তা কাল্পনিকই হোক, প্রবন্ধই হোক বা গবেষণাপ্রসূতই হোক। একটা বইয়ের স্থায়িত্ব ও গুরুত্ব অন্যান্য ছাপা বস্তুর চেয়ে অনেক বেশি। বই বিনোদনের জন্যও হতে পারে, তবে পাঠ্যপুস্তক বা শিক্ষা প্রদানে ব্যবহৃত বই সাধারণ বই থেকে ভিন্ন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। সেসব প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে ধাপে ধাপে জ্ঞান বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা একমাত্র বই দিয়েই স্থায়ীভাবে করা সম্ভব। শিক্ষা ছাড়া আনুষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করা কঠিন হয়তো। আরো কঠিন আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অন্যদের জ্ঞানার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা। একমাত্র বই-ই পারে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রমিতকরণ। এর অর্থ অবশ্য এটা নয় যে একই বিষয়ে সব বই-ই একই কথা লিখে খাকবে। পাঠ্য বই থেকে আহৃত জ্ঞান মনে রাখার বিষয়টা শিক্ষামহলে নানা মতামতের জন্ম দিয়েছে; অনেকে মুখস্থ করার বিরুদ্ধে। তবে এটাও তারা স্বীকার করে যে কিছু বিদ্যা অবশ্যই মুখস্থ করে রাখার দাবিদার- পরীক্ষার খাতায় সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরেও মুখস্থ জ্ঞানের প্রয়োজন রয়ে যায়। আবার কিছু পেশাগত পাঠ আছে, যেসবের প্রায়োগিক ক্ষেত্রের সঙ্গে পুস্তকের জ্ঞানের সম্মিলন (একমাত্র বেসিক বিষয়টি ছাড়া) বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব। অবশ্য এসব ক্ষেত্রেও পাঠ্যপুস্তককে অবহেলা করা যায় না। আবার কিছু বিদ্যা আছে, যেসবে সারা জীবনই পাশে 'রেফারেন্স বই' নিয়ে কাজ করতে হয়।
আমার মনে হয়, আমরা অনেকে মুখস্থ করা আর ধাতস্থ করা- এই দুইয়ের পার্থক্য ভুলতে বসেছি। অনেক জ্ঞান আছে, যা মুখস্থ করতেই হবে, এবং পরবর্তী পর্যায়ে ধাতস্থ করতে হবে। না পড়েই কোনো কিছু ধাতস্থ করার ক্ষমতা কয়জনের থাকতে পারে (সৃজনশীলতাভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সব সময়ই ছিল, ছিল না পরীক্ষক। আমরা কি রাতারাতি সৃজনশীল পরীক্ষক তৈরি করতে পেরেছি?)!
আজকের সুপণ্ডিতরা তো পুরনো মুখস্থ উত্তর ব্যবস্থারই ফসল। চমৎকৃত না হয়ে পারি না যে তাঁরা এই কথা বলতে না বলতেই এক বছরেই সৃজনশীল পরীক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশে সফল হয়ে গেল; ছাত্রছাত্রীরা সৃজনশীল পরীক্ষায় আরো বেশি জিপিএ ৫ পেল। অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হয় না কি!
যা হোক, পাঠ্যপুস্তকের কথা বাদ দিয়ে অন্য বইয়ের কথায় আসি। বই যেমন নিজে নিজেই পড়া যায়, সে রকম বই পড়ানোর একটা জগৎ আছে। একাডেমিক পাঠাগারের কথা বাদ দিলেও সাধারণ নাগরিকদের জন্য কিছু ধরনের পাঠাগার আমাদের দেশেও চালু আছে। তারা বই পড়াতে এগিয়ে এসেছে। বই যদি উত্তম সৃষ্টি হয়, তাহলে বই পড়ানোর ব্রত অবশ্যই অতি উত্তম।
কিন্তু এটা কি পুরোপুরি সমস্যাবিহীন? কারণ বই বিশিষ্ট সৃষ্টি হলেও বইমাত্রই যে কীটহীন তা মনে করা ভুল (চলতি সময়ে একজন বিশিষ্ট জনপ্রিয় বাঙালি লেখকের নতুন বইটির কথা স্মরণ করা যায়)।
যাঁরা বই পড়িয়ে জ্ঞানী নাগরিক তৈরি করবেন বলে কাজ করছেন, তাঁদের নিজেদের জ্ঞানেরও সীমারেখা থাকা সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশেষ বিশেষ বই পড়ানোয় আগ্রহী হতে পারেন। কী বই পড়ানো উচিত, তাও পাঠাগারের নীতিমালাভিত্তিক হতে পারে। তাঁরা কি ধর্মপুস্তকও পড়াবেন? না শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও বিনোদনমূলক (গল্প-উপন্যাস) বই পড়াবেন? শুধু পড়ানো নয়, পড়িয়ে আবার পরীক্ষাও নেওয়া যেতে পারে- পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে। অবশ্য সব বইয়ের ওপর পরীক্ষা নেওয়া অসম্ভব বিধায় তাঁরা নির্বাচিত কিছু বই নিয়ে পরীক্ষার কাজটা সারেন। অবশ্যই এই নির্বাচিত বইয়ের তালিকায় বিশ্বের সেরা বই স্থান পায় এবং তা-ই পাচ্ছে। কিন্তু সেখানেও বিশাল সমস্যা রয়েছে।
আমরা যেসব বইকে আন্তর্জাতিকভাবে শ্রেষ্ঠ বলছি, সেসবের বেশির ভাগই বিশেষ বিশেষ মত ও তত্ত্বসংবলিত (আইডিওলজিক্যাল)। অর্থাৎ কোনো না কোনো কুটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক জ্ঞান বিতরণ সেসব বইয়ের উদ্দেশ্য, সরাসরি নয়, প্রকারান্তরে (ডিকেন্সের 'এ টেল অব টু সিটিজ' একটি চমৎকার জনপ্রিয় উপন্যাস, কিন্তু বইটি পড়ার পর ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশনের মতো একটি যুগান্তকারী ইতিহাস সম্পর্কে বিরূপ ধারণা হতে বাধ্য। 'টারজান', 'লিলিপুট', 'রবিনসন ক্রুসো', 'ট্রেজার আইল্যান্ড', 'অ্যারাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ'- এ ধরনের বইয়ের তালিকা অফুরন্ত)। বই পড়াতে আগ্রহী করানোর জন্য এসব বই পড়াতেই হয়, কারণ এগুলো আন্তর্জাতিকভাবে শ্রেষ্ঠ বই! এই বইগুলোর উদ্দেশ্য কিন্তু একই- গল্পচ্ছলে এগুলো ককেশান ইউরোপিয়ানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের দলিল। এগুলো প্রমাণ করে ইউরোপের মহত্ত্ব, মহানুভবতা, ন্যায়বিচার প্রদান। এসবে আরো থাকে অসভ্য দেশে (আমাদের দেশসহ আফ্রিকা ও অন্যত্র) সভ্যতার আলোক বিস্তারের কথা- তার ওপর থাকে ব্রিটিশদের (বিশেষত ইংরেজদের) বীরত্বগাথা, শৌর্য-বীর্য, কূটনৈতিকতা, যুদ্ধে পারদর্শিতার কথা। এসব নিয়েই এসব বই লেখা হয়েছে বলে সেসব অবশ্যপাঠ্য তালিকাভুক্ত।
ঔপনিবেশিকতার প্রভাব বজায় রাখার কৌশল এসব বই পড়িয়ে বজায় রাখা হয়। তার ওপর আছে সাম্প্রদায়িকতার খেলা। পড়াতে হবে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালংকার- এঁরা কিভাবে ইংরেজদের পথ অনুসরণ করে বঙ্গকে শিক্ষিত ও আধুনিক করে তুললেন। সে সময় মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কথা- সেই দুঃখে দ্বিজাতিতত্ত্ব ও দাঙ্গা, ভারত বিভাগ- সেই দুঃখে আমাদের সব ধনসম্পদ ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে স্বাধীনতা লাভ। বই পড়ানোর নামে- শ্রেষ্ঠ বই পড়ানোর নামে ব্রিটিশ ও উপনিবেশ রাষ্ট্রের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো জ্বলজ্বল করে। আফ্রিকাকে নিঃস্ব বানিয়ে অসভ্য করার কাহিনী- এসবই তো পড়াব! ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতি- এঁদেরও পড়াব, কিন্তু শুধু সেইগুলোতে যাতে ব্রিটিশবিরোধিতা না থাকে, আর মুসলমানদের প্রাধান্য না থাকে! মুসলমানদের প্রাধান্যওয়ালা বই আবার পুরোপুরি হিন্দুবর্জিত হতে হবে (একটি সুবিখ্যাত গণপাঠাগারে চিরস্থায়ী চেয়ারপারসনের আদেশে 'বিষাদসিন্ধু' বাজেয়াপ্ত করা হয়েই আছে)।
এই তো বই পড়ানোর ফর্মুলা। এই ফর্মুলা অনুসরণ করা হচ্ছে বলেই স্বাধীন বাংলাদেশের 'অবক্ষয়তা দূরীকরণে' বই পড়ানোর যজ্ঞ সুন্দরভাবে শুরু হতে পেরেছিল এবং এখনো একই ফর্মুলায় চলছে। উত্তর-ঔপনিবেশিকতা বজায় রাখতে এটাই চালিয়ে যেতে হবে।
পাঠক, আপনারা জানেন যে মিল্টন বইকে মাস্টার স্পিরিট বলেছিলেন। সেটাই আমাদের পণ্ডিতরা বারবার বলছেন। তাঁরা কিন্তু মিল্টন ব্যবহৃত একটা বিশেষ শব্দ বেমালুম বা ইচ্ছা করে ভুলে গেছেন- শব্দটা হলো 'গুড'। মিল্টন লিখেছিলেন, 'এ গুড বুক ইজ দ্য লাইফব্লাড অব এ মাস্টার স্পিরিট...।' 'গুড'টুকু ফেলে দিয়ে বই পড়ে আর পড়িয়ে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারব বলে মনে হয় না।
(এই লেখার শুরুতে মিল্টনের উদ্ধৃতির চমৎকার বঙ্গানুবাদ করে দিয়েছেন বন্ধুবর কবি মোফাজ্জল করিম)
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
No comments