চারদিক-পাখির নিরাপদ ঘর by আকমল হোসেন

গ্রামের পথে পথে শিশুরা খেলা করছে। দিনের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছেন বিভিন্ন বাড়িতে লোকজন। মেঠোপথে দু-চারজন পথিক হেঁটে চলছেন। শান্ত, কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। তবে এই শান্ত অবস্থা বেশি সময় থাকে না। সন্ধ্যা গাঢ় হতে থাকলে খুব দ্রুতই এ পরিবেশটা বদলে যেতে থাকে। তবে এই বদল নিয়ে কারও কোনো উদ্বেগ নেই, উৎকণ্ঠা নেই।


বরং চোখেমুখে আছে কেমন মুগ্ধতা ও ভালো লাগার আবেশ। তখন গোধূলির রং লেগেছে পশ্চিমের সোনার মেঘে। সেই রং ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের গাছগাছালিতে। তখন বকের সাদা ডানায় গোধূলির হালকা লাল আলোর ঝিকিমিকি। সাদা বকের ভিড়ে চকচকে রূপ নিয়ে উড়ে কালো পানকৌড়ির দল।
উত্তরে শীতের হাওয়া শুরু হলেই মৌলভীবাজারের কাওয়াদিঘি হাওরে হাজার মাইল পথ পাড়ি দেওয়া নানা জাতের হাঁস, নানা বর্ণের অতিথি পাখির দল উড়ে আসতে থাকে। হাওরে কৃষি জমি বৃদ্ধি, শিকারির উৎপাত, মৎস্য প্রজননের পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়া—এসব কারণে পাখির আসাটা আগের মতো নেই। অনেকটাই কমেছে। কিন্তু কাওয়াদিঘি হাওরে অতিথি পাখির শীতবাস একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। কম-বেশি প্রতিবছরই অতিথি পাখির ঝাঁক আসে। ডানায় উল্লাস করে গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। এটা দেখেই হাওরপারের মানুষ অভ্যস্ত। কখনো কখনো দলছুট দু-একটা পাখি বা ছোট কোনো ঝাঁক কারও বাড়ির বাঁশঝাড়, বটগাছ বা ঝোঁপে আশ্রয় নিয়েছে। সাময়িক বিরতি নিয়েছে। তবে কারও বাড়িতে দল বেঁধে পাখি আসে, গাছে গাছে রাত কাটায়। আর সে পাখিকে কেউ বিরক্ত করে না, এ রকম ঘটনা অঞ্চলটিতে বিরল। তবু এই বিরল ঘটনাটিই বিস্মিত করেছে অনেককে। মানুষ মেনেও নিয়েছে পাখির এমন বাসকে। বাড়ির প্রতিটি গাছ রাতের জন্য হয়ে ওঠে পাখির নিরাপদ ঘর। মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কাওয়াদিঘি হাওরপারের পাঁচগাঁও ইউনিয়নের বাগেশ্বর গ্রামে এ রকম দু-তিনটি বাড়ি পাখিবৈচিত্র্যে হয়ে উঠেছে আলাদা।
পাঁচগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ইউছুফ মিয়া বলেন, ‘বাড়িতে আগে কিছু কিছু পাখি আসত। তবে বছর তিনেক ধরে আমাদের বাড়িতে প্রচুর পাখি আসছে। কেউ পাখিকে বিরক্ত করে না। পাখিগুলো যখন সন্ধ্যার সময় বাড়িতে আসতে থাকে, দেখতে খুব সুন্দর লাগে।’ ইউছুফ মিয়া জানান, বাড়িতে বক ও পানকৌড়িই বেশি। তবে কার্তিক মাসে সরালি ও পানকৌড়ি বেশি থাকে। সারা বাড়ি ভরা হাজার হাজার পাখি। গৃহিণী মিনারা বেগম বলেন, ‘বিকেল হলেই পাখি আসা শুরু হয়। তারপর রাত আটটা পর্যন্ত বাড়ির গাছে গাছে ডাকাডাকি করে। কান ঝালাপালা হয়ে যায়। সূর্য ওঠার পর আবার সব পাখি হাওরে চলে যায়।’ মিনারা বেগম জানান, পাখির জন্য বাড়িতে গন্ধ হয়ে যায়। তবে এর জন্য তাঁরা বিরক্ত না। বাড়িতে আসা পাখি দেখতে তাঁদের ভালো লাগে। অনেক লোক আসে পাখি দেখতে। সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। আরেক গৃহিণী তাজি বেগম বলেন, ‘আমাদের মুরব্বিরা পাখি ধরতে দেইন না। তাঁরা বলেন, সারা দিনে আধার খাইয়া উঠিয়া আর (খাদ্য খেয়ে উঠে আসছে)। ধরলে পাখি অভিশাপ দিব।’ কিশোর জুবেল মিয়া জানায়, ঝড় এলে গাছের নিচু ডালগুলোতে পাখি আশ্রয় নেয়। ঝড় থামলে উঁচু ডালে চলে যায়। এলাকাবাসী জানালেন, শিলাঝড় হলে অনেক পাখি আহত হয়ে আশপাশের গ্রামে গিয়ে ধরা পড়ে। অনেক পাখি মারাও যায়। একমাত্র শিলাবৃষ্টি বা বড় ঝড় হলেই তাদের বিপদ।
এলাকাবাসী জানিয়েছিলেন, দিনে পাখি দেখবেন না। মনেই হবে না, এই বাড়িতে কত পাখি থাকে। দেখা গেছে, সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত বাড়িগুলোতে তেমন একটা পাখি নেই। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটা পাখি দূরে দূরে উড়ছে। গ্রামের একটি উঁচু বটগাছের চূড়ায় শরীরে বিকেলের আলো মেখে বকের একটি দল বসে। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই বাড়তে থাকে পাখির সংখ্যা। হাওরাঞ্চল থেকে ঝাঁক বেঁধে মালার মতো সাদা বকের দল উড়ে আসে বাড়ির দিকে। গাছের উঁচু ডালে বসে লম্বা ঠোঁট দিয়ে ডানার পালক খুঁচিয়ে ডানা ঝাপটায়। একটা উড়াল দিলে গাছের সবকটাই উড়াল দেয়। আবার গাছে ফিরে আসে। বকপাখি বেশি হলেও পানকৌড়ির সংখ্যা নেহাত কম না। তারা ঝাঁক বেঁধে বা বকের সঙ্গে মিশে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটা করে এসে গাছে বসে। সন্ধ্যার ঘন হওয়া অন্ধকারে পানকৌড়ির কালো শরীর মিশে যায়।
দেখতে দেখতে মুহূর্তেই বাড়ির চেহারা বদলে যায়। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই পাখি। পাখির ডাকাডাকিতে বাড়িটা সরগরম হয়ে ওঠে, সরব হয়ে ওঠে আশপাশের গাছপালার বন। সন্ধ্যা যখন অন্ধকারে ডুবে যায়, তখন আর পাখি দেখা যায় না। কিন্তু তখনো শোনা যায় পাখির ডাক। তবে পাখির এই উড়ে আসা, গাছে গাছে বসে পড়া—এসব শিশু-কিশোর থেকে বড় সবার কাছে যেন সাধারণ একটি ঘটনা। সবাই যার যার মতো কাজ করছেন। পাখি উড়ছে, বসছে, ডাকছে। মানুষ চলছে, তার মতো। মনে হচ্ছিল, পাখি ও মানুষ যুগ যুগের প্রতিবেশী। সবাই যেন মিলেমিশে আছে কতকাল! কতকাল একে অপরের সাথী!

No comments

Powered by Blogger.