দিল্লির চিঠি-সেনা বনাম সরকার বিতর্ক by কুলদীপ নায়ার
একজন সৈনিক কেবল একজন সৈনিকই, আর কিছু হওয়ার চেষ্টা তার করা উচিত নয়। কথাটা পুরোনো কিন্তু আজকের ভারতে সেনাপ্রধান ভি কে সিংয়ের অবসর গ্রহণের সময় এটা খুবই প্রাসঙ্গিক। অতিচালাকি করতে গিয়ে তিনি যেমন নিজেকে খেলো করেছেন, তেমনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভেতরও সন্দেহের জন্ম দিয়েছেন।
তাঁকে কেবল অসতর্ক বললে কম বলা হয়। তাহলেও আত্মপক্ষ সমর্থনে অপ্রস্তুতি কিংবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দূরত্ব তৈরিতে আমলাতন্ত্রের চাল সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তা বিশ্বাসযোগ্য। সরকারের তরফে জেনারেলের অভিযোগ মোকাবিলায় অস্বস্তিতে তা প্রমাণিত হয়।
সম্ভবত, বিদায়ী জেনারেল বেশি মুখ খুলেছিলেন এবং নিজেকে অনেক বেশি বিতর্কের মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছেন। তাঁর মতো অবস্থানের কারও এসব থেকে দূরে থাকাই ভালো। তিনি কেবল কিছু ধুলোই ওড়াননি, প্রতিরক্ষা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকাও বন্ধ করেছেন। তিনি সেনাবাহিনীকে জনগণের নজরের সামনে নিয়ে এসে একে সমালোচনা ও পরিহাসের পাত্র করে তুলেছেন। এসবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী বিকৃত হয়েছে, যার মেরামতে হয়তো কেবল একটি প্লাস্টিক সার্জারিই যথেষ্ট ছিল।
মানুষের চোখে রহস্যাবৃত থাকার মজা সেনাবাহিনী এতকাল উপভোগ করে এসেছে। সেনাবাহিনীর হাতে দেশের নিরাপত্তাভার থাকা নিয়েও মানুষ নিশ্চিন্ত ছিল। জেনারেল সিং এই শিশুসুলভ বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে জনগণকে অস্বস্তি ও অনিরাপত্তার অনুভূতিতে ফেলেছেন। ভারতের সেনাবাহিনী এখন আর ধোয়া তুলসীপাতা নয়। এখন থেকে এর সচেতন বা অসচেতন ভুলত্রুটি আর ছাড় পাবে না।
এসব থেকে সেনানিবাসের ধারণা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এগুলো কি নগরের বাইরে রাখা উচিত, যেসব নগরে রয়েছে জবাবদিহির অধীন নির্বাচিত পৌরসভা? সেনানিবাসে কেবল মনোনীত পরিষদ থাকে। প্রশ্নও উঠবে, কেন ‘প্রতিরক্ষাভূমি’ বলে আলাদা করা হাজার হাজার একর জমিতে সেনাবাহিনী ছাড়া আর কারও কোনো এখতিয়ার থাকবে না? বাংলাদেশ ও পাকিস্তানও এই একই সমস্যা মোকাবিলা করছে। জনগণ সবখানেই আরও স্বচ্ছতা দেখতে চায়।
কাশ্মীর ও সিয়াচেন বিষয়ে জেনারেলদের বক্তব্যে পাকিস্তানিদের প্রতি সোজাসাপ্টা পরিষ্কার উত্তর থাকা উচিত। তিনি বলেছেন, ভারত সিয়াচেন ছাড়বে না, কারণ তা করা কৌশলগতভাবে ভুল হবে। বরং তিনি অভিযোগ করেছেন, কারগিল ঘটনার পর পাকিস্তানকে আর বিশ্বাস করা যায় না।
পাকিস্তানও হয়তো ভিসা-সুবিধা সহজ করার দিকে আর এগোবে না, যদিও উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন। তাহলেও পাকিস্তানকে বিশ্বাসের ঘাটতি দূর করার পথ খুঁজতে হবে। এটা ছাড়া হিমবাহ বিষয়ের বিবাদেও কোনো অগ্রগতি আসবে না। আমার মনে হয়, সিয়াচেন হিমবাহ এলাকাকে মনুষ্যবর্জিত এলাকা ঘোষণা করা উচিত। কিন্তু তার আগে পাকিস্তানকেও কার্যকর প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে ভারতীয় সেনারা চলে গেলে তারা এলাকাটি দখল করবে না।
জেনারেলের তরফে কাশ্মীরে সেনা আইন (বিশেষ ক্ষমতা) প্রত্যাহার না করার পক্ষে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণকে রক্ষা করা, বিশেষত যারা ভারত সরকারের প্রতি অনুগত, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সরকার এবং রাজ্য পুলিশের কর্তব্য। এ কাজে ব্যর্থতা বা দুর্বলতা সেনাবাহিনীর না হোক, নয়াদিল্লির চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত।
জেনারেল ভি কে সিংয়ের কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যখন তিনি বলেন যে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র-সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি আহরণের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কথাও শুনতে হবে। এসব প্রযুক্তি নিজেদেরই তৈরি করতে পারা উচিত ছিল।
ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন-কাঠামো মোটামুটি উন্মোচিত। কারণ, আত্মনির্ভরতার ধারেকাছেও আমরা নেই। প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন ১৯৬০ সালে যে বড়াই করেছিলেন, ১৯৬২ সালে চীনাদের কাছে পরাজিত হয়ে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। এখন প্রধানমন্ত্রীকে লেখা জেনারেল ভি কে সিংয়ের চিঠির বরাতে জানতে পারছি, সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখায়ই ঘাটতি ও দুর্বলতা রয়েছে। এই চিঠিটি চোখ খুলে দেওয়ার মতো। এ ব্যাপারে সরকারি দাবি বক্তৃতার বেশি কিছু নয়।
এই চিঠিটি ফাঁস হয়ে যাওয়াটা এখনো রহস্য হয়ে আছে। জেনারেল সিং যখন বলেন যে সেনাবাহিনী এটা করেনি, তখন আমি তা বিশ্বাস করি। সেনাবাহিনীর গোপনীয়তার বন্দোবস্ত ত্রুটিহীন। তাহলে রইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দপ্তর। এই দুই দপ্তর থেকেই এটা ফাঁস হওয়া সম্ভব, কারণ এই দুই দপ্তরের আমলারা জেনারেলকে দুর্নাম দিতে আগ্রহী ছিল।
গণমাধ্যমে এমনকি এটাও প্রকাশিত হয়েছে যে চিঠি ফাঁস করা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক ভদ্রমহিলার কাজ। বাস্তবে সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ মুখ বুজে রয়েছে। এতে করে আমলাতন্ত্রের কারও জড়িত থাকার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। ভি কে সিং তো নিজের সুনাম নষ্ট করেছেনই। এখন তাঁকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা গোয়েন্দাদের উচিত নয়। তাঁকে ভোগান্তিতে ফেলার প্রতিক্রিয়া সেনাবাহিনীর মধ্যে খারাপ হতে পারে। সেটা দেশের জন্য ভালো হবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
সম্ভবত, বিদায়ী জেনারেল বেশি মুখ খুলেছিলেন এবং নিজেকে অনেক বেশি বিতর্কের মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছেন। তাঁর মতো অবস্থানের কারও এসব থেকে দূরে থাকাই ভালো। তিনি কেবল কিছু ধুলোই ওড়াননি, প্রতিরক্ষা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকাও বন্ধ করেছেন। তিনি সেনাবাহিনীকে জনগণের নজরের সামনে নিয়ে এসে একে সমালোচনা ও পরিহাসের পাত্র করে তুলেছেন। এসবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী বিকৃত হয়েছে, যার মেরামতে হয়তো কেবল একটি প্লাস্টিক সার্জারিই যথেষ্ট ছিল।
মানুষের চোখে রহস্যাবৃত থাকার মজা সেনাবাহিনী এতকাল উপভোগ করে এসেছে। সেনাবাহিনীর হাতে দেশের নিরাপত্তাভার থাকা নিয়েও মানুষ নিশ্চিন্ত ছিল। জেনারেল সিং এই শিশুসুলভ বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে জনগণকে অস্বস্তি ও অনিরাপত্তার অনুভূতিতে ফেলেছেন। ভারতের সেনাবাহিনী এখন আর ধোয়া তুলসীপাতা নয়। এখন থেকে এর সচেতন বা অসচেতন ভুলত্রুটি আর ছাড় পাবে না।
এসব থেকে সেনানিবাসের ধারণা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এগুলো কি নগরের বাইরে রাখা উচিত, যেসব নগরে রয়েছে জবাবদিহির অধীন নির্বাচিত পৌরসভা? সেনানিবাসে কেবল মনোনীত পরিষদ থাকে। প্রশ্নও উঠবে, কেন ‘প্রতিরক্ষাভূমি’ বলে আলাদা করা হাজার হাজার একর জমিতে সেনাবাহিনী ছাড়া আর কারও কোনো এখতিয়ার থাকবে না? বাংলাদেশ ও পাকিস্তানও এই একই সমস্যা মোকাবিলা করছে। জনগণ সবখানেই আরও স্বচ্ছতা দেখতে চায়।
কাশ্মীর ও সিয়াচেন বিষয়ে জেনারেলদের বক্তব্যে পাকিস্তানিদের প্রতি সোজাসাপ্টা পরিষ্কার উত্তর থাকা উচিত। তিনি বলেছেন, ভারত সিয়াচেন ছাড়বে না, কারণ তা করা কৌশলগতভাবে ভুল হবে। বরং তিনি অভিযোগ করেছেন, কারগিল ঘটনার পর পাকিস্তানকে আর বিশ্বাস করা যায় না।
পাকিস্তানও হয়তো ভিসা-সুবিধা সহজ করার দিকে আর এগোবে না, যদিও উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন। তাহলেও পাকিস্তানকে বিশ্বাসের ঘাটতি দূর করার পথ খুঁজতে হবে। এটা ছাড়া হিমবাহ বিষয়ের বিবাদেও কোনো অগ্রগতি আসবে না। আমার মনে হয়, সিয়াচেন হিমবাহ এলাকাকে মনুষ্যবর্জিত এলাকা ঘোষণা করা উচিত। কিন্তু তার আগে পাকিস্তানকেও কার্যকর প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে ভারতীয় সেনারা চলে গেলে তারা এলাকাটি দখল করবে না।
জেনারেলের তরফে কাশ্মীরে সেনা আইন (বিশেষ ক্ষমতা) প্রত্যাহার না করার পক্ষে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণকে রক্ষা করা, বিশেষত যারা ভারত সরকারের প্রতি অনুগত, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সরকার এবং রাজ্য পুলিশের কর্তব্য। এ কাজে ব্যর্থতা বা দুর্বলতা সেনাবাহিনীর না হোক, নয়াদিল্লির চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত।
জেনারেল ভি কে সিংয়ের কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যখন তিনি বলেন যে সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র-সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি আহরণের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কথাও শুনতে হবে। এসব প্রযুক্তি নিজেদেরই তৈরি করতে পারা উচিত ছিল।
ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন-কাঠামো মোটামুটি উন্মোচিত। কারণ, আত্মনির্ভরতার ধারেকাছেও আমরা নেই। প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন ১৯৬০ সালে যে বড়াই করেছিলেন, ১৯৬২ সালে চীনাদের কাছে পরাজিত হয়ে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। এখন প্রধানমন্ত্রীকে লেখা জেনারেল ভি কে সিংয়ের চিঠির বরাতে জানতে পারছি, সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখায়ই ঘাটতি ও দুর্বলতা রয়েছে। এই চিঠিটি চোখ খুলে দেওয়ার মতো। এ ব্যাপারে সরকারি দাবি বক্তৃতার বেশি কিছু নয়।
এই চিঠিটি ফাঁস হয়ে যাওয়াটা এখনো রহস্য হয়ে আছে। জেনারেল সিং যখন বলেন যে সেনাবাহিনী এটা করেনি, তখন আমি তা বিশ্বাস করি। সেনাবাহিনীর গোপনীয়তার বন্দোবস্ত ত্রুটিহীন। তাহলে রইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দপ্তর। এই দুই দপ্তর থেকেই এটা ফাঁস হওয়া সম্ভব, কারণ এই দুই দপ্তরের আমলারা জেনারেলকে দুর্নাম দিতে আগ্রহী ছিল।
গণমাধ্যমে এমনকি এটাও প্রকাশিত হয়েছে যে চিঠি ফাঁস করা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক ভদ্রমহিলার কাজ। বাস্তবে সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ মুখ বুজে রয়েছে। এতে করে আমলাতন্ত্রের কারও জড়িত থাকার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। ভি কে সিং তো নিজের সুনাম নষ্ট করেছেনই। এখন তাঁকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা গোয়েন্দাদের উচিত নয়। তাঁকে ভোগান্তিতে ফেলার প্রতিক্রিয়া সেনাবাহিনীর মধ্যে খারাপ হতে পারে। সেটা দেশের জন্য ভালো হবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments