মত দ্বিমত-এখনই দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন নয় by তোফায়েল আহমেদ
স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন দলীয়ভাবে করার বিষয়ে সরকারের চিন্তাভাবনার কথা সম্প্রতি একাধিকবার বলেছেন স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী। সরকারের এ ভাবনার বিষয়ে দুটি মতামত ছাপা হলো
স্থানীয় সরকার প্রকৃতিগতভাবে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান নয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৃতিগতভাবে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান নয়।
আমাদের স্থানীয় সরকার নেতাদেরও শক্তিশালী দলীয় সংযোগ-সম্পৃক্ততা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। তবে ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে স্বাধীন দেশের সামরিক-বেসামরিক সব শাসনামলে স্থানীয় সরকারকে সাংবিধানিকভাবে নির্বাহী বিভাগের অঙ্গীভূত করে দেখার কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে দলভিত্তিক নির্বাচনের বাইরে দেখা হয়। দেশে সুস্থ, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর মারমুখী প্রবণতা তৃণমূল পর্যায়ে এ নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে তা আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন বর্তমানকার অতিকেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক দলগুলোকে তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী হতে বা দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় প্রভূতভাবে সহায়তা করবে। কিন্তু রাজনীতির মাত্রাজ্ঞানহীনতা, সংঘাত, সহিংসতা, বিভক্তি, দখলবাজি ইত্যাদি সব মিলিয়ে বিরোধী শক্তিকে ঘরছাড়া-ভিটেমাটিছাড়া করার যে অশুভ প্রবণতা তা একটি প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা পেয়ে যেতে পারে। সমাজ পরিবর্তন ও সমাজ প্রশাসনে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা সবটা নেতিবাচক নয়। কিন্তু আমাদের অতিরাজনীতি-মনস্কতা শুধু অশুভ নয়, ক্ষতিকারক। তাই কিছু কিছু বিষয়ে কতটুকু রাজনৈতিকীকরণ হবে তার একটি সীমারেখা থাকা উচিত।
পশ্চিমে রাজনৈতিক উদারতা, সহনশীলতা, রাজনীতির মাত্রাজ্ঞান এবং স্বাধীন মানুষের সামাজিক পরিসর অনেক বেশি বিস্তৃত, যা এ দেশে বিরল। তাই এ মুহূর্তে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন অসহিষ্ণুতা ও অস্থিরতা বাড়াবে। সমাজ ও রাজনীতিতে বিভাজন, বিদ্বেষ ও বিভক্তি বাড়াবে। দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের প্রয়োজনীতা আকস্মিকভাবে কেন দেখা দিল তা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দরকার। এ উদ্যোগ কি স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের জন্য, নাকি তৃণমূলে দলীয় ভিত্তি মজবুত করার জন্য। ধারণা করা হচ্ছে, শেষ কারণটিই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। দল গঠন দলীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই হোক। একটি ঐতিহ্যবাহী শাসন প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূলে আঘাত করে নয়।
তা ছাড়া রাজনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বাদ দিলেও দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন নতুন আইনগত জটিলতার জন্ম দেবে। শুধু স্থানীয় সরকার আইনের একটি ধারা পরিবর্তন করে দলীয় মনোনয়ন এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচন সম্ভব নয়। এখানে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনসহ আরও বহু আইনের সংযোগ রয়েছে। ওই সব আইনেরও পরিবর্তন করতে হবে। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন উচিত বিদ্যমান আইনে অতি দ্রুত মেয়াদ উত্তীর্ণ নির্বাচনগুলো সম্পন্ন করা। নির্বাচন নিয়ে নতুন বিতর্ক অন্তত এ মুহূর্তে কাম্য হতে পারে না।
বর্তমান আইনের অধীনে যারা সক্রিয় রাজনীতিতে নেই, কিন্তু সমাজকর্মে আগ্রহী এমন সব ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়ী হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা বিদ্যমান। রয়েছে দলের ভেতরের একাধিক প্রার্থীরও নির্বাচনে অংশগ্রহণের অবারিত সুযোগ। তাতে দলের ভেতরে বহুবাচনিকতার প্রসার হতে পারে। কেউ পরাজিত হলে দল তার কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না, কিন্তু বিজয়ী প্রার্থী দলেরই থাকছে। দলভিত্তিক নির্বাচন হলে দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। তাতে একদিকে সাধারণ মানুষের নেতা বাছাইয়ের সুযোগ সংকুচিত হবে, অপরদিকে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ব্যক্তি দলে মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। দলে বিদ্রোহ-কোন্দল বাড়বে। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চাবিমুখ রাজনৈতিক দল থেকে সঠিক মনোনয়নের প্রত্যাশা করা অকল্পনীয়। বরং মনোনয়ন-বাণিজ্যের সম্ভাবনা এখানে অধিক। তা ছাড়া স্থানীয় নির্বাচন অদলীয় হলে নির্বাচনী মাঠ অনেক বেশি সমতল থাকবে। দলভিত্তিক নির্বাচনী ময়দান সাধারণ প্রার্থীর জন্য অনেক বেশি অসমতল ও বন্ধুর হয়ে পড়বে। জাতীয় নির্বাচনগুলো জাতীয় ভিত্তিক নির্বাচনী মেনিফেস্টো দিয়েই হোক। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় কর্মসূচিও জাতীয় প্রতীকে হওয়া অর্থহীন। এটি স্থানীয় নেতৃত্বের গুণাবলিতে স্থানীয় ইস্যুভিত্তিক হওয়াই ভালো।
ভারতে পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের বিধান কার্যকর রয়েছে। সেখানে স্থানীয় সরকারের রং, আদল, কাঠামো, কার্যক্রম ও অর্থায়ন পদ্ধতি আমাদের চেয়ে ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ‘সংসদীয় পদ্ধতি’তে চলে। সেখানে বিধানিক ও নির্বাহী কার্যক্রমে সীমারেখা নির্ধারিত আছে। কলকাতা সিটি করপোরেশনের ‘কাউন্সিল সভার’ সভাপতির পদমর্যাদা ডেপুটি মেয়রের। তার কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। প্রতিটি স্থানীয় পরিষদে সংসদীয় পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার গঠিত হয়। সংখ্যালঘিষ্ঠরা বিরোধী আসনে বসেন। আমাদের স্থানীয় সরকারকাঠমো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে গঠিত। আমরা মূলত চেয়ারম্যান বা মেয়রসর্বস্ব পরিষদ, পৌরসভা বা করপোরেশন গঠন করি। তাই দলভিত্তিক এবং দলীয় প্রতীক স্থানীয় নির্বাচন দুই বছরের অধিককালের মেয়াদ উত্তীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তের বিষয় হতে পারে না। এ বিষয়টি মেয়াদ উত্তীর্ণ নির্বাচনগুলো সমাপ্ত করে ধীরে-সুস্থে বিবেচনার দাবি রাখে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক কিন্তু সময়টা ভুল। এটি নির্বাচনকে আরও অনিশ্চিত করে দিতে পারে। বিতর্ক হিসেবে এটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক বিতর্ক। এটি চলতে থাকুক। এ নিয়ে একটি জাতীয় মতৈক্য সৃষ্টি হোক। এ মুহূর্তে এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে সংখ্যার শক্তিতে আইন পাস করতে যাওয়া হঠকারিতার শামিল হতে পারে।
তোফায়েল আহমেদ : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন বর্তমানকার অতিকেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক দলগুলোকে তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী হতে বা দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় প্রভূতভাবে সহায়তা করবে। কিন্তু রাজনীতির মাত্রাজ্ঞানহীনতা, সংঘাত, সহিংসতা, বিভক্তি, দখলবাজি ইত্যাদি সব মিলিয়ে বিরোধী শক্তিকে ঘরছাড়া-ভিটেমাটিছাড়া করার যে অশুভ প্রবণতা তা একটি প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা পেয়ে যেতে পারে। সমাজ পরিবর্তন ও সমাজ প্রশাসনে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা সবটা নেতিবাচক নয়। কিন্তু আমাদের অতিরাজনীতি-মনস্কতা শুধু অশুভ নয়, ক্ষতিকারক। তাই কিছু কিছু বিষয়ে কতটুকু রাজনৈতিকীকরণ হবে তার একটি সীমারেখা থাকা উচিত।
পশ্চিমে রাজনৈতিক উদারতা, সহনশীলতা, রাজনীতির মাত্রাজ্ঞান এবং স্বাধীন মানুষের সামাজিক পরিসর অনেক বেশি বিস্তৃত, যা এ দেশে বিরল। তাই এ মুহূর্তে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন অসহিষ্ণুতা ও অস্থিরতা বাড়াবে। সমাজ ও রাজনীতিতে বিভাজন, বিদ্বেষ ও বিভক্তি বাড়াবে। দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের প্রয়োজনীতা আকস্মিকভাবে কেন দেখা দিল তা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দরকার। এ উদ্যোগ কি স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের জন্য, নাকি তৃণমূলে দলীয় ভিত্তি মজবুত করার জন্য। ধারণা করা হচ্ছে, শেষ কারণটিই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। দল গঠন দলীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই হোক। একটি ঐতিহ্যবাহী শাসন প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিমূলে আঘাত করে নয়।
তা ছাড়া রাজনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বাদ দিলেও দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন নতুন আইনগত জটিলতার জন্ম দেবে। শুধু স্থানীয় সরকার আইনের একটি ধারা পরিবর্তন করে দলীয় মনোনয়ন এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচন সম্ভব নয়। এখানে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনসহ আরও বহু আইনের সংযোগ রয়েছে। ওই সব আইনেরও পরিবর্তন করতে হবে। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন উচিত বিদ্যমান আইনে অতি দ্রুত মেয়াদ উত্তীর্ণ নির্বাচনগুলো সম্পন্ন করা। নির্বাচন নিয়ে নতুন বিতর্ক অন্তত এ মুহূর্তে কাম্য হতে পারে না।
বর্তমান আইনের অধীনে যারা সক্রিয় রাজনীতিতে নেই, কিন্তু সমাজকর্মে আগ্রহী এমন সব ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়ী হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা বিদ্যমান। রয়েছে দলের ভেতরের একাধিক প্রার্থীরও নির্বাচনে অংশগ্রহণের অবারিত সুযোগ। তাতে দলের ভেতরে বহুবাচনিকতার প্রসার হতে পারে। কেউ পরাজিত হলে দল তার কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না, কিন্তু বিজয়ী প্রার্থী দলেরই থাকছে। দলভিত্তিক নির্বাচন হলে দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। তাতে একদিকে সাধারণ মানুষের নেতা বাছাইয়ের সুযোগ সংকুচিত হবে, অপরদিকে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ব্যক্তি দলে মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। দলে বিদ্রোহ-কোন্দল বাড়বে। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চাবিমুখ রাজনৈতিক দল থেকে সঠিক মনোনয়নের প্রত্যাশা করা অকল্পনীয়। বরং মনোনয়ন-বাণিজ্যের সম্ভাবনা এখানে অধিক। তা ছাড়া স্থানীয় নির্বাচন অদলীয় হলে নির্বাচনী মাঠ অনেক বেশি সমতল থাকবে। দলভিত্তিক নির্বাচনী ময়দান সাধারণ প্রার্থীর জন্য অনেক বেশি অসমতল ও বন্ধুর হয়ে পড়বে। জাতীয় নির্বাচনগুলো জাতীয় ভিত্তিক নির্বাচনী মেনিফেস্টো দিয়েই হোক। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় কর্মসূচিও জাতীয় প্রতীকে হওয়া অর্থহীন। এটি স্থানীয় নেতৃত্বের গুণাবলিতে স্থানীয় ইস্যুভিত্তিক হওয়াই ভালো।
ভারতে পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের বিধান কার্যকর রয়েছে। সেখানে স্থানীয় সরকারের রং, আদল, কাঠামো, কার্যক্রম ও অর্থায়ন পদ্ধতি আমাদের চেয়ে ভিন্ন। পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ‘সংসদীয় পদ্ধতি’তে চলে। সেখানে বিধানিক ও নির্বাহী কার্যক্রমে সীমারেখা নির্ধারিত আছে। কলকাতা সিটি করপোরেশনের ‘কাউন্সিল সভার’ সভাপতির পদমর্যাদা ডেপুটি মেয়রের। তার কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। প্রতিটি স্থানীয় পরিষদে সংসদীয় পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার গঠিত হয়। সংখ্যালঘিষ্ঠরা বিরোধী আসনে বসেন। আমাদের স্থানীয় সরকারকাঠমো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে গঠিত। আমরা মূলত চেয়ারম্যান বা মেয়রসর্বস্ব পরিষদ, পৌরসভা বা করপোরেশন গঠন করি। তাই দলভিত্তিক এবং দলীয় প্রতীক স্থানীয় নির্বাচন দুই বছরের অধিককালের মেয়াদ উত্তীর্ণ ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তের বিষয় হতে পারে না। এ বিষয়টি মেয়াদ উত্তীর্ণ নির্বাচনগুলো সমাপ্ত করে ধীরে-সুস্থে বিবেচনার দাবি রাখে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক কিন্তু সময়টা ভুল। এটি নির্বাচনকে আরও অনিশ্চিত করে দিতে পারে। বিতর্ক হিসেবে এটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক বিতর্ক। এটি চলতে থাকুক। এ নিয়ে একটি জাতীয় মতৈক্য সৃষ্টি হোক। এ মুহূর্তে এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে সংখ্যার শক্তিতে আইন পাস করতে যাওয়া হঠকারিতার শামিল হতে পারে।
তোফায়েল আহমেদ : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।
No comments