চারদিক-বর্ষা যখন বঙ্গে by মোশাহেদ মিয়া
শেষ হয়ে যাচ্ছে বর্ষাকাল। অথচ বলাই হলো না বর্ষার হাওরের কথা। বলা যাক এবার। বর্ষায় হাওরজুড়ে মেঘ করে আর অঝোরধারায় বৃষ্টি ঝরে। মেঘ আর বৃষ্টির খেলা চলতেই থাকে। হাওর হয়ে ওঠে জলে জলময়। স্নিগ্ধ জননী কিংবা রূপসী প্রেয়সী।
হাওরের বিভিন্ন রকম মেঘ আর বৃষ্টি কাজে গতি এনে দেয়, আবার কখনো করে মন্থর।
এ জন্য হাওরের মানুষজন বৃষ্টির বিভিন্ন রকম নাম দিয়েছে। ছেছুর মেঘ, ব্যাঙামেঘ, নাওদৌড়ান্যা মেঘ, কালু মেঘ, রাঙ্গা মেঘ।
এই সময়টাতে হাওরে নৌকার এক গলুইতে মেঘ পড়ে, অন্য গলুইতে মেঘ পড়ে না।
এক গ্রামে বৃষ্টির অঝোর বর্ষণে কিছুই দেখা যায় না, আবার অন্য গ্রামে ঠাঁ-ঠাঁ রোদ। অবিরাম বর্ষণে হাওরের বুকে ওঠে জলের ঘূর্ণন। হাওর হয়ে ওঠে যৌবনবতী।
হাওরের স্ফীত পেটে পানি আর পানি। সাদা পানি, ঘোলা পানি, নীল পানি, বৃষ্টির পানি।
বর্ষার পানিতে নদী-নালা, খাল-বিল ভরে ওঠে থইথই করে, একেকটি হাওরকে অতলান্ত সমুদ্রের মতো মনে হয়। আর হাওরের জলে একটু দূরে দূরে ভেসে থাকা একেকটা গ্রাম-সড়ক আর উঁচু ভিটেমাটি যেন একেকটা অজানা ভাসমান দ্বীপ।
সেই পানিতে নাম না-জানা কত না মাছের দল খেলা করে অবিরত। বৈছা মাছের দল পরে নতুন আঁচিলে লাল-নীল রং। দেখে মনে হয়, পরেছে নতুন শাড়ি। হাওরের মানুষ বুঝে যায়, এসেছে বর্ষা।
বিলের ধারে কদমশাখে অজস্র কদম ফুল ফুটে জানিয়ে দেয়, এসেছে বর্ষা।
বর্ষা মানে নতুন পানি। নতুন পানি মানে ঋতু পরিবর্তন। অভ্যাস পরিবর্তন, হাঁটার পরিবর্তে নৌকায় চড়া।
নতুন পানির আগমন মানে জাল ফেলে মাছ ধরা। জেলে নৌকাগুলো বিভিন্ন রকম জাল নিয়ে চষে বেড়ায় হাওরের জল। রুপালি মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসে জেলেদের জালে।
আমন ধানের সবুজ কচি চারাগুলো নরম শরীর বিছিয়ে দেয় হাওরের জলে। আদরে আদরে, পানিতে ভাসতে ভাসতে, খেলতে খেলতে, তির তির করে বাড়তে থাকে।
হাওরের জলের শ্বাসে জন্মানো লিলুয়া বাতাসে ক্লান্ত মাঝির কণ্ঠে ঝরে উদাস বাউলের সুর। সেই সুর ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে।
গ্রীষ্মের শেষে বর্ষার অবসরের অপেক্ষায় থাকা একেকজন বাউলের সঙ্গে তখন জুটে যায় হাজারো বাউল। নতুন পানি, নতুন সুর, নতুন গান। জেগে ওঠে হাওরের ঘুমন্ত গ্রামগুলো।
রাতের পর রাত গ্রামে-গ্রামে চলে বাউল গান, পালা কীর্তন, আর বর্ষার বিভিন্ন রকম উৎসব। বর্ষায় যে জেলে দিনে মাছ ধরে, যে মাঝি নৌকা টানে, যে দোকানি দিনের বেলায় দোকান চালায়, তারাই রাতের বেলায় একেকজন শাহ আব্দুল করিম, রাধা রমন, উকিল মুন্সি, হাসন রাজা কিংবা দুরবিন শাহ হয়ে যায়।
ওই সব বাউলের সুরের ইন্দ্রজালে হাওরের প্রকৃতিও উন্মাদ নৃত্যের তালে নেচে ওঠে। তখন মেঘ-বৃষ্টি আর লিলুয়া বাতাসই নয়, বাউলদের সুরের ইন্দ্রজাল বিদ্রোহ করে ছড়িয়ে পড়তে চায় ১০ দিকে। বাউলদের সুর হয়ে যায় বিদ্রোহী আফাল (প্রবল বাতাস); বিদ্যুতের চমক আর মেঘের গর্জন হয়ে যায় বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি।
একসময় থেমে যায় বাউলদের গান। পরিশ্রান্ত ও ক্লান্ত বাউলেরা ঘুমিয়ে যায়, প্রকৃতিও নিশ্চুপ হয়। তখন বর্ষার রুপালি জলে জোছনা ঝরে। একেকটা রাত তখন আসে অন্য রকম উন্মাদনা নিয়ে। নানা-নানি, দাদা-দাদি বিশেষ করে প্রবীণেরা উঠোনে উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে ঘুমাতে যায়। নাতি-পুতিরা ঘুমাতে দেয় না। চলে দৈত্য-দানবের কিসসার আসর।
যুবক-তরুণেরা রুপালি ঢেউয়ে নৌকা ভাসাতে ভাসাতে বাঁশের বাঁশিতে জীবন্ত করে তুলে আনে কোনো কল্পরাজ্যের দুঃখিনী পরির জীবনকাহিনির সুর।
এই বাংলার হাওরে-বাওড়ে, হাজার হাজার বছর ধরে এভাবেই বর্ষা আসে আর যায়। ফোটে কদম আর ঝরে বৃষ্টি। হাওরের বর্ষা আর মেঘের স্তুতি লিখতে নতুন করে আর কোনো কালিদাস জন্মাবেন না। তবু ঋতুচক্রে বর্ষা এলেই হাওরে ঝরবে বৃষ্টি আর বিরহী গান, গ্রাম থেকে গ্রামে, হাওর থেকে হাওরে। দক্ষিণে, উত্তরে, পুর্বে আর পশ্চিমে।
এ জন্য হাওরের মানুষজন বৃষ্টির বিভিন্ন রকম নাম দিয়েছে। ছেছুর মেঘ, ব্যাঙামেঘ, নাওদৌড়ান্যা মেঘ, কালু মেঘ, রাঙ্গা মেঘ।
এই সময়টাতে হাওরে নৌকার এক গলুইতে মেঘ পড়ে, অন্য গলুইতে মেঘ পড়ে না।
এক গ্রামে বৃষ্টির অঝোর বর্ষণে কিছুই দেখা যায় না, আবার অন্য গ্রামে ঠাঁ-ঠাঁ রোদ। অবিরাম বর্ষণে হাওরের বুকে ওঠে জলের ঘূর্ণন। হাওর হয়ে ওঠে যৌবনবতী।
হাওরের স্ফীত পেটে পানি আর পানি। সাদা পানি, ঘোলা পানি, নীল পানি, বৃষ্টির পানি।
বর্ষার পানিতে নদী-নালা, খাল-বিল ভরে ওঠে থইথই করে, একেকটি হাওরকে অতলান্ত সমুদ্রের মতো মনে হয়। আর হাওরের জলে একটু দূরে দূরে ভেসে থাকা একেকটা গ্রাম-সড়ক আর উঁচু ভিটেমাটি যেন একেকটা অজানা ভাসমান দ্বীপ।
সেই পানিতে নাম না-জানা কত না মাছের দল খেলা করে অবিরত। বৈছা মাছের দল পরে নতুন আঁচিলে লাল-নীল রং। দেখে মনে হয়, পরেছে নতুন শাড়ি। হাওরের মানুষ বুঝে যায়, এসেছে বর্ষা।
বিলের ধারে কদমশাখে অজস্র কদম ফুল ফুটে জানিয়ে দেয়, এসেছে বর্ষা।
বর্ষা মানে নতুন পানি। নতুন পানি মানে ঋতু পরিবর্তন। অভ্যাস পরিবর্তন, হাঁটার পরিবর্তে নৌকায় চড়া।
নতুন পানির আগমন মানে জাল ফেলে মাছ ধরা। জেলে নৌকাগুলো বিভিন্ন রকম জাল নিয়ে চষে বেড়ায় হাওরের জল। রুপালি মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসে জেলেদের জালে।
আমন ধানের সবুজ কচি চারাগুলো নরম শরীর বিছিয়ে দেয় হাওরের জলে। আদরে আদরে, পানিতে ভাসতে ভাসতে, খেলতে খেলতে, তির তির করে বাড়তে থাকে।
হাওরের জলের শ্বাসে জন্মানো লিলুয়া বাতাসে ক্লান্ত মাঝির কণ্ঠে ঝরে উদাস বাউলের সুর। সেই সুর ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে।
গ্রীষ্মের শেষে বর্ষার অবসরের অপেক্ষায় থাকা একেকজন বাউলের সঙ্গে তখন জুটে যায় হাজারো বাউল। নতুন পানি, নতুন সুর, নতুন গান। জেগে ওঠে হাওরের ঘুমন্ত গ্রামগুলো।
রাতের পর রাত গ্রামে-গ্রামে চলে বাউল গান, পালা কীর্তন, আর বর্ষার বিভিন্ন রকম উৎসব। বর্ষায় যে জেলে দিনে মাছ ধরে, যে মাঝি নৌকা টানে, যে দোকানি দিনের বেলায় দোকান চালায়, তারাই রাতের বেলায় একেকজন শাহ আব্দুল করিম, রাধা রমন, উকিল মুন্সি, হাসন রাজা কিংবা দুরবিন শাহ হয়ে যায়।
ওই সব বাউলের সুরের ইন্দ্রজালে হাওরের প্রকৃতিও উন্মাদ নৃত্যের তালে নেচে ওঠে। তখন মেঘ-বৃষ্টি আর লিলুয়া বাতাসই নয়, বাউলদের সুরের ইন্দ্রজাল বিদ্রোহ করে ছড়িয়ে পড়তে চায় ১০ দিকে। বাউলদের সুর হয়ে যায় বিদ্রোহী আফাল (প্রবল বাতাস); বিদ্যুতের চমক আর মেঘের গর্জন হয়ে যায় বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি।
একসময় থেমে যায় বাউলদের গান। পরিশ্রান্ত ও ক্লান্ত বাউলেরা ঘুমিয়ে যায়, প্রকৃতিও নিশ্চুপ হয়। তখন বর্ষার রুপালি জলে জোছনা ঝরে। একেকটা রাত তখন আসে অন্য রকম উন্মাদনা নিয়ে। নানা-নানি, দাদা-দাদি বিশেষ করে প্রবীণেরা উঠোনে উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে ঘুমাতে যায়। নাতি-পুতিরা ঘুমাতে দেয় না। চলে দৈত্য-দানবের কিসসার আসর।
যুবক-তরুণেরা রুপালি ঢেউয়ে নৌকা ভাসাতে ভাসাতে বাঁশের বাঁশিতে জীবন্ত করে তুলে আনে কোনো কল্পরাজ্যের দুঃখিনী পরির জীবনকাহিনির সুর।
এই বাংলার হাওরে-বাওড়ে, হাজার হাজার বছর ধরে এভাবেই বর্ষা আসে আর যায়। ফোটে কদম আর ঝরে বৃষ্টি। হাওরের বর্ষা আর মেঘের স্তুতি লিখতে নতুন করে আর কোনো কালিদাস জন্মাবেন না। তবু ঋতুচক্রে বর্ষা এলেই হাওরে ঝরবে বৃষ্টি আর বিরহী গান, গ্রাম থেকে গ্রামে, হাওর থেকে হাওরে। দক্ষিণে, উত্তরে, পুর্বে আর পশ্চিমে।
No comments