পরিবেশ-সাত নদী হত্যা by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
নদীশাসনের নামে রাজশাহীর সাতটি প্রবহমান নদ-নদীকে হত্যা করা হয়েছে। নদ-নদীগুলোর নামও ভুলতে বসেছে মানুষ। দখল-বেদখলে নদ-নদীর চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে। তবে কিছু জায়গায় নদ-নদীর ধারা বেশ স্পষ্ট। সরকারি নকশাতেও রয়েছে এর প্রমাণ।
হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকীর গবেষণাগ্রন্থ ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহতে নদীগুলোর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। নদী অববাহিকার মানুষের জীবনযাত্রা এবং গড়ে ওঠা সভ্যতার পরিচয়ও এতে তুলে ধরা হয়েছে। নদ-নদীগুলো হচ্ছে নারদ, সন্ধ্যা, স্বরমঙ্গলা, দয়া, বারাহী, হোজা ও মুসা খান। সব কটি নদ-নদীর উৎসমুখ রাজশাহীতে।
১৮৮৫ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পদ্মা নদীর তীর দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখন নগরের বুলনপুর এলাকা থেকে তালাইমারী পর্যন্ত ১২টি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। নদীগুলোর উৎসমুখেও এই গেট বসানো হয়। এর পর থেকে আস্তে আস্তে উৎসমুখ মরে যেতে থাকে। বর্তমানে নদীর বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় পদ্মার তীরে ব্লক বসিয়ে পাকা করে দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরেই ঢাকা পড়ে গেছে নদীগুলোর উৎসমুখ।
নগরের তালাইমারী এলাকায় ছিল স্বরমঙ্গলা নদীর উৎসমুখ। নদীটি কাজলা-জামালপুর ও নামোভদ্রা দিয়ে প্রবাহিত হতো। জামালপুরে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ক্যাম্পাসের উত্তর-পূর্ব অংশ এখনো নাওডোবা নামে পরিচিত। কথিত আছে, স্বরমঙ্গলা নদীপথে ধনপতি সওদাগর নামের একজন ব্যবসায়ী তাঁর ছেলের বরযাত্রী নিয়ে যাওয়ার পথে এ এলাকায় নৌকা ডুবে যায়। এতে ধনপতির সলিলসমাধি হয়। নদীটি পবা এলাকার ললিতাহার, ভালুকপুকুর, রামচন্দ্রপুর হয়ে ফলিয়ার বিলে পড়ে। এখন একে আর নদী বলা যায় না।
দয়া নদীটি স্বরমঙ্গলার একটি শাখা। রুয়েট এলাকায় ঢোকার ২০-২৫ গজ আগেই দয়া জন্ম নেয়। সেখান থেকে নদীটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দেয়াল বরাবর উত্তর দিকে বয়ে গেছে। সমতল থেকে প্রায় চার ফুট গভীর ও প্রায় ২৫ গজ প্রশস্ত এই জলাভূমিতে বছরের ছয় মাস পানি থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি খনন করে এখানে একটি পুকুরের আকৃতি তৈরি করেছে। এটি মেহেরচণ্ডী, খড়খড়ি বাজার, কুখুণ্ডী, বামন শিকড়, মল্লিকপুর, তেবাড়িয়া, সারাংপুর হয়ে ঘোলহারিয়া গ্রামে ফের স্বরমঙ্গলার সঙ্গে মিলে ফলিয়ার বিলে পড়েছে।
ফলিয়ার বিল থেকে স্বরমঙ্গলা ও দয়া নদীর সম্মিলিত প্রবাহটি হোজা নাম ধারণ করে রাজশাহীর দুর্গাপুর থানার পলাশবাড়ী গ্রামের মধ্য দিয়ে তিন কিলোমিটার বয়ে যায়। এরপর বর্ধনপুর, চৌপুকুরিয়া, সিঙ্গা, দুর্গাপুর, পনানগর, দমদমা, চকপলাশী, গাংধোপাপাড়া, গণ্ডগোহালি, গোবিন্দনগর হয়ে পুঠিয়ার কানাইপাড়ার মধ্য দিয়ে মুসা খান নদে পড়েছে। এই নদের দমদমা থেকে কানাইপাড়া পর্যন্ত নয় কিলোমিটার এলাকার প্রবাহপথটি বেদখল হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের কেউ জানে না, এই এলাকায় নদ ছিল।
নারদ ঐতিহাসিক নদ। এর মোট তিনটি প্রবাহ। এর প্রথম প্রবাহ রাজশাহীতে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি নাটোরে। রাজশাহী শহর থেকে নয় কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শাহপুর গ্রামে পদ্মা নদী থেকে এর উৎপত্তি। এটি শাহাপুর থেকে কাটাখালী, কাপাশিয়া, জামিরা, হলিদাগাছি, মৌগাাছি, পুঠিয়ার তাতারপুর, বিড়ালদহ, ভাড়রা, কান্দ্রা পীরগাছা হয়ে নাটোরের ভেতর দিয়ে নন্দকুজা নদীতে পড়েছে। নারদের তৃতীয় প্রবাহটি নাটোরের বাগাতিপাড়ার আটঘরিয়া গ্রামের নন্দকুজা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে ১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে নাটোরের ধরাইল গ্রামে নারদের দ্বিতীয় প্রবাহে মিলিত হয়েছে। এই নদীর রাজশাহীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার প্রবাহপথে পাঁচটি নীলকুঠি ছিল। বর্তমানে এর উৎসমুখসহ প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশ সম্পূর্ণ বেদখল হয়ে এতে ফসলি মাঠ ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। বাকি অংশ স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে।
সন্ধ্যা নদী নারদের একটি শাখা। এটির উৎসমুখ পুঠিয়া উপজেলার রঘুরামপুর বাগিচাপাড়ায়। পুঠিয়ার শিবপুর বাজারের পাশ দিয়ে বাঁশপুকুরিয়া, নন্দনপুর হয়ে কান্তার বিলে পড়েছে সন্ধ্যা। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। এই নদীর ধারে নন্দনপুর গ্রামেই সেই ধনপতি সওদাগরের বসত রয়েছে।
মুসা খানের উৎসমুখ বড়াল নদ। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার হাঁপানিয়া গ্রামে এর উৎপত্তি। এটি পুঠিয়ার ঝলমলিয়া, কানাইপাড়া, নাটোরের আগদিঘা, ছাতনি হয়ে ত্রিমোহনীতে এসে গদাই নাম ধারণ করে আত্রাই নদের সঙ্গে মিশে চলনবিলে পড়েছে। নদী গবেষকদের ধারণা, মুসা খান প্রাকৃতিক কোনো প্রবাহ নয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে ঈশা খাঁর ছেলে মুসা খান বড়াল থেকে নারদ নদের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এটি খনন করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড এর উৎসমুখ হাঁপানিয়া ও ভাটিতে বাকসরে দুটি স্লুইসগেট স্থাপন করে। এতে প্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে নদীটি ভরাট হয়ে যায়।
বারাহী নদীর উৎসমুখ রাজশাহী নগরের ফুদকিপাড়া মহল্লায় পদ্মা থেকে। নগরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিনটি নদীর এটি অন্যতম। বারাহী সম্পর্কে প্রথম তথ্যটি পাওয়া যায় উইলিয়াম উইলসন হান্টার রচিত স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব দি ডিস্ট্রিক্ট অব রাজশাহী গ্রন্থের ২৫ পৃষ্ঠায়। নদীটি পবা থানার মহানন্দখালী গ্রামে বারনই নদে গিয়ে পড়েছে। উৎস থেকে প্রথম পাঁচ কিলোমিটারে নদের কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০ কিলোমিটার এই নদটির বাকি অংশটুকুও মৃত। এর মোহনায় একটি স্লুইসগেট রয়েছে।
মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, এই সাতটি নদ-নদীর হাজার হাজার হেক্টর সরকারি খাসজমি এখনো দখলমুক্ত রয়েছে, যা খনন করে বর্ষার পানি ধরে কৃষিকাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
রাজশাহী
১৮৮৫ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পদ্মা নদীর তীর দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখন নগরের বুলনপুর এলাকা থেকে তালাইমারী পর্যন্ত ১২টি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। নদীগুলোর উৎসমুখেও এই গেট বসানো হয়। এর পর থেকে আস্তে আস্তে উৎসমুখ মরে যেতে থাকে। বর্তমানে নদীর বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় পদ্মার তীরে ব্লক বসিয়ে পাকা করে দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরেই ঢাকা পড়ে গেছে নদীগুলোর উৎসমুখ।
নগরের তালাইমারী এলাকায় ছিল স্বরমঙ্গলা নদীর উৎসমুখ। নদীটি কাজলা-জামালপুর ও নামোভদ্রা দিয়ে প্রবাহিত হতো। জামালপুরে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ক্যাম্পাসের উত্তর-পূর্ব অংশ এখনো নাওডোবা নামে পরিচিত। কথিত আছে, স্বরমঙ্গলা নদীপথে ধনপতি সওদাগর নামের একজন ব্যবসায়ী তাঁর ছেলের বরযাত্রী নিয়ে যাওয়ার পথে এ এলাকায় নৌকা ডুবে যায়। এতে ধনপতির সলিলসমাধি হয়। নদীটি পবা এলাকার ললিতাহার, ভালুকপুকুর, রামচন্দ্রপুর হয়ে ফলিয়ার বিলে পড়ে। এখন একে আর নদী বলা যায় না।
দয়া নদীটি স্বরমঙ্গলার একটি শাখা। রুয়েট এলাকায় ঢোকার ২০-২৫ গজ আগেই দয়া জন্ম নেয়। সেখান থেকে নদীটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দেয়াল বরাবর উত্তর দিকে বয়ে গেছে। সমতল থেকে প্রায় চার ফুট গভীর ও প্রায় ২৫ গজ প্রশস্ত এই জলাভূমিতে বছরের ছয় মাস পানি থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি খনন করে এখানে একটি পুকুরের আকৃতি তৈরি করেছে। এটি মেহেরচণ্ডী, খড়খড়ি বাজার, কুখুণ্ডী, বামন শিকড়, মল্লিকপুর, তেবাড়িয়া, সারাংপুর হয়ে ঘোলহারিয়া গ্রামে ফের স্বরমঙ্গলার সঙ্গে মিলে ফলিয়ার বিলে পড়েছে।
ফলিয়ার বিল থেকে স্বরমঙ্গলা ও দয়া নদীর সম্মিলিত প্রবাহটি হোজা নাম ধারণ করে রাজশাহীর দুর্গাপুর থানার পলাশবাড়ী গ্রামের মধ্য দিয়ে তিন কিলোমিটার বয়ে যায়। এরপর বর্ধনপুর, চৌপুকুরিয়া, সিঙ্গা, দুর্গাপুর, পনানগর, দমদমা, চকপলাশী, গাংধোপাপাড়া, গণ্ডগোহালি, গোবিন্দনগর হয়ে পুঠিয়ার কানাইপাড়ার মধ্য দিয়ে মুসা খান নদে পড়েছে। এই নদের দমদমা থেকে কানাইপাড়া পর্যন্ত নয় কিলোমিটার এলাকার প্রবাহপথটি বেদখল হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের কেউ জানে না, এই এলাকায় নদ ছিল।
নারদ ঐতিহাসিক নদ। এর মোট তিনটি প্রবাহ। এর প্রথম প্রবাহ রাজশাহীতে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি নাটোরে। রাজশাহী শহর থেকে নয় কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শাহপুর গ্রামে পদ্মা নদী থেকে এর উৎপত্তি। এটি শাহাপুর থেকে কাটাখালী, কাপাশিয়া, জামিরা, হলিদাগাছি, মৌগাাছি, পুঠিয়ার তাতারপুর, বিড়ালদহ, ভাড়রা, কান্দ্রা পীরগাছা হয়ে নাটোরের ভেতর দিয়ে নন্দকুজা নদীতে পড়েছে। নারদের তৃতীয় প্রবাহটি নাটোরের বাগাতিপাড়ার আটঘরিয়া গ্রামের নন্দকুজা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে ১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে নাটোরের ধরাইল গ্রামে নারদের দ্বিতীয় প্রবাহে মিলিত হয়েছে। এই নদীর রাজশাহীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার প্রবাহপথে পাঁচটি নীলকুঠি ছিল। বর্তমানে এর উৎসমুখসহ প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশ সম্পূর্ণ বেদখল হয়ে এতে ফসলি মাঠ ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। বাকি অংশ স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে।
সন্ধ্যা নদী নারদের একটি শাখা। এটির উৎসমুখ পুঠিয়া উপজেলার রঘুরামপুর বাগিচাপাড়ায়। পুঠিয়ার শিবপুর বাজারের পাশ দিয়ে বাঁশপুকুরিয়া, নন্দনপুর হয়ে কান্তার বিলে পড়েছে সন্ধ্যা। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। এই নদীর ধারে নন্দনপুর গ্রামেই সেই ধনপতি সওদাগরের বসত রয়েছে।
মুসা খানের উৎসমুখ বড়াল নদ। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার হাঁপানিয়া গ্রামে এর উৎপত্তি। এটি পুঠিয়ার ঝলমলিয়া, কানাইপাড়া, নাটোরের আগদিঘা, ছাতনি হয়ে ত্রিমোহনীতে এসে গদাই নাম ধারণ করে আত্রাই নদের সঙ্গে মিশে চলনবিলে পড়েছে। নদী গবেষকদের ধারণা, মুসা খান প্রাকৃতিক কোনো প্রবাহ নয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে ঈশা খাঁর ছেলে মুসা খান বড়াল থেকে নারদ নদের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এটি খনন করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড এর উৎসমুখ হাঁপানিয়া ও ভাটিতে বাকসরে দুটি স্লুইসগেট স্থাপন করে। এতে প্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে নদীটি ভরাট হয়ে যায়।
বারাহী নদীর উৎসমুখ রাজশাহী নগরের ফুদকিপাড়া মহল্লায় পদ্মা থেকে। নগরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিনটি নদীর এটি অন্যতম। বারাহী সম্পর্কে প্রথম তথ্যটি পাওয়া যায় উইলিয়াম উইলসন হান্টার রচিত স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব দি ডিস্ট্রিক্ট অব রাজশাহী গ্রন্থের ২৫ পৃষ্ঠায়। নদীটি পবা থানার মহানন্দখালী গ্রামে বারনই নদে গিয়ে পড়েছে। উৎস থেকে প্রথম পাঁচ কিলোমিটারে নদের কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০ কিলোমিটার এই নদটির বাকি অংশটুকুও মৃত। এর মোহনায় একটি স্লুইসগেট রয়েছে।
মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, এই সাতটি নদ-নদীর হাজার হাজার হেক্টর সরকারি খাসজমি এখনো দখলমুক্ত রয়েছে, যা খনন করে বর্ষার পানি ধরে কৃষিকাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
রাজশাহী
No comments