প্রশাসনে আউটসোর্সিং বিধান

উদ্যোগটি সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে দেশের প্রশাসনে কোনো নতুন বিধান করতে হলে তা সাময়িক সুবিধা বা অসুবিধার বিবেচনায় নয়, হতে হয় দীর্ঘস্থায়ী; এর ফলাফল ও পরিণামের দিকে দূরদৃষ্টি রাখা আবশ্যক। দেশে বেসরকারি পর্যায় থেকে সচিবসহ যেকোনো পর্যায়ে লোক নিয়োগের বিধান রেখে যে 'সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১২'


খসড়া করা হয়েছে, তা প্রশাসনের জটিলতা ও দলীয়করণের দীর্ঘকালের সংস্কৃতিকে আরো বিস্তৃত করবে বলে আশঙ্কা করার অনেক কারণ রয়েছে। রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে সিভিল সার্ভিস চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন-বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম জানিয়েছেন, এখন শুধু আইনের খসড়া উপস্থাপন করা হয়েছে। এটির ওপর সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত গ্রহণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেলে এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রতি কারো দাবি নেই। সরকার এটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই করতে যাচ্ছে। আইনটি দ্রুত কার্যকর করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। সরকারের এ নতুন বিধান অনুসারে, শুধু ক্যাডার কর্মকর্তা নন, আইন হবে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সব কর্মচারীর জন্য। এ আইনেই দেশের যেকোনো বিশেষজ্ঞকে সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন স্তরে নিয়োগ করা যাবে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য দেশে আইন প্রণয়নের এবং নতুন করে নীতিমালা সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা যদি প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও জনকল্যাণের জন্য পরিচ্ছন্ন না হয়ে আরো বেশি জট তৈরি করে, তাহলে এ আইন তৈরি সার্থক হবে না, বরং ভবিষ্যতে সরকারের জন্য একটি কলঙ্কজনক উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। সরকার বিশেষ করে সচিব পর্যায়ে ক্যাডার-বহির্ভূত কাউকে নিয়োগ দেওয়ার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাচ্ছে, তা বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা কয়েক দশক ধরে দেখে আসছি, সরকার যেসব প্রতিষ্ঠানে ক্যাডার-বহির্ভূত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে আসছে, তার প্রায় প্রতিটি নিয়োগ নিয়েই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সর্বদাই সেসব নিয়োগে দলীয় ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে সচিব পর্যায়ে যে ক্যাডার-বহির্ভূত ব্যক্তিদের নিয়োগের সম্ভাবনা থাকবে, তা একদিকে যেমন জ্যেষ্ঠতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করতে পারে, অন্যদিকে একজন কর্মকর্তাকে রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য করতে পারে। পেশাগত দক্ষতার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে আমলে নেওয়া প্রয়োজন। প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা দীর্ঘকাল সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে সাচিবিক কাজের জন্য দক্ষ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ক্যাডার সার্ভিসের বাইরের একজন বিশেষজ্ঞ আর যা-ই হোক, সরকারের প্রশাসনের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় পরিচালনার জন্য দক্ষ নাও হতে পারেন। সুতরাং বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। অবশ্য ক্যাডার সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রয়োজনে প্রশাসনে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কারণ ও সুস্পষ্ট ক্রাইটেরিয়া মেনে চলতে হবে। সে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া সৃষ্টি করাও প্রায় অসম্ভব। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই প্রশাসনের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির মতো বিষয়গুলোকে স্বচ্ছ করে তোলা সম্ভব হয়নি। উত্তরোত্তর পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠেছে। কখনো কখনো এসব কারণে প্রশাসনে অচলাবস্থাও পরিলক্ষিত হয়েছে। যে দেশে সচিবালয়ে পদোন্নতিবঞ্চিতদের অফিসকক্ষে কাঁদতে হয়, যে দেশে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সচিবালয়ে সরকারবিরোধী লিফলেট প্রচার করতে দেখা যায়, সে দেশে আউটসোর্সিং থেকে এই দায়িত্বশীল পদে লোক নিয়োগ বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। সুতরাং নতুন সিদ্ধান্ত তড়িঘড়ি করে নেওয়া ঠিক হবে না। আরো ধীরেসুস্থে, ভেবেচিন্তে এগোনোর পরামর্শ থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.