মত দ্বিমত-দলীয় ভিত্তিতেই হতে পারে by এম এম আকাশ
স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন দলীয়ভাবে করার বিষয়ে সরকারের চিন্তাভাবনার কথা সম্প্রতি একাধিকবার বলেছেন স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী। সরকারের এ ভাবনার বিষয়ে দুটি মতামত ছাপা হলো দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচন করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা অযৌক্তিক বলে মনে করি না।
প্রত্যেক ব্যক্তিরই রাজনীতি করার অধিকার আছে। আমরা যা-ই বলি না না কেন, পেশাজীবী সংগঠন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিচয়ই প্রধান হয়ে উঠেছে। সে ক্ষেত্রে এসব নির্বাচন অরাজনৈতিকভাবে করে কী লাভ?
ওপরে অরাজনৈতিক প্রলেপ নিলেও আধেয় রাজনৈতিকই থেকে যাচ্ছে। বিএমএ আইনজীবী সমিতি, শিক্ষক সমিতির মতো সংগঠনগুলোর নির্বাচন অরাজনৈতিকভাবে হতে পারে; যেহেতু সেসব সংগঠন উন্নয়ননীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। উন্নয়ননীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সব সংস্থার নির্বাচন রাজনৈতিক পরিচয়েই হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আমাদের দেখতে হবে, কী উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো প্রতিষ্ঠিত? ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নই স্থানীয় সরকার সংস্থার প্রধান কাজ। এ ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে উপজেলা এবং উপজেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত একটি ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় নীতি-আদর্শ ও পরিকল্পনা ঠিক করে কেন্দ্র। অতএব তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূলের সংযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উন্নয়ননীতি কৌশল ও পরিকল্পনা নির্ধারণে উভয়ের মধ্যে সংগতি না থাকলে কেন্দ্র ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
স্থানীয় সমস্যার আলোকে কী উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয় এবং এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকৌশল কী—দুটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েই ভোটাররা ভোট দেবেন। ডানপন্থী, বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী দলের কর্মকৌশল ও উন্নয়ন পরিকল্পনা নিশ্চয়ই এক হবে না। তেমনি স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাবও অগ্রাহ্য করা যাবে না। স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন থাকবে; কিন্তু বরাদ্দ তারা ঠিক করবে না। স্থানীয় জনগণের চাহিদা ও মতামতের ভিত্তিতে বরাদ্দ হবে। পশ্চিমবঙ্গে আমরা যেমনটি দেখে এসেছি। সেখানে শক্তিশালী পঞ্চায়েতব্যবস্থা চালু আছে। সিপিএম, তৃণমূল বা কংগ্রেস—যেই দল থেকেই স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধি নির্বাচিত হোন না কেন তাঁরা জনগণের সঙ্গে বৈঠক করে উন্নয়ন কর্মসূচি ঠিক করেন, সেই অনুযায়ী রাজ্য সরকারের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়। স্থানীয় বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দক্ষতা ও যোগ্যতার বিষয়টিও আমলে আনতে হবে। আগের বছরের বরাদ্দ যদি ঠিকমতো ব্যয় হয়ে থাকে পরের বছর বরাদ্দ বাড়বে, না হয়ে থাকলে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি করতে হবে। তবে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনটি যাতে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়, জনগণ যাতে পছন্দসই প্রার্থীকে বাছাই করতে পারে, সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সব প্রার্থীকে নির্বাচনী বিধিমালা মানতে বাধ্য করতে হবে।
স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন পেশিশক্তি বা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবমুক্ত রাখতে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রচারসভাগুলো একমঞ্চে আয়োজন করতে পারে। যেখান থেকে বিভিন্ন দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নিজ নিজ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করবেন। কী করেছেন, কী করতে চাইছেন তাও জানাবেন। জনগণ সব প্রার্থীর কর্মপরিকল্পনা মিলিয়ে দেখবেন, যাঁর জাতীয় এবং স্থানীয় পরিকল্পনা তাঁদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর মনে হবে তাঁকে বেছে নেবেন।
স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন ও অংশীদারি নিশ্চিত করতে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে স্থানীয় সব জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। সেখানে অবশ্যই দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পাবে না। বাজেট পেশের আগে একটি সভা হবে, যাতে গ্রামবাসীর চাহিদা ও সমস্যা জানতে চাওয়া হবে। আবার বছর শেষে গৃহীত পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সে বিষয়েও আরেকটি সভা ডাকা হবে। তবে বর্তমানে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হোক অথবা না হোক, কিছু আশঙ্কার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু সেটির উৎস অনেক গভীরে প্রোথিত। অপ-অর্থনীতি দূর না করে সেই অপরাজনীতি দূর করা যাবে না। তবে অন্তর্বর্তী সময়ের এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বা কমিয়ে আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরই। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করতে হবে। আর্থিক বা লোকবল কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের মুখাপেক্ষী হলে চলবে না। দলীয় ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন যদি ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ করা যায় স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করা যাবে না কেন?
আমাদের নির্বচনে এখন কেউ যদি কোনোভাবে একটি ভোটও বেশি পান তাহলে তিনিই জয়ী হন। একজন এলাকার ৪৯% ভোট পেয়েও প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নাও পেতে পারেন! যদি স্ক্যান্ডেনেভীয় দেশগুলোর মতো আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা হয় তাহলে ‘Winners take all’-এর ত্রুটি থেকে আমাদের নির্বাচিত স্থানীয় সংস্থাগুলো মুক্ত হবে। ফলে স্থানীয় উন্নয়নে জনগণের সব প্রতিনিধিরই আনুপাতিক হারে একটি Voice সৃষ্টি হবে। তখন গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলভিত্তিক হলেও সংকীর্ণ দলীয় চরিত্রের হবে না।
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ওপরে অরাজনৈতিক প্রলেপ নিলেও আধেয় রাজনৈতিকই থেকে যাচ্ছে। বিএমএ আইনজীবী সমিতি, শিক্ষক সমিতির মতো সংগঠনগুলোর নির্বাচন অরাজনৈতিকভাবে হতে পারে; যেহেতু সেসব সংগঠন উন্নয়ননীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। উন্নয়ননীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সব সংস্থার নির্বাচন রাজনৈতিক পরিচয়েই হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আমাদের দেখতে হবে, কী উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো প্রতিষ্ঠিত? ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নই স্থানীয় সরকার সংস্থার প্রধান কাজ। এ ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে উপজেলা এবং উপজেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত একটি ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় নীতি-আদর্শ ও পরিকল্পনা ঠিক করে কেন্দ্র। অতএব তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূলের সংযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উন্নয়ননীতি কৌশল ও পরিকল্পনা নির্ধারণে উভয়ের মধ্যে সংগতি না থাকলে কেন্দ্র ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
স্থানীয় সমস্যার আলোকে কী উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয় এবং এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকৌশল কী—দুটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েই ভোটাররা ভোট দেবেন। ডানপন্থী, বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী দলের কর্মকৌশল ও উন্নয়ন পরিকল্পনা নিশ্চয়ই এক হবে না। তেমনি স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাবও অগ্রাহ্য করা যাবে না। স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন থাকবে; কিন্তু বরাদ্দ তারা ঠিক করবে না। স্থানীয় জনগণের চাহিদা ও মতামতের ভিত্তিতে বরাদ্দ হবে। পশ্চিমবঙ্গে আমরা যেমনটি দেখে এসেছি। সেখানে শক্তিশালী পঞ্চায়েতব্যবস্থা চালু আছে। সিপিএম, তৃণমূল বা কংগ্রেস—যেই দল থেকেই স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধি নির্বাচিত হোন না কেন তাঁরা জনগণের সঙ্গে বৈঠক করে উন্নয়ন কর্মসূচি ঠিক করেন, সেই অনুযায়ী রাজ্য সরকারের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়। স্থানীয় বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দক্ষতা ও যোগ্যতার বিষয়টিও আমলে আনতে হবে। আগের বছরের বরাদ্দ যদি ঠিকমতো ব্যয় হয়ে থাকে পরের বছর বরাদ্দ বাড়বে, না হয়ে থাকলে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি করতে হবে। তবে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনটি যাতে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়, জনগণ যাতে পছন্দসই প্রার্থীকে বাছাই করতে পারে, সে জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সব প্রার্থীকে নির্বাচনী বিধিমালা মানতে বাধ্য করতে হবে।
স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন পেশিশক্তি বা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবমুক্ত রাখতে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রচারসভাগুলো একমঞ্চে আয়োজন করতে পারে। যেখান থেকে বিভিন্ন দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নিজ নিজ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করবেন। কী করেছেন, কী করতে চাইছেন তাও জানাবেন। জনগণ সব প্রার্থীর কর্মপরিকল্পনা মিলিয়ে দেখবেন, যাঁর জাতীয় এবং স্থানীয় পরিকল্পনা তাঁদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর মনে হবে তাঁকে বেছে নেবেন।
স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন ও অংশীদারি নিশ্চিত করতে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে স্থানীয় সব জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। সেখানে অবশ্যই দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পাবে না। বাজেট পেশের আগে একটি সভা হবে, যাতে গ্রামবাসীর চাহিদা ও সমস্যা জানতে চাওয়া হবে। আবার বছর শেষে গৃহীত পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সে বিষয়েও আরেকটি সভা ডাকা হবে। তবে বর্তমানে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হোক অথবা না হোক, কিছু আশঙ্কার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু সেটির উৎস অনেক গভীরে প্রোথিত। অপ-অর্থনীতি দূর না করে সেই অপরাজনীতি দূর করা যাবে না। তবে অন্তর্বর্তী সময়ের এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বা কমিয়ে আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরই। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করতে হবে। আর্থিক বা লোকবল কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের মুখাপেক্ষী হলে চলবে না। দলীয় ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন যদি ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ করা যায় স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করা যাবে না কেন?
আমাদের নির্বচনে এখন কেউ যদি কোনোভাবে একটি ভোটও বেশি পান তাহলে তিনিই জয়ী হন। একজন এলাকার ৪৯% ভোট পেয়েও প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নাও পেতে পারেন! যদি স্ক্যান্ডেনেভীয় দেশগুলোর মতো আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা হয় তাহলে ‘Winners take all’-এর ত্রুটি থেকে আমাদের নির্বাচিত স্থানীয় সংস্থাগুলো মুক্ত হবে। ফলে স্থানীয় উন্নয়নে জনগণের সব প্রতিনিধিরই আনুপাতিক হারে একটি Voice সৃষ্টি হবে। তখন গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলভিত্তিক হলেও সংকীর্ণ দলীয় চরিত্রের হবে না।
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments