সবুজ অর্থনীতি : আপনি অন্তর্ভুক্ত তো? by বিধান চন্দ্র দাস
আজ (মঙ্গলবার) বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায়। রাজপ্রাসাদে ব্রাজিলের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট দিলমা ভ্যানা রাওসেফ স্থানীয় সময় বেলা ৩টায় পরিবেশবিষয়ক উদ্যোগগুলোর ঘোষণা দেবেন এবং এর মাধ্যমেই সূচিত হবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০১২-এর শুভ
উদ্বোধন। এর পরই পৃথিবী বিখ্যাত সুরস্রষ্টা কার্লোস মার্টিনের রিও+২০ স্তবক বন্দনা এবং সিনেটের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির এক সভায় ব্রাজিলকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০১২-এর স্বাগতিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একই সভায় বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয় 'সবুজ অর্থনীতি : আপনি অন্তর্ভুক্ত তো?' এর আগেও একবার ১৯৯২ সালে ধরিত্রী শীর্ষ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ হিসেবে ব্রাজিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপনের সুযোগ লাভ করেছিল। ২০ বছর পর আবারও ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে ২০ থেকে ২২ জুন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ধরিত্রী শীর্ষ সম্মেলনের ২০তম বার্ষিকী। আর তাতে যোগ দেবেন নানা দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা। উদ্দেশ্য একটাই- টেকসই উন্নয়ন। কাজেই জাতিসংঘের আসন্ন এই ধরিত্রী শীর্ষ সম্মেলনের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও তার প্রতিপাদ্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসন্দেহে তা অধিক টেকসই পৃথিবী নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টিকারী একটি বিশ্ব অনুষ্ঠান।
এ কথা অনস্বীকার্য যে মানুষের কৃতকর্মের ফলে পৃথিবী নামক এই ছোট্ট নীল গ্রহটি আজ রীতিমতো অসুস্থ। তার শরীরে এখন অস্বাভাবিক তাপমাত্রা। আর এই অস্বাভাবিক তাপমাত্রার ফলে ভেঙে পড়ছে তার খাদ্যশৃঙ্খল। অসংগতিতে পরিপূর্ণ তার বাস্তুতন্ত্র। পাহাড়, অরণ্য আর নদীর স্বাভাবিক পরিবেশ যাচ্ছে পাল্টে। মেরু অঞ্চলে যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত বরফের রাজ্যেও দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। বিগলিত হিমবাহ। সমুদ্র উঠছে ফেঁপে। অসংখ্য জনপদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংকুচিত হচ্ছে মিষ্টি পানির আধার। ঋতুবৈচিত্র্য যাচ্ছে পাল্টে। কখনো অনাবৃষ্টি, আবার কখনো অতিবৃষ্টি। জীববৈচিত্র্য আজ রীতিমতো হুমকির সম্মুখীন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এই প্রবল অভিঘাতে মানব সভ্যতা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।
এই বিপর্যয় রোধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যত দেরি হবে, অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসযজ্ঞ ততই এগিয়ে আসবে। সে কারণে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা অতীব জরুরি। আমাদের চিন্তায়, বিশ্বাসে এবং কর্মে পরিবেশগত ভারসাম্যের সঙ্গে উন্নয়নের যোগসূত্র স্থাপন করতে পারলেই আমরা প্রত্যেকে হতে পারব সবুজ অর্থনীতির অংশীদার। ভেবে দেখুন তো, আমাদের বাসায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত কয়টা ফ্যান আমরা চালিয়ে রাখি অথবা বাতি জ্বালিয়ে রাখি? কিংবা আমাদের বাসায় পানির কতটুকু অপচয় হয়? সারা জীবন আমরা গাছ বা উদ্ভিদ থেকে উপকার পেয়ে আসছি- কিন্তু আমরা নিজের হাতে এ পর্যন্ত কয়টা গাছ লাগিয়েছি? আসলে এ ধরনের হিসাব যদি আমাদের মাথায় থাকে এবং সেই মতো যদি আমরা আমাদের নিত্যদিনের কাজকর্ম করি, তাহলেই আমরা হতে পারব সবুজ অর্থনীতির অংশীদার।
সবুজ অর্থনীতি হচ্ছে সেই অর্থনীতি, যার দ্বারা পরিবেশগত ঝুঁকি ও বাস্তুতান্ত্রিক অভাব কমিয়ে মানবকল্যাণ ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা যায়। আসলে ২০০৭ সালের পর বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দাভাব চলছে, তা বিগত শতকের ত্রিশের দশকের মহামন্দার সঙ্গে তুলনীয়। চলমান যে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা বসবাস করছি, তা পৃথিবীর দেশে দেশে গণমানুষের কল্যাণ ও পরিবেশগত ভারসাম্য নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শিশুমৃত্যু, রোগ-ব্যাধি, পরিবেশদূষণ, সামাজিক বৈষম্য ইত্যাদি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নামিয়ে আনাও সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণে বিকল্প ধারার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, যা টেকসই উন্নয়নকে আরো বেশি করে নির্ভরতা প্রদান করতে সক্ষম- তাকেই এখন বিশেষজ্ঞরা সবুজ অর্থনীতি বলে অভিহিত করছেন।
জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি ২০০৮ সালে বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতের জন্য সবুজ অর্থনীতির বিস্তৃত কর্মকৌশল সুপারিশ করে, বিশেষ করে যেসব জায়গায় সবুজ অর্থনীতির উপাদানগুলোকে উপযুক্তভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। বাতাসে কার্বন তথা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনা সবুজ অর্থনীতির অন্যতম দিক। যেমন- গাড়ি তৈরির কারখানায় সে ধরনের গাড়ি তৈরি করতে হবে, যা জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়াই চলতে পারবে। কম খরচের ব্যাটারি, সোলার সেল কিংবা জৈবজ্বালানি অথবা তার থেকেও অন্য কোনো দূষণমুক্ত উপায় উদ্ভাবনের মাধ্যমে গাড়ি চালানো গেলে তা হবে সবুজ অর্থনীতির জন্য সহায়ক।
সবুজ অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেন, যেকোনো জিনিস পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা রিসাইক্লিং করা গেলে তা পরিবেশের জন্য কম দূষণের কারণ হয়। ময়লা-আবর্জনার সঠিক ও যথাযথ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের জন্য একটি উন্নত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থাপনা এমন এক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যগুলো ব্যবহারের পর তা যত্রতত্র ফেলে রাখা হয় না। নির্দিষ্ট স্থানে সেসব জমা রাখার পর সেখান থেকে একসময় তা সংগ্রহ করা হয়। পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে সেসব পণ্য আবার তৈরি করা হয় কিংবা সেসব থেকে ভিন্ন ধরনের পণ্যও উৎপাদন করা হয়।
মিষ্টি পানির অপচয় সর্বতোভাবে বন্ধ করা এবং তার যথাযথ ব্যবহার সবুজ অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পৃথিবীতে মিষ্টি পানির উৎস ক্রমাগতভাবে সংকুচিত হচ্ছে। এই মিষ্টি পানির ওপরই নির্ভরশীল পৃথিবীর অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ। মিষ্টি পানির অভাবে আমাদের বেঁচে থাকা একেবারেই অসম্ভব। আর সে কারণে মিষ্টি পানি সংরক্ষণে আমাদের আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।
সূর্যশক্তি, ভূতাপীয় শক্তি, অপ্রচলিত শক্তি প্রভৃতির ব্যবহার যথাযথভাবে করতে পারলে তা হবে সবুজ অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বন উজাড়, গাছপালা ধ্বংস, জলাশয় নির্মূল কিংবা নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে সবুজ অর্থনীতি কখনো প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। আর সবুজ অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা ছাড়া সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা বর্তমান সময়ে একেবারেই অসম্ভব।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০১২-এর বাণীতে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন উল্লেখ করেছেন, 'অর্থনীতি আর পরিবেশের সুস্বাস্থ্য সাংঘর্ষিক- এই চিরায়ত ধারণা আমাদের অবশ্যই খণ্ডন করতে হবে। সুষ্ঠু নীতিমালা ও সঠিক বিনিয়োগের দ্বারা যেকোনো দেশ তার পরিবেশকে রক্ষা করতে সক্ষম, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সফল এবং উপযুক্ত কর্ম সৃষ্টিতে পারঙ্গম হয়ে উঠতে পারে।' কাজেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় সবুজ অর্থনীতি হয়ে উঠতে পারে আমাদের হিরণ্ময় হাতিয়ার।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments