সময়ের প্রতিধ্বনি-'তৃতীয় শক্তি' নিয়ে এত কথাবার্তা কেন by মোস্তফা কামাল
তৃতীয় শক্তি আসছে, তৃতীয় শক্তি আসতে পারে_এমন আশঙ্কার কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনও বলা হচ্ছে, ওয়ান-ইলেভেনের মতো ঘটনা আবারও ঘটতে পারে। দেশে কি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটতে পারে? নাকি সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পাঁয়তারা চলছে? এ বিষয় নিয়ে ইদানীং রাজনৈতিক মহলে তো বটেই, সরকারি পর্যায়েও আলোচনা হচ্ছে।
দেশের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিকে সামনে রেখে একটি মহল বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর মদদে ওই মহলটি এর নেপথ্যে কাজ করছে। এ বিষয়ে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। গোয়েন্দারা ইতিমধ্যেই সরকারকে কিছু তথ্য-প্রমাণ দিয়েছে এবং তার ভিত্তিতে সরকার কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
তা ছাড়া সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একাধিকবার তৃতীয় শক্তির বিষয়ে সতর্কসংকেত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ব্যর্থ করার নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চলছে। এ ব্যাপারে তিনি নেতা-কর্মীদের সজাগ থাকার আহ্বান জানান। সরকারের মন্ত্রিসভার আরো কয়েকজন সদস্য বলে আসছেন, আবার যাতে দেশে ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে। বারবার কেন এসব সতর্কবাণী উচ্চারিত হচ্ছে? তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে পারলে কি ষড়যন্ত্রকারীদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে? তাঁরা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে বারবার তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে চাচ্ছেন। নির্বাচিত সরকারকে দিয়ে সব কাজ করানো যাচ্ছে না বলেই কি তাঁরা নতুন করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন? তাঁরা আসলে দেশের মঙ্গল চান না, চান নিজেদের স্বার্থ। ছলেবলে-কৌশলে সেই স্বার্থসিদ্ধির পাঁয়তারা করছেন তাঁরা।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে ওয়ান-ইলেভেন পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহের কথা। এখন নিশ্চয়ই সবাই একবাক্যে বলবেন, সেই পরিস্থিতি আমরা আর দেখতে চাই না। আমরা দেখেছি তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট একতরফাভাবে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সেই নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলেও চারদলীয় জোট নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিল, যদিও তখন ভোটার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। প্রশ্ন ছিল নির্বাচন কমিশন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও। চারদলীয় জোট সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এ হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে চেয়েছিল। এ জন্য জোট সরকার কৌশলে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমাও বাড়িয়েছিল। কিন্তু মহাজোটের আন্দোলনের মুখে এম এ হাসানকে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করতে ব্যর্থ হলো, তখন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে গেলেন। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান তখন খালেদা জিয়ার টেলিফোনে প্রাপ্ত নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতেন।
তখন কোনো কোনো উপদেষ্টা এই লেখককে বলেছিলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনার পর তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দিতেন না। ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বলতেন, 'আপনাদের কথা শুনলাম। পরে সিদ্ধান্ত জানাব।' পরে তিনি নাকি রাষ্ট্রীয় সেসব বিষয় নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতেন। তিনি যে সিদ্ধান্ত দিতেন সে সিদ্ধান্তই উপদেষ্টাদের অবহিত করতেন এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। এ বিষয়টি উপদেষ্টাদের মধ্যে জানাজানি হওয়ার পর চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা হুমকির মুখে পড়ে। দেশের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়।
এদিকে রাজনীতির মাঠও ব্যাপকভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। রাজনীতিতে নেমে আসে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা। শঙ্কিত হয়ে পড়ে দেশের সাধারণ মানুষ। তখন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ প্রতিনিধির অনেক দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। তাঁরা তখন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। তখন সিভিল সোসাইটির একটি অংশ সেনাপ্রধানকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। অনেক আলোচনা-পর্যালোচনার একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুরুতেই ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজে হাত দেয়। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের কারণে দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের সন্ধান পাওয়া যায়। এই ভুয়া ভোটার তালিকা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রণয়ন করা হয়েছিল।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় বসেছে। এখন এই সরকারকে হটাতে এত ষড়যন্ত্র কেন? কেন তৃতীয় শক্তিকে আবার ক্ষমতায় বসানোর পাঁয়তারা? কারা তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটাতে চায়, এদের মদদদাতা কারা? তাদের মুখোশ উন্মোচন করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষের উচিত ষড়যন্ত্রকারীদের চিনে রাখা।
বর্তমান সরকার যখন জঙ্গিদের মূলোৎপাটন শুরু করল, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো তখনই শুরু হলো সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ক্ষমতাসীন দল এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলোতে ছদ্মবেশী জামায়াত-শিবির এবং একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ঢুকে পড়েছে। তারা সরকারকে বিপদে ফেলতে ফন্দি-ফিকির করছে।
ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন জেলা ও থানা কমিটিতে নতুন মুখ নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ির কথা আমরা শুনতে পাই। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল। এ দল ক্ষমতায় আসার পর নতুন নেতা-কর্মীদের জায়গা দেওয়া হবে কেন? যাঁরা নতুনদের অনুপ্রবেশের সুযোগ দিচ্ছেন তাঁদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ অনুপ্রবেশকারী নেতা-কর্মীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারকে বেশ সমালোচিত হতে হয়েছে এবং হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ গঠনের সুযোগ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখনো বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ করতে দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এখনো সেই একই রকম ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই ষড়যন্ত্রকারীরা বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারকে ব্যর্থ করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি একজোট হয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচার-প্রপাগাণ্ডা শুরু করে। এ কারণে স্বাধীনতার ৪০ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ মাত্র ১০ বছরের মতো সরকার পরিচালনার সুযোগ পায়। বাকি সময়টা (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকাল বাদে) কোনো না কোনোভাবে স্বৈরশাসক এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তারা দেশের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল। নিজেদের স্বার্থে তছনছ করেছিল দেশের সংবিধান। নতুন প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শেখানো হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালি জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মানবতাবিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল তৎকালীন শাসকরা। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হলেও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাই তো বারবার সামরিক শাসন জেঁকে বসেছিল দেশটির ওপর। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম আর রক্তের বিনিময়ে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরাচারমুক্ত হয় দেশ। ১৯৯১ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হলেও ষড়যন্ত্র কিন্তু বন্ধ হয়নি। আমরা দেখছি, একটি দেশ একজন ব্যক্তিকে নিয়ে কতটা বাড়াবাড়ি করছে। ব্যক্তি কি একটি দেশের চেয়েও বড়? বড় দেশ সব সময়ই ছোট দেশের ওপর হস্তক্ষেপ করে। তাই বলে অস্তিত্বের ওপর আঘাত! সচেতন মহলকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে।
তবে এটা পরিষ্কার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকুক এটা ষড়যন্ত্রকারীরা চায় না। এ কারণেই এত ষড়যন্ত্র। সরকারকে ব্যর্থ করতে সংঘবদ্ধ একটি চক্র সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে ঢুকে গেছে। ভেতর থেকে তারা ঘুণপোকার মতো সরকারকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আর বাইরে 'তৃতীয় শক্তি'র জুজুর ভয় দেখানোর মহড়া চলছে। এই জুজুর ভয়ে সরকারকে তটস্থ রাখতে ব্যস্ত ষড়যন্ত্রকারীরা। এই ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে আমলাদের একটি অংশ জড়িত বলে শোনা যায়। কথায় আছে, ঘরের শত্রু বিভীষণ। সরকারের ভেতরে থেকে ষড়যন্ত্র করলে বিপদে পড়ার ভয়টা বেশিই থাকে। এ বিষয়েও সরকার সতর্ক রয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আমরা এ-ও বিশ্বাস করি, তৃতীয় শক্তি নামের জুজুর ভয়ে সরকার ভীত না হয়ে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবিলা করবে। মিছে আলেয়ার পেছনে ছুটবে না। দেশের স্বার্থে এবং জনগণের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করবে। তাহলে কোনো অশুভ শক্তিই সরকারকে বিপদে ফেলতে পারবে না। জনগণের শক্তির ওপর আর কোনো শক্তি নেই। জনগণই সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
তা ছাড়া সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একাধিকবার তৃতীয় শক্তির বিষয়ে সতর্কসংকেত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ব্যর্থ করার নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চলছে। এ ব্যাপারে তিনি নেতা-কর্মীদের সজাগ থাকার আহ্বান জানান। সরকারের মন্ত্রিসভার আরো কয়েকজন সদস্য বলে আসছেন, আবার যাতে দেশে ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে। বারবার কেন এসব সতর্কবাণী উচ্চারিত হচ্ছে? তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে পারলে কি ষড়যন্ত্রকারীদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে? তাঁরা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে বারবার তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে চাচ্ছেন। নির্বাচিত সরকারকে দিয়ে সব কাজ করানো যাচ্ছে না বলেই কি তাঁরা নতুন করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন? তাঁরা আসলে দেশের মঙ্গল চান না, চান নিজেদের স্বার্থ। ছলেবলে-কৌশলে সেই স্বার্থসিদ্ধির পাঁয়তারা করছেন তাঁরা।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে ওয়ান-ইলেভেন পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহের কথা। এখন নিশ্চয়ই সবাই একবাক্যে বলবেন, সেই পরিস্থিতি আমরা আর দেখতে চাই না। আমরা দেখেছি তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট একতরফাভাবে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সেই নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলেও চারদলীয় জোট নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিল, যদিও তখন ভোটার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। প্রশ্ন ছিল নির্বাচন কমিশন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও। চারদলীয় জোট সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এ হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে চেয়েছিল। এ জন্য জোট সরকার কৌশলে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমাও বাড়িয়েছিল। কিন্তু মহাজোটের আন্দোলনের মুখে এম এ হাসানকে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করতে ব্যর্থ হলো, তখন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে গেলেন। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান তখন খালেদা জিয়ার টেলিফোনে প্রাপ্ত নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতেন।
তখন কোনো কোনো উপদেষ্টা এই লেখককে বলেছিলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনার পর তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দিতেন না। ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বলতেন, 'আপনাদের কথা শুনলাম। পরে সিদ্ধান্ত জানাব।' পরে তিনি নাকি রাষ্ট্রীয় সেসব বিষয় নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতেন। তিনি যে সিদ্ধান্ত দিতেন সে সিদ্ধান্তই উপদেষ্টাদের অবহিত করতেন এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। এ বিষয়টি উপদেষ্টাদের মধ্যে জানাজানি হওয়ার পর চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা হুমকির মুখে পড়ে। দেশের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়।
এদিকে রাজনীতির মাঠও ব্যাপকভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। রাজনীতিতে নেমে আসে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা। শঙ্কিত হয়ে পড়ে দেশের সাধারণ মানুষ। তখন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ প্রতিনিধির অনেক দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। তাঁরা তখন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। তখন সিভিল সোসাইটির একটি অংশ সেনাপ্রধানকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। অনেক আলোচনা-পর্যালোচনার একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুরুতেই ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজে হাত দেয়। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের কারণে দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের সন্ধান পাওয়া যায়। এই ভুয়া ভোটার তালিকা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রণয়ন করা হয়েছিল।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় বসেছে। এখন এই সরকারকে হটাতে এত ষড়যন্ত্র কেন? কেন তৃতীয় শক্তিকে আবার ক্ষমতায় বসানোর পাঁয়তারা? কারা তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটাতে চায়, এদের মদদদাতা কারা? তাদের মুখোশ উন্মোচন করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষের উচিত ষড়যন্ত্রকারীদের চিনে রাখা।
বর্তমান সরকার যখন জঙ্গিদের মূলোৎপাটন শুরু করল, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো তখনই শুরু হলো সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ক্ষমতাসীন দল এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলোতে ছদ্মবেশী জামায়াত-শিবির এবং একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ঢুকে পড়েছে। তারা সরকারকে বিপদে ফেলতে ফন্দি-ফিকির করছে।
ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন জেলা ও থানা কমিটিতে নতুন মুখ নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ির কথা আমরা শুনতে পাই। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল। এ দল ক্ষমতায় আসার পর নতুন নেতা-কর্মীদের জায়গা দেওয়া হবে কেন? যাঁরা নতুনদের অনুপ্রবেশের সুযোগ দিচ্ছেন তাঁদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ অনুপ্রবেশকারী নেতা-কর্মীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারকে বেশ সমালোচিত হতে হয়েছে এবং হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ গঠনের সুযোগ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখনো বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ করতে দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এখনো সেই একই রকম ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই ষড়যন্ত্রকারীরা বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারকে ব্যর্থ করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি একজোট হয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী প্রচার-প্রপাগাণ্ডা শুরু করে। এ কারণে স্বাধীনতার ৪০ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ মাত্র ১০ বছরের মতো সরকার পরিচালনার সুযোগ পায়। বাকি সময়টা (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকাল বাদে) কোনো না কোনোভাবে স্বৈরশাসক এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তারা দেশের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল। নিজেদের স্বার্থে তছনছ করেছিল দেশের সংবিধান। নতুন প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শেখানো হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালি জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মানবতাবিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল তৎকালীন শাসকরা। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হলেও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাই তো বারবার সামরিক শাসন জেঁকে বসেছিল দেশটির ওপর। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম আর রক্তের বিনিময়ে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরাচারমুক্ত হয় দেশ। ১৯৯১ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হলেও ষড়যন্ত্র কিন্তু বন্ধ হয়নি। আমরা দেখছি, একটি দেশ একজন ব্যক্তিকে নিয়ে কতটা বাড়াবাড়ি করছে। ব্যক্তি কি একটি দেশের চেয়েও বড়? বড় দেশ সব সময়ই ছোট দেশের ওপর হস্তক্ষেপ করে। তাই বলে অস্তিত্বের ওপর আঘাত! সচেতন মহলকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে।
তবে এটা পরিষ্কার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকুক এটা ষড়যন্ত্রকারীরা চায় না। এ কারণেই এত ষড়যন্ত্র। সরকারকে ব্যর্থ করতে সংঘবদ্ধ একটি চক্র সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে ঢুকে গেছে। ভেতর থেকে তারা ঘুণপোকার মতো সরকারকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আর বাইরে 'তৃতীয় শক্তি'র জুজুর ভয় দেখানোর মহড়া চলছে। এই জুজুর ভয়ে সরকারকে তটস্থ রাখতে ব্যস্ত ষড়যন্ত্রকারীরা। এই ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে আমলাদের একটি অংশ জড়িত বলে শোনা যায়। কথায় আছে, ঘরের শত্রু বিভীষণ। সরকারের ভেতরে থেকে ষড়যন্ত্র করলে বিপদে পড়ার ভয়টা বেশিই থাকে। এ বিষয়েও সরকার সতর্ক রয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আমরা এ-ও বিশ্বাস করি, তৃতীয় শক্তি নামের জুজুর ভয়ে সরকার ভীত না হয়ে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবিলা করবে। মিছে আলেয়ার পেছনে ছুটবে না। দেশের স্বার্থে এবং জনগণের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করবে। তাহলে কোনো অশুভ শক্তিই সরকারকে বিপদে ফেলতে পারবে না। জনগণের শক্তির ওপর আর কোনো শক্তি নেই। জনগণই সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
No comments