ভূমি বন্দোবস্ত-ভূমিহীনদের জন্য খাসজমি by এ এম এম শওকত আলী
ভূমিহীনদের খাসজমি বিতরণের জন্য সব ক্ষমতাসীন দলই কম-বেশি উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগের সফলতা ও ব্যর্থতা সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন আজ পর্যন্ত হয়নি। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো অর্জন নেই। চল্লিশের দশক থেকেই শুরু হয় ভূমিসংক্রান্ত বিতর্ক।
১৯৪০ সালে ভূমি রাজস্ব কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে। এ কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সময়ে জমিদারপদ্ধতি বিলুপ্ত করার বিষয়ে তদানীন্তন বাংলা প্রদেশে বিল প্রণয়ন ও আলোচনা হয়।
বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত আইন প্রণীত হয় ১৯৫০ সালে এবং আইনটি কার্যকর করা হয় ১৯৫১ সালে। এ আইনে ভূমিহীন শব্দটি কখনো ব্যবহার করা হয়নি। আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে দুটি বিষয়। এক. জমিদারিপ্রথার বিলুপ্তি। দুই. প্রজাদের স্বার্থরক্ষা। ১৯৫০ সালে এ আইনের বিলে বর্গাদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য একটি পৃথক অধ্যায় সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। তদানীন্তন প্রাদেশিক আইনসভার চতুর্থ সেশনে অধ্যায়টি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের আইনসভার বিবেচনার জন্য মূলত বর্গাদারদের জন্য ১৯৪৬ সালেই একটি বিল প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু তা গৃহীত না হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম বাংলায় এ সংক্রান্ত আইন ১৯৫০ সালে প্রণীত হয়। বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত প্রথম আইন ১৯৮৪ সালে।
১৯৫০ সালে প্রণীত আইনের শিরোনাম ছিল রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন। এ আইনে ভূমি মালিকানায় সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত করা হয় ৩৭৫ বিঘা। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে এ সীমা করা ৩০০ বিঘা। ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশবলে মালিকানার সীমা ৬০ বিঘা করা হয়। মালিকানার সর্বোচ্চ সীমার বাইরে সব অতিরিক্ত জমির মালিকানা হবে সরকারের। আশা করা হয়েছিল যে এসব অতিরিক্ত জমি ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। কত অতিরিক্ত জমি আইনি প্রক্রিয়ায় সরকার পেয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর।
১৯৫০ সালের আইনের একটি ধারায় সরকারি মালিকানার কৃষি জমি কীভাবে এবং কোন ব্যক্তিকে বন্দোবস্ত দেওয়া হবে সে বিষয়ে বিধান রয়েছে। ওই ধারার প্রথম ভাগে বলা আছে যে আইনের অধীনে বিধির মাধ্যমে এসব জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হবে অথবা সরকার যেকোনোভাবে জমি ব্যবহার করতে পারবে। তবে এ বিষয়ে দুটি শর্ত প্রযোজ্য। এক. কোনোভাবেই যাদের জমির সর্বোচ্চ সীমা ৩৭৫ বিঘা অতিক্রম করে তাদের বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না। দুই. জমি বন্দোবস্তে যেসব ব্যক্তি নিজে অথবা তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা জমি চাষ করে এবং যে ব্যক্তির জমির মালিকানা নয় বিঘার চেয়ে কম তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এ আইনের অধীনে ১৯৫১ সালে প্রণীত বিধানে এ বিষয় বলা আছে, আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুসরণ করে বিধি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত প্রচলিত বিধি অনুযায়ী জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে। অর্থাৎ, ১৯৫১ সালে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি প্রণীত হয়নি। আজ পর্যন্ত এ ধরনের বিধিও প্রণীত হয়নি। বর্তমানে এ ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা অনুসরণে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত নীতিমালার অভাবে সময়ে সময়ে ভূমি মন্ত্রণালয় সার্কুলারের মাধ্যমে যে দিকনিদের্শনা প্রদান করত সে নির্দেশনাই মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হতো। ১৯৯৮ সালে নীতিমালায় কিছু সংশোধন করা হয়। ২০০০ সালেও কিছু সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ করা হয় ২০০৩ সালে।
সরকার এখনো রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের বিধান অনুসরণ করছে না। তার মূল কারণ হলো সংশ্লিষ্ট ধারায় ‘অথবা সরকার যে কোন ভাবে সরকারি জমি ব্যবহার’ বাক্যটির সংযোজন। বিষয়টি আগেই বলা হয়েছে।
বর্তমান নীতিমালায় ভূমিহীন পরিবারের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সরকারি কৃষি জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিহীনরাই যোগ্য। অন্য কেউ নয়। ভূমিহীন পরিবারের সংজ্ঞা হলো বসতবাড়ি বা জমি নেই এমন পরিবার। এ সংজ্ঞার পরে অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে
দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার;
নদী ভাঙনের ফলে ভূমিহীন পরিবার;
বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্ত পরিবার, যাদের সক্ষম পুত্রসন্তান রয়েছে;
কৃষি জমি ও বসতবাড়িহীন পরিবার এবং
ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার
এ নিয়ে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করা যায়। কৃষি জমি ও বসতবাড়িহীন পরিবারসংক্রান্ত বিষয়টির প্রয়োজন নেই। কারণ, ভূমিহীনের সংজ্ঞায় বিষয়টি রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে বলা যায় যে অন্যদের বসতবাড়ি ও কিছু জমি থাকলে কী হবে। অথবা বসতবাড়ি রয়েছে কিন্তু কোনো জমি নেই। সার্বিকভাবে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করেই একটি স্বতন্ত্র বিধি করা প্রয়োজন। সরকার ইচ্ছামতো নীতিমালা করবে এবং নীতিমালা পরিবর্তন করবে, এ ধরনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার আইনি নিয়ন্ত্রণ করা সমীচীন হবে। এ বিষয়ে আরও একটি বিষয় চিহ্নিত করা সম্ভব। সে বিষয়টি হলো ভূমিহীনদের নিয়ে যেসব বেসরকারি সংস্থা কাজ করে তাদের নীতিমালা বাস্তবায়নে অধিকতর সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে স্বল্প সংখ্যক কিছু জেলায় এ ধরনের সম্পৃক্ততার ফলে সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি হচ্ছে বন্দোবস্তযোগ্য কৃষি খাসজমির পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় ১৯৭২ থেকে আজ পর্যন্ত অনেক নির্দেশ/আদেশ মাঠপর্যায়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নের গতি মন্থর। তবে একটি সাফল্যের বিষয় উল্লেখ করা সম্ভব। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে সব জেলার জেলা প্রশাসকেরা এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে তথ্য পাঠিয়েছে। কম্পিউটারভিত্তিক এ তথ্যসম্ভার সংরক্ষণ করা উচিত হবে। যাতে অগ্রগতি পরিবীক্ষণ করা সম্ভব হয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সংসদে এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ ও তথ্যনির্ভর হয়। সাংসদেরাও এতে নিজস্ব এলাকায় এ বিষয় যাচাই করতে সক্ষম হবে।
ওপরে বর্ণিত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রথমে আইনের এবং বিধির বিদ্যমান ধারায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হবে। আইনের সংশোধনের পর সম্পূর্ণ নতুন একটি পৃথক বিধি এ বিষয়ে করতে হবে। একই সঙ্গে ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে তার মন্ত্রণালয়ের তথ্যভান্ডারের সঙ্গে সংযোগও প্রয়োজন হবে। এর ফলে গ্রামের সবারই বিষয়টি জানার অধিকারও নিশ্চিত করা যাবে।
কৃষি জমির নীতিমালা ছাড়াও অকৃষি জমির বন্দোবস্তসংক্রান্ত নীতিমালা রয়েছে। এ নীতিমালারও ধাপে ধাপে পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালার আদৌ প্রয়োজন নেই। কারণ, ১৯৪৯ সালেই অকৃষি জমিসংক্রান্ত আইন প্রণীত হয়েছিল। এ আইনের কার্যকরতা সমগ্র বাংলাদেশ। এটা একটি বড় ধরনের আইনি ভুল। কারণ, চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলাগুলোয় যেসব আইন প্রযোজ্য তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনসহ অন্য কিছু আইন। এর মধ্যে ভূমির ক্ষেত্রে আংশিকভাবে প্রযোজ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় জেলা পরিষদ আইন রয়েছে। এ বিষয়েও সংশোধন আনা প্রয়োজন।
অকৃষি জমিসংক্রান্ত আইনের যেসব সংশোধনী রয়েছে তা ১৯৭১ সালের আগেই করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে অকৃষি জমির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইনে এ প্রকারের জমি মাত্র তিন উদ্দেশ্যে বন্দোবস্তযোগ্য। এক. আবাসিক। দুই. কারখানা বা ব্যবসা পরিচালনা। তিন. ধর্মীয় অথবা অন্যান্য। ‘অন্যান্য’ বিষয়টির কোনো সংজ্ঞা আইনে নেই। ব্যাপক অর্থে এ শব্দ ব্যবহার করা সম্ভব। সংজ্ঞায়িত করে এ ধরনের বন্দোবস্ত সীমিত করা প্রয়োজন।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত আইন প্রণীত হয় ১৯৫০ সালে এবং আইনটি কার্যকর করা হয় ১৯৫১ সালে। এ আইনে ভূমিহীন শব্দটি কখনো ব্যবহার করা হয়নি। আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে দুটি বিষয়। এক. জমিদারিপ্রথার বিলুপ্তি। দুই. প্রজাদের স্বার্থরক্ষা। ১৯৫০ সালে এ আইনের বিলে বর্গাদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য একটি পৃথক অধ্যায় সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। তদানীন্তন প্রাদেশিক আইনসভার চতুর্থ সেশনে অধ্যায়টি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের আইনসভার বিবেচনার জন্য মূলত বর্গাদারদের জন্য ১৯৪৬ সালেই একটি বিল প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু তা গৃহীত না হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম বাংলায় এ সংক্রান্ত আইন ১৯৫০ সালে প্রণীত হয়। বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত প্রথম আইন ১৯৮৪ সালে।
১৯৫০ সালে প্রণীত আইনের শিরোনাম ছিল রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন। এ আইনে ভূমি মালিকানায় সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত করা হয় ৩৭৫ বিঘা। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে এ সীমা করা ৩০০ বিঘা। ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশবলে মালিকানার সীমা ৬০ বিঘা করা হয়। মালিকানার সর্বোচ্চ সীমার বাইরে সব অতিরিক্ত জমির মালিকানা হবে সরকারের। আশা করা হয়েছিল যে এসব অতিরিক্ত জমি ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। কত অতিরিক্ত জমি আইনি প্রক্রিয়ায় সরকার পেয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর।
১৯৫০ সালের আইনের একটি ধারায় সরকারি মালিকানার কৃষি জমি কীভাবে এবং কোন ব্যক্তিকে বন্দোবস্ত দেওয়া হবে সে বিষয়ে বিধান রয়েছে। ওই ধারার প্রথম ভাগে বলা আছে যে আইনের অধীনে বিধির মাধ্যমে এসব জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হবে অথবা সরকার যেকোনোভাবে জমি ব্যবহার করতে পারবে। তবে এ বিষয়ে দুটি শর্ত প্রযোজ্য। এক. কোনোভাবেই যাদের জমির সর্বোচ্চ সীমা ৩৭৫ বিঘা অতিক্রম করে তাদের বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না। দুই. জমি বন্দোবস্তে যেসব ব্যক্তি নিজে অথবা তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা জমি চাষ করে এবং যে ব্যক্তির জমির মালিকানা নয় বিঘার চেয়ে কম তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এ আইনের অধীনে ১৯৫১ সালে প্রণীত বিধানে এ বিষয় বলা আছে, আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুসরণ করে বিধি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত প্রচলিত বিধি অনুযায়ী জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে। অর্থাৎ, ১৯৫১ সালে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি প্রণীত হয়নি। আজ পর্যন্ত এ ধরনের বিধিও প্রণীত হয়নি। বর্তমানে এ ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা অনুসরণে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত নীতিমালার অভাবে সময়ে সময়ে ভূমি মন্ত্রণালয় সার্কুলারের মাধ্যমে যে দিকনিদের্শনা প্রদান করত সে নির্দেশনাই মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হতো। ১৯৯৮ সালে নীতিমালায় কিছু সংশোধন করা হয়। ২০০০ সালেও কিছু সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ করা হয় ২০০৩ সালে।
সরকার এখনো রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের বিধান অনুসরণ করছে না। তার মূল কারণ হলো সংশ্লিষ্ট ধারায় ‘অথবা সরকার যে কোন ভাবে সরকারি জমি ব্যবহার’ বাক্যটির সংযোজন। বিষয়টি আগেই বলা হয়েছে।
বর্তমান নীতিমালায় ভূমিহীন পরিবারের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সরকারি কৃষি জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিহীনরাই যোগ্য। অন্য কেউ নয়। ভূমিহীন পরিবারের সংজ্ঞা হলো বসতবাড়ি বা জমি নেই এমন পরিবার। এ সংজ্ঞার পরে অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে
দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার;
নদী ভাঙনের ফলে ভূমিহীন পরিবার;
বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্ত পরিবার, যাদের সক্ষম পুত্রসন্তান রয়েছে;
কৃষি জমি ও বসতবাড়িহীন পরিবার এবং
ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার
এ নিয়ে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করা যায়। কৃষি জমি ও বসতবাড়িহীন পরিবারসংক্রান্ত বিষয়টির প্রয়োজন নেই। কারণ, ভূমিহীনের সংজ্ঞায় বিষয়টি রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে বলা যায় যে অন্যদের বসতবাড়ি ও কিছু জমি থাকলে কী হবে। অথবা বসতবাড়ি রয়েছে কিন্তু কোনো জমি নেই। সার্বিকভাবে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করেই একটি স্বতন্ত্র বিধি করা প্রয়োজন। সরকার ইচ্ছামতো নীতিমালা করবে এবং নীতিমালা পরিবর্তন করবে, এ ধরনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার আইনি নিয়ন্ত্রণ করা সমীচীন হবে। এ বিষয়ে আরও একটি বিষয় চিহ্নিত করা সম্ভব। সে বিষয়টি হলো ভূমিহীনদের নিয়ে যেসব বেসরকারি সংস্থা কাজ করে তাদের নীতিমালা বাস্তবায়নে অধিকতর সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে স্বল্প সংখ্যক কিছু জেলায় এ ধরনের সম্পৃক্ততার ফলে সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি হচ্ছে বন্দোবস্তযোগ্য কৃষি খাসজমির পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় ১৯৭২ থেকে আজ পর্যন্ত অনেক নির্দেশ/আদেশ মাঠপর্যায়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নের গতি মন্থর। তবে একটি সাফল্যের বিষয় উল্লেখ করা সম্ভব। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে সব জেলার জেলা প্রশাসকেরা এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে তথ্য পাঠিয়েছে। কম্পিউটারভিত্তিক এ তথ্যসম্ভার সংরক্ষণ করা উচিত হবে। যাতে অগ্রগতি পরিবীক্ষণ করা সম্ভব হয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সংসদে এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ ও তথ্যনির্ভর হয়। সাংসদেরাও এতে নিজস্ব এলাকায় এ বিষয় যাচাই করতে সক্ষম হবে।
ওপরে বর্ণিত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রথমে আইনের এবং বিধির বিদ্যমান ধারায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হবে। আইনের সংশোধনের পর সম্পূর্ণ নতুন একটি পৃথক বিধি এ বিষয়ে করতে হবে। একই সঙ্গে ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে তার মন্ত্রণালয়ের তথ্যভান্ডারের সঙ্গে সংযোগও প্রয়োজন হবে। এর ফলে গ্রামের সবারই বিষয়টি জানার অধিকারও নিশ্চিত করা যাবে।
কৃষি জমির নীতিমালা ছাড়াও অকৃষি জমির বন্দোবস্তসংক্রান্ত নীতিমালা রয়েছে। এ নীতিমালারও ধাপে ধাপে পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালার আদৌ প্রয়োজন নেই। কারণ, ১৯৪৯ সালেই অকৃষি জমিসংক্রান্ত আইন প্রণীত হয়েছিল। এ আইনের কার্যকরতা সমগ্র বাংলাদেশ। এটা একটি বড় ধরনের আইনি ভুল। কারণ, চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলাগুলোয় যেসব আইন প্রযোজ্য তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনসহ অন্য কিছু আইন। এর মধ্যে ভূমির ক্ষেত্রে আংশিকভাবে প্রযোজ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় জেলা পরিষদ আইন রয়েছে। এ বিষয়েও সংশোধন আনা প্রয়োজন।
অকৃষি জমিসংক্রান্ত আইনের যেসব সংশোধনী রয়েছে তা ১৯৭১ সালের আগেই করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে অকৃষি জমির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইনে এ প্রকারের জমি মাত্র তিন উদ্দেশ্যে বন্দোবস্তযোগ্য। এক. আবাসিক। দুই. কারখানা বা ব্যবসা পরিচালনা। তিন. ধর্মীয় অথবা অন্যান্য। ‘অন্যান্য’ বিষয়টির কোনো সংজ্ঞা আইনে নেই। ব্যাপক অর্থে এ শব্দ ব্যবহার করা সম্ভব। সংজ্ঞায়িত করে এ ধরনের বন্দোবস্ত সীমিত করা প্রয়োজন।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
No comments