পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন by মোঃ খবির উদ্দীন

পরিবেশ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় 'পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে আপনিও গর্বিত অংশীদার হোন'। টেকসই অর্থনীতি অর্জনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি সৃষ্টি করা। একটি দেশের উন্নয়নে যেমন শিল্প-কারখানার ভূমিকা অপরিসীম, তার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাও জরুরি।


আর তার জন্য প্রয়োজন একটি সুপরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আমাদের এখন শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা ভাবলেই চলবে না বরং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর পরিবেশের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করেই এগিয়ে যেতে হবে উন্নত বিশ্বের টেকসই অর্থনীতির দিকে।
বিশ্বায়নের ঘোড়দৌড়ে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও শিল্প-কলকারখানার বিস্তার ঘটেছে অনেক। উন্নত বিশ্বের আধুনিক জাতির সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের দেশে গড়ে ওঠা এসব শিল্প-কলকারখানার ওপর আজ অনেক মানুষেরই জীবিকা নির্ভরশীল। এসব কলকারখানা থেকেই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য অর্জিত হচ্ছে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু উন্নত বিশ্বের আধুনিক নাগরিক সুবিধাভোগী মানুষগুলোর পাশাপাশি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষগুলোও আজ বুঝতে পারছে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয় বরং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করেই বিস্তার ঘটাতে হবে আমাদের দেশের শিল্প-কলকারখানা অর্থাৎ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে অর্থনীতিকে। আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা বিশেষ করে ঢাকার আশপাশে যেসব কলকারখানা গড়ে উঠেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সচেতন হতে হবে আশপাশের জীববৈচিত্র্য, নদ-নদী ও জলাভূমি সম্পর্কে। তারা তাদের প্রত্যেক কারখানাতেই ইটিপি স্থাপন করে বর্জ্য পরিশোধনের মাধ্যমে জলাভূমিগুলোতে ফেলতে পারে। এতে করে তাদের কলকারখানার উৎপাদনের জন্য সৃষ্ট বর্জ্যগুলো পরিশোধনের ফলে তা অনেকটাই কম দূষণ করবে। বিদেশি বিনিয়োগও অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে, যা পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি সৃষ্টির সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
তরল বর্জ্য আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পরিবেশের জন্য প্রধান হুমকিস্বরূপ। আইএসও ১৪০০১ অনুসারে প্রতিটি শিল্প-কারখানায় ইটিপি স্থাপন করা বাধ্যতামূলক। বাস্তবিক ক্ষেত্রে শিল্প মালিকরা ইটিপি চালাচ্ছেন কি? ইটিপি চালালে বংশী, ধলেশ্বরী, তুরাগ, বুড়িগঙ্গা আর বালু নদীর পানির ঢ়ঐ-এর মান ১০ কী করে হয় (শুষ্ক সময়ে)? যেখানে নিরপেক্ষ পানির ঢ়ঐ-এর মান ৭। এ ছাড়াও পানির অন্যান্য বৈশিষ্ট্যও গ্রহণযোগ্য সীমার থেকে অনেক বেশি পার্থক্য দেখা যায়। এ পানি কোনো প্রকার ব্যবহারের জন্যই উপযোগী নয়, যা জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য অসহনীয়। শিল্প মালিকদের ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য আমরা দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পরিশ্রম করে যাচ্ছি, যা আমাদের পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সহায়ক হবে এবং আমাদের গর্বের কারণে পরিণত হতে পারে। পানির সঙ্গে মিশ্রিত দূষিত পদার্থ ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে। আমাদের দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে পানি ও খাদ্যদ্রব্য দূষণের ফলে। দেশীয় প্রযুক্তিই পারে পরিবেশবান্ধব শিল্পোন্নয়ন।
বিশ্বব্যাংক ও ইউজিসির সহযোগিতায় উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের (ঐঊছঊচ) আওতায় আমি ও আমার গবেষক দল কীভাবে দেশীয় সামগ্রী ব্যবহার করে স্বল্প ব্যয়ে বর্জ্য পরিশোধন করা যায় তার গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। মূলত বিভিন্ন কলকারখানা মালিকদের ইটিপি ব্যবহারে উৎসাহী করতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা। যাতে করে অল্প খরচে দেশীয় সামগ্রী ব্যবহার করে তারা খুব সহজেই তাদের ইফ্লুয়েন্ট অর্থাৎ তরল বর্জ্য পরিশোধন করতে পারেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম শিকার বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিক থেকে। জার্মানিসহ বেশকিছু উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা এ ক্ষেত্রে সহায়তা করছে বাংলাদেশকে। আর সরকারও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহারে গ্রহণ করছে বেশকিছু কর্মসূচি। বিশেষ করে জৈব গ্যাস এবং সৌরশক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি জ্বালানি সাশ্রয়ে উদ্বুদ্ধ করছে সারাদেশের মানুষকে। এমনকি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাতি বিতরণ করা হয়েছে জনগণের মধ্যে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করেছে। এর আওতায় যেমন বিভিন্ন ব্যাংক অফিস নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে নিজেদের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে পারছে, তেমনি করে টেকসই অর্থনীতি গঠনেও অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে। মূলত গ্রিন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ার প্রথম ধাপই এই কার্যক্রমগুলো। তা ছাড়া সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপকে কার্যকর করতে পারলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন সম্ভব।
আমাদের শহরকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনে দিনের পর দিন আরও একটি সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে আর তা হলো, ময়লা-আবর্জনার সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার অভাব। পরিবারবর্গের কঠিন বর্জ্য নাগরিক জীবনে অপরিসীম কষ্টের ও পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। বর্তমানে ঢাকা শহরের বর্জ্য জাইকার অনুদানের গাড়ির মাধ্যমে বলিয়ারপুরের ইটভাটার কাছে ফেলা হচ্ছে, যা একসময় ছিল ধানি জমি। যেহেতু ধানি জমি দখলের কথা এলো সে কারণে এ ব্যাপারে একটু আলোকপাত করছি। বাংলাদেশের মানুষ কৃষি উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল এবং কৃষিজমিগুলো পাল্লা দিয়ে দখল করছেন বিভিন্ন শিল্প মালিক ও হাউজিং সোসাইটি। নিকট ভবিষ্যতে এ বিশাল জনগোষ্ঠী কী খাবে সেদিকে কারও কোনো দৃষ্টি আছে বলে মনে হয় না। পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের মাধ্যমে এ ধানি জমিগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন।
কঠিন বর্জ্য ডাম্পিংয়ের কথা লিখছিলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে বর্জ্য ফেলা হয় কিন্তু তার ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ এই ময়লা-আবর্জনাই হতে পারে আমাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস আর জৈবসারের অন্যতম উৎস। ময়লা-আবর্জনা পচে বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাসের সৃষ্টি করে, যা ভূমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। তাই সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা যেমন সহজেই এই মিথেন গ্যাস ব্যবহার করতে পারি নিজেদের জ্বালানির উৎস হিসেবে, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ও জলবায়ুর ওপর এই গ্যাসের বিরূপ প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। ইতিমধ্যে জাপানের জাইকা ও গ্রামীণ শক্তির সহযোগিতায় আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যার ফলে পচনশীল কঠিন বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বেশকিছু বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কোনো একক পরিবেশের উন্নয়ন নয়। প্রতিটি স্তরের প্রতিটি ক্ষেত্রের সামগ্রিক উন্নয়নের সেতুবন্ধ অতি জরুরি। তাই পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের মধ্যে সামষ্টিক উন্নয়ন। তবেই টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব হবে।

স অধ্যাপক ড. মোঃ খবির উদ্দীন : পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, জাবি ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ বিজ্ঞানী সমিতি
 

No comments

Powered by Blogger.