সময়চিত্র-সংবিধান সংশোধন: কিছু প্রশ্ন, কিছু ভিন্নমত by আসিফ নজরুল

সংবিধানের বিচিত্র ব্যাখ্যা বাংলাদেশে নতুন নয়। ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন ও ২০০৬-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে সংবিধানের ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা দেওয়ার বহু নজির রয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের পরও এই রায় ও সংবিধান সংশোধনী নিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা চলছে দেশে।


কেউ কেউ বলছেন, পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের পর সংবিধান আপনাআপনি সংশোধন হয়ে গেছে। আপনাআপনি সংশোধিত হয়ে গেলে নতুন করে সংবিধান সংশোধনী কমিটির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এ ধরনের একটি কমিটি ইতিমধ্যে গঠিত হয়েছে এবং তা আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য করা হয়েছে এমন কথাও বলা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, রায়ের পর আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গেছি। কিন্তু তাহলে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে করা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংশোধনীগুলোর কী হবে, সেটি তাঁরা ব্যাখ্যা করছেন না। এ বিষয়ে কিছু গোলমাল আছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্যেও। রায়ের একটি তালিকায় ‘অরিজিনাল কনস্টিটিউশন’ শিরোনামে ১৪২ অনুচ্ছেদের যে বর্ণনা আছে, তা আসলে অরিজিনাল বা ১৯৭২ সালের সংবিধানের নয়, দ্বিতীয় সংশোধনী-পরবর্তী সংবিধানের বিধান। এখন এ ক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে ফিরে যাওয়া বলতে আমরা কী বুঝব?
সংবিধান সংশোধনী-সংক্রান্ত রায়টি নিয়ে উচ্ছ্বাসের আতিশয্যও আছে দেশে। এমন অভিমত ব্যক্ত করা হচ্ছে যে এই রায়ের ফলে সামরিক শাসকদের ক্ষমতারোহণের পথ চিরতরে বন্ধ হয়েছে। সামরিক শাসনের সুযোগ আসলে বন্ধ করতে পারে প্রকৃত গণতন্ত্রচর্চা, সংবিধানের কঠোরতম কোনো বিধানও নয়। প্রতিবেশী ভারত আর পাকিস্তানে এর বহু উদাহরণ রয়েছে।
সংবিধান নিয়ে সবচেয়ে তুঘলকি ব্যাখ্যা চলছে ধর্মনিরপেক্ষতা ইস্যুতে। আদালতের রায়ে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এমন কথা বলা হচ্ছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন যে, এ কারণে নাকি ইতিমধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে গেছে! তাঁদের বক্তব্য, সরকার বা নির্বাচন কমিশন এ রকম একটি ঘোষণা দিয়ে দিলেই হলো এখন।
সংবিধান সংশোধনী এবং এর ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যার বহু মাশুল জাতিকে পোহাতে হয়েছে অতীতে। মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে, মানুষের বিভ্রান্তিকে বিভিন্ন মহল তাদের নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এমনকি বিভ্রান্তকারীরা বিভিন্ন অসাধু সুযোগও ভোগ করেছে। এখন ভুল যত কম হয়, ভালো। ভুল কম হওয়া সম্ভব কেবল স্বাধীনভাবে মতৈক্য বা ভিন্নমত প্রকাশের মাধ্যমে। আমি এখানে মূলত ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগটি নিচ্ছি কিছু ক্ষেত্রে।

২.
আমার প্রথম বক্তব্য হচ্ছে, উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া সংসদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। সংবিধান বা আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে আদালতের চেয়ে সংসদ বরং অনেক বেশি ক্ষমতাশীল। এর একটি বহুল পরিচিত প্রমাণ হচ্ছে, ভারতে শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় অকার্যকর করার জন্য ভারতীয় সংসদ কর্তৃক মুসলিম ওমেনস (প্রোটেকশন অব রাইট অন ডিভোর্সে) অ্যাক্ট বা আইন প্রণয়ন। ভারতের অতি যোগ্য এবং প্রাজ্ঞ বিচারকেরা পর্যন্ত তাঁদের রায় বাতিল করা এই আইনকে অবৈধ ঘোষণা করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ভারতের মতো বাংলাদেশ সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদও আদালতের রায় অনুসারে সংবিধান সংশোধনের বাধ্যবাধকতা সংসদের ওপর আরোপ করেনি। সংবিধান সংশোধনের জন্য রায়ের দোহাই দেওয়ার কোনো প্রয়োজন তাই নেই।
আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান পরিবর্তন করতে হচ্ছে, এ ধরনের বক্তব্য বরং মানুষকে সন্দিহান করে তুলতে পারে। অতীতে বাংলাদেশের সরকারগুলো স্থানীয় শাসন, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার, পুলিশ রিমান্ড, নির্বাচনে প্রার্থীর তথ্য প্রকাশসংক্রান্তসহ সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় পুরোপুরি বা অনেকাংশে অগ্রাহ্য করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো একাধিকবার সংবিধান লঙ্ঘনে (যেমন ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন কর্তৃক নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ২০০৭ সালে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন) অংশগ্রহণ পর্যন্ত করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক সরকারের এই বক্তব্য কতটা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাবশত, কতটা নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে তা নিয়ে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক।
পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে কিছু বিষয়ে আদালতের ভূমিকা নিয়েও ইতিমধ্যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সংবিধান উচ্চ আদালতকে সংবিধান-পরিপন্থী কোনো আইন বা সংবিধান সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করার ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু অবৈধ ঘোষিত সংশোধনীগুলোর শ্রেণীবিন্যাস করে কোনগুলো সংবিধানে থাকবে, কোনগুলো বাতিল হবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সংবিধান উচ্চ আদালতকে কোথায় দিয়েছে তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা এমনকি উল্লিখিত রায়ের মধ্যেও নেই। সুপ্রিম কোর্টের এ ধরনের একটি রায় আপনাআপনি সংবিধান সংশোধন করে ফেলেছে যাঁরা বলছেন, তাঁদের বোঝা উচিত যদি তা-ই হয় তাহলে সংবিধান কিছু ক্ষেত্রে হাস্যকর একটি দলিলে পরিণত হয়েছে। যেমন, সুপ্রিম কোর্টের রায় আপনাআপনি সংবিধান সংশোধন করে ফেললে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষতাও রয়েছে, আবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও রয়েছে!
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে একটি বৈধ সংশোধনীর (চতুর্থ) সঙ্গে অবৈধ সংশোধনীর (পঞ্চম সংশোধনী) সংঘাতপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে অবৈধ সংশোধনীটির বিধানগুলোকে রেখে দেওয়া হয়েছে। এতে একদলীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার ভীতি থেকে অন্তত জাতি রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এই রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনার যে কথা বলা হয়েছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকার কারণে তার নিরসন সরকারের জন্য সহজ হবে না। তা ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ—এ ধরনের দাবি দেশের কিছু মহল থেকে যেভাবে করা হচ্ছে, তা দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এর বিশদ বিশ্লেষণ এ মূহূর্তে তাই জরুরি হয়ে পড়েছে।

৩.
সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্থান দেওয়া হয়। সে সময় দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এমনকি ভারতেও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত ছিল না (ভারতে ১৯৭৬ সালে এটি করা হয়)। তখন এবং পরে বরং পাকিস্তান, নেপাল ও মালদ্বীপে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে কোনো না কোনো ধর্মকে স্থান দেওয়া হয়। এমনকি শিক্ষিত ও অগ্রসর জনগোষ্ঠীর দেশ শ্রীলঙ্কার সংবিধানে বৌদ্ধধর্মকে প্যারামাউন্ট প্লেস বা সর্বোচ্চ অবস্থান দেওয়া হয়।
১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ একটি কারণে আকস্মিকও মনে হতে পারে। কারণটি হচ্ছে, ইতিপূর্বে এ অঞ্চলের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলিল, ভাষণ বা নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর (যেমন: ছয় দফা, ১৯৭০ নির্বাচন-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র) কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়নি। ১০ এপ্রিল ১৯৭১-এর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সার্বভৌম রাষ্ট্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো উল্লেখ সেখানে ছিল না।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে মূল্যবান রাজনৈতিক দলিল। এর সঙ্গে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বর্ণিত অন্তত তিনটি মূলনীতির সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন: ঘোষণাপত্রের প্রস্তাবনায় জনগণের ম্যান্ডেট, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সার্বভৌমত্বের উল্লেখ যথাক্রমে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদের ইঙ্গিতবাহী বলা যায়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে এ ধরনের কোনো যোগসূত্রও ছিল না স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের।
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ তাই আকস্মিক হতে পারে, কিন্তু তা এক অর্থে অযৌক্তিক ছিল না। একাত্তরের নয় মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তার এ দেশীয় দোসররা বাংলাদেশে জনগণের ওপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে শুধু পাকিস্তান নয়, ধর্মরক্ষার নামেও। মুক্তিযোদ্ধাদের ইসলামের শত্রু, কাফের বা হিন্দু আখ্যায়িত করে এ সময় ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় সরকারনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে। এই স্মৃতি এতই দগদগে ছিল যে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকারের বিরোধিতা করেনি কোনো রাজনৈতিক মহল (যদিও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন সংবিধান প্রণয়ন কমিটি এ বিষয়ে ব্যাপকভিত্তিক কোনো মতবিনিময় করেনি তখন)।
ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ করেই ১৯৭২ সালের সংবিধান থেমে যায়নি। এর ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য ক. সাম্প্রদায়িকতা, খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান গ. রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মের অপব্যবহার এবং ঘ. ধর্মভিত্তিক বৈষম্য ও নিপীড়নের বিলোপ করা হবে বলা হয়। ৩৮ অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন কোনো সামপ্রদায়িক বা ধর্মভিত্তিক ‘সমিতি বা সংঘ’ করার অধিকার কারও নেই এটিও বলা হয়।
১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ এবং ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। কিন্তু ১২ অনুচ্ছেদ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ‘অপব্যবহারের’ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ধর্মের ‘ব্যবহারের’ ক্ষেত্রে নয়। ১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে ধর্মের অপব্যবহারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্মভিত্তিক অপতৎপরতা নিয়ন্ত্রণ এমনকি নিষিদ্ধ করা সম্ভব সরকারের পক্ষে, তা করা উচিত বলেও আমি মনে করি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ১২ অনুচ্ছেদ নিজে নিজে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকেই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে বা এটি করা উচিত। একই কথা প্রযোজ্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে। এই অনুচ্ছেদে খতমে নবুয়ত বা হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের মতো সমিতি বা সংঘের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে নয়। কারণ, ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে স্বতন্ত্র কোনো ‘অধিসংঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি’ হিসেবে, সমিতি বা সংঘ হিসেবে নয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে থাকলেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাতিল হয়ে যায় না। ধর্মনিরপেক্ষতার সূতিকাগার বলে পরিচিত ইউরোপের অধিকাংশ দেশে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক (বা সোশ্যালিস্ট) পার্টি, লিগ বা ইউনিয়ন ধরনের বহু রাজনৈতিক দল রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে রয়েছে আরএসএসের মতো ধর্মভিত্তিক সংগঠন এবং একই সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল, মুসলিম লীগ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মতো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল।
ধর্মভিত্তিক সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দল আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার তাই বলে এক নয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগবিরোধী অনেক রাজনৈতিক মহল, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ধর্মের অপব্যবহার করেছে এ ধরনের বহু নজির রয়েছে। অমুককে ভোট দিলে কাফের হয়ে যাবেন বা অমুক দল ক্ষমতায় গেলে দেশে ইসলাম থাকবে না—এ ধরনের অপতৎপরতা বন্ধের জন্য কঠোর আইন সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের আলোকে অবশ্যই করা উচিত। দেশে দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় অন্য ধর্মের প্রতি যেকোনো আক্রমণাত্মক বা অবমাননাকর তৎপরতার জন্য শাস্তির বিধানও ইতিমধ্যে রয়েছে। এই আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করেও দেশে সব ধর্মীয় সমপ্রদায়ের স্বার্থ তথা ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন নেই, উন্নত বিশ্বে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহে এর কোনো নজির নেই, আমাদের ’৭২ সালের সংবিধানেও তা চাওয়া হয়নি।

৪.
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপন জরুরি। কিন্তু এর চেয়ে বেশি জরুরি গণতন্ত্র ও সুশাসনের সম্ভাবনা সুশক্তকরণ। সরকার যদি এসব লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করতে চায়, তাহলে কী করতে হবে তা নিয়ে বহু আলোচনা ইতিমধ্যে দেশে হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শক্তিশালীকরণ, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের আলোকে সরকারের দায়দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণ—এ ধরনের বিষয়ে সমাজে ব্যাপকভিত্তিক মতৈক্যও রয়েছে। ১৯৭২ সালের মূল চেতনাকে সরকার অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে পারে সংবিধানে। তবে সংশোধনীর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এসব মতৈক্যের ভিত্তিতে আরও গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক একটি ভবিষ্যৎমুখী সংবিধান প্রণয়ন।
অতীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে বিনষ্ট করার জন্য অথবা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। সামরিক শাসকেরাও এটি করেছেন, গণতান্ত্রিক শাসকেরাও একই কাজ করেছেন। এবার যেন কোনোভাবেই এটি না করা হয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.