দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক-প্রণব মুখার্জির ঝটিকা সফর by সোহরাব হাসান

ভারতের অর্থমন্ত্রী বাঙালি সন্তান প্রণব মুখার্জি অনেক ব্যস্ততা সত্ত্বেও চার ঘণ্টার ঝটিকা সফরে যে আজ ঢাকায় আসছেন, তা দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের বাধাগুলো দূর করতে ত্বরিত প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে কি না, তা আগেভাগে বলা কঠিন।


তাঁর এ সফরের উদ্দেশ্য যদি হয় ভারতের প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তা চুক্তি সই, তাহলে বলব, প্রণব মুখার্জিকে বহনকারী বিমানের তেল খরচটাই জলে গেল। কেননা এ ধরনের চুক্তি সইয়ের জন্য অত বড় দেশের অত বড় অর্থমন্ত্রীর আসার প্রয়োজন নেই। কাজটি মধ্যম মানের আমলারাই করতে পারেন।
কূটনৈতিক সূত্রে যেসব খবর পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয়, তাঁর এ সফর নিছক চুক্তি সইয়ের আনুষ্ঠানিকতা নয়। আট মাস আগে দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেসব চুক্তি সই করেছিলেন এবং যেসব বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছিলেন, তার বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া কোন পর্যায়ে আছে, সেটি পর্যালোচনা করতেই প্রণব মুখার্জি ঢাকায় আসছেন। কূটনৈতিক মহল মনে করেন, চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার ঘাটতি না থাকলেও বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি প্রতিশ্রুতি পালনে বরাবর ঔদাসীন্য দেখিয়ে আসছে। ভারতের উৎকণ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তার অবসানে যা যা করার সবই করেছে ঢাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশের উদ্বেগকে দিল্লি কতটা আমলে নিয়েছে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
বাংলাদেশের প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া, পর্বতপ্রমাণ বাণিজ্য ঘাটতি এবং সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিরীহ মানুষ মারা যাওয়া। আর ভারতের উদ্বেগ হলো জঙ্গি হানা ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা। দিল্লি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সেটি যে শুধু কথার কথা ছিল না, তা সাউথ ব্লকের চৌকস অধিকর্তারাও স্বীকার করবেন। বিনিময়ে তাঁরা কী দিয়েছেন? ভারত বাংলাদেশের অবকাঠামোর উন্নয়নে যে ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিচ্ছে, তার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো এবং পণ্য পরিবহনের কাজে। তাতে দুই দেশই লাভবান হবে।
যদিও কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত পণ্য পরিবহনের সুবিধা পেলে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি কমে যাবে। বাণিজ্য-ঘাটতি আরও বাড়বে। নয়াদিল্লির দাবি, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হলে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। কীভাবে? সে ক্ষেত্রে ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে, দূর করতে হবে শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো। প্রশ্ন হলো, ভারত সরকার সেই ‘সহজ কাজ’টি করতে রাজি আছে কি না। এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। সে দেশের সাবেক ও বর্তমান মিলে অন্তত তিনজন প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্য বৈষম্য কমানোর মৌখিক ও লিখিত আশ্বাসও কার্যকর হয়নি। ড. মনমোহন সিংয়ের প্রথম মেয়াদে ভারত যে বাংলাদেশ থেকে ৮৫ লাখ পিস তৈরি পোশাক আমদানির ওয়াদা করেছিল, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। এটি কি শুধুই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নাকি সদিচ্ছার অভাব?
ভারতে পাঠানোর মতো খুব বেশি পণ্য আমাদের নেই। কিন্তু যেসব বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা সেখানকার বাজারে আছে, তাও পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না শুল্ক ও অশুল্ক বাধার কারণে। বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান গত বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে ব্যবসা করার কাজটি বেশ কঠিন।’ কেন কঠিন? কেন্দ্রীয় সরকার রাজি তো, রাজ্য সরকার আপত্তি জানায়। আবার রাজ্য সরকার চাইলেও পারে না, দিল্লির অনুমোদনের অপেক্ষায় তাদের থাকতে হয়। পণ্যের মান পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ৪০ থেকে ৫০ দিন। এসবের অর্থ হলো ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রবেশ বন্ধ করা।
প্রণব মুখার্জি একসময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে ছিলেন। তিনিও সমস্যাগুলো জানেন। বাধাটি আইনি হলে দূর করা অসম্ভব নয়, কিন্তু মনের বাধা কখনো দূর করা যায় না।
বিরোধী দলের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী দিল্লি গিয়েছিলেন দুই দেশের অমীমাংসিত বকেয়া সমস্যাগুলো সমাধান করার আশায়। ধারণা করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরপরই তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের চুক্তিটি সম্পন্ন হবে। হয়নি। বাংলাদেশ আশা করেছিল, বিএসএফ সংযত আচরণ করবে। করেনি।
এত দিন শুনে এসেছি, ভারতের সঙ্গে যেকোনো চুক্তি বা সমঝোতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ইস্যু করা হয়। ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস চালু কিংবা গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির সময় ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত ছিল। এখন শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টিও নাকি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামনে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। এ সময় রাজ্য সরকার তিস্তা চুক্তিতে সম্মতি দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাইছে না। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রত্যাশী, কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও ‘বাংলাদেশের বন্ধুত্বে’র বিনিময়ে বামফ্রন্ট সরকারকে ছাড় দিতে নারাজ।
এ অবস্থায় কি তিস্তা সমস্যাটি অনন্তকাল ঝুলে থাকবে? বলা হচ্ছে, মমতা ব্যানার্জির দল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যদি না আসে? তখন যদি বামফ্রন্ট এর বিরোধিতা করে?
এভাবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় করা হয়েছে দহগ্রাম-আঙ্গুরপোতাও। ১৯৭২ সালের চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ বেরুবাড়ী ছেড়ে দিলেও তিন বিঘা করিডরে স্থায়ী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এর জবাব কী?
সোনিয়া গান্ধী ও ড. মনমোহন সিংয়ের পর দিল্লির দরবারে প্রণব মুখার্জিই ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি কি পারবেন বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা মিটিয়ে, যৌক্তিক উদ্বেগগুলো আমলে নিয়ে দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কে নব-অধ্যায় সৃষ্টি করতে? না তাঁর ঝটিকা সফরও সময়ের ব্যবধানে আশ্বাসের কুজ্ঝটিকায় পরিণত হবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.