যুক্তি তর্ক গল্প-তরুণদের জাগরণের আওয়াজ পাওয়া যায় by আবুল মোমেন
একাত্তর বাঙালির জীবনে একটি বড় অর্জন। সেই অর্জনকে ঘিরে জাতীয় ইতিহাসে টানা যায় একটি বিভাজন-রেখা। এর আগের সঙ্গে পরের ইতিহাসে যেন অনেক গুণগত পার্থক্য ঘটে গেছে। এ অনেকটা ফরাসি বিপ্লবের মতো, যা বিশ্ব পটভূমিতে আরও বড় আঙ্গিকে ঘটেছে। কথাটা একটু ভেঙে বলা দরকার।
ফরাসি বিপ্লব সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী ধারণ করে অনেক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়েছিল। বিপ্লবের প্রাথমিক সাফল্য চমকপ্রদ হলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। রাজতন্ত্র আবার ফিরে এসেছিল। পরে দেখা গেল, যতই দিন গেছে ততই ফরাসি বিপ্লবের নানামুখী তাৎপর্য ইউরোপের রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা এবং সমাজমানসে প্রতিফলিত হতে শুরু করে। পরে ইউরোপের ঔপনিবেশিক অভিযাত্রার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। বিপ্লবীরা নাগরিক অধিকারের ঘোষণা দিয়েছিল। তা তখনই বাস্তবায়িত হয়নি বটে কিন্তু এ বিপ্লবের পথ ধরে ফ্রান্স এবং পরে ইংল্যান্ড ও পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশে রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের অবসান হয়ে গণতন্ত্রের যুগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ব্যক্তির সমানাধিকার এবং গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকল, যা সামন্ত সংস্কৃতিকে বিতাড়িত করে আধুনিক গণতান্ত্রিক নাগরিক সংস্কৃতির জন্ম দিল।
দূর থেকে আজ বিচার করলে দেখি সাহিত্যের ইতিহাসেও ফরাসি বিপ্লব একটি বিভাজন-রেখা টেনেছে। বিপ্লবের আগে সাধারণ মানুষ, সমাজের অভাজনের পক্ষে সাহিত্যের নায়ক হওয়া সম্ভব ছিল না। সাধারণত নায়কেরা হতেন রাজপুরুষ, জমিদার, যাজক বা এমনি সব মানুষ। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের পরের সাহিত্যে দেখি সাধারণ মানুষও নায়কের ভূমিকায় অঙ্কিত হচ্ছেন। ভিক্টর উগোর লে মিজারেবল-এর নায়ক জাঁ ভালজাঁ রুটি চুরির এবং জেল পালানোর দায়ে কুড়ি বছর জেল খাটা দাগি আসামি। তাঁরই হাঞ্চব্যাক অব নোতরদাম উপন্যাসে এক কুঁজো দরিদ্রকে পাই নায়কের ভূমিকায়, এমিল জোলা লিখলেন এক গণিকাকে নায়িকা করে উপন্যাস নানা। এদিকে ইংল্যান্ডে ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখতে থাকলেন সাধারণ ঘরের বালিকা, কর্মজীবী মানুষদের নিয়ে কবিতা। এভাবে সাধারণের এবং ব্যক্তির স্বীকৃতি, এবং ব্যাপক মানুষের জাগরণ সমাজে ও সমাজমানসে বিরাট গুণগত পরিবর্তন এনেছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির চিরকালের অভ্যস্ত জীবন তছনছ করে দিয়েছিল। ঘরকুনো আড্ডাবাজ বাঙালি তরুণদের যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে এনেছিল। এ কথা সত্যি, সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক অত্যাচারের ফলে নিশ্চিন্ত ঘরোয়াজীবনে ভরসা রাখতে পারেনি। কি তরুণ কি বৃদ্ধ, কি নারী কি পুরুষ কোনো বাঙালিই। তরুণেরা ঝুঁকি নিতে শিখেছে তখন। সবচেয়ে বড় কথা, জুলুমবাজ বা অন্যায়কারী যত বড় ও শক্তিশালীই হোক তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতে সে আর দ্বিধা করে না, ভয় পায় না। বাংলাদেশের তরুণসমাজ বারবার এটা করে দেখিয়েছে।
আমার মনে হয়, একাত্তরের তাৎপর্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে— বিভ্রান্তির কুয়াশা কি বিতর্কের ধূম্রমেঘ ছিন্ন করে একাত্তরের সূর্য ক্রমেই ভাস্বর হয়ে উঠেছে। একাত্তরের আগের সমাজ ও সমাজমানস ছিল প্রাচীন, প্রথাবদ্ধ, অনেককালের ঘুমিয়ে পড়া জড়তাক্লিষ্ট এক তামাদি সমাজ। তবে হ্যাঁ, পাঁচের দশক থেকে জাগরণের ঢেউ লাগতে শুরু করে, ষাটের দশকে যা শহরগুলোতে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে জোরালো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু একাত্তর যেন জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় সেই দ্বিধাগ্রস্ত জাতিকে এক ধাক্কায় জাগিয়ে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এনে ফেলেছে, তাকে তারুণ্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে, সচল ও সফল হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে।
দূর থেকে বিচার করলে দেখব কীভাবে এ তারুণ্যের মেজাজ জাতি গ্রহণ করেছে। খুব সাদামাটা দৃশ্যত সাধারণ একটা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করব, যার তাৎপর্য গভীর বলেই আমার বিশ্বাস। একাত্তর-পূর্ব বাস্তবতা ছিল বাঙালি পুরুষের পোশাক হতো প্রায়শ সাদা। আমার ছেলেবেলার স্মৃতি হলো—পথচারীদের প্রতি-দশজনের মধ্যে নয়জনের পোশাক সাদা, বাসার সামনের মাঠে ধোপারা দড়ি টানিয়ে শুকানোর জন্য উল্টো করে ঝুলিয়ে দিত যেসব শার্ট তারও দশটার মধ্যে নয়টা সাদা, আর দূরে স্টেডিয়ামে গ্যালারি ভরা ফুটবল দর্শকেরা মিলে যেন সাদা জলাশয়ে কালো ফুল (মাথা) ফোটাত। এমনকি সেকালে শিশুদের পোশাকের বেলায়ও বড়দের রুচির শাসন চলত, ঈদে-উৎসবেও বড়জোর সোবার কালার অর্থাৎ আকাশি নীল, ফিকে সবুজ, হালকা গোলাপি, বাদামি, হালকা হলুদ ইত্যাদি রঙের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত আমাদের পোশাক। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে পোশাকের রং উজ্জ্বল ও গাঢ় হতে থাকে। একাত্তর আমাদের মনের যে জড়তা ও স্থবিরতা কাটিয়েছে পোশাকে যেন তার প্রতিফলন ঘটতে থাকল। আজ ৮৮ বছরের জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লাল রঙের ফতুয়া পরে বা সম্মানীয় বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান উজ্জ্বল রঙের সিল্ক শার্ট পরে বাইরে অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন।
পঁচাত্তরের পরে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের চেতনাকে কবর দেওয়ার, বাংলাদেশের উল্টোযাত্রার চেষ্টা শুরু হয়েছে। নব্বই পর্যন্ত ১৫ বছরের সামরিক শাসনে এটাই চলেছে, এমনকি গণতন্ত্রের, বহুদলীয় গণতন্ত্রের, ছদ্মবেশেও এ কাজই চলেছে।
কিন্তু একাত্তরের বীজ এত বন্ধ্যা নয়, তার প্রভাব সমাজে নানাভাবেই পড়েছে, সেই দুর্দিনেও একটি অংশ সমাজকে অন্যায় জবরদস্তি মেনে নিতে দেয়নি, তাকে ঘুমিয়ে পড়তে দেয়নি, চাপিয়ে দেওয়া অসত্য ইতিহাস বা ব্যবস্থা কোনোটাই মানতে দেয়নি। বাঙালির তারুণ্য, জাগরণ, সাহস, সৃজনশীলতা কেউ মারতে পারেনি। তার মনে যে রং লেগেছিল তা চাপা পড়েনি।
অনেকেই খেয়াল করেছেন, পঁচাত্তরের পর থেকে প্রায় তিন দশক যেন বিভ্রান্তিতে কেটেছে, সর্বত্র দিশাহীনতা চলেছে এবং নানাভাবে দূষণ ঘটেছে সমাজে। মনে হচ্ছিল তারুণ্যে পচন লেগেছে, অবক্ষয় এত গাঢ় হয়েছে যা ঠেকানো যাবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক আমলের দুই বছরের শাসনের সময় থেকে বাংলাদেশের তরুণসমাজের মধ্যে আবারও জাগরণের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। এর বিশ্লেষণ করে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। তবে দীর্ঘ বিশ্লেষণের সুযোগ এখানে নেই বলে ব্যাখ্যাটাই তুলে ধরা যায়। ভুল কিছু হতে পারে, কিন্তু জনমানসে আইনের শাসনের প্রতি আস্থা, রাষ্ট্র ও শাসকদের নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে গৌরববোধ ফিরে আসতে শুরু করে এই সময়েই। ফলে তার পরপর যে নির্বাচন হলো তাতে একাত্তরের চেতনার প্রতি তরুণদের একাত্মতার আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে উন্মুখ এ তরুণেরা যেন এই প্রথম উপলব্ধি করল কেবল ব্যক্তিগত সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়ে কাজ হবে না, তাদের সরাসরি ভূমিকা নিতে হবে। এই একই স্পৃহা থেকে ছাত্র-তরুণেরা বর্তমান ধারার ছাত্ররাজনীতির প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করে না। তারা ছাত্ররাজনীতির নামে ভোগদখলের রাজনীতি, মানবিক বিকাশবিমুখ ধর্মান্ধতার রাজনীতি কিংবা স্থবির ও তামাদি হয়ে পড়া নীতিবাগিশ রাজনীতির মধ্যে অর্জন-অবদানের কোনো পথ দেখতে পায় না। তারা নানা রকম সৃজনশীল কাজে যুক্ত হচ্ছে এখন। সবচেয়ে বড় কথা, তারা একাত্তরের চেতনায় আস্থা রেখেছে। সেই চেতনার সূত্র ধরেই তারা এবার আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি চায়।
আমরা লক্ষ করি, সমাজে বিরাজমান ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার এবং নানা রকম বৈষম্য তারা মানতে পারছে না। এনজিওর মধ্যে অনেক সমস্যা থাকলেও লক্ষ করি এর বিপুল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তরুণদের একটা বড় অংশ সমাজের সব অভ্যস্ত গণ্ডি ভেঙে দরিদ্র, অভাজন, নিপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। নয়তো ভাবা যায় মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা গণিকাদের (যাদের ওরা যৌনকর্মী বলছে) নিয়ে কাজ করছে। এইডস রোগী, হিজড়া, এসিডদগ্ধ, ধর্ষিতা, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী—সবার পাশে দাঁড়ানোর মতো তরুণ-তরুণীর অভাব হচ্ছে না। পোশাক কারখানায় শোষণ আছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু তা যে লাখ লাখ তরুণকে স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বিতার স্বাদ দিয়েছে তা তো আর ফেরতযোগ্য নয়।
তরুণসমাজের আলাপচারিতায় কান পাতলে জাগরণের আলামত পাওয়া যায়। এটাও মনে হয় যে তারা শেখ হাসিনাকে নেত্রী হিসেবে পছন্দ করেছে, আস্থায় নিয়েছে। ফলে তাঁর দায়িত্ব অনেক। ইতিহাস একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাঁধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দায় চাপিয়েছিল। আজ সেই ইতিহাস সোনার বাংলা গড়ার দায় চাপিয়েছে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার ওপর।
এই তরুণসমাজের নেতৃত্ব ছাত্রলীগ দিতে পারবে না, যুবলীগও নয়। এমনকি গতানুগতিক ধারার রাজনীতিও পারবে না। বরং সাধারণ ছাত্রদের এই জায়মান জাগরণকে সম্পূর্ণতা দিতে ও সফল করতে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মতো সংগঠন কোনো অবদান রাখতে পারবে না। দুঃখের সঙ্গে বলব, বাম ছাত্রসংগঠনগুলোও স্থবিরতা ও সংকীর্ণতার কবলে পড়ে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। কিন্তু এ জাগরণের সুফলকে তো সম্পূর্ণতা দিতে হবে, তার ফসল তো জাতির পাওয়া দরকার। সেখানেই বলব, সরকার সামাজিক নেতৃত্বের সহযোগিতা নিয়ে দেশের কাজে ছাত্রদের যুক্ত করতে পারে। আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সৃজনশীল কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করে সুস্থ মানবিক সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে তোলা জরুরি। এখানে অর্থব্যয় করলে তা দেশের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করার কাজে লাগবে। সারা দেশে এভাবে কয়েকটি কর্মযজ্ঞ চালু করা যায়। যেমন : ক. সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা। খ. সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি। গ. সবার জন্য স্বাস্থ্য। ঘ. দেশজুড়ে মানবিক সাংস্কৃতিক জাগরণ।
এ চার জাতীয় মহাকর্মযজ্ঞে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজে লাগানো যায়। আর স্কুল-পর্যায়ে ছাত্ররা পড়াশোনা, সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কাজ আর এলাকাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা ও সেবার কাজে যুক্ত হতে পারে। এসব কাজ সরকারি পরিকল্পনা ও নির্দেশনার ভিত্তিতে স্কুলের পরিচালনায় হতে পারে।
এভাবে যে জাগরণের আলামত দেখা যাচ্ছে তা থেকে জাতি উপকৃত হবে এবং ভবিষ্যতে দেশপ্রেমিক যোগ্য নাগরিকের সেবা পাবে দেশ।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
দূর থেকে আজ বিচার করলে দেখি সাহিত্যের ইতিহাসেও ফরাসি বিপ্লব একটি বিভাজন-রেখা টেনেছে। বিপ্লবের আগে সাধারণ মানুষ, সমাজের অভাজনের পক্ষে সাহিত্যের নায়ক হওয়া সম্ভব ছিল না। সাধারণত নায়কেরা হতেন রাজপুরুষ, জমিদার, যাজক বা এমনি সব মানুষ। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের পরের সাহিত্যে দেখি সাধারণ মানুষও নায়কের ভূমিকায় অঙ্কিত হচ্ছেন। ভিক্টর উগোর লে মিজারেবল-এর নায়ক জাঁ ভালজাঁ রুটি চুরির এবং জেল পালানোর দায়ে কুড়ি বছর জেল খাটা দাগি আসামি। তাঁরই হাঞ্চব্যাক অব নোতরদাম উপন্যাসে এক কুঁজো দরিদ্রকে পাই নায়কের ভূমিকায়, এমিল জোলা লিখলেন এক গণিকাকে নায়িকা করে উপন্যাস নানা। এদিকে ইংল্যান্ডে ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখতে থাকলেন সাধারণ ঘরের বালিকা, কর্মজীবী মানুষদের নিয়ে কবিতা। এভাবে সাধারণের এবং ব্যক্তির স্বীকৃতি, এবং ব্যাপক মানুষের জাগরণ সমাজে ও সমাজমানসে বিরাট গুণগত পরিবর্তন এনেছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির চিরকালের অভ্যস্ত জীবন তছনছ করে দিয়েছিল। ঘরকুনো আড্ডাবাজ বাঙালি তরুণদের যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে এনেছিল। এ কথা সত্যি, সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক অত্যাচারের ফলে নিশ্চিন্ত ঘরোয়াজীবনে ভরসা রাখতে পারেনি। কি তরুণ কি বৃদ্ধ, কি নারী কি পুরুষ কোনো বাঙালিই। তরুণেরা ঝুঁকি নিতে শিখেছে তখন। সবচেয়ে বড় কথা, জুলুমবাজ বা অন্যায়কারী যত বড় ও শক্তিশালীই হোক তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতে সে আর দ্বিধা করে না, ভয় পায় না। বাংলাদেশের তরুণসমাজ বারবার এটা করে দেখিয়েছে।
আমার মনে হয়, একাত্তরের তাৎপর্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে— বিভ্রান্তির কুয়াশা কি বিতর্কের ধূম্রমেঘ ছিন্ন করে একাত্তরের সূর্য ক্রমেই ভাস্বর হয়ে উঠেছে। একাত্তরের আগের সমাজ ও সমাজমানস ছিল প্রাচীন, প্রথাবদ্ধ, অনেককালের ঘুমিয়ে পড়া জড়তাক্লিষ্ট এক তামাদি সমাজ। তবে হ্যাঁ, পাঁচের দশক থেকে জাগরণের ঢেউ লাগতে শুরু করে, ষাটের দশকে যা শহরগুলোতে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে জোরালো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু একাত্তর যেন জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় সেই দ্বিধাগ্রস্ত জাতিকে এক ধাক্কায় জাগিয়ে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এনে ফেলেছে, তাকে তারুণ্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে, সচল ও সফল হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে।
দূর থেকে বিচার করলে দেখব কীভাবে এ তারুণ্যের মেজাজ জাতি গ্রহণ করেছে। খুব সাদামাটা দৃশ্যত সাধারণ একটা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করব, যার তাৎপর্য গভীর বলেই আমার বিশ্বাস। একাত্তর-পূর্ব বাস্তবতা ছিল বাঙালি পুরুষের পোশাক হতো প্রায়শ সাদা। আমার ছেলেবেলার স্মৃতি হলো—পথচারীদের প্রতি-দশজনের মধ্যে নয়জনের পোশাক সাদা, বাসার সামনের মাঠে ধোপারা দড়ি টানিয়ে শুকানোর জন্য উল্টো করে ঝুলিয়ে দিত যেসব শার্ট তারও দশটার মধ্যে নয়টা সাদা, আর দূরে স্টেডিয়ামে গ্যালারি ভরা ফুটবল দর্শকেরা মিলে যেন সাদা জলাশয়ে কালো ফুল (মাথা) ফোটাত। এমনকি সেকালে শিশুদের পোশাকের বেলায়ও বড়দের রুচির শাসন চলত, ঈদে-উৎসবেও বড়জোর সোবার কালার অর্থাৎ আকাশি নীল, ফিকে সবুজ, হালকা গোলাপি, বাদামি, হালকা হলুদ ইত্যাদি রঙের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত আমাদের পোশাক। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে পোশাকের রং উজ্জ্বল ও গাঢ় হতে থাকে। একাত্তর আমাদের মনের যে জড়তা ও স্থবিরতা কাটিয়েছে পোশাকে যেন তার প্রতিফলন ঘটতে থাকল। আজ ৮৮ বছরের জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লাল রঙের ফতুয়া পরে বা সম্মানীয় বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান উজ্জ্বল রঙের সিল্ক শার্ট পরে বাইরে অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন।
পঁচাত্তরের পরে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের চেতনাকে কবর দেওয়ার, বাংলাদেশের উল্টোযাত্রার চেষ্টা শুরু হয়েছে। নব্বই পর্যন্ত ১৫ বছরের সামরিক শাসনে এটাই চলেছে, এমনকি গণতন্ত্রের, বহুদলীয় গণতন্ত্রের, ছদ্মবেশেও এ কাজই চলেছে।
কিন্তু একাত্তরের বীজ এত বন্ধ্যা নয়, তার প্রভাব সমাজে নানাভাবেই পড়েছে, সেই দুর্দিনেও একটি অংশ সমাজকে অন্যায় জবরদস্তি মেনে নিতে দেয়নি, তাকে ঘুমিয়ে পড়তে দেয়নি, চাপিয়ে দেওয়া অসত্য ইতিহাস বা ব্যবস্থা কোনোটাই মানতে দেয়নি। বাঙালির তারুণ্য, জাগরণ, সাহস, সৃজনশীলতা কেউ মারতে পারেনি। তার মনে যে রং লেগেছিল তা চাপা পড়েনি।
অনেকেই খেয়াল করেছেন, পঁচাত্তরের পর থেকে প্রায় তিন দশক যেন বিভ্রান্তিতে কেটেছে, সর্বত্র দিশাহীনতা চলেছে এবং নানাভাবে দূষণ ঘটেছে সমাজে। মনে হচ্ছিল তারুণ্যে পচন লেগেছে, অবক্ষয় এত গাঢ় হয়েছে যা ঠেকানো যাবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক আমলের দুই বছরের শাসনের সময় থেকে বাংলাদেশের তরুণসমাজের মধ্যে আবারও জাগরণের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। এর বিশ্লেষণ করে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। তবে দীর্ঘ বিশ্লেষণের সুযোগ এখানে নেই বলে ব্যাখ্যাটাই তুলে ধরা যায়। ভুল কিছু হতে পারে, কিন্তু জনমানসে আইনের শাসনের প্রতি আস্থা, রাষ্ট্র ও শাসকদের নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে গৌরববোধ ফিরে আসতে শুরু করে এই সময়েই। ফলে তার পরপর যে নির্বাচন হলো তাতে একাত্তরের চেতনার প্রতি তরুণদের একাত্মতার আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে উন্মুখ এ তরুণেরা যেন এই প্রথম উপলব্ধি করল কেবল ব্যক্তিগত সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়ে কাজ হবে না, তাদের সরাসরি ভূমিকা নিতে হবে। এই একই স্পৃহা থেকে ছাত্র-তরুণেরা বর্তমান ধারার ছাত্ররাজনীতির প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করে না। তারা ছাত্ররাজনীতির নামে ভোগদখলের রাজনীতি, মানবিক বিকাশবিমুখ ধর্মান্ধতার রাজনীতি কিংবা স্থবির ও তামাদি হয়ে পড়া নীতিবাগিশ রাজনীতির মধ্যে অর্জন-অবদানের কোনো পথ দেখতে পায় না। তারা নানা রকম সৃজনশীল কাজে যুক্ত হচ্ছে এখন। সবচেয়ে বড় কথা, তারা একাত্তরের চেতনায় আস্থা রেখেছে। সেই চেতনার সূত্র ধরেই তারা এবার আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি চায়।
আমরা লক্ষ করি, সমাজে বিরাজমান ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার এবং নানা রকম বৈষম্য তারা মানতে পারছে না। এনজিওর মধ্যে অনেক সমস্যা থাকলেও লক্ষ করি এর বিপুল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তরুণদের একটা বড় অংশ সমাজের সব অভ্যস্ত গণ্ডি ভেঙে দরিদ্র, অভাজন, নিপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। নয়তো ভাবা যায় মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা গণিকাদের (যাদের ওরা যৌনকর্মী বলছে) নিয়ে কাজ করছে। এইডস রোগী, হিজড়া, এসিডদগ্ধ, ধর্ষিতা, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী—সবার পাশে দাঁড়ানোর মতো তরুণ-তরুণীর অভাব হচ্ছে না। পোশাক কারখানায় শোষণ আছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু তা যে লাখ লাখ তরুণকে স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বিতার স্বাদ দিয়েছে তা তো আর ফেরতযোগ্য নয়।
তরুণসমাজের আলাপচারিতায় কান পাতলে জাগরণের আলামত পাওয়া যায়। এটাও মনে হয় যে তারা শেখ হাসিনাকে নেত্রী হিসেবে পছন্দ করেছে, আস্থায় নিয়েছে। ফলে তাঁর দায়িত্ব অনেক। ইতিহাস একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাঁধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দায় চাপিয়েছিল। আজ সেই ইতিহাস সোনার বাংলা গড়ার দায় চাপিয়েছে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার ওপর।
এই তরুণসমাজের নেতৃত্ব ছাত্রলীগ দিতে পারবে না, যুবলীগও নয়। এমনকি গতানুগতিক ধারার রাজনীতিও পারবে না। বরং সাধারণ ছাত্রদের এই জায়মান জাগরণকে সম্পূর্ণতা দিতে ও সফল করতে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মতো সংগঠন কোনো অবদান রাখতে পারবে না। দুঃখের সঙ্গে বলব, বাম ছাত্রসংগঠনগুলোও স্থবিরতা ও সংকীর্ণতার কবলে পড়ে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। কিন্তু এ জাগরণের সুফলকে তো সম্পূর্ণতা দিতে হবে, তার ফসল তো জাতির পাওয়া দরকার। সেখানেই বলব, সরকার সামাজিক নেতৃত্বের সহযোগিতা নিয়ে দেশের কাজে ছাত্রদের যুক্ত করতে পারে। আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সৃজনশীল কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করে সুস্থ মানবিক সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে তোলা জরুরি। এখানে অর্থব্যয় করলে তা দেশের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করার কাজে লাগবে। সারা দেশে এভাবে কয়েকটি কর্মযজ্ঞ চালু করা যায়। যেমন : ক. সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা। খ. সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি। গ. সবার জন্য স্বাস্থ্য। ঘ. দেশজুড়ে মানবিক সাংস্কৃতিক জাগরণ।
এ চার জাতীয় মহাকর্মযজ্ঞে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজে লাগানো যায়। আর স্কুল-পর্যায়ে ছাত্ররা পড়াশোনা, সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কাজ আর এলাকাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা ও সেবার কাজে যুক্ত হতে পারে। এসব কাজ সরকারি পরিকল্পনা ও নির্দেশনার ভিত্তিতে স্কুলের পরিচালনায় হতে পারে।
এভাবে যে জাগরণের আলামত দেখা যাচ্ছে তা থেকে জাতি উপকৃত হবে এবং ভবিষ্যতে দেশপ্রেমিক যোগ্য নাগরিকের সেবা পাবে দেশ।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments