সরল গরল-আপিল বিভাগের দায় by মিজানুর রহমান খান
বরিশালের পাঠক-কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলাম। দিনটি ছিল ২৭ মে ২০১০। প্রশ্নবাণ এল দুভাবে। প্রথমত, প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে উচ্চ আদালতের অতিরিক্ত বিচারকদের তৃতীয় বিভাগধারী বলে খাটো করা হয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো ব্যাপার নয়, পেশাগত যোগ্যতাই আসল।
দ্বিতীয় বাণটি তথ্যভিত্তিক। সৈয়দ দুলাল পেশায় আইনজীবী। তিনি ২৫ মে ২০১০ আমাদের সময়-এ প্রকাশিত আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমানের নিবন্ধের বরাত দিলেন। এর শিরোনাম ছিল, ‘বিচারক নিয়োগ নিয়ে মিথ্যাচার কেন?’ তিনি নির্দিষ্টভাবে এই লেখককে মিথ্যাচারের দায়ে অভিযুক্ত করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের সক্রিয় আইনজীবী। তাঁর অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়াই যৌক্তিক। আলোচিত ১০ বিচারক মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জনস্বার্থে মামলা করার ক্ষেত্রে তাঁর সুনাম আছে। তাঁর অভিযোগ হলো, আদালতের রায়ে যা নেই, আমি তা-ই লিখেছি।
৩১ জুলাই ২০১০। একটি আইনজীবী সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠান করছে। বিচারাঙ্গনের অনেক রথী-মহারথী তাতে আমন্ত্রিত। একটি দামি সংকলন বের করেছে তারা। এর নাম সাম্প্রতিক বিচারক নিয়োগ: তর্ক নয়, সত্যের কাছে যাবার চেষ্টা। ৮০ পৃষ্ঠার এই সংকলনের শুরুতেই দেখলাম, ওই নিবন্ধ পুনর্মুদ্রিত। এমনকি মূল প্রচ্ছদেও ঠাঁই পেয়েছে ওই নিবন্ধের আলোকচিত্র। সম্পাদকীয়তে প্রথম আলো সম্পর্কে অযাচিত বিদ্বেষ। জানা গেল, যাঁরা বিচারক হতে ইচ্ছুক, তাঁরা এর নেপথ্যে।
জনাব ইদ্রিসের নিবন্ধের যুক্তি হলো, হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগের তুলনা ‘আপত্তিকর’। কিন্তু তুলনা করি কি সাধে? অধস্তন আদালতের জগতে সুশাসন দেওয়ার দায় সরকারের নয়। এটা একান্তভাবে সুপ্রিম কোর্টের। সুতরাং তারা সর্বতোভাবে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বস। এটা সংবিধানে লেখা। আইনমন্ত্রীর কথা খাঁটি! সংবিধানে লেখা নেই যে হাইকোর্টের বিচারক হতে তৃতীয় বিভাগ কোনো বাধা। তাহলে সংবিধানে তো এটাও লেখা নেই যে তৃতীয় বিভাগ পেলে নিম্ন আদালতের বিচারক হওয়া যাবে না। তাহলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা কেন তৃতীয় বিভাগধারীদের জন্য সেখানকার দরজা বন্ধ করেছেন? তাঁরা কি অসাংবিধানিক কাজ করছেন?
জনাব ইদ্রিস লিখেছেন, ‘মামলার রায় সম্পর্কে মিথ্যা বলে আজ যদি কেউ উচ্চ আদালতকে হেয় করার চেষ্টা করেন, আমি অবশ্যই তীব্রভাবে তাঁর বিরুদ্ধে। আমি ওই মামলার দীর্ঘ রায় মনোযোগসহ পড়েছি, সেখানে কোথাও “বিচারক হতে উৎকৃষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতার” কথা বলা নেই। যেটি আছে, তা উৎকৃষ্ট পেশাগত যোগ্যতা।’
আমি বলেছি, সুপ্রিম কোর্টের নীতিমালায় উৎকৃষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা বলা আছে। আপিল বিভাগের কথা বলিনি। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের কথা বলেছি। আমি সতর্কতার সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নীতিমালা শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। ১০ বিচারকের মামলায় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৮ সালে ২৭১ পৃষ্ঠার রায় দেন। বর্তমান সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করেনি। তারা বরং রায়টি অক্ষরে অক্ষরে পালনে সংকল্পবদ্ধ হয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন হাইকোর্টে কর্মরত ২৯ বিচারক। কিন্তু তাও মূলত ১০ বিচারককে দেওয়া ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা প্রদানের প্রশ্নে। বিচারক নিয়োগে হাইকোর্ট বিস্তারিত নীতিমালা বেঁধে দেন। এর আগে আমরা মানবজমিন-এর ক্যাসেট কেলেঙ্কারি মামলার রায়ে বিস্তারিত নীতিমালা পেয়েছিলাম। কিন্তু এর ওপরে আলো পড়েনি। কোনো আলোচনায়ই আসেনি। যা-ই হোক, ১০ বিচারকের মামলায় হাইকোর্টের রায়টি কিছুটা পরিমার্জন সাপেক্ষে আপিল বিভাগ সমুন্নত রাখেন। মীমাংসিত রীতি হলো, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের যে অংশ নির্দিষ্টভাবে বাতিল করেন, সেটুকু বাদে হাইকোর্টের রায় টিকে থাকে। তো এখন আমরা দেখব, হাইকোর্টের রায়ে কী ছিল। বিচারপতি এস কে সিনহা বর্তমানে আপিল বিভাগে আছেন। তিনি ওই মামলায় রায়দানকারী বৃহত্তর বেঞ্চের অন্যতম বিচারক ছিলেন। তিনি তাঁর দেওয়া রায়ের ১১৭ পৃষ্ঠায় বিচারক হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণী কিছু বিষয় নির্দিষ্ট করেন। সেখানে আছে, তাঁর কথায়, ‘he must have excellent academic qualification.’ আমি এর তরজমা করেছি উৎকৃষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। আর আপিল বিভাগের রায়ে হাইকোর্টের রায়ের কিছু বিষয় বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে যোগ্যতা নির্ধারণী আলোচ্য অংশটি বাদ পড়েনি। আশা করি, জনাব ইদ্রিসসহ অন্যান্য পাঠক এখন বুঝবেন যে আমি অন্তত ‘মিথ্যাচার’ করিনি।
এখানে আরও একটি কৈফিয়ত প্রাসঙ্গিক। শিক্ষাগত যোগ্যতা বড় নয়, বড় হলো পেশাগত যোগ্যতা? এ কথা সত্য, শিক্ষাজীবনে একাধিক তৃতীয় বিভাগ নিয়ে অনেকে উৎকৃষ্ট বিচারক হতে পেরেছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো পারবেন। তবে প্রতিবছর লাখ লাখ জিপিএ-৫ পাওয়ার দেশে আমাদের কিন্তু একটি পর্যায়ে থামতে হবে। সহকারী জজ হতে তৃতীয় বিভাগধারী আবেদন করতে পারেন না। এর অর্থ এই নয় যে যাঁরাই তৃতীয় বিভাগ পেয়েছেন, তাঁরা জীবনে ভালো বিচারক হতে পারতেন না। কিন্তু একটি ন্যূনতম নীতিমালায় আমাদের অবশ্যই পৌঁছাতে হবে। আমি এর আগে একটি লেখায় বলেছিলাম, আওয়ামী লীগ সমর্থকদেরই নিন, কিন্তু তাঁদের মধ্য থেকে যোগ্যতমদের বেছে নিন। একজন আইনবিদ দুঃখ করলেন। বললেন, এটা ঠিক মানা গেল না। বিচারককে তো অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। এই চেতনার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু এও সত্য, দল করলেই কেউ নিরপেক্ষতা হারাবেন, তা ধরে নেওয়া যাবে না। বিচারক নিয়োগে এখন যেটা ঘটে, সেটা তদবির ও ধরাধরি। এটা অবিশ্বাস্য ও অভাবনীয় পর্যায়ে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
১০ বিচারকের মামলার রায়কে আমরা কিন্তু আগাগোড়া দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন করেছি। কারণ আমরা প্রধান বিচারপতি নামের প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী দেখতে চেয়েছি। তাঁর পরামর্শ অগ্রাহ্য হওয়ায় আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। ১৯৯৪ সালেও আমরা প্রধান বিচারপতির পাশেই ছিলাম। সুতরাং ১০ বিচারকের মামলার রায় সমর্থন মোটেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল না, ছিল নীতিগত। একই কারণে প্রধান বিচারপতি যখন দুজন বিচারককে শপথ দিলেন না, তখন আমরা চকিতে চোখ ওল্টাতে পারিনি।
আমরা আশা করেছিলাম, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে রাজার সন্তুষ্টি-ব্যবস্থা হ্রাস পাবে। মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের রাজকীয় মনোভাব থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। বর্তমানে দুজন অতিরিক্ত বিচারককে শপথ পাঠ করানোর প্রশ্নে একটা অচলাবস্থা চলছে। আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারক কেন শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বর্জন করলেন, সে সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। তবে ধারণা করা যায়, এই সিদ্ধান্তের প্রশ্নে প্রধান বিচারপতি একা হয়ে পড়েছেন। প্রজ্ঞাপন সংশোধন ছাড়াই দুজনকে বাদ দিয়ে শপথ পড়ানো হয়। এই কারিগরি অসংগতি হয়তো আপিল বিভাগের অবশিষ্ট বিচারপতিদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। তবে পত্রিকার পাতায় আপিল বিভাগের বিচারকদের বর্জনজনিত শূন্য সোফার ছবি আমাকে আশাবাদী করেছিল। প্রথমেই ভেবেছিলাম, সম্ভবত বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের নীতিমালা অনুসৃত না হওয়ায় এমন নজিরবিহীন ঘটনা ঘটল। কারণ নীতিমালা প্রণয়নকারী বিচারপতিরাই এই মুহূর্তে আপিল বিভাগে আছেন। কিন্তু আমার ধারণা ঠিক ছিল না।
বিচারক নিয়োগে করা বিচারকদের আইন বিচারকেরাই প্রকারান্তরে ভাঙলেন। কিংবা চেয়ে চেয়ে দেখলেন। এই আমাদের ললাটলিখন।
বিচার করা প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে কঠিন কাজ। এ জন্য প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি বাছাই করাই ছিল আপিল বিভাগের নির্দেশনা। যোগ্যতম লিখলেই লেখা হয় যে একটা প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। কিন্তু কোথায় প্রতিযোগিতা? আগ্রহীদের অগোচরে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা হওয়ার নয়। ১৭ অতিরিক্ত বিচারকের দায়ের করা অতীব সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্তগুলোও এর প্রমাণ দেয়। যে প্রক্রিয়ায় ১৭ বিচারক নিয়োগ করা হলো, তা যদি আপিল বিভাগের নীতিমালার কষ্টিপাথরে যাচাই করা বাধ্যতামূলক হয়ে থাকে, তাহলে আমি বলব, ১৭ বিচারক নিয়োগের পুরো বাছাইপ্রক্রিয়া অবশ্যই অস্বচ্ছ, এখতিয়ারবহির্ভূত ও ভয়েড অ্যাব ইনিশিও বা গোড়া থেকে বাতিল। আমরা কিন্তু জোট সরকারের বিবর্ণ আমলের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে গেলাম না। এমনকি আমরা বিশ্বাসও করি, ১৭ জনের মধ্যে অনেক সুযোগ্য বিচারক সত্যি আছেন। কিন্তু প্রশ্নটি ব্যক্তিনির্ভর নয়, প্রশ্নটি নীতিগত। পদ্ধতিগত। কীভাবে তাঁদের বাছাই করা হলো, সেই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। পঞ্চম সংশোধনীর মামলায় আপিল বিভাগ যেমনটা বলেছেন, কতিপয় বিষয় হলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, যেটা সংসদও বদলাতে পারে না। আমরা মনে করি, বিচারক বাছাইয়ে যোগ্যতম ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা এবং তাতে স্বচ্ছতা বজায় রাখাও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগ এটা পাশ কাটিয়ে চলতে পারেন না। হাইকোর্টের যথার্থ রায়ে ব্যক্তিপ্রধান বিচারপতিকে নয়, একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। আপিল বিভাগ তা বিনা বাক্যব্যয়ে বিসর্জন দেন। বিচারক বাছাইয়ের সব ক্ষমতা তুলে দেন প্রধান বিচারপতির হাতে। পরিহাস হলো, এর মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই প্রধান বিচারপতি পরিচালিত শপথ অনুষ্ঠানে আমরা শূন্য সোফা দেখতে পাই।
পঞ্চম সংশোধনী মামলাসূত্রে এখন বড় বিপদ টের পাই। আপিল বিভাগের পাঁচটি পদ প্রায় ছয় মাস ধরে খালি পড়ে আছে। সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলে যাই। বিচারক নিয়োগ ছিল আলোচনার বিষয়। বক্তা দুজন। আমি আর একজন প্রতিমন্ত্রী। বললাম, বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ তারাই ইতিহাসে প্রথম আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা ১১ নির্দিষ্ট করেছে। প্রতিমন্ত্রী অবাক করলেন। বললেন, ‘এ রকম তথ্য তো জানি না।’ অথচ তাঁর জানাটাই স্বাভাবিক। বললাম, প্রজ্ঞাপন আছে। প্রতিমন্ত্রী বড় অসতর্ক। তদুপরি বললেন, ‘আপনার কথা ঠিক হলে আপিল বিভাগ চলছে কী করে?’ বললাম, আমারও তা-ই প্রশ্ন। পাঁচ-ছয় মাস ধরে আমাদের আপিল বিভাগ প্রশাসনিক অর্থে কোরাম নন-জুডিশ—অর্থাৎ যথাযথভাবে গঠিত নয়। সংবিধান যে সুপ্রিম কোর্টকে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শাসন করতে অধিকার দিয়েছে, সেই সুপ্রিম কোর্ট আমরা পাই না। উল্লেখ্য, ৯ জুলাই ২০০৯ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৪(২) অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা সাত থেকে উন্নতি করে ১১ তে নির্ধারণ করলেন।’
১০ বিচারকের মামলার রায়ে আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগেও নির্দিষ্ট নীতিমালা বেঁধে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেই নীতিমালাও আপিল বিভাগ কাটাছেঁড়া করেছেন। যদি তাঁরা তা না করতেন, তাহলে প্রধান বিচারপতি আজ আপিল বিভাগের শূন্য পদ পূরণে স্বপ্রণোদিতভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পাঠাতে পারতেন। সরকারের মুখাপেক্ষী হতেন না। অবশ্য আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি এখনো তেমন উদ্যোগ নিতে পারেন এবং সেটাই সংগত। কারণ রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপনে সাত সংখ্যা ১১-তে উন্নীত করা হয়েছে। অনধিক ১১ বলা হয়নি। সুতরাং এই আইনটি কারও খেয়ালখুশি অনুযায়ী পড়ে থাকতে পারে না।
সবচেয়ে তাজ্জবের ব্যাপার হলো, বড় দুই দলের মেঠো বিতর্কে বিচারক নিয়োগ নিয়ে কোনো কথা নেই। বিশেষ সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে চুপচাপ। রাজনৈতিক চমক ছাড়া কোনো ধরনের বিকেন্দ্রীকরণের সাড়া পাই না। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ৯৫ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবন করেছিলেন। বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধান চতুর্থ সংশোধনীতে বাদ পড়ে। সায়েম এক ফরমানে আনেন, জিয়া আরেক ফরমানে তা বাতিল করেন। হাইকোর্ট সায়েমের ফরমান মার্জনা করেন। আপিল বিভাগ এর সঙ্গে একমত হননি। কিন্তু তাঁরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য নিম্ন আদালত-সংক্রান্ত ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফেরাতে বলেছেন। কিন্তু সেখানে যতটা জোর পড়েছে, ততটা পড়েনি উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে। অথচ উচ্চ আদালতের নিয়োগ-প্রশ্ন মলিন রেখে নিম্ন আদালতের শ্রীবৃদ্ধি আশা করা যায় না। প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম তাঁর রায়ে ১০ বিচারকের মামলার বরাত দিয়েছেন। বলেছেন, ‘পরামর্শ করার রেওয়াজ এখন একটি সাংবিধানিক অপরিহার্যতা। প্রত্যেকের জন্য এটা এখন বাধ্যতামূলক।’ কিন্তু আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, শুধু প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শনির্ভর বিচারক নিয়োগব্যবস্থা কার্যকর বলে গণ্য হচ্ছে না। ভারতের পর পাকিস্তানও তা বর্জন করেছে। এখন বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশে যেন প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধানটা ফিরিয়ে আনা না হয়। বিচারক নিয়োগে একটি জুডিশিয়াল কমিশন অবশ্যই সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। আবার তাঁদের অপসারণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইয়ুব-জিয়ার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল চাই না। এখানে বাহাত্তরের অভিশংসন ব্যবস্থায় ফিরতে চাই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
৩১ জুলাই ২০১০। একটি আইনজীবী সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠান করছে। বিচারাঙ্গনের অনেক রথী-মহারথী তাতে আমন্ত্রিত। একটি দামি সংকলন বের করেছে তারা। এর নাম সাম্প্রতিক বিচারক নিয়োগ: তর্ক নয়, সত্যের কাছে যাবার চেষ্টা। ৮০ পৃষ্ঠার এই সংকলনের শুরুতেই দেখলাম, ওই নিবন্ধ পুনর্মুদ্রিত। এমনকি মূল প্রচ্ছদেও ঠাঁই পেয়েছে ওই নিবন্ধের আলোকচিত্র। সম্পাদকীয়তে প্রথম আলো সম্পর্কে অযাচিত বিদ্বেষ। জানা গেল, যাঁরা বিচারক হতে ইচ্ছুক, তাঁরা এর নেপথ্যে।
জনাব ইদ্রিসের নিবন্ধের যুক্তি হলো, হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগের তুলনা ‘আপত্তিকর’। কিন্তু তুলনা করি কি সাধে? অধস্তন আদালতের জগতে সুশাসন দেওয়ার দায় সরকারের নয়। এটা একান্তভাবে সুপ্রিম কোর্টের। সুতরাং তারা সর্বতোভাবে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বস। এটা সংবিধানে লেখা। আইনমন্ত্রীর কথা খাঁটি! সংবিধানে লেখা নেই যে হাইকোর্টের বিচারক হতে তৃতীয় বিভাগ কোনো বাধা। তাহলে সংবিধানে তো এটাও লেখা নেই যে তৃতীয় বিভাগ পেলে নিম্ন আদালতের বিচারক হওয়া যাবে না। তাহলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা কেন তৃতীয় বিভাগধারীদের জন্য সেখানকার দরজা বন্ধ করেছেন? তাঁরা কি অসাংবিধানিক কাজ করছেন?
জনাব ইদ্রিস লিখেছেন, ‘মামলার রায় সম্পর্কে মিথ্যা বলে আজ যদি কেউ উচ্চ আদালতকে হেয় করার চেষ্টা করেন, আমি অবশ্যই তীব্রভাবে তাঁর বিরুদ্ধে। আমি ওই মামলার দীর্ঘ রায় মনোযোগসহ পড়েছি, সেখানে কোথাও “বিচারক হতে উৎকৃষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতার” কথা বলা নেই। যেটি আছে, তা উৎকৃষ্ট পেশাগত যোগ্যতা।’
আমি বলেছি, সুপ্রিম কোর্টের নীতিমালায় উৎকৃষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা বলা আছে। আপিল বিভাগের কথা বলিনি। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের কথা বলেছি। আমি সতর্কতার সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নীতিমালা শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। ১০ বিচারকের মামলায় হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৮ সালে ২৭১ পৃষ্ঠার রায় দেন। বর্তমান সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করেনি। তারা বরং রায়টি অক্ষরে অক্ষরে পালনে সংকল্পবদ্ধ হয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন হাইকোর্টে কর্মরত ২৯ বিচারক। কিন্তু তাও মূলত ১০ বিচারককে দেওয়া ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা প্রদানের প্রশ্নে। বিচারক নিয়োগে হাইকোর্ট বিস্তারিত নীতিমালা বেঁধে দেন। এর আগে আমরা মানবজমিন-এর ক্যাসেট কেলেঙ্কারি মামলার রায়ে বিস্তারিত নীতিমালা পেয়েছিলাম। কিন্তু এর ওপরে আলো পড়েনি। কোনো আলোচনায়ই আসেনি। যা-ই হোক, ১০ বিচারকের মামলায় হাইকোর্টের রায়টি কিছুটা পরিমার্জন সাপেক্ষে আপিল বিভাগ সমুন্নত রাখেন। মীমাংসিত রীতি হলো, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের যে অংশ নির্দিষ্টভাবে বাতিল করেন, সেটুকু বাদে হাইকোর্টের রায় টিকে থাকে। তো এখন আমরা দেখব, হাইকোর্টের রায়ে কী ছিল। বিচারপতি এস কে সিনহা বর্তমানে আপিল বিভাগে আছেন। তিনি ওই মামলায় রায়দানকারী বৃহত্তর বেঞ্চের অন্যতম বিচারক ছিলেন। তিনি তাঁর দেওয়া রায়ের ১১৭ পৃষ্ঠায় বিচারক হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণী কিছু বিষয় নির্দিষ্ট করেন। সেখানে আছে, তাঁর কথায়, ‘he must have excellent academic qualification.’ আমি এর তরজমা করেছি উৎকৃষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। আর আপিল বিভাগের রায়ে হাইকোর্টের রায়ের কিছু বিষয় বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে যোগ্যতা নির্ধারণী আলোচ্য অংশটি বাদ পড়েনি। আশা করি, জনাব ইদ্রিসসহ অন্যান্য পাঠক এখন বুঝবেন যে আমি অন্তত ‘মিথ্যাচার’ করিনি।
এখানে আরও একটি কৈফিয়ত প্রাসঙ্গিক। শিক্ষাগত যোগ্যতা বড় নয়, বড় হলো পেশাগত যোগ্যতা? এ কথা সত্য, শিক্ষাজীবনে একাধিক তৃতীয় বিভাগ নিয়ে অনেকে উৎকৃষ্ট বিচারক হতে পেরেছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো পারবেন। তবে প্রতিবছর লাখ লাখ জিপিএ-৫ পাওয়ার দেশে আমাদের কিন্তু একটি পর্যায়ে থামতে হবে। সহকারী জজ হতে তৃতীয় বিভাগধারী আবেদন করতে পারেন না। এর অর্থ এই নয় যে যাঁরাই তৃতীয় বিভাগ পেয়েছেন, তাঁরা জীবনে ভালো বিচারক হতে পারতেন না। কিন্তু একটি ন্যূনতম নীতিমালায় আমাদের অবশ্যই পৌঁছাতে হবে। আমি এর আগে একটি লেখায় বলেছিলাম, আওয়ামী লীগ সমর্থকদেরই নিন, কিন্তু তাঁদের মধ্য থেকে যোগ্যতমদের বেছে নিন। একজন আইনবিদ দুঃখ করলেন। বললেন, এটা ঠিক মানা গেল না। বিচারককে তো অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। এই চেতনার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু এও সত্য, দল করলেই কেউ নিরপেক্ষতা হারাবেন, তা ধরে নেওয়া যাবে না। বিচারক নিয়োগে এখন যেটা ঘটে, সেটা তদবির ও ধরাধরি। এটা অবিশ্বাস্য ও অভাবনীয় পর্যায়ে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
১০ বিচারকের মামলার রায়কে আমরা কিন্তু আগাগোড়া দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন করেছি। কারণ আমরা প্রধান বিচারপতি নামের প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী দেখতে চেয়েছি। তাঁর পরামর্শ অগ্রাহ্য হওয়ায় আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। ১৯৯৪ সালেও আমরা প্রধান বিচারপতির পাশেই ছিলাম। সুতরাং ১০ বিচারকের মামলার রায় সমর্থন মোটেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল না, ছিল নীতিগত। একই কারণে প্রধান বিচারপতি যখন দুজন বিচারককে শপথ দিলেন না, তখন আমরা চকিতে চোখ ওল্টাতে পারিনি।
আমরা আশা করেছিলাম, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে রাজার সন্তুষ্টি-ব্যবস্থা হ্রাস পাবে। মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের রাজকীয় মনোভাব থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। বর্তমানে দুজন অতিরিক্ত বিচারককে শপথ পাঠ করানোর প্রশ্নে একটা অচলাবস্থা চলছে। আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারক কেন শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বর্জন করলেন, সে সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। তবে ধারণা করা যায়, এই সিদ্ধান্তের প্রশ্নে প্রধান বিচারপতি একা হয়ে পড়েছেন। প্রজ্ঞাপন সংশোধন ছাড়াই দুজনকে বাদ দিয়ে শপথ পড়ানো হয়। এই কারিগরি অসংগতি হয়তো আপিল বিভাগের অবশিষ্ট বিচারপতিদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। তবে পত্রিকার পাতায় আপিল বিভাগের বিচারকদের বর্জনজনিত শূন্য সোফার ছবি আমাকে আশাবাদী করেছিল। প্রথমেই ভেবেছিলাম, সম্ভবত বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের নীতিমালা অনুসৃত না হওয়ায় এমন নজিরবিহীন ঘটনা ঘটল। কারণ নীতিমালা প্রণয়নকারী বিচারপতিরাই এই মুহূর্তে আপিল বিভাগে আছেন। কিন্তু আমার ধারণা ঠিক ছিল না।
বিচারক নিয়োগে করা বিচারকদের আইন বিচারকেরাই প্রকারান্তরে ভাঙলেন। কিংবা চেয়ে চেয়ে দেখলেন। এই আমাদের ললাটলিখন।
বিচার করা প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে কঠিন কাজ। এ জন্য প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি বাছাই করাই ছিল আপিল বিভাগের নির্দেশনা। যোগ্যতম লিখলেই লেখা হয় যে একটা প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। কিন্তু কোথায় প্রতিযোগিতা? আগ্রহীদের অগোচরে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা হওয়ার নয়। ১৭ অতিরিক্ত বিচারকের দায়ের করা অতীব সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্তগুলোও এর প্রমাণ দেয়। যে প্রক্রিয়ায় ১৭ বিচারক নিয়োগ করা হলো, তা যদি আপিল বিভাগের নীতিমালার কষ্টিপাথরে যাচাই করা বাধ্যতামূলক হয়ে থাকে, তাহলে আমি বলব, ১৭ বিচারক নিয়োগের পুরো বাছাইপ্রক্রিয়া অবশ্যই অস্বচ্ছ, এখতিয়ারবহির্ভূত ও ভয়েড অ্যাব ইনিশিও বা গোড়া থেকে বাতিল। আমরা কিন্তু জোট সরকারের বিবর্ণ আমলের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে গেলাম না। এমনকি আমরা বিশ্বাসও করি, ১৭ জনের মধ্যে অনেক সুযোগ্য বিচারক সত্যি আছেন। কিন্তু প্রশ্নটি ব্যক্তিনির্ভর নয়, প্রশ্নটি নীতিগত। পদ্ধতিগত। কীভাবে তাঁদের বাছাই করা হলো, সেই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। পঞ্চম সংশোধনীর মামলায় আপিল বিভাগ যেমনটা বলেছেন, কতিপয় বিষয় হলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, যেটা সংসদও বদলাতে পারে না। আমরা মনে করি, বিচারক বাছাইয়ে যোগ্যতম ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা এবং তাতে স্বচ্ছতা বজায় রাখাও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগ এটা পাশ কাটিয়ে চলতে পারেন না। হাইকোর্টের যথার্থ রায়ে ব্যক্তিপ্রধান বিচারপতিকে নয়, একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। আপিল বিভাগ তা বিনা বাক্যব্যয়ে বিসর্জন দেন। বিচারক বাছাইয়ের সব ক্ষমতা তুলে দেন প্রধান বিচারপতির হাতে। পরিহাস হলো, এর মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই প্রধান বিচারপতি পরিচালিত শপথ অনুষ্ঠানে আমরা শূন্য সোফা দেখতে পাই।
পঞ্চম সংশোধনী মামলাসূত্রে এখন বড় বিপদ টের পাই। আপিল বিভাগের পাঁচটি পদ প্রায় ছয় মাস ধরে খালি পড়ে আছে। সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলে যাই। বিচারক নিয়োগ ছিল আলোচনার বিষয়। বক্তা দুজন। আমি আর একজন প্রতিমন্ত্রী। বললাম, বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ তারাই ইতিহাসে প্রথম আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা ১১ নির্দিষ্ট করেছে। প্রতিমন্ত্রী অবাক করলেন। বললেন, ‘এ রকম তথ্য তো জানি না।’ অথচ তাঁর জানাটাই স্বাভাবিক। বললাম, প্রজ্ঞাপন আছে। প্রতিমন্ত্রী বড় অসতর্ক। তদুপরি বললেন, ‘আপনার কথা ঠিক হলে আপিল বিভাগ চলছে কী করে?’ বললাম, আমারও তা-ই প্রশ্ন। পাঁচ-ছয় মাস ধরে আমাদের আপিল বিভাগ প্রশাসনিক অর্থে কোরাম নন-জুডিশ—অর্থাৎ যথাযথভাবে গঠিত নয়। সংবিধান যে সুপ্রিম কোর্টকে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শাসন করতে অধিকার দিয়েছে, সেই সুপ্রিম কোর্ট আমরা পাই না। উল্লেখ্য, ৯ জুলাই ২০০৯ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৪(২) অনুচ্ছেদের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকের সংখ্যা সাত থেকে উন্নতি করে ১১ তে নির্ধারণ করলেন।’
১০ বিচারকের মামলার রায়ে আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগেও নির্দিষ্ট নীতিমালা বেঁধে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেই নীতিমালাও আপিল বিভাগ কাটাছেঁড়া করেছেন। যদি তাঁরা তা না করতেন, তাহলে প্রধান বিচারপতি আজ আপিল বিভাগের শূন্য পদ পূরণে স্বপ্রণোদিতভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পাঠাতে পারতেন। সরকারের মুখাপেক্ষী হতেন না। অবশ্য আমি মনে করি, প্রধান বিচারপতি এখনো তেমন উদ্যোগ নিতে পারেন এবং সেটাই সংগত। কারণ রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপনে সাত সংখ্যা ১১-তে উন্নীত করা হয়েছে। অনধিক ১১ বলা হয়নি। সুতরাং এই আইনটি কারও খেয়ালখুশি অনুযায়ী পড়ে থাকতে পারে না।
সবচেয়ে তাজ্জবের ব্যাপার হলো, বড় দুই দলের মেঠো বিতর্কে বিচারক নিয়োগ নিয়ে কোনো কথা নেই। বিশেষ সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে চুপচাপ। রাজনৈতিক চমক ছাড়া কোনো ধরনের বিকেন্দ্রীকরণের সাড়া পাই না। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ৯৫ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবন করেছিলেন। বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধান চতুর্থ সংশোধনীতে বাদ পড়ে। সায়েম এক ফরমানে আনেন, জিয়া আরেক ফরমানে তা বাতিল করেন। হাইকোর্ট সায়েমের ফরমান মার্জনা করেন। আপিল বিভাগ এর সঙ্গে একমত হননি। কিন্তু তাঁরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য নিম্ন আদালত-সংক্রান্ত ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদকে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফেরাতে বলেছেন। কিন্তু সেখানে যতটা জোর পড়েছে, ততটা পড়েনি উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে। অথচ উচ্চ আদালতের নিয়োগ-প্রশ্ন মলিন রেখে নিম্ন আদালতের শ্রীবৃদ্ধি আশা করা যায় না। প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম তাঁর রায়ে ১০ বিচারকের মামলার বরাত দিয়েছেন। বলেছেন, ‘পরামর্শ করার রেওয়াজ এখন একটি সাংবিধানিক অপরিহার্যতা। প্রত্যেকের জন্য এটা এখন বাধ্যতামূলক।’ কিন্তু আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, শুধু প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শনির্ভর বিচারক নিয়োগব্যবস্থা কার্যকর বলে গণ্য হচ্ছে না। ভারতের পর পাকিস্তানও তা বর্জন করেছে। এখন বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশে যেন প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধানটা ফিরিয়ে আনা না হয়। বিচারক নিয়োগে একটি জুডিশিয়াল কমিশন অবশ্যই সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। আবার তাঁদের অপসারণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইয়ুব-জিয়ার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল চাই না। এখানে বাহাত্তরের অভিশংসন ব্যবস্থায় ফিরতে চাই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments