বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা : 'প্রশিক্ষণ' কেন জরুরি by মো. আসাদুল্লাহ
একটা জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য পূরণে শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান অবলম্বন। মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পেঁৗছে দিতে পারে। তাই 'শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড'। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার প্রধান শক্তি মানসম্মত দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। আমাদের জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে তুলতে তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃত শিক্ষা, জ্ঞান, প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো, জ্ঞান সঞ্চারণ ও নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন এবং সেই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে দায়িত্ব পালনে সাফল্য অর্জন করলেও বলা যায়, আরো সাফল্য অর্জন সম্ভব। এ কথা সত্য যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পড়াশোনা করে আসা নাম করা পণ্ডিত ব্যক্তিরা শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত আছেন। তার পরও উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিশেষ করে তরুণ শিক্ষকদের ব্যাপক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, গবেষণার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, মৌলিক গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপসহ শিক্ষকদের গবেষণায় অংশগ্রহণ, উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ গমনে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষকদের গবেষণার উদ্দেশে যথেষ্টসংখ্যক আকর্ষণীয় মূল্যের গবেষণা অনুদান এবং ফেলোশিপের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, উচ্চ শিক্ষার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য শিক্ষা খাতে বিশেষ করে তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা (যদিও এর কোনোটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নয়) খুবই গতানুগতিক, অসম্পূর্ণ, সনদপত্রসর্বস্ব, তত্ত্বীয় বিদ্যাপ্রধান, ব্যবহারিক শিক্ষা অপূর্ণ, মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল এবং পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসারী। তাই আশানুরূপ ফল লাভ হচ্ছে না। বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য ১৪টি সরকারি প্রশিক্ষণ কলেজ, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নায়েম), মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের জন্য পাঁচটি এইচএসটিটিআই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য একটি শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে। ১৪টি সরকারি প্রশিক্ষণ কলেজেই বিএড ডিগ্রি দেওয়া হয়। কয়েকটি প্রশিক্ষণ কলেজে এমএড ডিগ্রিও প্রদান করা হয়। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও দূরশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবছর বিএড ডিগ্রি প্রদান করছে। এ ছাড়া ১০৬টি বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোতে ভৌতব্যবস্থা, প্রশিক্ষকের মান এবং প্রদত্ত প্রশিক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে খুবই নিম্নমানের। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ৫৩টি সরকারি ও দুটি বেসরকারি প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে। এগুলোতে এক বছরমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে তা অপ্রতুল, চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত এবং যুগোপযোগী নয়। তাই প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোসহ প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন করা জরুরি।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮২টি, যার মধ্যে সরকারি ৩১টি, বেসরকারি ৫১টি। অবশ্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াধীন। একসময় বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অথবা বেসরকারি যা-ই হোক না কেন, আগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষক। আমি অস্বীকার করি না যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষক নেই। তবে এর সংখ্যা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে কয়টি স্তর আছে তার মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ স্তর হলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা। একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অবাধ বুদ্ধিচর্চা, মননশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতা বিকাশ, নিরলস জ্ঞানচর্চা এবং নিত্যনতুন বহুমুখী মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ভেতর দিয়ে জ্ঞানের দিগন্তের ক্রম সম্প্রসারণসহ জাতীয় জীবনে সর্বত্র নেতৃত্বদানের উপযোগী বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক, মানবমুখী, প্রগতিশীল ও দূরদর্শী নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়ে থাকে। নিরলস জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানসাধনায় নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের সংস্পর্শে এসে জীবনকে আলোকিত করে। বর্তমান পদ্ধতিতে একজন ছাত্র পাস করেই শিক্ষক হন। ফলে দেখা যায়, শিক্ষক হয়েও তাঁর মধ্যে এক ধরনের 'ছাত্রত্ব' কাজ করে। অনেক সময় তাঁর পক্ষে ক্লাসে ঠিকমতো পাঠদান করা সম্ভব হয় না। গবেষণার ক্ষেত্রে আশানুরূপ কোনো ফল পাওয়া যায় না। নিজেকে উন্নয়ন করার চেষ্টা হয়তো থাকে; কিন্তু পারিপাশ্বর্িকতা, প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতার কারণে মানোন্নয়নের ব্যাপারটা গৌণই থেকে যায় অনেক ক্ষেত্রে। সুতরাং একজন ছাত্র যিনি শিক্ষক হতে চান, তাঁকে শুধু ভালো ফল করলেই চলবে না, বরং তাঁকে একজন সিনিয়র শিক্ষকের সহকারী হিসেবে নূ্যনতম এক বছর কাজ করতে হবে। গবেষণা করতে হবে। তারপর তিনি আবেদনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ছাত্র হয়েও শিক্ষক হয়ে তিনি পড়াতে পারেন না। এ ধরনের দৃষ্টান্ত হাজারটা দেওয়া যায়। এ জন্য যেটা জরুরি, তা হচ্ছে পেশাগত প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন। যদি স্কুল-শিক্ষক ও কলেজ-শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের মানোন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে না কেন? তাই শিক্ষার মানোন্নয়নের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
আর শিক্ষক প্রশিক্ষণের দায়িত্বটি নিতে পারে মঞ্জুরি কমিশন। এ জন্য প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় অথবা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমী গঠন করা যেতে পারে। মঞ্জুরি কমিশনের এক বা একাধিক সদস্য এর দায়িত্বে থাকবেন। যাঁর দায়িত্ব হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রথমে এটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য করা যেতে পারে এবং আস্তে আস্তে অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য করা যেতে পারে। এ জন্য সরকারকে প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভূমিকা রাখতে পারে। এ প্রশিক্ষণের মেয়াদ হবে কমপক্ষে তিন মাস। এখানে কম্পিউটার প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতিকরণ, বিষয়বস্তু উপস্থাপনার কৌশল, গবেষণার নিয়মকানুন সম্পর্কে ধারণাসহ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। আর এটা হতে হবে ধাপে ধাপে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক, দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিজ উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন, প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন, প্রশিক্ষক নির্বাচন, প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের উদ্যোগে এ ধরনের একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। প্রথমদিকে ছিল শুধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের জন্য। মঞ্জুরি কমিশন এখন ওই প্রজেক্টে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ।
লেখক : প্রভাষক, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। ashadullah@bdgmail.com
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা (যদিও এর কোনোটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নয়) খুবই গতানুগতিক, অসম্পূর্ণ, সনদপত্রসর্বস্ব, তত্ত্বীয় বিদ্যাপ্রধান, ব্যবহারিক শিক্ষা অপূর্ণ, মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল এবং পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসারী। তাই আশানুরূপ ফল লাভ হচ্ছে না। বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য ১৪টি সরকারি প্রশিক্ষণ কলেজ, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নায়েম), মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের জন্য পাঁচটি এইচএসটিটিআই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য একটি শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে। ১৪টি সরকারি প্রশিক্ষণ কলেজেই বিএড ডিগ্রি দেওয়া হয়। কয়েকটি প্রশিক্ষণ কলেজে এমএড ডিগ্রিও প্রদান করা হয়। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও দূরশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবছর বিএড ডিগ্রি প্রদান করছে। এ ছাড়া ১০৬টি বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোতে ভৌতব্যবস্থা, প্রশিক্ষকের মান এবং প্রদত্ত প্রশিক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে খুবই নিম্নমানের। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ৫৩টি সরকারি ও দুটি বেসরকারি প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে। এগুলোতে এক বছরমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে তা অপ্রতুল, চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত এবং যুগোপযোগী নয়। তাই প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোসহ প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন করা জরুরি।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮২টি, যার মধ্যে সরকারি ৩১টি, বেসরকারি ৫১টি। অবশ্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াধীন। একসময় বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অথবা বেসরকারি যা-ই হোক না কেন, আগে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসম্পন্ন শিক্ষক। আমি অস্বীকার করি না যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষক নেই। তবে এর সংখ্যা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে কয়টি স্তর আছে তার মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ স্তর হলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা। একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অবাধ বুদ্ধিচর্চা, মননশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতা বিকাশ, নিরলস জ্ঞানচর্চা এবং নিত্যনতুন বহুমুখী মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ভেতর দিয়ে জ্ঞানের দিগন্তের ক্রম সম্প্রসারণসহ জাতীয় জীবনে সর্বত্র নেতৃত্বদানের উপযোগী বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক, মানবমুখী, প্রগতিশীল ও দূরদর্শী নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়ে থাকে। নিরলস জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানসাধনায় নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের সংস্পর্শে এসে জীবনকে আলোকিত করে। বর্তমান পদ্ধতিতে একজন ছাত্র পাস করেই শিক্ষক হন। ফলে দেখা যায়, শিক্ষক হয়েও তাঁর মধ্যে এক ধরনের 'ছাত্রত্ব' কাজ করে। অনেক সময় তাঁর পক্ষে ক্লাসে ঠিকমতো পাঠদান করা সম্ভব হয় না। গবেষণার ক্ষেত্রে আশানুরূপ কোনো ফল পাওয়া যায় না। নিজেকে উন্নয়ন করার চেষ্টা হয়তো থাকে; কিন্তু পারিপাশ্বর্িকতা, প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতার কারণে মানোন্নয়নের ব্যাপারটা গৌণই থেকে যায় অনেক ক্ষেত্রে। সুতরাং একজন ছাত্র যিনি শিক্ষক হতে চান, তাঁকে শুধু ভালো ফল করলেই চলবে না, বরং তাঁকে একজন সিনিয়র শিক্ষকের সহকারী হিসেবে নূ্যনতম এক বছর কাজ করতে হবে। গবেষণা করতে হবে। তারপর তিনি আবেদনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ছাত্র হয়েও শিক্ষক হয়ে তিনি পড়াতে পারেন না। এ ধরনের দৃষ্টান্ত হাজারটা দেওয়া যায়। এ জন্য যেটা জরুরি, তা হচ্ছে পেশাগত প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন। যদি স্কুল-শিক্ষক ও কলেজ-শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের মানোন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে না কেন? তাই শিক্ষার মানোন্নয়নের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
আর শিক্ষক প্রশিক্ষণের দায়িত্বটি নিতে পারে মঞ্জুরি কমিশন। এ জন্য প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় অথবা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমী গঠন করা যেতে পারে। মঞ্জুরি কমিশনের এক বা একাধিক সদস্য এর দায়িত্বে থাকবেন। যাঁর দায়িত্ব হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রথমে এটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য করা যেতে পারে এবং আস্তে আস্তে অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য করা যেতে পারে। এ জন্য সরকারকে প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভূমিকা রাখতে পারে। এ প্রশিক্ষণের মেয়াদ হবে কমপক্ষে তিন মাস। এখানে কম্পিউটার প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতিকরণ, বিষয়বস্তু উপস্থাপনার কৌশল, গবেষণার নিয়মকানুন সম্পর্কে ধারণাসহ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। আর এটা হতে হবে ধাপে ধাপে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক, দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিজ উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন, প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন, প্রশিক্ষক নির্বাচন, প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের উদ্যোগে এ ধরনের একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। প্রথমদিকে ছিল শুধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের জন্য। মঞ্জুরি কমিশন এখন ওই প্রজেক্টে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ।
লেখক : প্রভাষক, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। ashadullah@bdgmail.com
No comments