১০ সংস্কার কমিশনের কাছে প্রবীণের ১০ দাবি by হাসান আলী
১. সংবিধান সংস্কার কমিশন: সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের ঘ ধারা সুনির্দিষ্ট করে, ‘অসহায়, দুস্থ প্রবীণদের ভরণপোষণ, চিকিৎসাসেবা, চলাচল, নিরাপত্তা, ভাতা, বিনোদনের দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করবে।’ এই কথাটি সংযুক্ত করতে হবে।
২. নির্বাচন সংস্কার কমিশন-অতি প্রবীণ, চলাচলে অক্ষম, ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন কিংবা প্রতিবন্ধী প্রবীণদের পক্ষে ভোটকেন্দ্রে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট প্রদান করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের প্রবীণদের কেন্দ্রভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। ভোটগ্রহণের আগের দিন নির্বাচন কর্মকর্তারা প্রবীণদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট সংগ্রহ করে আনবেন। ভোট মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রবীণের এই অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
৩. বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন- বিশেষ করে আদালতে বিচার প্রার্থী হন দুর্বল শ্রেণির মানুষ।। আর প্রবীণরা সেই দুর্বল শ্রেণিরই দুর্বল অংশ। মামলার তদন্তের সময় প্রবীণ ব্যক্তিকে হেনস্তা করা বন্ধ করতে হবে। প্রতি তারিখে হাজির হওয়ার বাধ্যবাধকতা শিথিল করতে হবে। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত জামিনে থাকার সুযোগ রাখতে হবে। জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হলে প্রবীণ ব্যক্তিকে ওষুধপত্র, খাবার দাবার, কাপড় চোপড়, থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ঘন ঘন তারিখ ফেলে আর্থিক ও মানসিক হয়রানি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রবীণ ব্যক্তি চাইলে নিজেই মামলার শুনানি করতে দিতে হবে। আদালতে বিচার চলাকালীন সময়ে প্রবীণদের বসার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলার শুনানি করে রায় দিতে হবে। প্রবীণের জানমাল রক্ষায় মামলা দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রবীণ যদি স্মৃতিশক্তি হারায়, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে না পারে, ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, অচেতন অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণ করে সেসব ক্ষেত্রে আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কল্যাণে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন।
৪. পুলিশ সংস্কার কমিশন- দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এই কথাটি পুলিশকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। প্রবীণের জানমাল, সহায়-সম্পদ রক্ষার আবেদন নিয়ে পুলিশের কাছে হাজির হলে কিংবা ফোনে সাহায্য প্রার্থী হলে পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রবীণকে সহযোগিতা ও সমর্থন করবে। প্রবীণ ব্যক্তিকে যেকোনো ধরনের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পুলিশ বাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতা দিবে। মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ প্রবীণদের গ্রেপ্তার, হয়রানি, হেনস্তা করবে না। প্রয়োজনে উপযুক্ত জামিনদারের জিম্মায় দিতে হবে। প্রবীণ ব্যক্তি দ্রুততম সময়ের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুলিশের সেবা লাভের অধিকারী হবেন।
৫. জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন- সরকারের পক্ষে জনসাধারণের চাহিদা মোতাবেক সেবা প্রদান, সরকারের নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা জনপ্রশাসনের মূল কাজ। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলায় জনপ্রশাসন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল অনুষ্ঠানে প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে বসবার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় প্রবীণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড প্রবীণবান্ধব করে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৬. স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশন- প্রত্যেক প্রবীণকে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনতে হবে; যাতে করে প্রবীণরা তাদের পছন্দমতো হাসপাতালে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা পায়। দুস্থ অসহায় প্রবীণদের বিনামূল্যে মানসম্মত চিকিৎসা এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ পাবার সুযোগ রাখতে হবে। প্রতিটি বিভাগে ৫০০ শয্যার জেরিয়েট্রিক হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। ইপিআইয়ের আওতায় বিনামূল্যে নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন দিতে হবে।
৭. দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন- দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য আইন প্রণয়ন এবং কর্মচারী পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। প্রত্যেক মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসংগতি, স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনে বৈধ আয়ের উৎস নিশ্চিত করা দরকার। প্রত্যেক ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় দুর্নীতি দমন বিরোধী কমিটিতে প্রবীণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন- প্রবীণের চোখের পানি, দুঃখ- দুর্দশা, নিপীড়ন-নির্যাতন, বৃদ্ধাশ্রম, অসহায়ত্ব, নিঃসঙ্গতা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। অনেক সময় এসব নেতিবাচক সংবাদ প্রবীণদের মধ্যে আতঙ্ক, আস্থাহীনতা তৈরি হয়। প্রবীণরা জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায়, গবেষণাধর্মী ও সৃষ্টিশীল কাজে, রাষ্ট্র পরিচালনায়, শিক্ষা, আইন, চিকিৎসা পেশায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছেন। প্রবীণদের এসব ইতিবাচক সংবাদ অন্যদের মধ্যে সাহস শক্তি মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রবীণরা কারও করুণা, দয়া, কৃপার পাত্র নয়। তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে গণমাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে।
৯. শ্রমিক সংস্কার কমিশন- শুধুমাত্র বয়সের কারণে কোনো শ্রমিককে কর্মে নিয়োগ বন্ধ করা কিংবা কর্ম থেকে বাদ দেয়া যাবে না। ৬০ বছর অতিক্রম করা একজন মানুষ যদি শারীরিক ও মানসিক ভাবে সক্ষম থাকলে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যাবে না। আর যদি অবসরে দিতেই হয়; তবে সবাইকে একই বয়সে অবসর বাধ্যতামূলক করতে হবে।
১০. নারী সংস্কার কমিশন- অধিকাংশ নারী গৃহবধূ হিসেবে স্বামীর সংসারে পুরো জীবন কাটিয়ে দেন। কোনো কারণে নারী তালাকপ্রাপ্ত হলে অথবা আলাদা বসবাসে বাধ্য হলে দেনমোহর, খোরপোশ পাওয়া যায় মাত্র। প্রবীণ নারীকে স্বামীর সংসারে অর্জিত সকল সহায়- সম্পদের সমান ভাগীদার করতে হবে। নারী দীর্ঘায়ু হওয়ার কারণে প্রবীণ বয়সে অনেক নারীকে বৈধব্য বরণ করতে হয়। তাদেরকে ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজনের দয়া ও করুণার উপর জীবন নির্বাহ করতে হয়। অসহায় দুস্থ প্রবীণ নারীর ভরণ পোষণ, চিকিৎসাসেবা, নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। উত্তরাধিকারের প্রশ্নে নারী সমান মালিকানা দাবি করলে রাষ্ট্র সমর্থন ও সহযোগিতা করবে।
No comments