৪৩ জনের তালিকা শ’ শ’ কোটি টাকা পাচারের তথ্য by মারুফ কিবরিয়া
ক্যাসিনোর
মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ উপার্জন করে একেকজন অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
দেশে-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে শ’ শ’ কোটি
টাকা পাচারের অভিযোগও। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে
সম্পদশালীদের এসব তথ্য। একই সঙ্গে তাদের তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে সংস্থাটির
কাছে। এ পর্যন্ত ৪৩ ব্যক্তির নাম হাতে এসেছে বলে জানিয়েছে দুদক।
ক্যাসিনো বন্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর নাম আসতে থাকে যুবলীগসহ সরকারদলীয় অনেক নেতার। গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ বেশ কয়েকজনকে। অভিযানকালে ক্যাসিনোয় জড়িতদের বাসায় পাওয়া যায় বড় অংকের টাকাও।
এ ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও সম্পদ থাকার তথ্যও উঠে আসে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে।
প্রাথমিক তথ্যের সূত্র ধরে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাসিনো হোতাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। যুবলীগ সভাপতি (বহিষ্কৃত) সম্রাট ছাড়াও মোট ৪২ জনের নাম সংস্থাটির অনুসন্ধান টেবিলে রয়েছে। দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে এই অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। গতকাল দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্ত জানান, ক্যাসিনোর মাধ্যমে যারা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের সম্পদের বিবরণী নেয়া হচ্ছে। তিনি আরো জানান, সম্পদের আয়ের উৎস যদি সঠিকভাবে না পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা এবং মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হতে পারে। দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, মালয়েশিয়ার আমপাং তেয়ারাকুন্ডে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকে সম্রাট যে লেনদেন করেছেন সে তথ্যও পেয়েছে সংস্থাটি। দুদকের অনুসন্ধানের সময় পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ, বিএফআইইউ, পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, সেকেন্ড হোমের এজেন্ট, মালয়েশিয়ান হাইকমিশন অনুমোদিত বিভিন্ন ভিসা এজেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য, পাসপোর্টের কপি, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে অনুমোদনপ্রাপ্তদের অনুমোদনপত্রের কপি ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী যাচাই-বাছাইয়ে সম্রাটের মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার ও ফ্ল্যাট থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর আগে ১৮ই সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানের একটি ভবন থেকে নগদ অর্থ, অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। গ্রেপ্তারের পরপরই বেরিয়ে আসে তাদের যত অবৈধ সম্পদের তথ্য।
সূত্র জানায়, ক্যাসিনো থেকে আয় করা যত অর্থ তার বেশিরভাগই যুবলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ পাচার করতেন বিদেশে। গত ১০ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক হন তিনি। এছাড়া পিডব্লিউডি, রাজউক, খামারবাড়ি, বিদ্যুৎ ও রেলভবনে টেন্ডারবাজির মাধ্যমে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন খালেদ। এসব টাকারও একটি বড় অংশ তিনি বিদেশে পাচার করেন। খালেদ মূলতঃ থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বড় অংকের অর্থ নিয়ে যান। ব্যাংককে খালেদ একটি দুই তারকা মানের হোটেল কেনেন। এছাড়া থাইল্যান্ডের পর্যটন শহর পাতায়ায় ৫টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। মালয়েশিয়াতেও ১১ কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কিনে সেকেন্ড হোম করেছেন খালেদ। গত ২০শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতন থেকে গ্রেপ্তার হন যুবলীগের আরেক নেতা জি কে শামীম। এদিন তার কার্যালয় থেকে নগদ টাকাসহ ১৬৫ কোটি টাকা মূল্যের এফডিআর নথি উদ্ধার করে র্যাব। সে সঙ্গে অস্ত্রও পাওয়া যায় সেখানে। গ্রেপ্তারের পর এই প্রভাবশালী নেতারও সম্পদের নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। সূত্র জানায়, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে জি কে শামীম বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার নিকেতন ও বাসাবো এলাকায় ৫টি করে ১০টি বহুতল বাড়ি, বাসাবোতে ১ বিঘার একটি বাণিজ্যিক প্লট, পর্যটন শহর বান্দরবানে একটি ৩ তারকা মানের রিসোর্ট রয়েছে তার। এছাড়া বিদেশেও পাচার করেছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।
এদিকে, ক্যাসিনোর মাধ্যমে বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদের মালিকদের অর্থ পাচার করার গোয়েন্দা তথ্যও এখন দুদকের হাতে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পক্ষ থেকে ক্যাসিনো হোতাদের অর্থ পাচার ও মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের তথ্য-উপাত্ত দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে এরই মধ্যে হস্তান্তর করা হয়। গত সপ্তাহেই চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ও বিএফআইউ প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানের মধ্যকার এক বৈঠকে অর্থ পাচারসহ অবৈধ ব্যাংকিং নিয়ে আলোচনা হয় । বিএফআইইউ প্রধান চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে মানলিন্ডারিং সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য দুদক চেয়ারম্যানের কাছে সরবরাহ করেন। এছাড়া ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের আর্থিক গোয়েন্দা তথ্যও অবহিত করেছেন বলে জানিয়েছে দুদকের একটি সূত্র।
অর্থ পাচারের মাধ্যমে সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগের একটি অভিযোগ ২০১৫ সাল থেকে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রথম পর্যায়ে স্বল্প কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হলেও পরে এ অভিযোগের সঙ্গে অনেকের নাম পাওয়া যায়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও বিএফআইইউ থেকে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা পাওয়া যায়। এর মধ্যে এসবির তালিকায় ১০ হাজার ৯০৪ জন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় ১৩ জনের নাম ছিল। দুদককে দেয়া এসবির নথিতে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে ওই ১০ হাজার ৯০৪ জন মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করেছেন। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক। অর্থ পাচারের তথ্য-প্রমাণসহ ১৩ জনের তালিকা দিয়েছিল বিএফআইইউ। তিন বছরের বেশি সময়ে দুদকের একাধিক টিম অনুসন্ধান করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নানা তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। সর্বশেষ, পরিচালক মো. জুলফিকার আলীর নেতৃত্বাধীন টিম অনুসন্ধান করে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা থেকে ২৩ জনকে চিহ্নিত করে। ওই ২৩ জনের মধ্যে ১২ জনের নাম চিহ্নিত করা হয়েছে এসবির নথিপত্র যাচাই করে। বিফআইইউর নথি যাচাই করে চিহ্নিত করা হয় ১১ জনের নাম। ওই ২৩ জনের তালিকায়ও সম্রাটের নাম ছিল। অনুসন্ধান দল তাদের প্রতিবেদনে সম্রাটসহ ওই ২৩ জনের অবৈধ সম্পদের বিষয়টি খতিয়ে দেখার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দিয়েছিল।
গত ১৮ই সেপ্টেম্বর র্যাবের অভিযানে একের পর এক প্রভাবশালী নেতাদের ক্যাসিনোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠে। সেই ধারাবাহিকতায় দুদকের পক্ষ থেকেও সেসব প্রভাবশালীদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করা হয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। খালেদ-সম্রাট-শামীম ছাড়াও ক্যাসিনো কাণ্ডে যাদের নাম ফলাও করে প্রকাশ্যে এসেছে তারা হলেন- কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম, মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, গেন্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু, রুপম ভুঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনো এর মূল হোতা সেলিম প্রধান এবং কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান।
গ্রেপ্তারের সময় কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ কলাবাগান স্পোর্টিং ক্লাবের আড়ালে ক্যাসিনো চালাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্যাসিনোর মাধ্যমে শ শ কোটি টাকার মালিকও হয়েছেন তিনি। এর বড় একটা অংশ দেশের বাইরে পাচার করতেন শফিকুল আলম ফিরোজ। মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকেও ক্যাসিনোর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাবের অভিযান ও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে র্যাব জানায় ক্যাসিনো ব্যবসা থেকেই লোকমান বিপুল পরিমাণ অর্থের অধিকারী হয়েছেন। শুধু তাই নয়, ক্যাসিনো থেকে অর্জিত ৪১ কোটি টাকা তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পাচারও করেছেন।
এদিকে গত ২৩শে সেপ্টেম্বর অভিযানের সময় র্যাব গেন্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও রুপম ভুঁইয়া এবং তাদের সহযোগীদের বাসার পাঁচটি ভল্ট ভেঙে নগদ পাঁচ কোটি চার লাখ ৯০ হাজার টাকা, ৭২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, বিভিন্ন ধরনের ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র্যাব। পরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাদের ১৫টি বাড়ির সন্ধান মিলেছে। এছাড়া তাদের ব্যাংক হিসাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদের বিষয়েও তথ্য পাওয়া গেছে। জানা যায়, ক্যাসিনোর মাধ্যমে আয় করা টাকা বিদেশে পাচার করেছেন এই দুই ভাই। অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগেই মূলত সেলিম প্রধান গ্রেপ্তার হয়েছেন। র্যাব জানায়, দেশে বিদেশে শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংকসহ মোট তিনটি ব্যাংকে বাংলাদেশের অনলাইন ক্যাসিনোর লেনদেন করে সেলিম। ব্যাংক তিনটি হলো, বিদেশী ব্যাংক কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন এবং দেশের বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক দ্য সিটি ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক। অনলাইন গেটওয়ে দিয়ে এই তিন ব্যাংকে টাকা আসতো। লেনদেন করত সেলিম প্রধানের সহকারী আক্তারুজ্জামান। সেলিম প্রধানের সঙ্গে সমান অংশীদারিত্বে উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মিস্টার তু অনলাইন ক্যাসিনোর ব্যবসা করত। এই অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হতো অথবা কোরিয়ান নাগরিক নিজে এসেও টাকা নিতেন।
সবশেষ, ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হন কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অবৈধ আয়ের অর্থেই টেক্সাসের বাড়ি কিনেছেন বলে স্বীকার করেছেন তিনি। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় পাঁচ ও ছয়তলার দুটি বাড়ি এবং একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। এছাড়া দেশে-বিদেশে নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ করেছেন। গত শুক্রবার মিজানকে গ্রেপ্তারের পর তার ঢাকার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র এবং ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক। এছাড়া বিদেশে অর্থ পাচারের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে মিজানের বিরুদ্ধে।
ক্যাসিনো বন্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর নাম আসতে থাকে যুবলীগসহ সরকারদলীয় অনেক নেতার। গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ বেশ কয়েকজনকে। অভিযানকালে ক্যাসিনোয় জড়িতদের বাসায় পাওয়া যায় বড় অংকের টাকাও।
এ ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও সম্পদ থাকার তথ্যও উঠে আসে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে।
প্রাথমিক তথ্যের সূত্র ধরে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাসিনো হোতাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। যুবলীগ সভাপতি (বহিষ্কৃত) সম্রাট ছাড়াও মোট ৪২ জনের নাম সংস্থাটির অনুসন্ধান টেবিলে রয়েছে। দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে এই অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। গতকাল দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্ত জানান, ক্যাসিনোর মাধ্যমে যারা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের সম্পদের বিবরণী নেয়া হচ্ছে। তিনি আরো জানান, সম্পদের আয়ের উৎস যদি সঠিকভাবে না পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা এবং মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হতে পারে। দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, মালয়েশিয়ার আমপাং তেয়ারাকুন্ডে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকে সম্রাট যে লেনদেন করেছেন সে তথ্যও পেয়েছে সংস্থাটি। দুদকের অনুসন্ধানের সময় পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ, বিএফআইইউ, পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, সেকেন্ড হোমের এজেন্ট, মালয়েশিয়ান হাইকমিশন অনুমোদিত বিভিন্ন ভিসা এজেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য, পাসপোর্টের কপি, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে অনুমোদনপ্রাপ্তদের অনুমোদনপত্রের কপি ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী যাচাই-বাছাইয়ে সম্রাটের মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার ও ফ্ল্যাট থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর আগে ১৮ই সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানের একটি ভবন থেকে নগদ অর্থ, অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। গ্রেপ্তারের পরপরই বেরিয়ে আসে তাদের যত অবৈধ সম্পদের তথ্য।
সূত্র জানায়, ক্যাসিনো থেকে আয় করা যত অর্থ তার বেশিরভাগই যুবলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ পাচার করতেন বিদেশে। গত ১০ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক হন তিনি। এছাড়া পিডব্লিউডি, রাজউক, খামারবাড়ি, বিদ্যুৎ ও রেলভবনে টেন্ডারবাজির মাধ্যমে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন খালেদ। এসব টাকারও একটি বড় অংশ তিনি বিদেশে পাচার করেন। খালেদ মূলতঃ থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বড় অংকের অর্থ নিয়ে যান। ব্যাংককে খালেদ একটি দুই তারকা মানের হোটেল কেনেন। এছাড়া থাইল্যান্ডের পর্যটন শহর পাতায়ায় ৫টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। মালয়েশিয়াতেও ১১ কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কিনে সেকেন্ড হোম করেছেন খালেদ। গত ২০শে সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতন থেকে গ্রেপ্তার হন যুবলীগের আরেক নেতা জি কে শামীম। এদিন তার কার্যালয় থেকে নগদ টাকাসহ ১৬৫ কোটি টাকা মূল্যের এফডিআর নথি উদ্ধার করে র্যাব। সে সঙ্গে অস্ত্রও পাওয়া যায় সেখানে। গ্রেপ্তারের পর এই প্রভাবশালী নেতারও সম্পদের নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। সূত্র জানায়, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে জি কে শামীম বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার নিকেতন ও বাসাবো এলাকায় ৫টি করে ১০টি বহুতল বাড়ি, বাসাবোতে ১ বিঘার একটি বাণিজ্যিক প্লট, পর্যটন শহর বান্দরবানে একটি ৩ তারকা মানের রিসোর্ট রয়েছে তার। এছাড়া বিদেশেও পাচার করেছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।
এদিকে, ক্যাসিনোর মাধ্যমে বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদের মালিকদের অর্থ পাচার করার গোয়েন্দা তথ্যও এখন দুদকের হাতে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পক্ষ থেকে ক্যাসিনো হোতাদের অর্থ পাচার ও মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের তথ্য-উপাত্ত দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে এরই মধ্যে হস্তান্তর করা হয়। গত সপ্তাহেই চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ও বিএফআইউ প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানের মধ্যকার এক বৈঠকে অর্থ পাচারসহ অবৈধ ব্যাংকিং নিয়ে আলোচনা হয় । বিএফআইইউ প্রধান চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে মানলিন্ডারিং সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য দুদক চেয়ারম্যানের কাছে সরবরাহ করেন। এছাড়া ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের আর্থিক গোয়েন্দা তথ্যও অবহিত করেছেন বলে জানিয়েছে দুদকের একটি সূত্র।
অর্থ পাচারের মাধ্যমে সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগের একটি অভিযোগ ২০১৫ সাল থেকে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রথম পর্যায়ে স্বল্প কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হলেও পরে এ অভিযোগের সঙ্গে অনেকের নাম পাওয়া যায়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও বিএফআইইউ থেকে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা পাওয়া যায়। এর মধ্যে এসবির তালিকায় ১০ হাজার ৯০৪ জন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় ১৩ জনের নাম ছিল। দুদককে দেয়া এসবির নথিতে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে ওই ১০ হাজার ৯০৪ জন মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করেছেন। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক। অর্থ পাচারের তথ্য-প্রমাণসহ ১৩ জনের তালিকা দিয়েছিল বিএফআইইউ। তিন বছরের বেশি সময়ে দুদকের একাধিক টিম অনুসন্ধান করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নানা তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। সর্বশেষ, পরিচালক মো. জুলফিকার আলীর নেতৃত্বাধীন টিম অনুসন্ধান করে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা থেকে ২৩ জনকে চিহ্নিত করে। ওই ২৩ জনের মধ্যে ১২ জনের নাম চিহ্নিত করা হয়েছে এসবির নথিপত্র যাচাই করে। বিফআইইউর নথি যাচাই করে চিহ্নিত করা হয় ১১ জনের নাম। ওই ২৩ জনের তালিকায়ও সম্রাটের নাম ছিল। অনুসন্ধান দল তাদের প্রতিবেদনে সম্রাটসহ ওই ২৩ জনের অবৈধ সম্পদের বিষয়টি খতিয়ে দেখার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দিয়েছিল।
গত ১৮ই সেপ্টেম্বর র্যাবের অভিযানে একের পর এক প্রভাবশালী নেতাদের ক্যাসিনোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠে। সেই ধারাবাহিকতায় দুদকের পক্ষ থেকেও সেসব প্রভাবশালীদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করা হয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। খালেদ-সম্রাট-শামীম ছাড়াও ক্যাসিনো কাণ্ডে যাদের নাম ফলাও করে প্রকাশ্যে এসেছে তারা হলেন- কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম, মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, গেন্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু, রুপম ভুঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনো এর মূল হোতা সেলিম প্রধান এবং কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান।
গ্রেপ্তারের সময় কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ কলাবাগান স্পোর্টিং ক্লাবের আড়ালে ক্যাসিনো চালাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্যাসিনোর মাধ্যমে শ শ কোটি টাকার মালিকও হয়েছেন তিনি। এর বড় একটা অংশ দেশের বাইরে পাচার করতেন শফিকুল আলম ফিরোজ। মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকেও ক্যাসিনোর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাবের অভিযান ও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে র্যাব জানায় ক্যাসিনো ব্যবসা থেকেই লোকমান বিপুল পরিমাণ অর্থের অধিকারী হয়েছেন। শুধু তাই নয়, ক্যাসিনো থেকে অর্জিত ৪১ কোটি টাকা তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পাচারও করেছেন।
এদিকে গত ২৩শে সেপ্টেম্বর অভিযানের সময় র্যাব গেন্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও রুপম ভুঁইয়া এবং তাদের সহযোগীদের বাসার পাঁচটি ভল্ট ভেঙে নগদ পাঁচ কোটি চার লাখ ৯০ হাজার টাকা, ৭২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, বিভিন্ন ধরনের ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র্যাব। পরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাদের ১৫টি বাড়ির সন্ধান মিলেছে। এছাড়া তাদের ব্যাংক হিসাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদের বিষয়েও তথ্য পাওয়া গেছে। জানা যায়, ক্যাসিনোর মাধ্যমে আয় করা টাকা বিদেশে পাচার করেছেন এই দুই ভাই। অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগেই মূলত সেলিম প্রধান গ্রেপ্তার হয়েছেন। র্যাব জানায়, দেশে বিদেশে শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংকসহ মোট তিনটি ব্যাংকে বাংলাদেশের অনলাইন ক্যাসিনোর লেনদেন করে সেলিম। ব্যাংক তিনটি হলো, বিদেশী ব্যাংক কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন এবং দেশের বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক দ্য সিটি ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক। অনলাইন গেটওয়ে দিয়ে এই তিন ব্যাংকে টাকা আসতো। লেনদেন করত সেলিম প্রধানের সহকারী আক্তারুজ্জামান। সেলিম প্রধানের সঙ্গে সমান অংশীদারিত্বে উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মিস্টার তু অনলাইন ক্যাসিনোর ব্যবসা করত। এই অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হতো অথবা কোরিয়ান নাগরিক নিজে এসেও টাকা নিতেন।
সবশেষ, ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হন কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অবৈধ আয়ের অর্থেই টেক্সাসের বাড়ি কিনেছেন বলে স্বীকার করেছেন তিনি। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় পাঁচ ও ছয়তলার দুটি বাড়ি এবং একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। এছাড়া দেশে-বিদেশে নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ করেছেন। গত শুক্রবার মিজানকে গ্রেপ্তারের পর তার ঢাকার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র এবং ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক। এছাড়া বিদেশে অর্থ পাচারের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে মিজানের বিরুদ্ধে।
No comments