ফেরার উপায় নেই দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দাদের by আলিমুজ্জামান মিলন
ববি,
শিখা, লাবনী, চাঁদনী দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দা। যদিও তাদের নির্দিষ্ট
কোনো নাম নেই। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের নামেরও পরিবর্তন হয়। ভাগ্যই এদের
করেছে নাম-ঠিকানাবিহীন। জীবন সম্পর্কে জানার আগেই ওরা হয়ে গেছে যৌনকর্মী।
নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার বয়স হওয়ার আগেই পরিবেশ তাদের বাধ্য করেছে এ পেশায়
আসতে। এ রকম হাজারো গল্প দেশের বৃহত্তম গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া
যৌনপল্লীর বাসিন্দার।
এ পথে আসার পেছনে প্রত্যেকের জীবনেই থাকে কষ্টের দীর্ঘ ইতিহাস। জীবিকার প্রয়োজনে কৃত্রিম আনন্দের মধ্যে তা লুকিয়ে রাখতে হয়। প্রতিদিন যৌনপল্লীর বিভিন্ন গলিতে হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় খদ্দের ধরতে। কারণ হাসি মুখ না দেখলে খদ্দের পাবে না। এক পৃথিবী কষ্ট বুকে চেপে কৃত্রিম হাসি মুখে খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকে ওরা। কাউকে বুঝতে বা জানতে দেয় না তারা।
এই অভিশপ্ত জীবন কাটানো আরো একজন হলেন দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দা রুপা (১৮)। ময়মনসিংহ শহরে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই সাজু-গুজুর প্রতি ছিল তার দারুণ আগ্রহ। এ আগ্রহই তার জীবনের কাল হয়েছে। সুশ্রী চেহারার সঙ্গে কথা বলার বাচনভঙ্গিতে সহজেই ফুটে ওঠে আভিজাত্য। আলাপকালে তিনি জানান, বছর তিনেক আগের কথা। তাদের বাড়িতে ভাড়া থাকত বৃষ্টি নামের এক নারী। লেখাপড়ায় তার তেমন আগ্রহ ছিল না।
বৃষ্টি তাকে বিউটি পার্লারের কাজ শোখার কথা বলে ফুসলিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন টাঙ্গাইলে। সেখানে একটি বাসায় আটকে প্রায় এক মাস তাকে লিপ্ত করে যৌন পেশায়। মাসখানেক পর সেখান থেকে বৃষ্টি তাকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে এনে বিক্রি করে দেন। হয়ে যান তালিকাভুক্ত যৌনকর্মী। তিনি আরো জানান, প্রথম দিকে তাকে একজন পাহারাদার সব সময় পাহারা দিয়ে রাখত। এরই মাঝে একদিন সুযোগ বুঝে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর কথিত পাহারাদার বাহিনীর সহযোগিতা চান।
কিন্তু তাকে সহযোগিতা করার বিনিময়ে ওই বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা দাবি করেন ২০ হাজার টাকা। ওই টাকা দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় তাদের কোনো সহযোগিতা পাননি। বরং এ অপরাধে তার ওপর নেমে আসে শারীরিক নির্যাতন। এরপর থেকে এ পেশায় নিজেকে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছেন। এখনো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু তারা জানে না তার এই অভিশপ্ত জীবন সম্পর্কে।
এ পল্লীর আরেক বাসিন্দা রানী (৩৫)। মানিকগঞ্জে উচ্চ বর্ণের এক হিন্দু পরিবারে তার জন্ম। কিশোরী বয়সেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এক মুসলিম ছেলের সঙ্গে। তার হাত ধরে সেই বয়সেই রানী ঘর ছাড়েন। কিন্তু তার সেই প্রেমিক ছিলেন একজন প্রতারক। তাকে নিয়ে বিক্রি করে দেন তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ যৌনপল্লীতে। রানী জানান, এরপর থেকে শুরু হয় তার অন্ধকারে পথচলা। নারায়ণগঞ্জ থেকে উচ্ছেদ হলে চলে আসেন দৌলতদিয়া। এখানে তার গর্ভে জন্ম হয় তিনজন ছেলে-মেয়ের। এই পেশা থেকে আয় করা টাকা দিয়ে ছেলেকে সেফ হোমে এবং মেয়েকে পল্লীর বাইরে একটি বাড়িতে রেখে মাসিক খরচ দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা উপজেলার নীলা (৩৬)। ছোট ছোট তিন বোনকে রেখে বাবা-মা দুজনই মারা যায় তার। তখন এক রকম না খেয়েই চলে তাদের জীবন। এ পরিস্থিতিতে তার বড় বোন বাড়ি থেকে বের হন কাজের সন্ধানে। কি কাজ করতেন তারা তা জানতেন না। সেই বোনের টাকায়ই জোটে তাদের এক বেলার খাবার। একদিন বড় বোন ওই কাজের জন্য তাকেও নিয়ে আসে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে। বিশ বছর ধরে তিনি এখানেই আছেন।
তিনি আবেগ ভরা কণ্ঠে বলেন, ‘এ অভিশপ্ত পথ আর ভালো লাগে না। এখন ভালো কিছু করতে চাই।’ তবে তা কীভাবে সম্ভব তা সে নিজেও জানে না।
পল্লীর আরেক বাসিন্দা নূপুর (১৮)। তার বাড়ি যশোর জেলায়। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাবার ছোট একটা মুদি দোকান আছে। কিন্তু ঘরে সৎ মার নির্যাতন সইতে না পেরে তার বড় বোনের সঙ্গে কাজের সন্ধানে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। দৌলতদিয়া ঘাটে এসে তার বোনকে হারিয়ে ফেলেন। এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ঢুকে পড়েন দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আটকা পড়ে যান পল্লীর এক সর্দারনীর কাছে। এরপর এক বছর তাকে দিয়ে ওই সর্দারনী যৌন ব্যবসা চালিয়ে তাকে মুক্ত করে দেন। কলঙ্কিত এই জীবন নিয়ে আর কোনোদিন ফিরে যেতে চান না স্বাভাবিক জীবনে। কেন জানতে চাইলে তার সোজা উত্তর, এ সমাজ আমাকে আর কোনোদিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেবে না, মেনে নেবে না। বাকি জীবনটা রাস্তায় কাটাতে হবে।
ছিপছিপে গড়নের শ্যামলা মেয়ে বৃষ্টি (১৮)। কুড়িগ্রাম জেলার দরিদ্র এক পরিবারের মেয়ে বৃষ্টি। দরিদ্র পরিবারে একটু সচ্ছলতা দিতে স্থানীয় পরিচিত এক ব্যক্তির হাত ধরে রাজধানীতে আসে গার্মেন্টসে কাজের সন্ধানে। সামান্য বেতনে কিছুদিন কাজও করেন। কিন্তু তা দিয়ে তার চলছিল না। একদিন এক সহকর্মী আরো ভালো বেতনে কাজ পাইয়ে দেয়ার প্রলভোন দেখিয়ে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেন। প্রথম দিকে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তির। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছেন। এখন মাঝে মধ্যেই বাড়িতে টাকা পাঠান বৃষ্টি। তবে চাকরি করে নয়, নিজেকে বিক্রি করে।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লী সংলগ্ন একটি এনজিও অফিসে কথা হয় পাপিয়া (৩৫) নামের এক নারীর সঙ্গে। তিনি এক সময় দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে থাকতেন। তখন জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংগ্রহ চলছিল। তথ্য সংগ্রহকারী তার স্বামীর নাম জানতে চাইলে তিনি তার কাছে মাঝে মধ্যে আসা এক ব্যক্তির নাম বলেন। সে অনুযায়ী তার জাতীয় পরিচয়পত্র হয়ে যায়। কিন্তু এর কিছুদিন পর তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেন এক ব্যবসায়ী।
বর্তমানে সেখানে তিনি সংসার করছেন। একটি কন্যা সন্তানও হয়েছে তাদের ঘরে। এখন কন্যার বাবার পরিচয়সহ বিভিন্ন কাজে তাকে দারুণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। স্বামীর নাম পরিবর্তন করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী তালাকনামা প্রয়োজন হয়। কিন্তু তার তো বিয়েই হয়নি। তালাকনামা পাবে কোথায়।
কীভাবে তিনি যৌনপল্লীতে এসেছিলেন জানতে চাইলে তিনি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, চার বোন ও মাকে রেখে বাবার মৃত্যু হয়। বড় বোন অভাবের তাড়নায় কাজের খোঁজে ঢাকায় গিয়ে ঠিকানা হয় নারায়ণগঞ্জের যৌনপল্লী। সেই প্রিয় বোন বাড়িতে গিয়ে আমাকে বলেছিল, ‘তোর দুলাভাই বিদেশে থাকে, আমি একা থাকি, তুই আমার কাছে থাকবি।’ তার কথা বিশ্বাস করে তার সঙ্গে এলে সেই বোন আমাকে জোর করে এই অভিশপ্ত জীবনযাপনে বাধ্য করে।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে অন্তত দুই হাজার যৌনকর্মীর বসবাস। এদের বেশির ভাগই ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে। পাল্টে নিতে চায় তাদের জীবনের গতিপথ। কিন্তু তাদের গন্তব্য জানা নেই। কারণ কে বাড়াবে সহযোগিতার হাত? কে দেখাবে সহানুভতি?
সূত্রমতে, দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাইরেও শত শত শিশু-কিশোরী যৌনকর্মী রয়েছে। এসব শিশু অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র আরো ভয়াবহ। এদের অনেকেই যৌনকর্মীদের মেয়ে বা পরিবারের দারিদ্র্যতার কারণে চাকরির জন্য ঢাকায় এসে দালালের খপ্পরে পড়ে বিক্রি হয়ে যায়। এরপর তাদের ঠিকানা হয় দেশের বিভিন্ন যৌনপল্লী। আর এ পথ থেকে ফিরে যেতে পারে না স্বাভাবিক জীবনে।
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, যৌনকর্মীদের অস্তিত্ব বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর যাদের অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়, তাদের কর্মসংস্থান দিয়ে পুনর্বাসনের মতো তেমন কোনো প্রকল্প সমাজ সেবা অধিদপ্তরে নেই। তবে যৌনকর্মীদের সামাজিক প্রতিবন্ধী হিসেবে গণ্য করে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সীমিত আকারে সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।
বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক উদ্ধার হওয়া নারীদের ওইসব কেন্দ্রে পাঠানো হয়ে থাকে। এ ছাড়া যৌনপল্লীতে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের জীবন মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে স্থানীয় সমাজ সেবা অধিদপ্তর।
এ পথে আসার পেছনে প্রত্যেকের জীবনেই থাকে কষ্টের দীর্ঘ ইতিহাস। জীবিকার প্রয়োজনে কৃত্রিম আনন্দের মধ্যে তা লুকিয়ে রাখতে হয়। প্রতিদিন যৌনপল্লীর বিভিন্ন গলিতে হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় খদ্দের ধরতে। কারণ হাসি মুখ না দেখলে খদ্দের পাবে না। এক পৃথিবী কষ্ট বুকে চেপে কৃত্রিম হাসি মুখে খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকে ওরা। কাউকে বুঝতে বা জানতে দেয় না তারা।
এই অভিশপ্ত জীবন কাটানো আরো একজন হলেন দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দা রুপা (১৮)। ময়মনসিংহ শহরে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই সাজু-গুজুর প্রতি ছিল তার দারুণ আগ্রহ। এ আগ্রহই তার জীবনের কাল হয়েছে। সুশ্রী চেহারার সঙ্গে কথা বলার বাচনভঙ্গিতে সহজেই ফুটে ওঠে আভিজাত্য। আলাপকালে তিনি জানান, বছর তিনেক আগের কথা। তাদের বাড়িতে ভাড়া থাকত বৃষ্টি নামের এক নারী। লেখাপড়ায় তার তেমন আগ্রহ ছিল না।
বৃষ্টি তাকে বিউটি পার্লারের কাজ শোখার কথা বলে ফুসলিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন টাঙ্গাইলে। সেখানে একটি বাসায় আটকে প্রায় এক মাস তাকে লিপ্ত করে যৌন পেশায়। মাসখানেক পর সেখান থেকে বৃষ্টি তাকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে এনে বিক্রি করে দেন। হয়ে যান তালিকাভুক্ত যৌনকর্মী। তিনি আরো জানান, প্রথম দিকে তাকে একজন পাহারাদার সব সময় পাহারা দিয়ে রাখত। এরই মাঝে একদিন সুযোগ বুঝে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর কথিত পাহারাদার বাহিনীর সহযোগিতা চান।
কিন্তু তাকে সহযোগিতা করার বিনিময়ে ওই বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা দাবি করেন ২০ হাজার টাকা। ওই টাকা দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় তাদের কোনো সহযোগিতা পাননি। বরং এ অপরাধে তার ওপর নেমে আসে শারীরিক নির্যাতন। এরপর থেকে এ পেশায় নিজেকে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছেন। এখনো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু তারা জানে না তার এই অভিশপ্ত জীবন সম্পর্কে।
এ পল্লীর আরেক বাসিন্দা রানী (৩৫)। মানিকগঞ্জে উচ্চ বর্ণের এক হিন্দু পরিবারে তার জন্ম। কিশোরী বয়সেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এক মুসলিম ছেলের সঙ্গে। তার হাত ধরে সেই বয়সেই রানী ঘর ছাড়েন। কিন্তু তার সেই প্রেমিক ছিলেন একজন প্রতারক। তাকে নিয়ে বিক্রি করে দেন তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ যৌনপল্লীতে। রানী জানান, এরপর থেকে শুরু হয় তার অন্ধকারে পথচলা। নারায়ণগঞ্জ থেকে উচ্ছেদ হলে চলে আসেন দৌলতদিয়া। এখানে তার গর্ভে জন্ম হয় তিনজন ছেলে-মেয়ের। এই পেশা থেকে আয় করা টাকা দিয়ে ছেলেকে সেফ হোমে এবং মেয়েকে পল্লীর বাইরে একটি বাড়িতে রেখে মাসিক খরচ দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা উপজেলার নীলা (৩৬)। ছোট ছোট তিন বোনকে রেখে বাবা-মা দুজনই মারা যায় তার। তখন এক রকম না খেয়েই চলে তাদের জীবন। এ পরিস্থিতিতে তার বড় বোন বাড়ি থেকে বের হন কাজের সন্ধানে। কি কাজ করতেন তারা তা জানতেন না। সেই বোনের টাকায়ই জোটে তাদের এক বেলার খাবার। একদিন বড় বোন ওই কাজের জন্য তাকেও নিয়ে আসে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে। বিশ বছর ধরে তিনি এখানেই আছেন।
তিনি আবেগ ভরা কণ্ঠে বলেন, ‘এ অভিশপ্ত পথ আর ভালো লাগে না। এখন ভালো কিছু করতে চাই।’ তবে তা কীভাবে সম্ভব তা সে নিজেও জানে না।
পল্লীর আরেক বাসিন্দা নূপুর (১৮)। তার বাড়ি যশোর জেলায়। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাবার ছোট একটা মুদি দোকান আছে। কিন্তু ঘরে সৎ মার নির্যাতন সইতে না পেরে তার বড় বোনের সঙ্গে কাজের সন্ধানে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। দৌলতদিয়া ঘাটে এসে তার বোনকে হারিয়ে ফেলেন। এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ঢুকে পড়েন দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আটকা পড়ে যান পল্লীর এক সর্দারনীর কাছে। এরপর এক বছর তাকে দিয়ে ওই সর্দারনী যৌন ব্যবসা চালিয়ে তাকে মুক্ত করে দেন। কলঙ্কিত এই জীবন নিয়ে আর কোনোদিন ফিরে যেতে চান না স্বাভাবিক জীবনে। কেন জানতে চাইলে তার সোজা উত্তর, এ সমাজ আমাকে আর কোনোদিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেবে না, মেনে নেবে না। বাকি জীবনটা রাস্তায় কাটাতে হবে।
ছিপছিপে গড়নের শ্যামলা মেয়ে বৃষ্টি (১৮)। কুড়িগ্রাম জেলার দরিদ্র এক পরিবারের মেয়ে বৃষ্টি। দরিদ্র পরিবারে একটু সচ্ছলতা দিতে স্থানীয় পরিচিত এক ব্যক্তির হাত ধরে রাজধানীতে আসে গার্মেন্টসে কাজের সন্ধানে। সামান্য বেতনে কিছুদিন কাজও করেন। কিন্তু তা দিয়ে তার চলছিল না। একদিন এক সহকর্মী আরো ভালো বেতনে কাজ পাইয়ে দেয়ার প্রলভোন দেখিয়ে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেন। প্রথম দিকে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তির। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছেন। এখন মাঝে মধ্যেই বাড়িতে টাকা পাঠান বৃষ্টি। তবে চাকরি করে নয়, নিজেকে বিক্রি করে।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লী সংলগ্ন একটি এনজিও অফিসে কথা হয় পাপিয়া (৩৫) নামের এক নারীর সঙ্গে। তিনি এক সময় দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে থাকতেন। তখন জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংগ্রহ চলছিল। তথ্য সংগ্রহকারী তার স্বামীর নাম জানতে চাইলে তিনি তার কাছে মাঝে মধ্যে আসা এক ব্যক্তির নাম বলেন। সে অনুযায়ী তার জাতীয় পরিচয়পত্র হয়ে যায়। কিন্তু এর কিছুদিন পর তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেন এক ব্যবসায়ী।
বর্তমানে সেখানে তিনি সংসার করছেন। একটি কন্যা সন্তানও হয়েছে তাদের ঘরে। এখন কন্যার বাবার পরিচয়সহ বিভিন্ন কাজে তাকে দারুণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। স্বামীর নাম পরিবর্তন করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী তালাকনামা প্রয়োজন হয়। কিন্তু তার তো বিয়েই হয়নি। তালাকনামা পাবে কোথায়।
কীভাবে তিনি যৌনপল্লীতে এসেছিলেন জানতে চাইলে তিনি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, চার বোন ও মাকে রেখে বাবার মৃত্যু হয়। বড় বোন অভাবের তাড়নায় কাজের খোঁজে ঢাকায় গিয়ে ঠিকানা হয় নারায়ণগঞ্জের যৌনপল্লী। সেই প্রিয় বোন বাড়িতে গিয়ে আমাকে বলেছিল, ‘তোর দুলাভাই বিদেশে থাকে, আমি একা থাকি, তুই আমার কাছে থাকবি।’ তার কথা বিশ্বাস করে তার সঙ্গে এলে সেই বোন আমাকে জোর করে এই অভিশপ্ত জীবনযাপনে বাধ্য করে।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে অন্তত দুই হাজার যৌনকর্মীর বসবাস। এদের বেশির ভাগই ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে। পাল্টে নিতে চায় তাদের জীবনের গতিপথ। কিন্তু তাদের গন্তব্য জানা নেই। কারণ কে বাড়াবে সহযোগিতার হাত? কে দেখাবে সহানুভতি?
সূত্রমতে, দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাইরেও শত শত শিশু-কিশোরী যৌনকর্মী রয়েছে। এসব শিশু অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র আরো ভয়াবহ। এদের অনেকেই যৌনকর্মীদের মেয়ে বা পরিবারের দারিদ্র্যতার কারণে চাকরির জন্য ঢাকায় এসে দালালের খপ্পরে পড়ে বিক্রি হয়ে যায়। এরপর তাদের ঠিকানা হয় দেশের বিভিন্ন যৌনপল্লী। আর এ পথ থেকে ফিরে যেতে পারে না স্বাভাবিক জীবনে।
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, যৌনকর্মীদের অস্তিত্ব বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর যাদের অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়, তাদের কর্মসংস্থান দিয়ে পুনর্বাসনের মতো তেমন কোনো প্রকল্প সমাজ সেবা অধিদপ্তরে নেই। তবে যৌনকর্মীদের সামাজিক প্রতিবন্ধী হিসেবে গণ্য করে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সীমিত আকারে সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।
বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক উদ্ধার হওয়া নারীদের ওইসব কেন্দ্রে পাঠানো হয়ে থাকে। এ ছাড়া যৌনপল্লীতে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের জীবন মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে স্থানীয় সমাজ সেবা অধিদপ্তর।
আগস্ট ৯, ২০১৮ ভোরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদন
No comments