মোহাম্মদপুরের সুলতান by মোহাম্মদ ওমর ফারুক
কী
ছিলেন, আর কী হলেন! হিসাব মেলানো যায় না। এ এক অবিশ্বাস্য উত্থানের
কাহিনী। কাউন্সিলর পদ যেন আলাদীনের চেরাগের চেয়েও বেশি কিছু। ফুঁ দিলেই
বদলে যায় সব। বদলে গেছে যেমন তারেকুজ্জামান রাজীবের জীবনও। তিনি ঢাকা
উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। স্থানীয়রা বলেন,
কাউন্সিলর হওয়ার পরপরই সম্পূর্ণ বদলে যান রাজীব। তার চালচলনে ব্যাপক
পরিবর্তন আসে।
হঠাৎ কেউ দেখলে মনে হবে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাজা, বাদশাহ বা সুলতান। কোথাও গেলে সঙ্গে থাকে গাড়ি আর মোটরবাইকের বহর। রাস্তা বন্ধ করে চলে এসব গাড়ি। রোদে গেলে আশেপাশের কেউ ধরে রাখে ছাতা। সঙ্গে ক্যাডার বাহিনী তো আছেই। মাত্র চার বছরে মালিক বনে গেছেন অঢেল সম্পত্তি, গাড়ি আর বাড়ির। ইচ্ছে হলেই বদলান গাড়ি। রয়েছে মোটা অঙ্কের ব্যাংক ব্যালেন্স। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দিয়েছেন বাড়ি-গাড়ি।
এই কাউন্সিলর নিজের এলাকায় গড়ে তুলেছেন রাজত্ব। চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, টেন্ডারবাজি, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ আর মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত করেছেন তার সাম্রাজ্য। মোহাম্মদপুরের বসিলা, ওয়াশপুর, কাটাসুর, গ্রাফিক্স আর্টস ও শারীরিক শিক্ষা কলেজ, মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি এবং বাঁশবাড়ী এলাকায় তৈরি করেছেন একক আধিপত্য। ২০১৫ সালের কাউন্সিলর নির্বাচনে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। বিভিন্ন কারসাজি করে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমানকে হারান। অভিযোগ রয়েছে এরপর থেকেই এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করছেন না তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৩৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, রাজীব কাউন্সিলর হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীকে পাত্তা দেন না। তার নির্যাতনে অস্থির সাধারণ নেতাকর্মীরা। আমাদের নেতাকর্মীদের মারধরসহ সবই হয় তার নেতৃত্বে। কয়েক বছর আগে ১০০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অফিস ভেঙে দেন রাজীব কাউন্সিলর।
জানা যায়, মোহাম্মদপুর এলাকায় যুবলীগের রাজনীতি দিয়েই শুরু হয় রাজীবের রাজনৈতিক জীবন। চালাক চতুর রাজীব অল্পদিনেই নেতাদের সান্নিধ্যে এসে মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ বাগিয়ে নেন। এই পদ পেয়েই থানা আওয়ামী লীগের এক নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্যে জুতা পিটাসহ লাঞ্ছিত করেন। সে সময় যুবলীগ থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, তারেকুজ্জামান রাজীব মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বহিষ্কারাদেশ বাতিল করে উল্টো ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বনে যান। কেন্দ্রীয় যুবলীগের আলোচিত দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমানকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে এ পদ কেনেন রাজীব। যুবলীগের সাইনবোর্ড আর কাউন্সিলরের পদটি ব্যবহার করে এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, ডিশ ব্যবসাসহ নানা মাধ্যমে হয়ে উঠেন আরো দুর্ধর্ষ ও বেপরোয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাউন্সিলর নির্বাচন করার আগে রাজনীতির পাশাপাশি এক চাচাকে কাজকর্মে সহযোগিতা করতেন। ওই চাচা ঠিকাদারি করতেন। নির্বাচনের সময় তার ওই চাচা একটি জমি বিক্রি করে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে তাকে কাউন্সিলর নির্বাচন করতে সহযোগিতা করেন। ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় এখন ওই চাচার সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। তার চাচার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি কথা বলতে চাননি। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত ৪ বছরে ৮-১০টির বেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কিনেছেন রাজীব। যার মধ্যে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, ক্রাউন প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮, বিএমডব্লিউ স্পোর্টস কার রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি গাড়ির নম্বর এসেছে এই রিপোর্টারের হাতে। ঢাকা মেট্রো-ম ০০-৬৬৪, ঢাকা মেট্রো-শ ০০-০৬৬৪, মেট্রো-ল-০০-০৬৬৪, মেট্রো-ঘ-১৮-২৬৯৩, ঢাকা মেট্রো ভ-১১-০১৭১, ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৪-২৮৫৪, ঢাকা মেট্রো-খ ১১-৭৭৮২। এই গাড়িগুলোর বেশ কয়েকটি নম্বরের রেজিস্ট্রেশন নেই। ভুয়া নম্বর ব্যবহার করে তিনি গাড়িগুলো চালাচ্ছেন। এ ছাড়াও গুলশান, মোহাম্মদপুরে তার সাত/আটটি ফ্ল্যাট কেনার তথ্যও পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা বলেন, কমিশনার হওয়ার পরপরই রাজীব তার ক্যাডার বাহিনীর প্রচারণায় বনে যান স্বঘোষিত ‘জনতার কমিশনার’। আর এই ‘জনতার কমিশনার’ জনতার কাছ থেকেই চাঁদা তুলেন কোটি কোটি টাকা। দখল করেন জনগণের জমি। বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, ফুটপাথই তার চাঁদা তোলার মূল উৎস। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহআলম, জীবন, ইয়াবা ব্যবসায়ী সিএনজি কামাল, অভি ফারুক, আশিকুর রহমান রনির মাধ্যমে প্রতিমাসে শুধু স্ট্যান্ড থেকেই তুলেন প্রায় দুই কোটি টাকা। কোথা থেকে কে, কত টাকা করে চাঁদা তুলে কাউন্সিলরকে দেন- এমন একটি লিস্ট এসেছে এই রিপোর্টারের কাছে। মোহাম্মদপুর এলাকার ফুটপাথগুলো থেকে প্রায় কোটি টাকা চাঁদা আসে তার পকেটে। তার ওয়ার্ডে সব ধরনের টেন্ডার থেকে তাকে দিতে হয় নির্দিষ্ট পার্সেন্টিজ। মোহাম্মদপুর থেকে আল্লাহকরিম মসজিদ পর্যন্ত পুরো ফুটপাথ থেকে প্রতিদিনই চাঁদা তুলেন তার লোকজন। অভিযোগ রয়েছে আল্লাহ করিম মসজিদ ও মার্কেট কমিটিতে জোর করে তার লোককে রাখা হয়। যদিও এই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগে। তারপরও নতুন কমিটি দেয়া হচ্ছে না। এই মসজিদ মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গায় দোকানপাট করে এসব দোকানপ্রতি একটা বড় অঙ্কের টাকা নেন তিনি। শুধু তাই নয়, মসজিদ ও মার্কেটের জেনারেটর রাখার জায়গাটিতেও তিনি দোকান বসিয়েছেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, তারেকুজ্জামান রাজীব মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নং রোড এলাকায় পানির পাম্পের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বাড়ি বানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আর্কিটেক্ট দিয়ে ডিজাইন করে অত্যাধুনিক ফিটিংস দিয়ে রাজপ্রাসাদের আদলে আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি বানান তিনি। শুধুমাত্র বাড়ির জায়গাটির দাম প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। বাড়িটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে আরো দুই কোটি টাকা। এ ছাড়াও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, দুবাইতে বুর্জ খলিফার পাশে একটি বাড়ি এবং সৌদি প্রবাসী মিজান নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে হোটেল ব্যবসায় অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলে আলোচনা রয়েছে তার এলাকায়।
এদিকে তার কাছের লোকজন দিয়েও চালিয়ে যাচ্ছেন রাজত্ব। অভিযোগ রয়েছে তার শ্যালক একরাম বিভিন্ন হাউজিংসহ নানা জায়গায় গিয়ে জায়গাজমিন সংক্রান্ত ব্যাপারে জবরদস্তি করেন। পরে এসব ঝামেলা মেটান কাউন্সিলর নিজেই। শুধু তাই নয়, রহিম ব্যাপারী ঘাটের ৩৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের অফিসটিও তার নেতৃত্বে দখল করেছে যুবলীগের নেতাকর্মীরা। কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা আশিকুর রহমান রনি (ভাঙ্গাড়ি রনি) চার রাস্তার মোড় ময়ূরী ভিলার পাশে সিটি করপোরেশনের পাবলিক টয়লেটের পাশে সরকারি জায়গা দখল করে চারটি পাকা দোকান এবং একটি অফিস করে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের জন্য যাদের জমি সরকার নিয়েছে তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দকৃত জায়গাটিও দখল করে ট্রাক ও বাস রাখার জন্য ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে প্রতিটি বাস ও ট্রাক থেকে অগ্রিম লাখখানেক টাকা নিয়েছেন কাউন্সিলরের লোকজন।
অভিযোগ পাওয়া যায়, মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে ৫ নম্বর রোডে ৫ নম্বর প্লটের ব্লক ডি- এর মন্টু মিয়া নামের একজনের প্লট দখল করে মহিউদ্দিন নামে একজনের কাছে বিক্রয় করে হস্তান্তর করেন। জানা যায়, বাড়িটির সামনে প্রথমে একটি গেইট ছিল এবং মন্টু মিয়ার নামে একটি সাইনবোর্ড ছিল। পরে কমিশনার কর্তৃক এই জায়গাটি দখল করা হয়। বাড়িটির ক্রেতা মহিউদ্দিন বলেন, কমিশনারের কাছ থেকে আমি ৭৫ লাখ টাকায় এই প্লটটি কিনেছি। কিন্তু কাউন্সিলর কার থেকে এই প্লটটি কিনেছেন তা আমি বলতে পারবো না। এদিকে সাত মসজিদ হাউজিং ব্লক সি রোড-১ এর পশ্চিমের মাথায় খালের জমি দখল করে দু’তলা বাড়ি করে তার চাচাতো ভাই বাবুকে উপহার দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা রিয়েল এস্টেটের তিন নম্বর রোডের একটি বাড়ি দখলে আছে তার। এদিকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে সাত মসজিদ হাউজিংয়ে আমেরিকা প্রবাসী নজরুল ইসলামের তিন কাঠার ১টি প্লট দখল করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নজরুল ইসলামের ভাগ্নে মামুন বলেন, আমরা কিস্তির মাধ্যমে এই প্লটটি কিনেছিলাম। সে সময় হাউজিং যখন আমাদের প্লটটি বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল, তখন তাজু নামে একজন আমাদের কাছে চাঁদা দাবি করেন। সে সময় আমরা চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায়, তাজু কাউন্সিলরের সহযোগিতায় কিছু দিন ভোগ করি। পরে কাউন্সিলর নিজেই জমিটি ভোগদখল শুরু করেন। হাউজিংয়ের অফিসে গেলেই সব খবর পাবেন। একই হাউজিংয়ে গিয়াস উদ্দিন নামে অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তার আড়াই কাঠা জমি দখল করার অভিযোগ আছে তার লোকজনের বিরুদ্ধে। গিয়াস উদ্দিনের শ্যালক আজিমুর রশিদ বলেন, ’৮০ সালের দিকে দুলাভাই জমিটা কিনেছে। আমি যেহেতু মোহাম্মদপুরে থাকি আমি জমিটার সব বিষয়ে সামনে ছিলাম। এটা অনেক পানির নিচে ছিল। পরে হাউজিংয়ের সঙ্গে এডজাস্ট হয়ে মাটি ভরাট করার পরে আমরা জমিটি বুঝে পাই ২০১০-এ। পরে গত কয়েক বছর আগে জমিটি দখল করতে গেলে চান্দু মিয়া আর নাজমা নামে দুই ব্যক্তি জমিটিতে কিছু করতে দিচ্ছিলো না। পরে বর্তমান এমপি সাদেক খান ও তেজগাঁও জোনের ডিসি বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য থানাকে নির্দেশ দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চান্দু মিয়া আর নাজমা বেগম যুবলীগের শাহআলম এবং কাউন্সিলরের কাছের লোক।
এদিকে আধিপত্য বজায় রাখতে মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের কাঁচাবাজারের নির্বাচিত সভাপতি আবুল হোসেনকে দীর্ঘদিন ধরে বাজারে প্রবেশ করতে দেয় না কাউন্সিলরের লোকজন। শুধু তাই নয় কাটাসুর বাজার দখল করে উন্নয়নের নামে প্রতিটি দোকান থেকে লাখ টাকা করে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি এখনো পর্যন্ত। প্রতিটি কোরবানি ঈদের সময় মোহাম্মদপুরের তিনটি হাট সবসময়ই থাকে তার নিয়ন্ত্রণে। এদিকে তার লোক যুবলীগ ৩৩ নং ওয়ার্ডের নেতা অভি ফারুক বসিলা রোডের ওপর জায়গা দখল করে নিজের অফিস বানিয়ে রেখেছেন। সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানা জায়গা দখল করে মোহাম্মদপুরে সবগুলো যুবলীগের অফিসই কাউন্সিলরের নেতৃত্বে করার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদপুরে যুবলীগ কর্মী তছির উদ্দিনের হত্যা মামলার আসামিরা কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের ঘনিষ্ঠ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে তছিরকে খুন করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলো জাকির, হাসান, সোলেমান, ফিরোজ এবং শাহীন। স্থানীয়রা জানায়, এলাকায় মাদক ব্যবসা, ডিশ ব্যবসা, গরুর হাটের নিয়ন্ত্রণ, খাল ভরাট করে দোকান নির্মাণ ও খাসজমি দখলকে কেন্দ্র করে রাজীব এবং কাইল্যা সুমনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। কাইল্যা সুমনের গ্রুপে কাজ করতো তছিরসহ কয়েকজন।
কাউন্সিলর রাজীব যা বলেন-
দিন কয়েক আগে তারেকুজ্জামান রাজীবের সঙ্গে ফোনে কথা হয় এই রিপোর্টারের। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দেন তিনি। বাসস্ট্যান্ড ও ফুটপাথে চাঁদাবাজি নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের পুলিশ আছে, গোয়েন্দা সংস্থার লোক আছে। তাদের তো জানার কথা। অভিযোগ তো সবার বিরুদ্ধে করা যায়। প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে তো দোষী বলা যাবে না। আমি রাজনীতি করি, এলাকার জনপ্রতিনিধি। আমার বিরুদ্ধে এক পক্ষ বলবেই, সেটাই স্বাভাবিক। এটাকে ঠিক অভিযোগ বলা যাবে না। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন জায়গা দখল করে ওয়ার্ড যুবলীগের অফিসের ব্যাপারে তিনি বলেন, এই অভিযোগ অলরেডি উচ্ছেদ তালিকাভুক্ত করা আছে। আমরা শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান চালাবো। পাবলিক টয়লেটের পাশে চারটি দোকান দখলের ব্যাপারে তিনি বলেন, কে বা কারা দখল করেছে বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেবো। যদিও তিনি এই দোকান ও পাবলিক টয়লেট উদ্বোধন করেন। নামিদামি ব্র্যান্ডের ৭/৮টি গাড়ির ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ধরনের আমার কোনো গাড়ি নেই। আমি বিভিন্ন শোরুম থেকে গাড়িগুলো ভাড়া করে এনে চালাই। আমার নামে শুধু একটি গাড়ি আছে। পানির পাম্প দখল করে বাড়ি নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটা পানির পাম্প করতে যতটুকু জায়গা প্রয়োজন আমার বাড়ির জায়গাটি এর চেয়ে বড়। কেউ অভিযোগ করলেই তো হবে না। আমার এই সম্পত্তি ক্রয়কৃত। কোনোকালেই এখানে পানির পাম্প করার কথা ছিল না। মোহাম্মদপুরে বাড়ি দখলের ব্যাপারে কাউন্সিলর রাজীব বলেন, আমি কোনো বাড়ি দখল করিনি। আমার যত বাড়ি আছে এনবিআরের কাছে তথ্য দেয়া আছে। আমি জানিও না কাদের বাড়ির কথা আপনি বলছেন। আমি কয়েকটা হাউজিংয়ের সঙ্গে শেয়ারে ব্যবসা করি। এবং ছোটখাটো কিছু ব্যবসা আছে। এসব তথ্য এনবিআরে দেয়া আছে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি বুর্জ খলিফার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে যদি বুর্জ খলিফা আমার হয়ে যায় তাহলে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমি যদি কোনো গাড়ির সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি ওই গাড়ি আমার হয়ে যায় তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আমার যদি দেশের বাইরে বাড়ি থাকে তাহলে তো সরকারের কাছে তথ্য থাকার কথা। তসির উদ্দিন হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের ইতিমধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কোর্ট থেকে এখন মনে হয় দুইজন জামিনে আছে। আমার কাছে অনেক মানুষ আসতে পারে। তার মানে আমার কাছের লোক বা আত্মীয় নয়। এক মুক্তিযোদ্ধাকে জুতাপেটা ও যুবলীগ থেকে বহিষ্কার হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যুবলীগের পদ কেনার ব্যাপারে তিনি বলেন, বিষয়টি হাস্যকর। উল্টো আমি যে জায়গায় থাকার কথা সেই জায়গায় আমি যেতে পারিনি। আমার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ এসেছে সবগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট।
হঠাৎ কেউ দেখলে মনে হবে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাজা, বাদশাহ বা সুলতান। কোথাও গেলে সঙ্গে থাকে গাড়ি আর মোটরবাইকের বহর। রাস্তা বন্ধ করে চলে এসব গাড়ি। রোদে গেলে আশেপাশের কেউ ধরে রাখে ছাতা। সঙ্গে ক্যাডার বাহিনী তো আছেই। মাত্র চার বছরে মালিক বনে গেছেন অঢেল সম্পত্তি, গাড়ি আর বাড়ির। ইচ্ছে হলেই বদলান গাড়ি। রয়েছে মোটা অঙ্কের ব্যাংক ব্যালেন্স। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দিয়েছেন বাড়ি-গাড়ি।
এই কাউন্সিলর নিজের এলাকায় গড়ে তুলেছেন রাজত্ব। চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, টেন্ডারবাজি, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ আর মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত করেছেন তার সাম্রাজ্য। মোহাম্মদপুরের বসিলা, ওয়াশপুর, কাটাসুর, গ্রাফিক্স আর্টস ও শারীরিক শিক্ষা কলেজ, মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি এবং বাঁশবাড়ী এলাকায় তৈরি করেছেন একক আধিপত্য। ২০১৫ সালের কাউন্সিলর নির্বাচনে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। বিভিন্ন কারসাজি করে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমানকে হারান। অভিযোগ রয়েছে এরপর থেকেই এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করছেন না তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৩৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, রাজীব কাউন্সিলর হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীকে পাত্তা দেন না। তার নির্যাতনে অস্থির সাধারণ নেতাকর্মীরা। আমাদের নেতাকর্মীদের মারধরসহ সবই হয় তার নেতৃত্বে। কয়েক বছর আগে ১০০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অফিস ভেঙে দেন রাজীব কাউন্সিলর।
জানা যায়, মোহাম্মদপুর এলাকায় যুবলীগের রাজনীতি দিয়েই শুরু হয় রাজীবের রাজনৈতিক জীবন। চালাক চতুর রাজীব অল্পদিনেই নেতাদের সান্নিধ্যে এসে মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ বাগিয়ে নেন। এই পদ পেয়েই থানা আওয়ামী লীগের এক নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্যে জুতা পিটাসহ লাঞ্ছিত করেন। সে সময় যুবলীগ থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, তারেকুজ্জামান রাজীব মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বহিষ্কারাদেশ বাতিল করে উল্টো ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বনে যান। কেন্দ্রীয় যুবলীগের আলোচিত দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমানকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে এ পদ কেনেন রাজীব। যুবলীগের সাইনবোর্ড আর কাউন্সিলরের পদটি ব্যবহার করে এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, ডিশ ব্যবসাসহ নানা মাধ্যমে হয়ে উঠেন আরো দুর্ধর্ষ ও বেপরোয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাউন্সিলর নির্বাচন করার আগে রাজনীতির পাশাপাশি এক চাচাকে কাজকর্মে সহযোগিতা করতেন। ওই চাচা ঠিকাদারি করতেন। নির্বাচনের সময় তার ওই চাচা একটি জমি বিক্রি করে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে তাকে কাউন্সিলর নির্বাচন করতে সহযোগিতা করেন। ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় এখন ওই চাচার সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। তার চাচার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি কথা বলতে চাননি। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত ৪ বছরে ৮-১০টির বেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কিনেছেন রাজীব। যার মধ্যে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, ক্রাউন প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮, বিএমডব্লিউ স্পোর্টস কার রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি গাড়ির নম্বর এসেছে এই রিপোর্টারের হাতে। ঢাকা মেট্রো-ম ০০-৬৬৪, ঢাকা মেট্রো-শ ০০-০৬৬৪, মেট্রো-ল-০০-০৬৬৪, মেট্রো-ঘ-১৮-২৬৯৩, ঢাকা মেট্রো ভ-১১-০১৭১, ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৪-২৮৫৪, ঢাকা মেট্রো-খ ১১-৭৭৮২। এই গাড়িগুলোর বেশ কয়েকটি নম্বরের রেজিস্ট্রেশন নেই। ভুয়া নম্বর ব্যবহার করে তিনি গাড়িগুলো চালাচ্ছেন। এ ছাড়াও গুলশান, মোহাম্মদপুরে তার সাত/আটটি ফ্ল্যাট কেনার তথ্যও পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা বলেন, কমিশনার হওয়ার পরপরই রাজীব তার ক্যাডার বাহিনীর প্রচারণায় বনে যান স্বঘোষিত ‘জনতার কমিশনার’। আর এই ‘জনতার কমিশনার’ জনতার কাছ থেকেই চাঁদা তুলেন কোটি কোটি টাকা। দখল করেন জনগণের জমি। বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, ফুটপাথই তার চাঁদা তোলার মূল উৎস। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহআলম, জীবন, ইয়াবা ব্যবসায়ী সিএনজি কামাল, অভি ফারুক, আশিকুর রহমান রনির মাধ্যমে প্রতিমাসে শুধু স্ট্যান্ড থেকেই তুলেন প্রায় দুই কোটি টাকা। কোথা থেকে কে, কত টাকা করে চাঁদা তুলে কাউন্সিলরকে দেন- এমন একটি লিস্ট এসেছে এই রিপোর্টারের কাছে। মোহাম্মদপুর এলাকার ফুটপাথগুলো থেকে প্রায় কোটি টাকা চাঁদা আসে তার পকেটে। তার ওয়ার্ডে সব ধরনের টেন্ডার থেকে তাকে দিতে হয় নির্দিষ্ট পার্সেন্টিজ। মোহাম্মদপুর থেকে আল্লাহকরিম মসজিদ পর্যন্ত পুরো ফুটপাথ থেকে প্রতিদিনই চাঁদা তুলেন তার লোকজন। অভিযোগ রয়েছে আল্লাহ করিম মসজিদ ও মার্কেট কমিটিতে জোর করে তার লোককে রাখা হয়। যদিও এই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগে। তারপরও নতুন কমিটি দেয়া হচ্ছে না। এই মসজিদ মার্কেটের পার্কিংয়ের জায়গায় দোকানপাট করে এসব দোকানপ্রতি একটা বড় অঙ্কের টাকা নেন তিনি। শুধু তাই নয়, মসজিদ ও মার্কেটের জেনারেটর রাখার জায়গাটিতেও তিনি দোকান বসিয়েছেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, তারেকুজ্জামান রাজীব মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নং রোড এলাকায় পানির পাম্পের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বাড়ি বানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আর্কিটেক্ট দিয়ে ডিজাইন করে অত্যাধুনিক ফিটিংস দিয়ে রাজপ্রাসাদের আদলে আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি বানান তিনি। শুধুমাত্র বাড়ির জায়গাটির দাম প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। বাড়িটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে আরো দুই কোটি টাকা। এ ছাড়াও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, দুবাইতে বুর্জ খলিফার পাশে একটি বাড়ি এবং সৌদি প্রবাসী মিজান নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে হোটেল ব্যবসায় অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলে আলোচনা রয়েছে তার এলাকায়।
এদিকে তার কাছের লোকজন দিয়েও চালিয়ে যাচ্ছেন রাজত্ব। অভিযোগ রয়েছে তার শ্যালক একরাম বিভিন্ন হাউজিংসহ নানা জায়গায় গিয়ে জায়গাজমিন সংক্রান্ত ব্যাপারে জবরদস্তি করেন। পরে এসব ঝামেলা মেটান কাউন্সিলর নিজেই। শুধু তাই নয়, রহিম ব্যাপারী ঘাটের ৩৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের অফিসটিও তার নেতৃত্বে দখল করেছে যুবলীগের নেতাকর্মীরা। কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা আশিকুর রহমান রনি (ভাঙ্গাড়ি রনি) চার রাস্তার মোড় ময়ূরী ভিলার পাশে সিটি করপোরেশনের পাবলিক টয়লেটের পাশে সরকারি জায়গা দখল করে চারটি পাকা দোকান এবং একটি অফিস করে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের জন্য যাদের জমি সরকার নিয়েছে তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দকৃত জায়গাটিও দখল করে ট্রাক ও বাস রাখার জন্য ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে প্রতিটি বাস ও ট্রাক থেকে অগ্রিম লাখখানেক টাকা নিয়েছেন কাউন্সিলরের লোকজন।
অভিযোগ পাওয়া যায়, মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে ৫ নম্বর রোডে ৫ নম্বর প্লটের ব্লক ডি- এর মন্টু মিয়া নামের একজনের প্লট দখল করে মহিউদ্দিন নামে একজনের কাছে বিক্রয় করে হস্তান্তর করেন। জানা যায়, বাড়িটির সামনে প্রথমে একটি গেইট ছিল এবং মন্টু মিয়ার নামে একটি সাইনবোর্ড ছিল। পরে কমিশনার কর্তৃক এই জায়গাটি দখল করা হয়। বাড়িটির ক্রেতা মহিউদ্দিন বলেন, কমিশনারের কাছ থেকে আমি ৭৫ লাখ টাকায় এই প্লটটি কিনেছি। কিন্তু কাউন্সিলর কার থেকে এই প্লটটি কিনেছেন তা আমি বলতে পারবো না। এদিকে সাত মসজিদ হাউজিং ব্লক সি রোড-১ এর পশ্চিমের মাথায় খালের জমি দখল করে দু’তলা বাড়ি করে তার চাচাতো ভাই বাবুকে উপহার দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা রিয়েল এস্টেটের তিন নম্বর রোডের একটি বাড়ি দখলে আছে তার। এদিকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে সাত মসজিদ হাউজিংয়ে আমেরিকা প্রবাসী নজরুল ইসলামের তিন কাঠার ১টি প্লট দখল করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নজরুল ইসলামের ভাগ্নে মামুন বলেন, আমরা কিস্তির মাধ্যমে এই প্লটটি কিনেছিলাম। সে সময় হাউজিং যখন আমাদের প্লটটি বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল, তখন তাজু নামে একজন আমাদের কাছে চাঁদা দাবি করেন। সে সময় আমরা চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায়, তাজু কাউন্সিলরের সহযোগিতায় কিছু দিন ভোগ করি। পরে কাউন্সিলর নিজেই জমিটি ভোগদখল শুরু করেন। হাউজিংয়ের অফিসে গেলেই সব খবর পাবেন। একই হাউজিংয়ে গিয়াস উদ্দিন নামে অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তার আড়াই কাঠা জমি দখল করার অভিযোগ আছে তার লোকজনের বিরুদ্ধে। গিয়াস উদ্দিনের শ্যালক আজিমুর রশিদ বলেন, ’৮০ সালের দিকে দুলাভাই জমিটা কিনেছে। আমি যেহেতু মোহাম্মদপুরে থাকি আমি জমিটার সব বিষয়ে সামনে ছিলাম। এটা অনেক পানির নিচে ছিল। পরে হাউজিংয়ের সঙ্গে এডজাস্ট হয়ে মাটি ভরাট করার পরে আমরা জমিটি বুঝে পাই ২০১০-এ। পরে গত কয়েক বছর আগে জমিটি দখল করতে গেলে চান্দু মিয়া আর নাজমা নামে দুই ব্যক্তি জমিটিতে কিছু করতে দিচ্ছিলো না। পরে বর্তমান এমপি সাদেক খান ও তেজগাঁও জোনের ডিসি বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য থানাকে নির্দেশ দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চান্দু মিয়া আর নাজমা বেগম যুবলীগের শাহআলম এবং কাউন্সিলরের কাছের লোক।
এদিকে আধিপত্য বজায় রাখতে মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের কাঁচাবাজারের নির্বাচিত সভাপতি আবুল হোসেনকে দীর্ঘদিন ধরে বাজারে প্রবেশ করতে দেয় না কাউন্সিলরের লোকজন। শুধু তাই নয় কাটাসুর বাজার দখল করে উন্নয়নের নামে প্রতিটি দোকান থেকে লাখ টাকা করে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি এখনো পর্যন্ত। প্রতিটি কোরবানি ঈদের সময় মোহাম্মদপুরের তিনটি হাট সবসময়ই থাকে তার নিয়ন্ত্রণে। এদিকে তার লোক যুবলীগ ৩৩ নং ওয়ার্ডের নেতা অভি ফারুক বসিলা রোডের ওপর জায়গা দখল করে নিজের অফিস বানিয়ে রেখেছেন। সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানা জায়গা দখল করে মোহাম্মদপুরে সবগুলো যুবলীগের অফিসই কাউন্সিলরের নেতৃত্বে করার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদপুরে যুবলীগ কর্মী তছির উদ্দিনের হত্যা মামলার আসামিরা কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের ঘনিষ্ঠ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে তছিরকে খুন করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলো জাকির, হাসান, সোলেমান, ফিরোজ এবং শাহীন। স্থানীয়রা জানায়, এলাকায় মাদক ব্যবসা, ডিশ ব্যবসা, গরুর হাটের নিয়ন্ত্রণ, খাল ভরাট করে দোকান নির্মাণ ও খাসজমি দখলকে কেন্দ্র করে রাজীব এবং কাইল্যা সুমনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। কাইল্যা সুমনের গ্রুপে কাজ করতো তছিরসহ কয়েকজন।
কাউন্সিলর রাজীব যা বলেন-
দিন কয়েক আগে তারেকুজ্জামান রাজীবের সঙ্গে ফোনে কথা হয় এই রিপোর্টারের। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দেন তিনি। বাসস্ট্যান্ড ও ফুটপাথে চাঁদাবাজি নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের পুলিশ আছে, গোয়েন্দা সংস্থার লোক আছে। তাদের তো জানার কথা। অভিযোগ তো সবার বিরুদ্ধে করা যায়। প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে তো দোষী বলা যাবে না। আমি রাজনীতি করি, এলাকার জনপ্রতিনিধি। আমার বিরুদ্ধে এক পক্ষ বলবেই, সেটাই স্বাভাবিক। এটাকে ঠিক অভিযোগ বলা যাবে না। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন জায়গা দখল করে ওয়ার্ড যুবলীগের অফিসের ব্যাপারে তিনি বলেন, এই অভিযোগ অলরেডি উচ্ছেদ তালিকাভুক্ত করা আছে। আমরা শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান চালাবো। পাবলিক টয়লেটের পাশে চারটি দোকান দখলের ব্যাপারে তিনি বলেন, কে বা কারা দখল করেছে বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেবো। যদিও তিনি এই দোকান ও পাবলিক টয়লেট উদ্বোধন করেন। নামিদামি ব্র্যান্ডের ৭/৮টি গাড়ির ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ধরনের আমার কোনো গাড়ি নেই। আমি বিভিন্ন শোরুম থেকে গাড়িগুলো ভাড়া করে এনে চালাই। আমার নামে শুধু একটি গাড়ি আছে। পানির পাম্প দখল করে বাড়ি নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটা পানির পাম্প করতে যতটুকু জায়গা প্রয়োজন আমার বাড়ির জায়গাটি এর চেয়ে বড়। কেউ অভিযোগ করলেই তো হবে না। আমার এই সম্পত্তি ক্রয়কৃত। কোনোকালেই এখানে পানির পাম্প করার কথা ছিল না। মোহাম্মদপুরে বাড়ি দখলের ব্যাপারে কাউন্সিলর রাজীব বলেন, আমি কোনো বাড়ি দখল করিনি। আমার যত বাড়ি আছে এনবিআরের কাছে তথ্য দেয়া আছে। আমি জানিও না কাদের বাড়ির কথা আপনি বলছেন। আমি কয়েকটা হাউজিংয়ের সঙ্গে শেয়ারে ব্যবসা করি। এবং ছোটখাটো কিছু ব্যবসা আছে। এসব তথ্য এনবিআরে দেয়া আছে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি বুর্জ খলিফার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে যদি বুর্জ খলিফা আমার হয়ে যায় তাহলে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমি যদি কোনো গাড়ির সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি ওই গাড়ি আমার হয়ে যায় তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আমার যদি দেশের বাইরে বাড়ি থাকে তাহলে তো সরকারের কাছে তথ্য থাকার কথা। তসির উদ্দিন হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের ইতিমধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কোর্ট থেকে এখন মনে হয় দুইজন জামিনে আছে। আমার কাছে অনেক মানুষ আসতে পারে। তার মানে আমার কাছের লোক বা আত্মীয় নয়। এক মুক্তিযোদ্ধাকে জুতাপেটা ও যুবলীগ থেকে বহিষ্কার হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যুবলীগের পদ কেনার ব্যাপারে তিনি বলেন, বিষয়টি হাস্যকর। উল্টো আমি যে জায়গায় থাকার কথা সেই জায়গায় আমি যেতে পারিনি। আমার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ এসেছে সবগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট।
No comments