শিক্ষকদের রাজনীতি by মাহমুদুর রহমান মান্না
১৯৯০ সালে এরশাদের পতন হয়। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি এবং প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। বিএনপি ক্ষমতায় আসার অল্প কয়েক মাসের মধ্যে ছাত্রদল নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন। এ সময় ছাত্রদলের একটা বাড়তি সুবিধা ছিল।
আর সেটা হচ্ছে, এর আগের বছর অর্থাৎ ১৯৯০-এর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল পুরো প্যানেল জেতে, আমান-খোকন-নাজিমউদ্দিন আলম পরিষদ। আবার অসুবিধাও একটা ছিল। সেটা হচ্ছে, তখনকার উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান। ছাত্রদলের এই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের বাধা দিলেন তিনি। এমন অবস্থায় ভিসির সঙ্গে ছাত্রদলের সম্পর্কের চরম অবনতি হয় এবং অধ্যাপক মান্নান ছাত্রদলের হাতে লাঞ্ছিত হন। যেদিন লাঞ্ছিত হন, ওই দিনই তিনি পদত্যাগ করেন।
অধ্যাপক মান্নানের পদত্যাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হন মনিরুজ্জামান মিঞা। তিনি প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতি দৃষ্টি দেন এবং কিছু কাজ করার চেষ্টা করেন। ফলে ছাত্রদলের সঙ্গে ঝামেলা হয় এবং তিনি চলে যেতে বাধ্য হন। এবার ছাত্রদলের জন্য উপযোগী ভিসি নির্ধারিত হলেন এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি জিয়া পরিষদের সদস্য ছিলেন। এমাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতা নিয়েছিলেন অস্থায়ী ভিত্তিতে; তবে পরে নির্বাচন করে তিনি স্থায়ী ভিসি নিয়োগ পান।
সেই সময় থেকেই শুরু হয় ছাত্রদের রাজনীতিতে ব্যবহার করার প্রকাশ্য প্রবণতা। তার আগেও এটা কমবেশি ছিল, তবে তখন থেকে সরাসরি ছাত্রসংগঠন ভিসি অফিসের মদদ পেতে শুরু করে।
এমাজউদ্দীনের আমলে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম শুরু হয়, যা তার আগে বন্ধ হয়ে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম, দলবাজি সেই পাকিস্তান আমল থেকেই চালু ছিল। এনএসএফের নেতারা বোন্দা করে ফরম জমা দিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে। এনএসএফের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল প্রধানত ছাত্রলীগ। তারাও জগন্নাথ কলেজসহ বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব রাখার চেষ্টা করত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. ওসমান গণি স্পষ্টতই এনএসএফের পক্ষে ছিলেন। এনএসএফের খোকা, পাঁচপাত্তুরদের সন্ত্রাসের কথা তখন সর্বজনবিদিত। এর মধ্যেই ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের কাজ চালিয়ে যেত। বলা বাহুল্য, দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক শিক্ষক সমাজ আইয়ুব শাহীর বিরোধী হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে তারা ৬ দফা, ১১ দফা এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সমর্থক হয়ে ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার অবদান সবারই মনে আছে। আর বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর দেশের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের মহান আত্মদান আমরা আজও গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি।
স্বাধীনতার পর দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। পাকিস্তানের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এনএসএফ নামের সংগঠনটি অবলুপ্ত হয়। ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। বোস অধ্যাপক ড. আবদুল মতিন চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। বিজয়ের আবেগ ও উন্মাদনা সর্বত্র। ড. মতিন চৌধুরীও মুজিববাদী ছাত্রলীগের অভিভাবকের মতো আচরণ করতে থাকেন, যদিও তখন ছাত্রলীগের মধ্যে ভাঙনের সুর খুব স্পষ্ট। ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে মুজিববাদী ছাত্রলীগের প্রায় একক প্রভাব। জগন্নাথ কলেজে তো ছাত্রসংগঠনগুলোর জন্য এক ধরনের কোটা ব্যবস্থাই চালু হয় এবং এতে সর্বত্র সরকারি ছাত্রলীগের প্রাধান্য বর্তমান থাকে। ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয় ১৯৭৯-৮০ সালে, যখন ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং এই লেখক ডাকসুর ভিপি।
ফজলুল হালিম চৌধুরী চিন্তার ক্ষেত্রে আওয়ামীপন্থী ছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রসংগঠনকে বিশেষ প্রশ্র্রয় দেননি। তিনি সরকারেরও মোসাহেবি করতেন না। একবার আমার সামনেই এক ভর্তীচ্ছু এসেছিল দরখাস্তে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সুপারিশ নিয়ে। তিনি ওই ছাত্রকে না করে দিলেন আর দরখাস্তটি ছিঁড়ে ময়লার বাক্সে ফেলে দিলেন। রসিকতা করে বললাম, আমি আছি বলেই এ রকম করলেন নাকি স্যার। ভিসি স্যার জবাব দিলেন, 'তুমি ছেলেটিকে চিনে রাখো। দেখো ও ভর্তি হয় কি না।' এরপর অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী আমাকে বললেন, 'আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভর্তি পরিচ্ছন্ন রাখতে চাই। তোমরা আমাকে সহযোগিতা করো।' আমি মানলাম। কারণ তদবির বা সুপারিশ রক্ষা করা মানে যোগ্য প্রার্থীর জায়গায় অযোগ্য লোকের সুযোগ লাভ। এটা তো বন্ধ হওয়াই উচিত। বললাম কিন্তু সে ক্ষেত্রে আপনারাও স্যার কোনো অনিয়ম করতে পারবেন না।
ভিসি স্যার তাঁর কথা রেখেছিলেন। এসএসসি, এইচএসসি এবং লিখিত ভর্তি পরীক্ষাগুলোর একটি শতকরা হিসাবে উত্তীর্ণরাই কেবল ভর্তি হতে পারবে- এ নিয়ম চালু হয়েছিল যা এখনো বহাল আছে। ভিসি স্যারের ছেলে (নামটা এখন মনে নেই) ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও এ প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি।
আমরা আমাদের আগের কথায় ফিরে আসি। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার অফিসে বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছেলেদের সংবর্ধনা দেওয়ার অনুষ্ঠান যেদিন ধার্য করা হয়, ওই দিন গ ইউনিট অর্থাৎ কমার্সের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। এ জন্য ওই মেধাবী ছাত্ররা প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যেতে অসম্মতি জানায়। তখন এমাজউদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স অনুষদের ডিন, শিক্ষক সমিতি কারো সঙ্গে কথা না বলে বলে দেন যে তোমরা ছেলেগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে পাঠাও। তোমাদের ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে। ওই ছেলেগুলো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যায়। কিন্তু কমার্স অনুষদের ডিন ভর্তি করতে অস্বীকার করেন, যেহেতু ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া ভর্তির কোনো নিয়ম নেই, সেটা যতই স্ট্যান্ড করা ছাত্র হোক। এক পর্যায়ে সব শিক্ষক, ছাত্রসংগঠন ছাত্রগুলোর ভবিষ্যৎ ভেবে তাদের ভর্তিতে রাজি হয়।
সিদ্ধান্ত হয়, ভিসির অফিস থেকে ওই ছাত্রদের লিস্ট পাঠানো হবে। ভিসির অফিস থেকে যে লিস্ট পাঠানো হয়, তাতে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া ভিসির কন্যার নামও ছিল। এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন গড়ে তোলে এবং ওইসব ভর্তি নিষিদ্ধ হয়। এভাবে ওই মেধাবী ছাত্ররা তাদের মূল্যবান একটি বছর হারায়।
এরপরের বছরের ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেল। সেটা নিয়ে আন্দোলন হলো; যার ফলে পরীক্ষা বাতিল হলো এবং আবার পরীক্ষা হলো। সে এক নিদারুণ ভোগান্তি ভর্তীচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের।
ওই সময় ছাত্রলীগের মধ্যে তীব্র গ্রুপিং দেখা দেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরাসরি গ্রুপিংয়ে ছেলেদের মদদ দিতে শুরু করে। প্রশাসন একদিকে টাকা দিয়ে, কাজ দিয়ে, পুলিশ দিয়ে প্রত্যক্ষ মদদ দিতে থাকে ছাত্রলীগের একাংশকে, অন্যদিকে ছাত্রদলকেও একইভাবে মদদ দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বড় পরিবর্তন আসে। ভিসি এমাজউদ্দীন পদত্যাগ করেন। এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসি নিয়োগ পান। এর কয়েক মাস পর তিনি ভিসি প্যানেল নির্বাচনে নির্বাচিত হন। এ সময় ছাত্রলীগ তাদের সর্বোচ্চ দাপট দেখাতে শুরু করে।
আজাদ চৌধুরী নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনসহ একাডেমিক বিষয়ে মনোযোগী হন। তিনি প্রশাসন যেমন ঠিক রাখতে চেয়েছেন, তেমনি কোনো রকম অনিয়ম যেন আর না হয়, সেদিকেও ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
যেমন তিনি প্রথমেই চেয়েছেন, তাঁর সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-অবস্থান থাকবে (ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল)। তিনি চেষ্টা করেন যে ছাত্রলীগসহ কোনো ছাত্রনেতা ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে না। বহিরাগতদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। এ জন্য তিনি ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। যেহেতু তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ছিলেন, সেহেতু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে সহযোগিতাও করেন। কিন্তু শেষে তাঁর এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
ছাত্রদল তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে প্রথম থেকেই তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখে। তারা নানাভাবে তাঁর উদ্যোগকে অসহযোগিতা ও বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু আজাদ চৌধুরী যতটা না শিক্ষক ছিলেন, এর চেয়ে বেশি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক এবং রাজনৈতিক বুদ্ধিও কম ছিল না। তিনি ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। ছাত্রদল তাঁর কাছে হলে ফিরে আসা এবং সাংগঠনিক কাজকর্ম চালানোর পরিবেশ তৈরির দাবি জানায়। আজাদ চৌধুরী তাদের আশ্বস্ত করেন এবং কাজগুলো করার উদ্যোগও গ্রহণ করেন।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে একটা কথা বলা দরকার, যা সে সময়কার শিক্ষক রাজনীতির একটা বড় নেতিবাচক দিক তুলে ধরে। এমনিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা দুটি বা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত।
যেহেতু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভিসি প্যানেল ঠিক হয় সেহেতু এ গ্রুপগুলোর মধ্যেও আবার গ্রুপিং হয়। আজাদ চৌধুরী নীল দলের নেতা ছিলেন। কিন্তু তাঁর দায়িত্ব পালনকালে নীল দলের মধ্যে থেকে তীব্র বিরোধিতা হয়। বিরোধিতাকারীরা দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাঁদের অবাধ যাতায়াত আছে ইত্যাদি। আজাদ চৌধুরী এ বিরোধিতাও কৌশলে মোকাবিলা করেন। কিন্তু এর ফল দাঁড়ায় যে সব কিছু ম্যানেজ করতে গিয়ে অনেক কিছু তাঁর হাতের বাইরে চলে যায়, যার ফলে ছাত্রদলকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তিনি যথাযথভাবে রাখতে ব্যর্থ হন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে নিয়ম ফিরিয়ে আনতেও ব্যর্থ হন।
বলা যেতে পারে, অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ (আমি বলতে পছন্দ করি দলীয়করণ) করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও দলীয় রাজনীতি নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে, শিক্ষা বা শিক্ষকের নীতি কোথাও দৃশ্যমান নয়। বিদ্যার সর্বোচ্চ পীঠ এভাবেই একটি আলোর বাতির জায়গা থেকে দিনে দিনে অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
অধ্যাপক মান্নানের পদত্যাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হন মনিরুজ্জামান মিঞা। তিনি প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতি দৃষ্টি দেন এবং কিছু কাজ করার চেষ্টা করেন। ফলে ছাত্রদলের সঙ্গে ঝামেলা হয় এবং তিনি চলে যেতে বাধ্য হন। এবার ছাত্রদলের জন্য উপযোগী ভিসি নির্ধারিত হলেন এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি জিয়া পরিষদের সদস্য ছিলেন। এমাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতা নিয়েছিলেন অস্থায়ী ভিত্তিতে; তবে পরে নির্বাচন করে তিনি স্থায়ী ভিসি নিয়োগ পান।
সেই সময় থেকেই শুরু হয় ছাত্রদের রাজনীতিতে ব্যবহার করার প্রকাশ্য প্রবণতা। তার আগেও এটা কমবেশি ছিল, তবে তখন থেকে সরাসরি ছাত্রসংগঠন ভিসি অফিসের মদদ পেতে শুরু করে।
এমাজউদ্দীনের আমলে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম শুরু হয়, যা তার আগে বন্ধ হয়ে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম, দলবাজি সেই পাকিস্তান আমল থেকেই চালু ছিল। এনএসএফের নেতারা বোন্দা করে ফরম জমা দিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে। এনএসএফের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল প্রধানত ছাত্রলীগ। তারাও জগন্নাথ কলেজসহ বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব রাখার চেষ্টা করত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. ওসমান গণি স্পষ্টতই এনএসএফের পক্ষে ছিলেন। এনএসএফের খোকা, পাঁচপাত্তুরদের সন্ত্রাসের কথা তখন সর্বজনবিদিত। এর মধ্যেই ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনের কাজ চালিয়ে যেত। বলা বাহুল্য, দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক শিক্ষক সমাজ আইয়ুব শাহীর বিরোধী হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে তারা ৬ দফা, ১১ দফা এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সমর্থক হয়ে ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার অবদান সবারই মনে আছে। আর বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর দেশের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের মহান আত্মদান আমরা আজও গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি।
স্বাধীনতার পর দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। পাকিস্তানের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এনএসএফ নামের সংগঠনটি অবলুপ্ত হয়। ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। বোস অধ্যাপক ড. আবদুল মতিন চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। বিজয়ের আবেগ ও উন্মাদনা সর্বত্র। ড. মতিন চৌধুরীও মুজিববাদী ছাত্রলীগের অভিভাবকের মতো আচরণ করতে থাকেন, যদিও তখন ছাত্রলীগের মধ্যে ভাঙনের সুর খুব স্পষ্ট। ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে মুজিববাদী ছাত্রলীগের প্রায় একক প্রভাব। জগন্নাথ কলেজে তো ছাত্রসংগঠনগুলোর জন্য এক ধরনের কোটা ব্যবস্থাই চালু হয় এবং এতে সর্বত্র সরকারি ছাত্রলীগের প্রাধান্য বর্তমান থাকে। ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয় ১৯৭৯-৮০ সালে, যখন ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং এই লেখক ডাকসুর ভিপি।
ফজলুল হালিম চৌধুরী চিন্তার ক্ষেত্রে আওয়ামীপন্থী ছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রসংগঠনকে বিশেষ প্রশ্র্রয় দেননি। তিনি সরকারেরও মোসাহেবি করতেন না। একবার আমার সামনেই এক ভর্তীচ্ছু এসেছিল দরখাস্তে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সুপারিশ নিয়ে। তিনি ওই ছাত্রকে না করে দিলেন আর দরখাস্তটি ছিঁড়ে ময়লার বাক্সে ফেলে দিলেন। রসিকতা করে বললাম, আমি আছি বলেই এ রকম করলেন নাকি স্যার। ভিসি স্যার জবাব দিলেন, 'তুমি ছেলেটিকে চিনে রাখো। দেখো ও ভর্তি হয় কি না।' এরপর অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী আমাকে বললেন, 'আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভর্তি পরিচ্ছন্ন রাখতে চাই। তোমরা আমাকে সহযোগিতা করো।' আমি মানলাম। কারণ তদবির বা সুপারিশ রক্ষা করা মানে যোগ্য প্রার্থীর জায়গায় অযোগ্য লোকের সুযোগ লাভ। এটা তো বন্ধ হওয়াই উচিত। বললাম কিন্তু সে ক্ষেত্রে আপনারাও স্যার কোনো অনিয়ম করতে পারবেন না।
ভিসি স্যার তাঁর কথা রেখেছিলেন। এসএসসি, এইচএসসি এবং লিখিত ভর্তি পরীক্ষাগুলোর একটি শতকরা হিসাবে উত্তীর্ণরাই কেবল ভর্তি হতে পারবে- এ নিয়ম চালু হয়েছিল যা এখনো বহাল আছে। ভিসি স্যারের ছেলে (নামটা এখন মনে নেই) ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও এ প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি।
আমরা আমাদের আগের কথায় ফিরে আসি। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার অফিসে বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছেলেদের সংবর্ধনা দেওয়ার অনুষ্ঠান যেদিন ধার্য করা হয়, ওই দিন গ ইউনিট অর্থাৎ কমার্সের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। এ জন্য ওই মেধাবী ছাত্ররা প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যেতে অসম্মতি জানায়। তখন এমাজউদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স অনুষদের ডিন, শিক্ষক সমিতি কারো সঙ্গে কথা না বলে বলে দেন যে তোমরা ছেলেগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে পাঠাও। তোমাদের ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে। ওই ছেলেগুলো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যায়। কিন্তু কমার্স অনুষদের ডিন ভর্তি করতে অস্বীকার করেন, যেহেতু ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া ভর্তির কোনো নিয়ম নেই, সেটা যতই স্ট্যান্ড করা ছাত্র হোক। এক পর্যায়ে সব শিক্ষক, ছাত্রসংগঠন ছাত্রগুলোর ভবিষ্যৎ ভেবে তাদের ভর্তিতে রাজি হয়।
সিদ্ধান্ত হয়, ভিসির অফিস থেকে ওই ছাত্রদের লিস্ট পাঠানো হবে। ভিসির অফিস থেকে যে লিস্ট পাঠানো হয়, তাতে দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া ভিসির কন্যার নামও ছিল। এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন গড়ে তোলে এবং ওইসব ভর্তি নিষিদ্ধ হয়। এভাবে ওই মেধাবী ছাত্ররা তাদের মূল্যবান একটি বছর হারায়।
এরপরের বছরের ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেল। সেটা নিয়ে আন্দোলন হলো; যার ফলে পরীক্ষা বাতিল হলো এবং আবার পরীক্ষা হলো। সে এক নিদারুণ ভোগান্তি ভর্তীচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের।
ওই সময় ছাত্রলীগের মধ্যে তীব্র গ্রুপিং দেখা দেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরাসরি গ্রুপিংয়ে ছেলেদের মদদ দিতে শুরু করে। প্রশাসন একদিকে টাকা দিয়ে, কাজ দিয়ে, পুলিশ দিয়ে প্রত্যক্ষ মদদ দিতে থাকে ছাত্রলীগের একাংশকে, অন্যদিকে ছাত্রদলকেও একইভাবে মদদ দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বড় পরিবর্তন আসে। ভিসি এমাজউদ্দীন পদত্যাগ করেন। এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসি নিয়োগ পান। এর কয়েক মাস পর তিনি ভিসি প্যানেল নির্বাচনে নির্বাচিত হন। এ সময় ছাত্রলীগ তাদের সর্বোচ্চ দাপট দেখাতে শুরু করে।
আজাদ চৌধুরী নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনসহ একাডেমিক বিষয়ে মনোযোগী হন। তিনি প্রশাসন যেমন ঠিক রাখতে চেয়েছেন, তেমনি কোনো রকম অনিয়ম যেন আর না হয়, সেদিকেও ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
যেমন তিনি প্রথমেই চেয়েছেন, তাঁর সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-অবস্থান থাকবে (ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল)। তিনি চেষ্টা করেন যে ছাত্রলীগসহ কোনো ছাত্রনেতা ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে না। বহিরাগতদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। এ জন্য তিনি ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। যেহেতু তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ছিলেন, সেহেতু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে সহযোগিতাও করেন। কিন্তু শেষে তাঁর এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
ছাত্রদল তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে প্রথম থেকেই তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখে। তারা নানাভাবে তাঁর উদ্যোগকে অসহযোগিতা ও বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু আজাদ চৌধুরী যতটা না শিক্ষক ছিলেন, এর চেয়ে বেশি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক এবং রাজনৈতিক বুদ্ধিও কম ছিল না। তিনি ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। ছাত্রদল তাঁর কাছে হলে ফিরে আসা এবং সাংগঠনিক কাজকর্ম চালানোর পরিবেশ তৈরির দাবি জানায়। আজাদ চৌধুরী তাদের আশ্বস্ত করেন এবং কাজগুলো করার উদ্যোগও গ্রহণ করেন।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে একটা কথা বলা দরকার, যা সে সময়কার শিক্ষক রাজনীতির একটা বড় নেতিবাচক দিক তুলে ধরে। এমনিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা দুটি বা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত।
যেহেতু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভিসি প্যানেল ঠিক হয় সেহেতু এ গ্রুপগুলোর মধ্যেও আবার গ্রুপিং হয়। আজাদ চৌধুরী নীল দলের নেতা ছিলেন। কিন্তু তাঁর দায়িত্ব পালনকালে নীল দলের মধ্যে থেকে তীব্র বিরোধিতা হয়। বিরোধিতাকারীরা দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাঁদের অবাধ যাতায়াত আছে ইত্যাদি। আজাদ চৌধুরী এ বিরোধিতাও কৌশলে মোকাবিলা করেন। কিন্তু এর ফল দাঁড়ায় যে সব কিছু ম্যানেজ করতে গিয়ে অনেক কিছু তাঁর হাতের বাইরে চলে যায়, যার ফলে ছাত্রদলকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তিনি যথাযথভাবে রাখতে ব্যর্থ হন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে নিয়ম ফিরিয়ে আনতেও ব্যর্থ হন।
বলা যেতে পারে, অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ (আমি বলতে পছন্দ করি দলীয়করণ) করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও দলীয় রাজনীতি নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে, শিক্ষা বা শিক্ষকের নীতি কোথাও দৃশ্যমান নয়। বিদ্যার সর্বোচ্চ পীঠ এভাবেই একটি আলোর বাতির জায়গা থেকে দিনে দিনে অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
No comments