জলবায়ুর পরিবর্তন, চরম আবহাওয়া এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণ by কানন পুরকায়স্থ
আবহাওয়ার পরিবর্তন হওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে আবহাওয়ার পরিবর্তনের সম্পর্ক নিরূপণ করার চেষ্টা নতুন। প্রায় ২০ বছর আগে সিলভার ও ডেফ্রিস তাঁদের 'ওয়ান আর্থ, ওয়ান ফিউচার' গ্রন্থে উল্লেখ করেন, পৃথিবীর আবহাওয়ার পরিবর্তন, সমুদ্রস্রোতের পরিবর্তন,
মেরু তুষারপাত, সাগরের বরফ গলার পরিবর্তন, ভূমিক্ষয় এবং উদ্ভিদের বিকাশ ও বিলয়ের মধ্যে যে এক বার্ষিক চক্র কাজ করছে, এর ফলে পৃথিবী বদলাতে থাকে। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় আমরা সারা বিশ্বে চরম আবহাওয়ার সম্মুখীন হই। তবে পরিসংখ্যানগত দিক থেকে লক্ষ করা যায়, ১৯২৩ সালের হিসেবে এবং বর্তমান হিসেবে চরম আবহাওয়ার ঘটনা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। এই চরম আবহাওয়ার জন্য আমরা জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করি। আবার জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য নিজেদের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করি। মনে পড়ে, ১৯৮৯ সালে 'আমাদের অভিন্ন ভবিষ্যৎ' শীর্ষক এক সভায় যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির প্রধান উইলিয়াম ডয়েল রাকেলহস বলেছিলেন, 'প্রকৃতি জ্বরাক্রান্ত। আমরা তাই জ্বরের ভাইরাস। আমরা এই পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকারক প্যাথোজেন হওয়ার চেয়ে আমাদের শরীরে যে উপকারী জীবাণু রয়েছে, তাদের মতো কি হতে পারি না? তিনি আরো বলেছিলেন, মানব প্রজাতি এই প্রকৃতির একটি অংশ। এর অস্তিত্ব নির্ভর করে সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে নিজেদের জীবন ধারণের সামর্থ্যের ওপর এবং এই প্রজাতির ক্রমাগত টিকে থাকা নির্ভর করছে প্রকৃতির পুনরুৎপাদন ক্ষমতাকে ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকার ওপর।
লর্ড সাকলটনের বর্ণনা থেকে পাই, ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটন শহরে ১৯৫৯ সালের নভেম্বর মাসে ক্লোরো-হাইড্রোকার্বনের কারণে সহস্রাধিক শিয়ালের মারা যাওয়ার ঘটনা। এমনকি এই রাসায়নিক পদার্থের ভয়ে শিয়ালরা মানুষের ভয়কে উপেক্ষা করে শহরে ঘোরাফেরা করতে থাকে। রেইচেল কারসনের 'সাইলেন্ট স্প্রিং' গ্রন্থে পরিবেশে রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে নানা তথ্য ও উপাত্ত রয়েছে। প্রশ্ন হলো- প্রকৃতিতে মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড কি জলবায়ুর পরিবর্তন এবং চরম আবহাওয়ার জন্ম দেয়?
আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো একটি নির্দেশকের গড় পরিবর্তনের সঙ্গে চরম আবহাওয়ার ঘটনার গড় সংখ্যার একটি সম্পর্ক নিরূপণ করতে পেরেছি। কিন্তু এই সম্পর্ক 'কার্যকারণ' সম্পর্ক কি না- তা সুস্পষ্ট নয়। আমরা 'যা পাই' (we get) তা হচ্ছে আবহাওয়া। আমাদের 'যা আছে' (we have) তা হচ্ছে জলবায়ু। এর মধ্যে সম্পর্ক এখনো নিরূপণ না হলেও দেশে দেশে জনজীবন চরম আবহাওয়ার ঘটনায় বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এটি আরো তীব্র আকার ধারণ করবে বলে ধারণা করি।
চরম আবহাওয়া এবং তার প্রভাবের সাম্প্রতিক কিছু নমুনা উল্লেখ করি। ২০১০ সালে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরের তাপমাত্রা ৪০ সে. পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল ও কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে অন্যান্য বছরের তুলনায় অধিক পরিমাণ তুষারপাত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় এবং সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির তীব্রতা সাম্প্রতিককালের রেকর্ডকৃত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। স্যান্ডির আঘাত হানার অব্যবহিত আগে মহাকাশ স্টেশনে অবস্থানরত নভোচারীরা লক্ষ করেছিলেন প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শিকাগো শহর পর্যন্ত পুরো এলাকা কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বার্তা পাঠান নাসায়- 'কী হচ্ছে পৃথিবীতে- সবাই ভালো তো?' ২০১১ সালের ঘূর্ণিঝড় 'আইরিন'-এর চেয়ে স্যান্ডি অনেক বেশি ক্ষতি করেছে। তার কারণ এই ঘূর্ণিঝড়ের স্থানান্তরিত হওয়ার গতি ছিল কম। ফলে অল্প জায়গায় অধিক বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটে। আবহাওয়াবিদরা মনে করেন, এ ধরনের শ্লথগতির ঘূর্ণিঝড় ভবিষ্যতে আরো হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে তাঁদের ধারণা।
খাদ্যশস্য উৎপাদনের দিকে যদি লক্ষ করি, তাহলে দেখা যায় যে বিভিন্ন দেশে খাদ্য উৎপাদন কম হওয়ার কারণ ভিন্ন ভিন্ন। যেমন- যুক্তরাজ্যে অতিবৃষ্টির কারণে ২০১২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার নাইজারে অনাবৃষ্টির কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি, যদিও এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে অতিরিক্ত জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছিল। ২০০৭ সালে আইপিসিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, অন্তত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে তাপমাত্রা ১.৫ সে. বৃদ্ধি পেলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বস্তুত বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ০.৮ সে. বৃদ্ধি পেলেও খাদ্যশস্য উৎপাদনের গড় পরিমাণ ১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ে সাগরের স্ফীতি হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা। যুক্তরাজ্যের হেডলি সেন্টারে আঞ্চলিক মডেল ব্যবহার করে দেখা যায় যে চরম আবহাওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা সম্পূর্ণরূপে বদলে যাবে। সে সময় ওই এলাকা কী রূপ পরিগ্রহ করবে, তা নির্ভর করছে ঘূর্ণিঝড় ছাড়া অন্যান্য কারণে সাগরের উচ্চতা কী পরিমাণ বাড়বে এবং ভূমিক্ষয় কী পরিমাণ হবে তার ওপর। উল্লেখ্য, বিদ্যমান জলবায়ু মডেলে অনেক সমস্যা রয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে মেঘের (cloud) ভূমিকাকে শনাক্ত করতে পারিনি। এর ফলে জলবায়ু মডেল থেকে প্রাপ্ত ভবিষ্যদ্বাণীতে অনিশ্চয়তার মাত্রা বেশি। আমি মনে করি, cloud makes climate prediction more cloudy।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও নাসার কিছু গবেষক কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, পৃথিবীর ভার বহন ক্ষমতা বলতে খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সম্পদ জোগানোর জন্য পৃথিবীর ভৌত ও জৈব সামর্থ্যই কেবল বোঝায় না, বরং নতুন প্রযুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার সামর্থ্যকেও বোঝায়। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক হতে হবে অর্থপূর্ণ। প্রযুক্তি প্রকৃতিকে সম্পদে রূপান্তরিত করে। কিন্তু সমাজে এই সম্পদের চাহিদা ও ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে প্রযুক্তির সফলতা। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। চরম আবহাওয়ার অবস্থায় এই নিয়ন্ত্রণ আরো বেশি জরুরি। অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল কলিয়ারের মতে, প্রকৃতি, প্রযুক্তি এবং নিয়ন্ত্রণ- এই ত্রয়ী সম্পর্কের সমীকরণ থেকে জাত হয় প্রাচুর্য। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন ভালো ও দক্ষ নিয়ন্ত্রক। আমাদের এই ত্রয়ের প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রক মোটামুটিভাবে ১৯৪টি দেশের সরকার। তাদের দক্ষতা ও জনগণের কাছে কাজের জবাবদিহিতার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণের সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। প্রকৃতি ও প্রযুক্তির সম্পর্ক থেকে নিয়ন্ত্রণকে বাদ দিলে আমরা যা পাই, তা হচ্ছে লুণ্ঠন। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস করা এর একটি উদাহরণ হতে পারে। প্রযুক্তি, প্রকৃতি ও নিয়ন্ত্রণের যে সমীকরণটি ওপরে উল্লেখ করা হলো, তার বাস্তবায়নের জন্য দুটি সমস্যা রয়েছে। একটি হলো- 'খারাপ নিয়ন্ত্রক' এবং অন্যটি হলো ভালো নিয়ন্ত্রকের সীমাবদ্ধতা। প্রথম ক্ষেত্রে দারিদ্র্যসীমার বিচারে যে এক বিলিয়ন জনগণ নিচে রয়েছে, মোটামুটিভাবে সেই সব দেশের সরকারগুলো এবং তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনাকে বোঝায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্র হলো, যে সম্পদের ব্যবস্থাপনা আন্তমহাদেশীয় এবং নির্দিষ্ট কোনো সরকারের ওপর এর বাস্তবায়ন নির্ভরশীল নয়। এ পরিস্থিতিতে একটি সমন্বিত নীতি প্রয়োজন, যা প্রণীত হবে ক্রিয়াকলাপ এবং তা থেকে নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণ- এ দুটি নির্দেশকের ভিত্তিতে। কোন রাষ্ট্র কী করল, তার ভিত্তিতে নয়। চরম আবহাওয়া মোকাবিলার ক্ষেত্রে এ ধরনের সমন্বিত নীতি প্রয়োজন।
আবার রাকেলহসের কথায় ফিরে আসি। তিনি বলেছিলেন, চার্লস ডিকেন্সের মি. মিক্সারের মতো 'কিছু একটা আসবে, আমাদের সমস্যার সমাধান করতে'- এই ভাবনাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু এই ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকাটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। জলবায়ুর চরম অবস্থা ও চরম আবহাওয়ার ঘটনা ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে একবার ঘটেছিল। সে সময় ব্যাপক হারে পৃথিবীতে বহু প্রজাতি ও প্রাণিকুল বিলীন হয়ে যায়। জেরাড ড্রামন্ডের 'কলাপস্' গ্রন্থে পাই, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মায়া-সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। তবে তখন নতুন প্রযুক্তি ও নিয়ন্ত্রণের যুগ। সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ চরম আবহাওয়া মোকাবিলায় কিছুটা হলেও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এ নিয়ন্ত্রণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত পরিবেশবিজ্ঞানী এবং যুক্তরাজ্যের দ্য ইনস্টিটিউশন অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের একজন ফেলো। K.purkayastha@btinternet.com
লর্ড সাকলটনের বর্ণনা থেকে পাই, ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটন শহরে ১৯৫৯ সালের নভেম্বর মাসে ক্লোরো-হাইড্রোকার্বনের কারণে সহস্রাধিক শিয়ালের মারা যাওয়ার ঘটনা। এমনকি এই রাসায়নিক পদার্থের ভয়ে শিয়ালরা মানুষের ভয়কে উপেক্ষা করে শহরে ঘোরাফেরা করতে থাকে। রেইচেল কারসনের 'সাইলেন্ট স্প্রিং' গ্রন্থে পরিবেশে রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে নানা তথ্য ও উপাত্ত রয়েছে। প্রশ্ন হলো- প্রকৃতিতে মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড কি জলবায়ুর পরিবর্তন এবং চরম আবহাওয়ার জন্ম দেয়?
আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো একটি নির্দেশকের গড় পরিবর্তনের সঙ্গে চরম আবহাওয়ার ঘটনার গড় সংখ্যার একটি সম্পর্ক নিরূপণ করতে পেরেছি। কিন্তু এই সম্পর্ক 'কার্যকারণ' সম্পর্ক কি না- তা সুস্পষ্ট নয়। আমরা 'যা পাই' (we get) তা হচ্ছে আবহাওয়া। আমাদের 'যা আছে' (we have) তা হচ্ছে জলবায়ু। এর মধ্যে সম্পর্ক এখনো নিরূপণ না হলেও দেশে দেশে জনজীবন চরম আবহাওয়ার ঘটনায় বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এটি আরো তীব্র আকার ধারণ করবে বলে ধারণা করি।
চরম আবহাওয়া এবং তার প্রভাবের সাম্প্রতিক কিছু নমুনা উল্লেখ করি। ২০১০ সালে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরের তাপমাত্রা ৪০ সে. পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল ও কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে অন্যান্য বছরের তুলনায় অধিক পরিমাণ তুষারপাত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় এবং সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির তীব্রতা সাম্প্রতিককালের রেকর্ডকৃত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। স্যান্ডির আঘাত হানার অব্যবহিত আগে মহাকাশ স্টেশনে অবস্থানরত নভোচারীরা লক্ষ করেছিলেন প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শিকাগো শহর পর্যন্ত পুরো এলাকা কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বার্তা পাঠান নাসায়- 'কী হচ্ছে পৃথিবীতে- সবাই ভালো তো?' ২০১১ সালের ঘূর্ণিঝড় 'আইরিন'-এর চেয়ে স্যান্ডি অনেক বেশি ক্ষতি করেছে। তার কারণ এই ঘূর্ণিঝড়ের স্থানান্তরিত হওয়ার গতি ছিল কম। ফলে অল্প জায়গায় অধিক বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটে। আবহাওয়াবিদরা মনে করেন, এ ধরনের শ্লথগতির ঘূর্ণিঝড় ভবিষ্যতে আরো হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে তাঁদের ধারণা।
খাদ্যশস্য উৎপাদনের দিকে যদি লক্ষ করি, তাহলে দেখা যায় যে বিভিন্ন দেশে খাদ্য উৎপাদন কম হওয়ার কারণ ভিন্ন ভিন্ন। যেমন- যুক্তরাজ্যে অতিবৃষ্টির কারণে ২০১২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার নাইজারে অনাবৃষ্টির কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি, যদিও এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে অতিরিক্ত জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছিল। ২০০৭ সালে আইপিসিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, অন্তত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে তাপমাত্রা ১.৫ সে. বৃদ্ধি পেলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বস্তুত বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ০.৮ সে. বৃদ্ধি পেলেও খাদ্যশস্য উৎপাদনের গড় পরিমাণ ১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ে সাগরের স্ফীতি হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা। যুক্তরাজ্যের হেডলি সেন্টারে আঞ্চলিক মডেল ব্যবহার করে দেখা যায় যে চরম আবহাওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা সম্পূর্ণরূপে বদলে যাবে। সে সময় ওই এলাকা কী রূপ পরিগ্রহ করবে, তা নির্ভর করছে ঘূর্ণিঝড় ছাড়া অন্যান্য কারণে সাগরের উচ্চতা কী পরিমাণ বাড়বে এবং ভূমিক্ষয় কী পরিমাণ হবে তার ওপর। উল্লেখ্য, বিদ্যমান জলবায়ু মডেলে অনেক সমস্যা রয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে মেঘের (cloud) ভূমিকাকে শনাক্ত করতে পারিনি। এর ফলে জলবায়ু মডেল থেকে প্রাপ্ত ভবিষ্যদ্বাণীতে অনিশ্চয়তার মাত্রা বেশি। আমি মনে করি, cloud makes climate prediction more cloudy।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও নাসার কিছু গবেষক কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, পৃথিবীর ভার বহন ক্ষমতা বলতে খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সম্পদ জোগানোর জন্য পৃথিবীর ভৌত ও জৈব সামর্থ্যই কেবল বোঝায় না, বরং নতুন প্রযুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার সামর্থ্যকেও বোঝায়। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক হতে হবে অর্থপূর্ণ। প্রযুক্তি প্রকৃতিকে সম্পদে রূপান্তরিত করে। কিন্তু সমাজে এই সম্পদের চাহিদা ও ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে প্রযুক্তির সফলতা। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। চরম আবহাওয়ার অবস্থায় এই নিয়ন্ত্রণ আরো বেশি জরুরি। অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল কলিয়ারের মতে, প্রকৃতি, প্রযুক্তি এবং নিয়ন্ত্রণ- এই ত্রয়ী সম্পর্কের সমীকরণ থেকে জাত হয় প্রাচুর্য। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন ভালো ও দক্ষ নিয়ন্ত্রক। আমাদের এই ত্রয়ের প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রক মোটামুটিভাবে ১৯৪টি দেশের সরকার। তাদের দক্ষতা ও জনগণের কাছে কাজের জবাবদিহিতার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণের সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। প্রকৃতি ও প্রযুক্তির সম্পর্ক থেকে নিয়ন্ত্রণকে বাদ দিলে আমরা যা পাই, তা হচ্ছে লুণ্ঠন। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস করা এর একটি উদাহরণ হতে পারে। প্রযুক্তি, প্রকৃতি ও নিয়ন্ত্রণের যে সমীকরণটি ওপরে উল্লেখ করা হলো, তার বাস্তবায়নের জন্য দুটি সমস্যা রয়েছে। একটি হলো- 'খারাপ নিয়ন্ত্রক' এবং অন্যটি হলো ভালো নিয়ন্ত্রকের সীমাবদ্ধতা। প্রথম ক্ষেত্রে দারিদ্র্যসীমার বিচারে যে এক বিলিয়ন জনগণ নিচে রয়েছে, মোটামুটিভাবে সেই সব দেশের সরকারগুলো এবং তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনাকে বোঝায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্র হলো, যে সম্পদের ব্যবস্থাপনা আন্তমহাদেশীয় এবং নির্দিষ্ট কোনো সরকারের ওপর এর বাস্তবায়ন নির্ভরশীল নয়। এ পরিস্থিতিতে একটি সমন্বিত নীতি প্রয়োজন, যা প্রণীত হবে ক্রিয়াকলাপ এবং তা থেকে নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণ- এ দুটি নির্দেশকের ভিত্তিতে। কোন রাষ্ট্র কী করল, তার ভিত্তিতে নয়। চরম আবহাওয়া মোকাবিলার ক্ষেত্রে এ ধরনের সমন্বিত নীতি প্রয়োজন।
আবার রাকেলহসের কথায় ফিরে আসি। তিনি বলেছিলেন, চার্লস ডিকেন্সের মি. মিক্সারের মতো 'কিছু একটা আসবে, আমাদের সমস্যার সমাধান করতে'- এই ভাবনাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু এই ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকাটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। জলবায়ুর চরম অবস্থা ও চরম আবহাওয়ার ঘটনা ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে একবার ঘটেছিল। সে সময় ব্যাপক হারে পৃথিবীতে বহু প্রজাতি ও প্রাণিকুল বিলীন হয়ে যায়। জেরাড ড্রামন্ডের 'কলাপস্' গ্রন্থে পাই, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে মায়া-সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। তবে তখন নতুন প্রযুক্তি ও নিয়ন্ত্রণের যুগ। সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ চরম আবহাওয়া মোকাবিলায় কিছুটা হলেও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এ নিয়ন্ত্রণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত পরিবেশবিজ্ঞানী এবং যুক্তরাজ্যের দ্য ইনস্টিটিউশন অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের একজন ফেলো। K.purkayastha@btinternet.com
No comments